#ছায়াতরু
#পর্ব_০৬
স্মরণ তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিজের বাসায় যেতেও কেমন অন্যরকম অনুভুতি অনুভুত হচ্ছে। পাশের টং এর দোকান থেকে সেলিম চাচা হাক ছাড়লো,“ কি রে স্মরণ? ওমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’’
স্মরণ ক্লেশিত কণ্ঠে বলল,“ জীবন বড় দুঃখময় গো চাচা।’’
“ তা আর বলতে?’’
স্মরণ সমস্ত কনফিডেন্স নিজের মধ্যে এনে পা বাড়ালো। রুমের সামনে আসতেই অনেক জুতোজোড়া দেখতে পেলো। স্মরণ বুঝলো না কিছু। দরজাটাও খোলা ছিলো। আস্তে ধীরে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো ভেতরে থাকা মানুষজনদের দেখে। এরা তো হিমেলের পরিবার।
সবাই মুখ গম্ভীর করে বসে আলাপ করছিলো কোনো বিষয়ে। স্মরণকে তেমন কেউ খেয়াল না করলেও সবার মধ্যিখানে বসা হিমেল আর রাহা ঠিকই খেয়াল করলো। হিমেল মুখ কালো করে স্মরণের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর রাহা এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে যেন চোখ দিয়েই স্মরণের মুখ ঝলসে দেবে। স্মরণ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেলো।
এদিকে বসার ঘরে অনিল সাহেব হিমেলের বাবা মইন সাহেবকে বলছেন,“ আগামীকালই তাহলে ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়ে যাক।’’
মইন সাহেবের স্ত্রী হাসিনা বেগম মুখ কালো করে বললেন,“ তা না হলে আর কি করার আছে? পছন্দ করলাম একজনকে আর ছেলের বউ করতে হবে অন্যজনকে। আমার ছেলে যে এতো বড় একটা চরিত্রহীন হয়েছে আগে জানলে মেরে ফেলতাম।’’
হিমেল চোখ ছোটছোট করে মায়ের দিকে তাকালো। এদিকে রাহা সেখানে আর বসে রইলো না। উঠে চলে গেলো নিজের রুমে। তার কখনোই এই খাটাশ হিমেলকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। আর ভাগ্য তাকে সেদিকেই নিয়ে গেছে। রাহা খুব জোরে দরজাটা বন্ধ করলো। স্মরণও পর্যন্ত কেঁপে উঠলো এমন শব্দে। স্মরণ নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললো,“ ফেল ফেল ভেঙ্গে ফেল সব। দরজা জানালা যা আছে সব ভেঙ্গে ফেল। আমার কিছুই হবে না।’’
স্মরণ ঠিক করেছে আজ রাতটা এখানে কোনোভাবে পার করবে তারপর ওই বাসায় উঠবে। এডভান্স ৫০০টাকাও দিয়ে এসেছে নোমান সাহেবকে। স্মরণ ভাবলো তার ইনকাম আরও বাড়ানো উচিত। নয়তো এই শহরে একা টিকতে খুবই কষ্টকর হয়ে পড়বে। জমানো যে টাকাগুলো আছে সেগুলো দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনবে আজ বিকেলে টিউশনি থেকে আসার সময়।
স্মরণ ব্যাগ গুছিয়ে এক কোণায় রাখলো। দুটো ব্যাগ হয়েছে। এগুল কালকে নিয়ে যেতে হবে ভেবেই ক্লান্ত লাগলো। তার রুমে এটাচ বাথরুম একটা আছে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে বের হতেই রাহার মুখোমুখি হলো। রাহা কটমট চোখে চাইলো। স্মরণ রাহার দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে চাইলে রাহা আটকালো।
“ দাঁড়া স্মরণ।’’
স্মরণ তবুও যেতে নিলে হাত ধরে ফেললো রাহা,“দাঁড়াতে বলেছিলাম!’’
স্মরণ এবার ঘুরে তাকালো,“ অবশ্যই তোর কথা শুনতে আমি বাধ্য নই।’’
“ তুই কি ভাবছিস আমি হেরে গেছি?’’
স্মরণ রাহার নামটাও নিজের ভাবনাতে আনে না আর এই মেয়ে বলে কি? স্মরণ হেসে জবাবে বলল,‘‘ছোট থেকে সবসময় তুই আমার থেকে একধাপ পিছিয়ে ছিলি, এখনও রয়েছিস। তাই হেরে যাওয়া তো দূর আমার ধারে কাছেও আসতে পারবি না।’’
মুচকি একটা হাসি দিয়ে হাত সড়িয়ে নিলো স্মরণ। তারপর আবারও বসার ঘরে সবার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো বাইরে। এবার সবাই স্মরণকে দেখতে পেলো। স্মরণকে দেখে হাসিনা বেগম হা হুতাশ করা শুরু করলেন,“ আমার ছেলে হিরে ফেলে কাঁচের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। এই যন্ত্রণা রাখি কোথায়?’’
_________________________
বিকেলে স্মরণ বাজারে গেলো। জিনিসপত্র কেনার জন্য। আজকাল বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম স্মরণ ভীষণ চিন্তিত। ফোন করে জিনিয়াকেও আসতে বলেছে বাজারে। জিনিয়া স্মরণের জন্য অপেক্ষা করছিলো। স্মরণ যখন আসলো তখন দুজনে বাজারে ঢুকে পড়লো। স্মরণ হাড়িপাতিল কিনবে আজ। তার কেমন যেন লজ্জা লাগলেও কিছু করার নেই।
“ আজ অনেক বেশি ঠান্ডা রে বইন।’’ শীতে কাঁপতে কাঁপতে কথাটা বললো জিনিয়া। পুনরায় একইভাবেই বললো,“ এই শীতে তুই ফ্লোরে কাপড় বিছিয়ে থাকতে পারবি না একটা খাট কিনে ফেল।’’
“ আমাকে কি তোর আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বংশধর মনে হয় রে? যে মন চাইলেই একটা খাট কিনে ফেলবো!’’
ফিক করে হেসে ফেললো জিনিয়া। স্মরণ তখন জিনিসপত্র দেখছে। আর দোকানদারকে দাম জিজ্ঞাসা করছে। স্বভাবতই দোকানদার দাম বেশি চাইছে। আর স্মরণ দিতে রাজি নয়। জিনিয়া জানতো এমনই কিছু হবে। স্মরণকে টেনে অন্যটাই নিয়ে গেলো।
প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দুজনেই নতুন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। নোমান সাহেবদের দরজায় কড়া নাড়তেই স্মরণদের সমবয়সী একটি মেয়ে দরজা খুলে দিলো। স্মরণরা বুঝলো এই হলো শীতল।
শীতল হেসে বললো,“ স্মরণ আর জিনিয়া?’’
জিনিয়া চমকালেও স্মরণ কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ না করলেও হেসে বললো,“ উপরের রুমের চাবিটা দিতে পারবে?’’
শীতল বললো,“ দাঁড়াও এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’’
শীতল একদৌড়ে ঘরে গিয়ে চাবিটা এনে দিলো। স্মরণকে দিয়ে বললো,“ তুমি কালই আসবে তাই না?’’
“ হ্যা আগামীকালই আসবো।’’
“ চমৎকার। দুজনে মিলে আড্ডা দিতে পারবো।’’
স্মরণ হাসলো। তিনজনে মিলে তিনতলায় উঠতে যাবে সেসময় শায়ন,অভ্র আর রিয়াদ নিচে থেকে উঠে আসলো। তারাও তিনতলার পথযাত্রী। শীতল তাদের দেখে হেসে বললো,“ আজ আপনারা আমাদের বাসায় ডিনার করবেন ভাইয়া। স্মরণ তোমরা চাইলে নৈশভোজ করে যেতে পারো।’’
স্মরণ বললো,“ আজ ব্যস্ত আছি, অন্য একদিন।’’
রিয়াদ স্মরণকে দেখে মুচকি হাসলো। অভ্র আবারও ভাবছে এই মেয়েকে সে কোথায় দেখেছে? শায়ন উপরে উঠে চলে গেছে। বাকিরাও শীতলের কথায় মাথা নাড়িয়ে উপরে চলে গেলো। তারা যেতেই স্মরণরাও উপরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো।
স্মরণ সেসময় জিজ্ঞাসা করলো,“ এরা কি এখানেই থাকে?’’
“ না তবে দিনে দু একবার আসে এই বাসায়। বাহারাজ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে।’’
“ কেন বাহারাজ কি মহিলা নাকি? দিনে দু একবার দেখা করতেই হবে?’’
তার কথায় শীতল জিনিয়া হেসে দিলো। তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো। রুমটা ভীষণ অপরিষ্কার। স্মরণ বুঝলো আগামীকাল খুব পরিশ্রম বয়ে যাবে ওপর। জিনিসপত্রগুলো রান্নাঘরে রেখে এলো স্মরণ। এরপর বেরিয়ে গেলো। শীতল বললো,“ কালকেই যেহেতু আসছো তবে চাবিটা নিয়ে যাও।’’
‘‘ ঠিক আছে।’’ বলে স্মরণ চাবিটা নিজের পকেটে রাখলো। সেসময় চোখ গেলো তারই সামনে বরাবর ফ্ল্যাট–টাই। এখানেই তাহলে থাকে বাহারাজ মশাই!
হঠাৎ রিয়াদ বেরিয়ে এলো। স্মরণরা নিচে নামছিলো তখন। শীতলকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে নিলে রিয়াদ নিচে নামতে নামতে বললো,“ রাত হয়ে গেছে। তোমরা কি যেতে পারবে?’’
তার কথা বলার ধরণ এমন যেন সে স্মরণদের বহুদিনের পরিচিত মানুষ। স্মরণ সৌজন্য হেসে বললো,“ ধন্যবাদ তবে তার দরকার নেই।’’
রিয়াদ বিড়বিড় করে বললো,“ তোমার দরকার না থাকলেও আমার আছে মেয়ে।’’ তবে মুখে বললো,“ ভেবে বলছো তো?’’
স্মরণ এর এতো আদিখ্যেতা সহ্য করতে পারছে না। বললো,“ ভেবেই বলছি। আপনি নিজ গন্তব্যে যেতে পারেন।’’
রিয়াদ ‘বাই’ বলে চলে গেলো সামনে। এদিকে রিয়াদ চলে যেতেই জিনিয়া বললো,“ দোস্ত ছেলেটা অনেক হ্যান্ডসাম নারে?’’
“ হ্যান্ডসাম না ছাই।’’
“ তুই যাই–ই বল একে আমার ভালো লেগেছে।’’
দুজনে হাঁটা আরম্ভ করলো। একটা সিএনজিতে উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তবে তাদের সিএনজিটার পেছনেই রিয়াদের গাড়িটা ছিলো। কেউ খেয়াল করে নি। মেয়ে মানুষ একটা চিন্তা তো আছেই। তবে রিয়াদ তাদের আজকেই চিনলো জানলো। বিশেষ করে স্মরণের বিষয়ে এমন চিন্তা ভারী বেমানান মনে হলেও মন ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো।
_________________________
সকালের ধুম ধাম আওয়াজে বাহারাজের ঘুম ভাঙলো। এটা কিসের আওয়াজ তৎক্ষনাৎ ঠাওর করতে পারলো না। তবে প্রচুর বিরক্ত হলো। এই সকালে কে এই শব্দ করছে দেখার জন্য ঘুম ঘুম চোখে এলোমেলো অবস্থায় দরজা খুলে বের হতেই দেখলো সামনে একটা মেয়ে এই শব্দটা করছে।
স্মরণ চাবিটা হারিয়ে ফেলেছে আজ সকালে। সকালে কিভাবে যে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সেই জানে। অনিল সাহেব ছাড়তে চাচ্ছিলেন না মেয়েকে তবে স্মরণ খুব দাম্ভীকের সাথে বেরিয়ে এসেছে সেই বাড়ি থেকে। যেই বাসায় তার কোনো দাম নেই সেই বাসায় থেকে কি লাভ?
চাবিটা হারানোর ফলে তালা খোলার মতো আর কোনো উপায় ছিলো না। কারণ এই তালার নাকি চাবি একটাই। তাই তালা ইট দিয়ে ভাঙছিলো স্মরণ। শীতল বললো,“ আরও জোরে দাও।’’
“ এই এখানে এতো শব্দ কিসের?’’
স্মরণ, শীতল দুজনেই ফিরে তাকালো। শীতল বললো,“ বাহারাজ ভাই আসলে তালার চাবিটা হারিয়ে ফেলেছে স্মরণ তাই তালাটা ভাঙতে হচ্ছে।’’
এভাব এলোমেলো অবস্থায় বাহারাজকে দেখে স্মরণ ভাবলো এই ছেলে না জানি কত এলোমেলো হয়। তার বাহারাজকে গুণ্ডার মতো মনে হলো। এদিকে বাহারাজ বিরক্তি নিয়ে বললো,“ আসতে না আসতেই এমন শুরু করেছে? না জানি আরও কত ঝামেলা সহ্য করতে হবে আমায়।’’
বলেই দুজনের সামনে ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। স্মরণ ঠোঁট বেকিয়ে বললো,“ পাগল নাকি?’’
শীতল বললো,“ ভাইয়া অনেক শান্তিপ্রিয় মানুষ তো তাই।’’
এদিকে স্মরণ আরও কয়েকবার বারি মারতেই তালা ভেঙ্গে গেলো। ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। ফোন করে বন্ধুদের তাকে সাহায্য করার জন্য আসতে বললো। শীতল বলল,“ আমি সাহায্য করি?’’
“ ঠিক আছে।’’ বলে দুজনেই কাজে লেগে পড়লো।
স্মরণ সর্বপ্রথম ঘর ঝাড়ু দিলো। শীতলকে সাহায্য করতে বললেও তেমন কোনো কাজ করতে দিলো না। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার পর একটা হুইলের প্যাকেট দিয়ে পুরো ঘরে ছিটিয়ে দিয়ে পানি ছড়িয়ে দিলো। আর ঘরটা পরিষ্কার করতে লাগলো। সেসব পানি দরজার বাইরে ফেলে দিলো। এতে রুমটা অনেকখানি পরিষ্কার হলো। ভালো পানি দিয়েও পরিষ্কার করলো। সমস্ত পানি সিড়ি বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লেও বাহারাজের রুমের সামনেও কিছু পানি গড়িয়ে গেলো।
এদিকে বাহারাজ কোথাও যাওয়ার জন্য দরজা খুলে বাইরে বের হতেই ধপাস করে চিটপটাং হয়ে পড়ে গেলো। বলিষ্ঠ শরীরে বিদ্যুৎ এর মতো শকড খেলো যেন। মুহুর্তেই চোখ মুখ কুঁচকে গেলো তার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যথা সংবরণের ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কি পরিমাণ ব্যথা পেয়েছে।
এদিকে তাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে স্মরণ খুব জোরে হেসে ফেলল। নিজের ব্যথা আর সামনের মেয়েটার হাসিতে যেন মাথায় কোনো দাহ্য পদার্থ ছাড়াই আগুন ধরে গেলো। ধমকে বললো,“ এই মেয়ে হাসছো কেন?’’
স্মরণ নিজের হাসি বহাল রেখেই বললো,“ সামনে এমন হাস্যকর দৃশ্য, আমি স্মরণ না হেসে থাকি কি করে?’’
আরও বেশি রেগে গেলো বাহারাজ। কোনোভাবে কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে নোমান সাহেবকে ডাকতে লাগলো। এমন চেঁচিয়ে ডাকাতে নোমান সাহেব কিছুক্ষণ পর এসে হাজির হলেন। বাহারাজ দাতে দাত চেপে জিজ্ঞাসা করলো,“ এই জায়গাটা পিচলা কেন? কোন গরু এখানে সাবানের পানি ফেলেছে?’’
নোমান সাহেব বিচলিত হয়ে বললেন,“ আমরা গরু পালি না বাবা। তবে বাইরে থেকে হয়তোবা কোনো গরু তিনতলায় এসে এখানে হিসু করে দিয়ে গেছে।’’
#চলবে
– জুনানী চাকমা