#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
১০
মুখোশধারী লোকটি অহনাকে নিয়ে বড় বাড়ির পেছনে যায়। তালাবদ্ধ একটা ঘর। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দেখা গেলেও মূলত ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ করা। বাইরে লোক দেখানোর জন্য তালা ঝুলানো হয়েছে। লোকটি দরজায় করাঘাত করতেই ভেতর থেকে একজন দরজা খুলে দেয়। লোকটি থপ করে অহনাকে নিচে ফেলে দেয়। গা ঝেড়ে বলে,’ তেজের থেকেও এর ওজন বেশি। সুন্দরী মেয়েরা বেশি ওজন হয় নাকি রে ক্যাবলা?’
ক্যাবলা দাঁত বের করে সাঁয় দেয়,’ হ বস। তবে এবারের মাইয়াডা খাসা।’
‘ এরে নিয়ে আলাদা ঘরে রাখ। এর তেজ বেশি, সবার সাথে মিশতে সময় লাগবে।’
মাথা দুলিয়ে বলল ক্যাবলা,’ জ্বী বস, এখুনি যাচ্ছি।’
মাহতিম রাগের বসে বাইরে ছিল। অদৃশ্য হওয়ার সুবাদে সে ঘুরে বেড়ায় চারিদিকে।
অহনার কথা তার মনে হতেই জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। না দেখতে পেয়ে ভাবে ওয়াশরুমে গিয়েছে হয়তো। কিন্তু দশ মিনিট পরেও যখন এলো না তখন মাহতিম ঘরে ঢুকে। কোথাও পায় না। এত রাতে কোথাও যাবেও না। মাহতিম নিজের বোকামির জন্য নিজেকে দোষারোপ করে। সে ভাবে, যদি সে রেগে বের হয়ে না যেত তাহলে এতো কিছু হতো না, তার দেখা উচিত ছিল। সে জানতো অহনা খুব বোকাসোকা মেয়ে। সহজে তার মাথায় বুদ্ধি আসে না। আবার কোনো ভুল করে বসবে। মাহতিম সবসময় তার মনোযোগ অহনার দিকে রাখে, আজ একটু রাগের জন্য ভুল করে বসল।
অহনার ঘোর কেটে যায়। নিভু নিভু চোখে চারিদিকে তাকায়। অন্ধকার ঘরে কাউকে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। হাতে-পায়ে বাঁধন দেওয়া, মুখেও রুমাল বাঁধা। একটা চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছোটার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এক চুলও নড়াতে পারে না নিজেকে। পরিশেষে শান্ত হয়ে দেখতে থাকে। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না।
রাত আরো গভীর হতেই মুখোশধারী লোকটি আসে। দরজায় কটকট শব্দ হয়। অহনা চোখ তুলে তাকায়। আবছা আলোয় মুখোমুখি দেখতে পায় একজন ছায়া মানবকে। অহনার চোখে হাসি ফুটে ওঠে। পরক্ষণেই তা মিলিয়ে যায়। লোকটা একটা দিয়াশলাই কাঠি জ্বালিয়ে নেয়, ফুটে ওঠে তার চেহারা। অহনা দেখতে পায়, এটা মাহতিম নয়, অন্য কেউ। কিন্তু তার মুখ ডাকা। লোকটি এক টানে নিজের মুখোশটি খুলে ফেলে। অহনা দেখতে পায় লোকটি আর কেউ নয়, দুপুরে কথা হওয়া সে লোকটি, বড় বাড়ির ছোট ছেলে। অহনা কিছু বলতে লাগে, কিন্তু মুখে রুমাল থাকার কারণে শব্দ বের হয় না। লোকটি অহনার মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে দেয়, বলল,’ তোতাপাখি কি কখনো কথা না বলে থাকতে পারে? তুমি বলো, আমি শুনছি।’
‘ কু/ত্তার বা/চ্চা।’ অহনা গালি দিতেই ফিক করে হেসে ফেলে লোকটি।
‘ তুমি মনে হয় আমার নাম জানো না তাই ভুল নামে ডাকছো। আমার নাম সোহেল জহরু।’
‘ আমাকে এখানে ধরে আনলি কেন?’
‘ ইশশ্, বুকে লাগে কথাগুলো। একটু আদর করে বলো, সুন্দরীরদের আদরমাখা কথা আমার খুব ভালো লাগে।’
‘ ছেঁড়ে দে শয়তান।’
‘ এটা বাংলা সিনেমা না। ডায়লগ বন্ধ করো। নিজ দায়িত্বে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করো।’
‘ কখখনো না।’ অহনা নিজেকে ছোটানোর অনেক চেষ্টা করে। শক্ত দড়ি দিয়ে বেধেছে, সহজে খুলবে না। সোহেল অহনার দিকে এগিয়ে আসে,
‘ নিজেকে তোমার অসহায় লাগছে না?’
অহনা রপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে,’ তুই একটা কাপুরুষ।’
‘একদম না, আমি সুপুরুষ। প্রমাণ চাও?’
‘ আমাকে ছাড় বলছি, না হয় পস্তাবি। ও আসবে, তোদের সবাইকে দেখে নেবে।’
সোহেল ভয় পাওয়ার ভান ধরে বলল,’ ওরি বাবা, ভয় পেয়ে গেলাম আমি। এ আসবে, আমাকে মারবে খুব। ভয় পাচ্ছি আমি, খুব ভয় পাচ্ছি।’ উচ্ছস্বরে হেসে উঠে সোহেল,’ তোমার কান্না, কথা, কেউ শুনবে না, এই চার দেয়াল ছাড়া। যত ইচ্ছে ডেকে যাও সবাইকে।’
‘ তোকে শেষ করতে ও একাই যথেষ্ট। দেখবি, আসবেই।’
‘ ওকে অপেক্ষা করি সেই মহামানবের জন্য। আরেকটা কথা বলব তোমায়, ময়নার ব্যাপারে।’
অহনা সচকিত হয়ে উঠে ময়নার কথা শুনে,
‘ ময়না কোথায়, বলুন আমাকে?’
‘ আমার কাছেই আছে।’
‘ ও কোথায়? আমি ওর কাছে যাব।’
‘ কাল সকালেই তোমাকে তার কাছে পাঠানো হবে। এখন আমার ঘুম পাচ্ছে, এনার্জি নেই একদম। কাল দেখা হবে, গুড নাইট।’
‘ আমাকে ছাড়….’
সোহেল চলে যায় ঘরের দরজা বন্ধ করে।
সকাল হতেই রোস্তম সারা বাড়ি খুঁজে মেয়েকে, পায় না। এক পর্যায়ে পুরো এলাকা খুঁজে, কোথাও নেই। রোস্তম হাঁউমাঁউ করে কাঁদে, ময়নার পর তার মেয়েটাকেও হারিয়ে গেল।
রোস্তম আর এক মুহূর্তও দেরী করে না। পুলিশের কাছে যায়। ময়নার ব্যাপারেও গিয়েছিল, কিন্তু বিষয়টা আগেই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল, মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল ময়নাকে। এখন অহনাকে খোঁজার জন্য আবার থানায় ডায়রি করতে গেলে সবাই তাকে পাগল ভাবে। তাকে বের করে দেয়। তার মামলাটা নেওয়া হয় না। রোস্তম বাড়ি না গিয়ে রাস্তার ধারেই বসে থাকে।
অহনার ঘুম ভাঙতেই সে পিঠে ব্যথা অনুভব করে। বন্দি থেকে সারা শরীর ফোঁড়ার মতো ব্যথা হয়ে যায়। অস্ফূট স্বরে আওয়াজ করে। জনমানব নেই এখানে যে সাহায্য করবে। অহনা স্থির থাকতে পারছে না, ব্যথা প্রচন্ড।
ক্যাবলা হাতে করে দুটো রুটি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। থালাটা এগিয়ে দেয় অহনার দিকে,
‘ খাইয়া লন।’
অহনা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ক্যাবলা আবারো বলল,’ এই জায়গায় এইডাই সকাল বিকালের খানা। না খাইলে সারাদিন না খাইয়া থাকন লাগব।’
‘ খাব না আমি। নিয়ে যাও এই ময়লা পানি আর বাশি রুটি।’
‘ তাইলে উপাস থাকেন। বসের আদেশ, না খেলে জোর না করতে।’
ক্যাবলা চলে যেতে চাইলেই অহনা থাকে ডাকে,’ ভাই শুনো?’
‘ হ আপা, কন।’
‘ আমি খাব।’
‘ এতক্ষণে লাইনে আইছেন। খাইয়া লন, এইছাড়া উপায় নাই। বসের যারে পছন্দ অয় তারেই নিয়া আহে। কপাল খারাপ আম্নের, সুন্দরী ক্যান আপনি?’
অহনা সুযোগ বুঝে বলল,’ হাতের বাঁধন না খুললে আমি খাব কি করে বলো?’
ক্যাবলা এক গাল হেসে বলল,’ কি যে কন আপা। খাঁড়ান, আমি খুইলা দিতাছি।’
মূলত অহনার উদ্দেশ্য এটাই ছিল। কোনোমতে বাঁধন খুলে ক্যাবলাকে আক্রমন করবে।
ক্যাবলা হাতের বাঁধন খুলে দেয়। অহনা বলল,’ আপনি ওপাশে ঘুরে দাঁড়ান, কারো সামনে খেতে লজ্জা করে আমার।’
‘ আইচ্ছা আপা। আমনে খান, বসের আদেশ আপনাকে খাওয়ানোর।’
ক্যাবলা উল্টো দিকে ফিরতেই অহনা পায়ের বাঁধন খুলে নেয়। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েই চেয়ারটা হাতে নেয়। শরীরে জোর নেই, তবুও সমস্ত শক্তি দিয়ে ক্যাবলার মাথায় আঘাত করে। ক্যাবলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
অহনা নিজেকে ছাড়াতে পেরে উচ্ছ্বাসিত হয়। বন্ধ ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসে। চারিদিকে কেমন অন্ধকার। পাশেই একটা জানালো দেখল অহনা। খুব ছোট সেটা, তাকিয়ে দেখে বড় বাড়ির পেছনের দিক এটা, ফুলের বাগানের কাছে। অহনা দেখল কেউ একজন নয়নতারা ফুল তুলছে। অহনা তাকে ডাকতেই কাঁধে কারো স্পর্শ পায়…..
চলবে…..
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
১১.
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়েই অহনার হৃদয়ে কেঁপে উঠে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’ কে?’
আস্তে আস্তে পেছনে তাকায়। সোহেল দাঁড়িয়ে আছে। এক ঝটকায় অহনা তার হাতটা সরিয়ে ফেলে। সোহেল হাতদুটো বুকের সাথে ভাঁজ করে দাঁড়ায়,
‘ পালাতে চেয়েছিলে তাই না?’
অহনা কিছু বলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সোহেল চোখ মুখ হিংস্র করে আবার থেমে যায়,
‘ সুন্দরীদের গায়ে হাত তুলি না আমি, তাদের আদর করতেই ভালোবাসি। কিন্তু সবাই আমাকে হতাশ করে, তারা আমার থেকে পালাতে চায়।’
‘ শয়তানের কাছে কেউ কখনো নিজ ইচ্ছায় থাকতে চায় না।’
‘ তুমি ভুলে গেছ, আমার নাম সোহেল।’
সোহেল অহনাকে আবার আগের ঘরটিতে টেনে নেয়। ক্যাবলাকে জোরেশোরে একটা লা*থি দিতেই সে চোখ খুলে। সোহেল চলে যায় বিশ্রী একটা গালি দিয়ে। এবার আর অহনাকে বাঁধা হয়নি। শুধু বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঘরটাতে তেমন আলো নেই। অনেক শীতও পড়ছে হঠাৎ করে। অহনা কান পেতে শুনল, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই অহনা আপনচিত্তে বৃষ্টিতে ভিজে। আজ সুযোগ নেই। শীতে তার দাঁত-মুখ খিঁচে আসে। একটা টিশার্ট আর প্লাজু ছিল শুধু পরনে। কাঁপন আসে শরীরে।
একটু পরই সোহেল আবার আসে। হাতে তাঁর বিরিয়ানি। অহনার সামনে এসেই প্যাকেট খুলে খেতে বলে। অহনা অন্য দিকে ফিরে যায়। সুযোগ পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। সোহেল সহজেই একহাতে টেনে ধরে ওকে। অহনা স্থির হয়ে যায়। সোহেল ধমক দেয়,”খেয়ে নাও বলছি। না হয় আর কিছুই পাবে না সারাদিন।’
‘ খাব না বলছিতো।’
‘ সুন্দরীদের প্রতি আমার একটু বেশি দরদ তাই বিরিয়ানি নিয়ে এলাম। খাও বলছি, না হয় কি করব?’
‘ আমি খাব না। বন্দি করে এখন খাবার খাওয়ানো হচ্ছে?’
‘ আহহ্, সুন্দরী, কথা বলো না বেশি, হৃদয়ে লাগে। যদি নিজে না খাও তাহলে আমি খাইয়ে দেব বলে দিলাম।’
অহনা রেগে যায়, তেড়ে আসে সোহেলের দিকে,’ তোকে আমি মে/রে দেব। আমাকে অসহায় ভাববি না একদম।’
‘ একদম না। তুমি অসহায় কে বলেছে? আমিতো পাশেই আছি, তাহলে কি করে অসহায় হলে?’
অহনা চুপ করে থাকে। কিছু বলতে পারছে না। বার বার ভাবছে মাহতিমের কথা। তাকে বেরিয়ে যেতে বলা উচিত হয়নি। এখন কত সমস্যায় পড়ল।
‘ মেয়ে মানুষ একটু বেশি না বললে শান্তি পায় না। আর সুন্দরী হলেতো কথাই নেই। যাই হোক, একটা কথা বলব।’
সোহেলের কথায় ব্রুক্ষেপ করে না অহনা। নিজেকেই বলল,’সারাক্ষণতো বলেই যাচ্ছিস, মুখ তোর থামছে না, আবার কি বলতে চাস?’
সোহেল অহনার কানের কাছে তার মুখ নেয়। তার কানের পাশ দিয়ে বেয়ে আসা চুলে ফুঁ দিয়ে পেছনে উড়িয়ে দেয়। পরক্ষণেই কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,’ খেয়ে নাও পাপি, ময়নাকে দেখতে যাবেতো তুমি তাই না?’
ময়নার কথা বলতেই অহনা বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে নেয়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গোগ্রাসে গিলতে থাকে খাবারগুলো। মরিচ কামড়ে পড়ায় আকাশ-বাতাশ এক করে চিৎকার করে উঠে। সোহেল কানে হাত চেপে ধরে,’ কানের পোকা বের করে ফেলবে দেখছি, পানি খাও তারাতাড়ি।’
সোহেল নিজেই পানি এগিয়ে দেয় অহনাকে। তারাতাড়ি খেতে গিয়ে কি একটা অবস্থা হলো। অহনা একদম ঝাল খেতে পারে না। অল্প ঝাল হলেও ম/রে যাওয়ার অবস্থা। অহনা খাওয়া অর্ধেক শেষ করেই বলল,’ আমার খাওয়া শেষ, এবার ময়নার কাছে যাব।’
সোহেল শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,’ পুরোটা শেষ করতে হবে। আজকে আর খাবার পাবে না, তাই ক্ষুদা থেকে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। তোমার মূল্য….’
সোহেল থেমে যায়।
অহনা কিছু না বলে আবারো খাওয়া শুরু করে। পুরোটা শেষ করে। ঝালের কারণে তার নাক-মুখ জ্বলতে শুরু করে, তবুও শেষ করে।
‘ আমার খাওয়া শেষ।’
সোহেল হাসে,’ বোনের জন্য এতো টান? ঝাল খাবার খেয়ে নিলে?’
‘ এতো কথা না বলে নিজের কাজ কর। কাপুরুষের মতো আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিস কেন?’
‘ এতো বিপদে থেকেও তোমার তেজ কমেনি। অতি দুঃসাহস। পাতানো বোনের জন্য নিজেই ফেঁসে গেলে। জানো না, বাঘের মুখে আছ, যে বাঘ কাউকে ছাড় দেয় না। এক থাবায় পুরোটা হজম করে নেয়, চিবানোর প্রয়োজন মনে করে না।’
‘ তোর মতো বেড়ালেরা নিজেকে বাঘ ভাবতেই শেখে। তাদের নিজস্বতা নেই। আমাকে আবার বোনের কাছে নিয়ে চল, অন্তত এই পূণ্যটা জীবনে কর, পাপের খাতা ভরে গেছে তোর, জায়গা খালি নেই।’
‘ বোন? হা হা হা… আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে যাচ্ছি।’
অহনা মনে মনে বলল,’ মুখ থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। কয়দিন দাঁত ব্রাশ করেনি কে জানে।’
‘ কিছু বললে?’
অহনা না বুঝার ভান ধরে,’ কই কিছু না তো। আপনার কানের পর্দা বেশি মোটা তাই শুনতে পান অনেক কিছু।’
অহনার বন্ধুরা এসে হাজির হয় ইলাশপুর। অহনাদের বাড়িতে আসতেই দেখল রোস্তম ঘরের চৌকাঠে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। টিকু তার পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ এই ব্রো, এখানে কোথায় অহনা থাকে?’
রোস্তম চোখ তুলে তাকায়,’ তোমরা কারা?’
‘ আমি টিকু, ওদের নাম জানতে হবে না, আপাতত আমারটাই জেনে নিন। বলুন অহনাকে চিনেন? আপনি কি তাদের কাজের লোক?’
‘ না বাবা, আমি অহনার বাবা। কিন্তু তোমরা কারা?’
টিকু রোস্তমের ঘাড়ে হাত রেখে কথা বলছিল এতক্ষণ, যখন জানল এটা অহনার বাবা, হকচকিয়ে উঠে। হাত সরিয়ে দেয় তার ঘাড় থেকে। আমতা আমতা করে বলে,’ আঙ্কেল আমার অভিনয়টা কেমন হয়েছে বলেন তো?’
‘ কিসের অভিনয়?’
‘ একটু আগে আমি আপনাকে বললো বললাম, ফাজলামো করে জিজ্ঞেস করলাম আপনার মেয়ের কথা সেটা আরকি।’
‘ ওহ, আমি ভেবেছি আজকালকার ছেলেমেয়েদের বুঝি অধঃপতন হলো।’
‘ স্যরি আঙ্কেল। আমি বুঝতে পারিনি।’
‘ আমি কিছু মনে করিনি। তোমরা ভেতরে যাও, অনেকটা পথ এসেছ।’
রুমি এতক্ষণ সেলফি নিয়েই বিজি ছিল আর অন্যদিকে ইরা পরিবেশের ছবি তুলতেই ব্যস্ত। হ্যারি কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে তাদের সবার অবস্থা দেখছিল।
সবাই ঘরে গিয়ে বসে। রোস্তম তাদের শরবত দেয়। তারা অহনার কথা জানতে চাইলেই সব কথা খুলে বলে। চারজন অবাক হয়ে যায়। এতকিছু ঘটে গেল কিন্তু অহনা তাদের কিছুই জানায়নি। ময়নার কথা কিছুই বলেনি। তবুও তারা ঠিক করে নেয় অহনাকে খুঁজে বের করবে।
সোহেল অহনাকে তিনটা ঘর পাড় করে নিয়ে যায় অন্য একটি ঘরে। সেখানে একটি সিঁড়ি। অহনা এবং সোহেল সেই সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে। দেখতে পায় থানে থানে বাক্স রাখা। বাক্সগুলো খুব বড়, আস্ত মানুষকে ঢুকিয়ে রেখে দেওয়ার মতো। অহনা সেগুলো ধরে দেখতে থাকে। সোহেল হাঁক দেয়,’ কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? এসো তারাতাড়ি।’
অহনা সোহেলের তালে হাঁটে। একটা ঘরে এসে পৌঁছায়। অহনা ঘরে পা দিয়েই ভেতরে তাকায়। চারিদিক দেখে বলল,’কই এখানে কি?’
সোহেল উপরে ইশারা দিয়ে দেখায়। অহনা উপরে তাকাতেই চিৎকার দিয়ে উঠে। পা দুটো শীতল হয়ে আসে…..
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
চলবে……
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
১২.
অহনা সোহেলের গলা চেপে ধরে। সোহেল এক টানে তার হাত সরিয়ে নেয়।
ময়নাকে উপরে সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একবার পালাতে চেয়েছিল বলে এই অবস্থা করেছে।
‘ তোমার অবস্থাও এমন হবে আবার পালাতে চাইলে।’ সোহেল জহুরী দৃষ্টিতে তাকিয়ে অহনাকে বলল।
অহনা মুখ থুবড়ে বসে পড়ে। অকথ্য নির্যা/তন করেছে ময়নার উপর। অজ্ঞান হয়ে আছে, আদৌ জ্ঞান ফিরবে কিনা জানা নেই।
সোহেল নিচে নামিয়ে আনে ময়নাকে। অহনা ওর কাছে গিয়ে বসে। আদর করে ডাকে, সাড়া পায় না। সোহেল ঘরটিতে তালা মেরে আবারো বেরিয়ে যায়।
অহনা দেখতে পায়, পাশেই পানির গামলা রাখা আছে। সেখান থেকে পানি এনে ময়নার চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরই ময়না চোখ খুলে। অহনাকে সামনে দেখে খুব আনন্দিত হয়। জড়িয়ে ধরে একে অপরকে।
‘ আপা তুমি এসেছ? আমি তোমাকে অনেক মনে করেছি।’
অহনা ওর গালে হাত রেখে বলে,’ পাগলী মেয়ে, কয়েক ঘন্টায় মন জয় করে নিলে, আর এখন বলছো আসছি কিনা? বোনের জন্য বোন সব করতে পারে।’
‘ আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আপা।’
‘ আমি সেটা জানি। কিন্তু কেন তোমাকে এখানে এনে কষ্ট দিচ্ছে এ সোহেল?’
‘ সে অনেক কথা আপা। তোমার সময় হবে না, আমাদের আগে এখান থেকে বের হতে হবে, বাড়ি গিয়ে সব বলব। এরা নরপশু, এদের থেকে বাঁচতেই হবে।’
‘ কিন্তু কিভাবে? চারিদিকে পাহারা, যেতে পারব না একদম। সবার চোখ এড়ানো সম্ভব হবে না।’
‘ আমি জানি। তবুও আমাদের চেষ্টা করতে হবে। সবার মতো আমরাও তাহলে আটকে যাব।’
‘ সবার মতো মানে? এখানে কি আরো কেউ আটকে ছিল?’
‘ এখনো শত শত মেয়ে আটকে আছে।’
অহনা আঁতকে উঠে। ময়নার গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,’ আমাকে সবটা খুলে বলো, সবটা।’
‘ বলব আপা। কিন্তু এখন পালাতে হবে।’
অহনা উঠে দাঁড়ায়, ঘরটার চারিদিকে দেখে, তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না। ময়না দেখতে পায় পাশের দেয়ালে একখানা ছবি আটকানো। এমন পরিত্যক্ত জায়গায় ঘরটিতে ছবি আটকানো থাকার কথা না। অহনা আর ময়না ছবিটি খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। অহনার সন্দেহ হয় এটা নিয়ে। ছবিটা অনেক ভারী, হাত দিয়ে সরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে কয়েক হাজার বছর ধরে ছবিটা এখানে রয়েছে। ময়না আর অহনা দুজন মিলে একসাথে ছবিটাকে ঠেলে সরায়। মুহুর্তেই চোখে মুখে বিষাদ নেমে আসে।
অহনার তার বন্ধু অহনার ঘর খুঁজে রুমালটা পায়। টিকু হাতে নিয়েই সেটা দিয়ে ঘাম মুছে। ঘাম থেকে পানির কণাগুলো রুমালে লাগতেই সেখানে কিছু লেখা ফুটে উঠে। টিকু ভয়ের চোটে সেটা হাত থেকে ফেলে দেয়,
‘ ভাই আমাকে বাঁচা। ভূতের রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে ফেলেছি ভুল করে। এখন আমার কি হবে?’
টিকু চোখ বন্ধ করে থাকে। সবাই তার কথায় নজর দেয়। ইরা তার মাথায় চাপড় মেরে বলল,’ আমার থেকে বড় ভূত আর একটাও নেই, আমাকে ভয় না পেয়ে একটা রুমালে ভয় পাচ্ছিস কেন? চোখ খোল।’
‘ না আমি খুলব না। রুমালের ভেতরে ভূত আছে। সে লিখেছে।’
হ্যারি হাতে নেয় রুমালটা। দেখল একটা লেখা,’ বড় বাড়ি।’
হ্যারি উল্টে পাল্টে দেখে বলল,’ কই তেমন কিছু না। লেখাটা আগেই ছিল, তুই খেয়াল করিসনি টিকুর বাচ্চা।’
রুমিও দেখল, বলল,’ হ্যাঁ, তেমন কিছু নেই। তবে একটু খটকা লাগছে।’
হ্যারি উৎসুক হয়ে তাকায়,’কিছু কি মনে হচ্ছে তোর?’
‘ হ্যাঁ, কেমন অদ্ভুত লাগছে আঁকা গুলো। আর দেখ, কিছু অগোছালো অক্ষর, আমার মনে হয় কেউ এই রুমালের দ্বারা সংকেত দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।’
‘দেখতে হবে। টিকু তাহলে ঠিক বলেছে। পানি লাগায় লেখাটা ফুটে উঠেছে। আমাদের দেখা উচিত, আর কোনো সূত্র পাই না।’
তারা রুমালটার উপর পানি ঢালল, আরো কিছু লেখা ফুটে উঠল। লেখা ছিল, ফুলের বাগান, বাম দ্বিতল।
লেখাগুলো বুঝতে পারছিল না কেউই, আসলে কি বোঝানো হয়েছে।
এরই মাঝে রোস্তম ঘরে প্রবেশ করে। ওদের হাতে রুমালটা দেখেই বলল,’ এটা ময়নার রুমাল, তার বাড়ি থেকে পেয়েছে।’
সবাই তখন জিজ্ঞেস করল,’ আপনি কি জানেন বড় বাড়ি দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে?’
‘ পাশের এলাকায় বড় বাড়ি রয়েছে। অহনা ঐ বাড়িটার কথা বলেছিল, ময়নার শশুর বাড়ি এটা।’
হ্যারি বলল,’ তার মানে এটাই সংকেত। আমরা ঐ বাড়িতে গেলেই পরবর্তী সংকেতের উদ্দেশ্য বুঝতে পারব। চলো সবাই।’
রোস্তম যেতে চাইলে সবাই তাকে না করে। তাকে বাড়িতে রেখেই চারজন রওনা দেয়। রাস্তার মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে বাড়ির ঠিকানাও নিয়ে নেয়।
বাড়ির গেইটে প্রবেশ করতেই দারোয়ান আটকায় তাদের। কিন্তু সবার স্মার্টনেস দেখে ঢুকতে দেয়। কলিং বেল চাপতেই বয়স্ক একজন মহিলা দরজা খুলে দেয়। বড় গলায় কাউকে ডেকে বলল,’ আপা, বাইত্তে মেহমান আইছে। দেইখ্যা যান।’
একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এগিয়ে আসেন। ব্রু কুঁচকে তাকায় চারজনের দিকে,’ কারা তোমরা?’
টিকু কিছু বলতে যেতেই রুমি তার হাত চেপে ধরে ইশারা দেয় চুপ থাকতে। তারপর হ্যারি বলল,’ আমরা ময়নার বন্ধু।’
চাকর মহিলাটি সুর টেনে বলল,’ ওমা, কয় কি? মাইয়া মানুষের আবার ছেইলে বন্ধু। আর কি যে দেহার বাকি আছে।’
মধ্যবয়সী মহিলাটি বলল,’ রুনি, তুই চুপ থাক। রান্নাঘরে যা।’ তারপর চারজনের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,’ কেমন বন্ধু? ময়নার তো কোনো কালে কোনো বন্ধু ছিল না।’
রুমি বলল,’ আমরা ওর ছোটবেলার বন্ধু। আমরা ওর থেকে বয়সে বড় ছিলাম, কিন্তু একসাথে খেলতাম। সেখান থেকেই পরিচয়, খবর নিয়ে দেখবেন।’
‘ ঠিক আছে। তোমরা কি জানো না ময়না আর নেই?’
‘ জানি তো।’
রুমি কথাটা বলতেই হ্যারি থামিয়ে দেয়,
‘ আসলে ওর কথা মনে পড়ছিল, এখানে ওর অনেক স্মৃতি আছে, তাই আপনাদের বাড়িতে ঘুরে দেখতে আসলাম।’
‘ ঠিক আছে। দেখো তবে।’
মহিলাটি উঠে, একজন কাজের লোককে তাদের নাস্তা দিতে বলে চলে যায়।
ইরা রেগে যায়,’ বড়লোক হয়েছে যে মনে হয় মাথা কিনে নিয়েছে। কিভাবে কথা বলে চলে গেল।’
‘ এই মুহূর্তে রাগ না করে আসল কাজ কর। আমাদের কাজ অহনাকে খুঁজে বের করা। পুরো বাড়িটা খুঁজে দেখ কে কি পাস!’
তারা সবাই মিলে বাড়ির আনাচে-কানাচে দেখতে থাকে। একেকজন একেক দিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।
হ্যারি আবিষ্কার করে ফুলের বাগান। রুমালটা বের করে দেখে। বাম দ্বিতল কথাটার মানে বুঝতে পারছে না। বাড়িটার দিকে তাকায়, বাম পাশের উপরের তলায় চোখ দেয়। একটি জানালা দেখতে পায়…..
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
চলবে….