#ছায়াতরু
#পর্ব_০৫
ভার্সিটিতে সিনিয়রদের আলাদা একটা ডিমান্ড থাকে। এইযে স্মরণের সেই হলের সিটে ওঠার আগেই কোনো এক সিনিয়র নাকি সেখানে উঠে গেছে।
এখন স্মরণ এতটাই রেগে আছে যে ওই সিনিয়রকে পেলে মুহুর্তেই খু*ন করতো। স্মরণ তো সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করেছিলো তবে বন্ধুরা থামিয়েছে তাকে।
আপাতত স্মরণ এখন তীব্র মাথা ব্যথা নিয়ে রেগে বসে আছে শিমুল গাছের নিচে পাতানো কাঠের বেঞ্চে। জিনিয়া খাতা দিয়ে বাতাস করে দিচ্ছে আর সিমানী মাথা টিপে দিচ্ছে। সামনে নকিব, তুষার আর নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তুষার বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে।
“ হলে থাকলেই কি না থাকলেই কি? হল থেকে তো বাসাবাড়িতে থাকা আরও বেটার।’’
নয়নও তাল মিলিয়ে বললো,“ হ্যা তাই–তো। তুই কোনো এক বাসায় উঠে পড় বা হোস্টেলে!’’
স্মরণ চোখ খুলে তাকালো। মুখায়ব শান্ত করে শান্তভাবে বললো,“ এই শহরে কমদামী রুম কোথায় খুঁজে সেসব বল ব্যাটা। শুধু ফটর ফটর করলেই হবে না। আর তোরাই বা কেমন ফ্রেন্ড? সেই বাচ্চাকাল থেকে এক স্কুলে, এক কলেজে এখন আবার একই ভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করছি। ল্যাডাকাল থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের। তন্মধ্যে একজন বিপদে পড়েছে, তাকে সাহায্য না করে এখানে বকর বকর করছিস?’’
নকিব নয়নের কাঁধে হাত রেখে স্মরণকে বললো,‘‘তুই এক কাজ কর। আমাদের বিল্ডিং এ রুম খালি আছে। সেখানে উঠে যা।’’
“ ভাড়া বল!’’
“ ১৯০০০ হাজার টাকা।’’
“ যদি তুই মাসে মাসে ভাড়াগুলো দিয়ে দিতে পারিস, তবে আমি আজকেই উঠবো।’’
“ অসম্ভব!’’ তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো নকিব। স্মরণ বিরক্তি নিয়ে বললো,“ তাহলে চুপ থাক।’’
স্মরণের পাশ থেকে সিমানী চিন্তিত সুরে জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ এখন কি করবি বইন?’’
“ রাস্তায় রাস্তায় থাকবো, তবুও ওই বাড়িতে আর থাকা একদমই সম্ভব না আমার। আমারও একটা সম্মান আছে নাকি? যে বাড়িতে নিজের কোনো সম্মানই নেই, সবসময়ই গালাগাল খেতে হয় ; তো ওই বাড়িতে কোন মুখে থাকবো। ইটস ইম্পসিবল।’’
“ হ্যা, স্মরণ ওই বাড়িতে আর থাকবে না।’’ কথাটা জিনিয়া বলে উঠলো।
সবাই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলো। ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে নিরবে। বাতাসের ঘ্রাণে আলাদা একটা ঘ্রাণ অনুভব করলো স্মরণ। হুট করেই তার ভালো লাগা শুরু করলো। বন্ধুদের সবগুলোকে একবার তাকালো। এদের সাথে ছোট থেকেই বন্ধুত্ব খুব ভালো বন্ধুত্ব তার। মা তো নেই, বাবাও স্মরণকে বোঝে না। একমাত্র এই বন্ধুরাই তাকে এতদিন যাবৎ খেয়াল রেখে আসছে।
নিরবতা ভেঙ্গে নয়ন বলে উঠলো,“ আমার একটা বাসা পরিচিত আছে। বাসার মালিকের মেয়ে আমার, আমার আসলে…’’
“ তোর গার্লফ্রেন্ড!’’ নকিব আর তুষার দুজনে সমস্বরে বলে উঠলো। নয়ন মাথা নিচু করে বললো,“ যাই–ই হোক। স্মরণ যদি তুই চাস তাহলে তোকে নিয়ে যাব।’’
তারপর থেমে আবারও বললো,“ ভাড়াও কম।’’
স্মরণ উৎসুক হলো,“ বাসাটা কোথায়?’’
“ বাসাটা একটু দূরে হলেও, নিরিবিলি জায়গায় পড়েছে। বাসার পেছনে জঙ্গল আছে। বাসার পাশে দু-একটা বিল্ডিং, আরেকটু এগিয়ে গেলেই মেইন রোড।’’
“ তাহলে চল।’’ উঠে দাঁড়ালো স্মরণ। জিনিয়া, সিমানীও উঠে দাঁড়ালো। স্মরণ নয়নের কাছে এসে পিঠে একটা চাপড় মেরে বললো,“ স্মরণ নিরিবিলি জায়গায় পছন্দ করে। দরকার হলে মাঝে মাঝে রাতে ওই জঙ্গলে গিয়ে একটা ছোটখাটো পিকনিক অ্যারেঞ্জ করবো।’’
তুষার হেসে বললো,“ আমি গিটার নিয়ে যাবো।’’
নকিব বললো,“ আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে।’’
জিনিয়া নকিবের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,“ তুমি মাইন্ড ঠিক করো নকিব।’’
“ আমার মাইন্ড ঠিকই আছে, এইযে তুই–ই খারাপ করে দিচ্ছিস।’’
সিমানী নিজের নাক গলালো,“ তোরা দুজনই ডার্টি মাইন্ডেড।’’
“ আর তুমি কচি খুঁকি।’’ ব্যাঙ্গ করে বললো নকিব। স্মরণ ধমকালো তিনজনকে,“ এই তোরা কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাক। এতো কথা কিভাবে বলিস?’’
“ সৃষ্টিকর্তা মুখ দিছে কথা বলার জন্যই।’’
নকিবের কথায় স্মরণ নকিবের দিকে তাকালো। নকিব তুষারের দিকে নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালো। স্মরণ আর কিছু বললো না। নয়নকে বললো,“ চলো বন্ধু। তোমার গার্লফ্রেন্ডের বাসায়। দরকার হলে আমি কালই উঠবো।’’
স্মরণের কথায় সবাই রওনা হলো নয়নের সেই গার্লফ্রেন্ডের বাসায়।
আধঘণ্টা পর এসে পৌঁছালো নির্জন এক এলাকায়। এদিকটা জনবসতি খুব কম। অথচ শহরেই যে এমন এক জায়গা আছে স্মরণের ধারণায় ছিলো না। দুটো সিএনজি এসে থামলো মেইন রোডে। নেমে পড়লো সবাই। যার যার ভাড়া সে সে দিয়ে দিলো।
নয়ন হাঁটা আরম্ভ। বাকিরাও পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলো। একটু হেঁটে গিয়ে একটি তিনতলা ভবন চোখে পড়লো। বাড়ির চারিধার ঘিরে রয়েছে জং ধরা টিন। তিনতলা এই বিল্ডিংটি নয়ন বাদে বাকি পাঁচ বন্ধু খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো৷ বাড়িটির রঙ উঠে গেছে। অনেকবছরের পুরোনো বাড়ি।
স্মরণ নয়নের পাশে এসে দাঁড়ালো,“ সবসময় আসা যাওয়া হয় বুঝি?’’
স্মরণের কথায় সবাই হেসে উঠলো। নকিব হাসতে হাসতে বললো,“ নাহলে কি এতো ভালোভাবে স্মরণে থাকতো নাকি?’’
তখনই চারটা গাড়ি এসে তাদের থেকে কিছুটা দূরে থামলো। গাড়ি থেকে বের হলো পরপর কিছু সাদা কাপড় পরনে লোক। দেখে মনে হচ্ছে কারও বডিগার্ড এরা। মাঝের গাড়ির সামনে এসে একজন গাড়ির দরজা খুলে দিলো। পরপর একদম সিনেমাটিক টাইপে এক মাঝবয়সী লোক নেমে পড়লো। পরনে শুভ্র পাঞ্জাবী-পাজামা। সুপুরষ লাগলেও মুখটা দেখে গুণ্ডা মনে হলো স্মরণের।
তুষার চমকে বলে উঠলো,“ আরেহ এ তো এমপি আব্দুল সরকার!’’
নকিব আর নয়নও মাথা ঝাকালো। তবে মেয়েরা চিনলো না। সাধারণত ছেলেদের এসব বিষয়ে জানা থাকলেও মেয়েরা নাম ছাড়া মানুষগুলোকে খুব একটা চেনে না। তাই স্মরণদেরও একই অবস্থা।
এদিকে সেই এমপি আব্দুল সরকার এগিয়ে এলেন স্মরণদের দিকে। স্মরণরা ভেবেছিলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তবে মানুষগুলো তাদের দিকে এগিয়ে এলো ঠিকই তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। সামনেই একটা জঙ্গল। তার আগে একটা বাড়ি শুধু। এমপি ও তার চ্যালাপ্যালারা সেই জঙ্গলের দিকেই গেলো।
তুষার ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো,“ আজকাল এমপি, মন্ত্রীরাও জঙ্গল পরিদর্শনে বের হয়।’’
একটা হাসির রোল পড়ে গেলো সেখানে। তখনই গেইট খুলে এক মাঝবয়সী লোক বের হয়ে এলেন আর ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,“কি চাই? ’’
হঠাৎ এরূপ প্রশ্নে স্মরণরা থতমত খেয়ে গেলো। নয়ন একবার বাকিদের দিকে তাকিয়ে সেই মাঝবয়সী লোকটাকে বললো,“ আসলে আঙ্কেল আমরা রুম দেখতে এসেছি। আপনাদের বিল্ডিং এ নাকি রুম খালি আছে।’’
লোকটা এবার খুশি হলেন মনে হলো। হেসে বললেন,“ কয়জন থাকবা?’’
“ আমার এক বান্ধবী থাকবে শুধু। হবে কি?’’
“ হবে মানে দৌঁড়াবে একদম৷ আমাদের তিনতলায় একটা রুম খালি আছে। সেখানে উঠতে পারবে। আমার মেয়েটাও আর নিঃসঙ্গতায় ভুগবে না।’’
নয়ন জিজ্ঞাসা করলো,“ ভাড়া ক…’’
“ দুই রুম, একটা বাথরুম, একটা রান্নাঘর। ভাড়া হচ্ছে ছয় হাজার টাকা।’’
এত কম ভাড়া শুমে চমকালো সবাই। তাদের এই চমকানো ভাব দেখে নোমান সাহেব বললেন,“ এদিকে রুম তেমন ভাড়া হয় না। আমি হুদাই তুলেছি এই বিল্ডিং। তাই ভাড়া কমিয়েছি এখন। তবে তোমরা চাইলে আরও বাড়াবো।’’
প্রায় সবাই একযোগে বলে উঠলো,“ দরকার নেই।’’
স্মরণ তো মহাখুশি। সেসময় বিল্ডিং থেকে চারজন যুবক কথা বলতে বলতে বের হয়ে এলো। সবাই সময় সেদিকে তাকালো। সবাই কপাল কুঁচকে তাকালেও অবাক হলো নয়ন।
বাহারাজরা বাসা থেকে বের হয়ে সামনে একদল ছেলেমেয়ে দেখে তারাও ভ্রু কুঁচকালো। তবে তাদের মধ্যে শায়ন একটু বেশিই ভ্রু কুঁচকালো। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছোট ভাই নয়নকে এখানে দেখে বললো,“ তুই এখানে?’’
নয়নও একইভাবে বললো,“ তুই এখানে?’’
শায়ন বিরক্ত হলো,“ আমি বড় আমার উত্তর আগে দে নয়ন।’’
তাদের এটুকু কথোপকথনেই একপ্রকার বিস্মিত সবাই। নয়ন বললো,“ আমি আমার বান্ধবীর জন্য বাসা খুঁজতে এসেছিলাম।’’
“ আর আমার বাসাতেই রুম নিয়েছে। ওইযে তিনতলার ওই দুইরুমের ফ্ল্যাট–টাই।’’
নোমান সাহেবের কথায় বাহারাজ যেন বিরক্ত হলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,“ আঙ্কেল! দরকার হলে ওই রুমের ভাড়াটাও আমিই দেবো। দ্বিগুণ দেবো। তবুও আপনি বাসায় ভাড়াটিয়া আনবেন না।’’
নয়ন স্মরণের দিকে তাকালো। দেখলো মেয়েটা রেগে গেছে। বাহারাজকে নয়ন চেনে। এই ছেলে খুবই গম্ভীর। এখানে স্মরণ আর তার যদি গণ্ডগোল হয় তাহলে স্মরণের এই বাসায় থাকা আর হবে না। বন্ধুর কথা ভেবেই স্মরণের কিছু বলার আগে নয়নই আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো,“ বাহারাজ ভাই, আসলে স্মরণ বিপদে পড়েছে। আশা করি তুমি কিছুটা হলেও বুঝবে।’’
শায়ন বললো,“ কে স্মরণ?’’
“ আমার বান্ধবী স্মরণ।’’ বলেই নয়ন স্মরণকে দেখিয়ে দিতেই চার বন্ধুর নজর গিয়ে পড়লো স্মরণের দিকে। অভ্রর মনে হলো সে স্মরণকে কোথাও দেখেছে। তবে তাৎক্ষণিক মনে করতে পারলো না।
রিয়াদ বাহারাজের কাঁধে হাত রেখে স্মরণের দিকে তাকিয়ে বললো,“ মেয়েটা হয়তো বিপদে পড়েছে। না করিস না।’’
বাহারাজ একবার স্মরণের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই সামনে হাঁটা ধরলো। স্মরণের সামনে দিয়ে চলে গেলো। দুজনের কেউ বুঝলো না তাদের আগেও দুইবার দেখা হয়েছে। এদিকে নোমান সাহেব খুশি হয়ে বললেন,“ সাবধানে যেও বাবা। আর রাতে আমাদের বাসায় ডিনার করো আজ।’’
এদিকে স্মরণ বুঝতে পারলো এরা এই বিল্ডিং এ ভাড়া থাকে। ভয় পেলো স্মরণ। এতগুলো যুবক এই বিল্ডিং এ থাকে। স্মরণ আর ভাবনার গভীরে গেলো না। এখানে না থাকলে আর রুমও পাবে না তাও আবার এতো কম দামে। এদিকে এই বাসায় এমন যুবক আছে। কি করবে না করবে ভাবতে লাগলো।
বাহারাজ চলে যেতেই শায়ন তার ছোট ভাইকে বললো,“ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবি।’’
সেও চলে গেলো। অভ্র আর রিয়াদ যাওয়ার সময় রিয়াদ স্মরণের দিকে একবার তাকালো। স্মরণও তার দিকে তাকাতেই রিয়াদ একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,“ স্বাগতম।’’
বলেই চলে গেলো রিয়াদ আর অভ্র। কথার মানে বুঝলো না স্মরণ। কিসের স্বাগতম জানাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে মনে করতে লাগলো খারাপ কিছুর নয়তো আবার?
এদিকে নয়ন বুঝলো তার ভাইয়ের বন্ধু বাহারাজ এই বাসায় ভাড়া থাকে। আর শায়নও এই বাসায় আসে মাঝে মাঝে। তবে দুই ভাইয়ের কখনোই দেখা হয় নি। নয়ন মাঝে মাঝে শীতলকে বাসায় ছেড়ে দিয়ে যায়। নয়ন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভাগ্যিস দেখা হয় নি।
স্মরণ নয়নের কাছে এসে বললো,“ এই নয়ন আমার কি এখানে ওঠা ঠিক হবে? এখানে এত যুবক থাকে। যদি কি…’’
“ বাজে কথা বলিস না। এখানে শুধু বাহারাজ ভাই থাকে। উনার মতো ভালো মানুষ নেই।’’
নোমান সাহেব তাদের কথার মাঝে বললেন,“ এইযে মেয়ে স্মরণ না মরণ তুমি কালই বাসায় উঠে পড়ো।’’
#চলবে
– জুনানী চাকমা