#ছায়াতরু
#পর্ব_০৭
“ কোথায় গরু? কিভাবে আসছে? আর কিভাবে হিসু করেছে আমাকেও দেখান আঙ্কেল।’’ কথাগুলো নকিব একপ্রকার উৎসুক হয়ে বলতে বলতে উপরে উঠছে। পেছনে তুষার, নয়ন, সিমানী আর জিনিয়াকেও দেখা গেলো।
নকিব নোমান সাহেবের পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাপাতে লাগলো। আর পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো,“ আঙ্কেল কোথায় গরু?’’
শীতলও সে মুহুর্তে বের হলো। নোমান সাহেবের পেছনে নয়নকে দেখে মনে মনে খুশি হলো ভীষণ। এদিকে বাহারাজ এদের এমন সব কথাবার্তায় খুব রেগে গেলো। এমনিতেই কোমরে চিনচিনে ব্যথা অনুভুত হচ্ছে। তার ওপর এখানে এতো গুলো গাধার দল। বাহারাজ আবারও নিজের রুমে ঢুকে দরজা ধরাম করে লাগিয়ে দিলো। সবাই কেঁপে উঠলো। নোমান সাহেব চিন্তিত গলায় শুধালেন,“ আমার দরজা!’’
নয়ন এগিয়ে এসে বললো,“ কি হয়েছিলো আঙ্কেল। বাহারাজ ভাই এতো রেগে গেলো কেন?’’
“ পড়ে গেছিলো এখানে। তাই এতো রাগ।’’ স্মরণের কথা শুনে সবাই তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। নয়ন বলে উঠলো,‘‘ কিইইই?’’
“ হ্যা।’’ স্মরণ আবারও নিজের কাজে মন দিলো। নয়ন এসে জিজ্ঞাসা করলো,“ তোকে কিছু বলে নি?’’
“ আমাকে আর কি বলবে? আমি কিছু করেছি নাকি? উনি কানা মানুষ। দেখে হাঁটতে পারেন না?’’
নয়ন স্মরণের মাথায় বারি মেরে বললো,“ চুপ থাক। এসব কি বলছিস? বাহারাজ ভাই শুনলে না তোর খবর করে দেবে?’’
“ কেন উনি কি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বংশধর নাকি স্পেনের রাজকন্যার বয়ফ্রেন্ড? যে আমার খবর করে দেবে।’’
“ দুটোর একটা না হলেও বাহারাজ ভাইয়ের দাদা ছিলেন সাবেক এমপি।’’
স্মরণ বিরক্তি নিয়ে বললো,“ তো?’’
“ আচ্ছা বাদ দে।’’
সবাই একে একে ভেতরে ঢুকলো। নোমান সাহেবও উঁকি দিলেন। শীতলকে বাসায় যেতে বলে তিনিও চলে গেলেন। এদিকে বাবা চলে যেতেই শীতল নয়নের কাছে এগিয়ে গেলো। নয়ন হেসে বললো,“কেমন আছো? গতকাল এতো মেসেজ দিলাম রিপ্লাই দিলে না যে?’’
শীতল মিষ্টি হেসে সুন্দরভাবে জবাব দিলো,“ ব্যস্ত ছিলাম নয়ন। সরি।’’
নকিব আর তুষার বুকে হাত গুঁজে তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো দুজন। দৃষ্টি তাদের নয়ন আর শীতলের দিকে। নকিব হা হুতাশ করে বলে উঠলো,“ অন্যের ভালোবাসা দেখতেও সুন্দর।’’
“ ঠিক বলেছিস।’’ পাশ থেকে তুষার বললো।
স্মরণ একটা ময়লা কাপড় তাদের দিকে ছুড়ে মেরে বললো,“ অন্যের ভালোবাসা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার জন্য ডাকিনি তোদের।’’
_________________________
সময়টা ভর দুপুর। শীতকাল হয়েও রোদের তেজ কমে নি। শীতকালের সকালের দিকের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই রোদের তেজ থাকে মিষ্টি। গায়ে পড়লেও আরামদায়ক অনুভুত হয়। তবে দুপুরের পরের সময়ের রোদের ঔদ্ধত্য বেড়ে যায় যেন। জানালার পর্দা কাপড় ভেদ করে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাওয়া রোদের কিছু আলো এসে পড়ছে ফ্লোরে। যা প্রতিফলিত হয়ে পুরো রুমের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। স্মরণ, জিনিয়া, সিমানী মিলে তিনজন রান্না করলো দুপুরের খাবার। শীতল বাসা থেকে খাবার এনে দিতে চেয়েছিলো তবে এরা কেউ রাজি হয় নি। বরং স্মরণের ফ্ল্যাটে একটা ছোটখাটো পার্টি করতে চেয়েছে। তাই তো এই ভরদুপুরে খেয়েদেয়ে এখন রেস্টে আছে সবাই। সেসময় স্মরণ এসে নয়নদের বললো,“ যা বাজার করে এনে দে। আমি লিস্ট করে দিয়েছি।’’
বলে একটা লিস্ট আর টাকা ধরিয়ে দিলো তাদের হাতে। নকিব হতবম্ভ হয়ে বললো,“ এই ভরদুপুরে কোন বেকুব বাজার করে? সিরিয়াসলি ভাই?’’
স্মরণ শুনলো না তাদের কথা। চলে যেতে যেতে বললো,“ তাড়াতাড়ি যা ভাই।’’
নয়ন উঠে দাঁড়ালো। আর বললো,“ চল।’’
অগত্যা বাধ্য হয়ে তারা বের হয়ে গেলো। সেসময় আবার রিয়াদ,অভ্র আর শায়ন উপরে আসছিলো। শায়ন নিজের ভাইকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে এলো আর জিজ্ঞাসা করলো,“ তুই আবারও এখানে কি করছিস?’’
“ ওইযে বলেছিলাম বান্ধবীটা ভাড়া নিয়েছে ওই রুম। তাই সাহায্য করতে এসেছিলাম।’’
অভ্র রসিকতা করে বললো,“ বড় ভাই সাহায্যের কথা বললে তো না করে দিস। কিন্তু বান্ধবী সাহায্যের কথা বললে একদম হুড়মুড়িয়ে চলে আসিস দেখছি।’’
নয়ন মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে বললো,“ তেমন কিছুই নয় অভ্র ভাই। আচ্ছা তোমরা যাও আমরা একটা কাজে যাচ্ছি।’’
শায়ন থামালো নয়নকে। এক সাইডে নিয়ে গেলো। বাকিরা চলে গেলো যে যার উদ্দেশ্যে। শায়ন নয়নকে বললো,“ কেউ যাতে কিছুই না জানে। বাহারাজ কিন্তু রেগে যাবে। মনে রাখিস বাহারাজের বিষয়ে কেউ যাতে কিছু না জানে।’’
নয়ন মাথা নাড়ালো। আর চলে গেলো। শায়নও বাহারাজের রুমে ঢুকলো। দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ভেতরে বাহারাজের রুমে এসে খাটের ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়লো। বাহারাজ তখন কার সাথে যেন কথা বলছিলো। তার মুখায়ব ভীষণ সিরিয়াস। বাহারাজ কথা বলা শেষে সোফায় বসে পড়লো। শায়ন এবার জিজ্ঞাসা করে উঠলো,“ পাশের বাসায় নতুন মেয়ে এসেছে। তোর ফিলিংস কেমন আমাদের কাছে ব্যাখ্যা কর এখন।’’
টিভিতে সেসময় খবর প্রচারিত হচ্ছে ‘ উমুক এলাকায় আরও দুটো নারীর মরদেহ উদ্ধার।’
বাহারাজ শায়নের কথা কানেই নিলো না। বরং কথা ঘুরিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বললো,“ আজকের মরদেহগুলো কি দেখেছিস?’’
শায়ন এবার সিরিয়াস হলো,“ এখানে আসার আগেই দেখে এসেছি।’’
“ সবে কয়েকমাস পার হলো। আর এখনই এমন কিছু আসলে ভাবতে পারি নি আমিও। উকিল মশাইকে মনে পড়ছে খুব।’’
বাহারাজের কথা শুনে মিনিট কয়েক সবাই নিরবতা পালন করলো। সবার মুখে কেমন কষ্টের ছাপ দেখা গেলো। বাহারাজই নিরবতা ভেঙ্গে অভ্রকে বলে উঠলো,“ পরশু বিথীর বিয়ে। আশা করি বুঝতে পারছিস অভ্র, তোর কাজটা ঠিক কি?’’
অভ্র সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললো,“ হু।’’
বাহারাজ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,“ খোঁজ পেয়েছিস ড্রাইভারের?’’
“ ফরিদপুরে নাকি আছে এখন, সপরিবারে।’’
বাহারাজ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,“ ওই লোককে কাছে পেলে আমি জ্যান্ত পুতে দেবো।’’
রিয়াদ খাটের ওপর শুয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে বললো,“ পাশের রুমের স্মরণ মেয়েটা বেশ রূপবতী।’’
তার কথা শুনে অভ্র আর শায়ন চোখ বড় বড় করে তাকালো রিয়াদের দিকে। রিয়াদ এই কথা বলছে তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। যেই রিয়াদ নিজের প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদের পর আর কোনো মেয়ের দিকেই ফিরে তাকায়নি সেই রিয়াদ কিনা কোনো মেয়ের প্রশংসা করছে? শায়ন উঠে বসে চমকিত আওয়াজে বললো,“ রিয়াদ তুই ঠিক আছিস?’’
রিয়াদ বিরক্ত হলো,“ আমাকে কি তোর অসুস্থ মনে হচ্ছে?’’
অভ্র ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে বললো,“ অসুস্থ মনে না হলেও খুবই অবাক লাগছে।’’
রিয়াদ কথা বাড়ালো না। এদিকে বাহারাজ চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“ মেয়েটা রূপে রূপবতী হলে কি হবে? জ্ঞানে তো গাঁধাবতী।’’
রিয়াদ উঠে বসলো। একে একে সবাই এখন বাহারাজের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বাহারাজের মুখের কথা শুনে সবাই একে অপরের দিকে একবার তাকালো। কেউ কিছু বলার আগেই বাহারাজ বলে উঠলো,“ সৎ মা আর বোনের পিছু ছাড়াতে এই ভয়ানক জায়গায় এসে বাসা ভাড়া নিয়েছে। মেয়েটা কি আদও জানে তার কি পরিমাণ বিপদ হবে?’’
অভ্র’র যেন কিছু একটা মনে পড়লো। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,“ বাহারাজ এটাই সেই মেয়েটা না যার সাথে তোর ধাক্কা লেগেছিলো সেদিন? যেদিন আমরা হোটেলে যাচ্ছিলাম?’’
“ হ্যা আর এই স্মরণই সেই মেয়ে যার সাথে দ্বিতীয়বার ধাক্কা লাগাতে সে আমাকে কানা বলেছে। আর আজ? আজ তো আমায় একদম ফেলেই দিলো। অন্তত বাকি হিসেবগুলো মওকুফ করা হলেও শেষবারের জন্য ক্ষমা নয়।’’
#চলবে
–জুনানী চাকমা