#ছায়াতরু
#পর্ব_৪
“ এভাবে রাস্তায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করাটা তোমার মতো বেকারকেই মানাবে, তবে তোমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কেমন সেটাও মাথায় রেখে তোমার চলাফেরা করা উচিত বাহারাজ।’’
কালো মাইক্রো থেকে এক মহিলা কথাগুলো খুব দাম্ভিকতা নিয়ে বললো। বাহারাজ গাড়ির দিকে তাকালো। বেকারত্ব শব্দটাই বেশি মাথায় ঘুরছে তার। বাহারাজ ব্যাগটা শায়নের দিকে ছুড়ে মেরে গাড়িতে বসে থাকা মহিলার দিকে না তাকিয়ে বললো,“ যে ফ্যামিলিতে থাকি না, সেই ফ্যামিলির স্ট্যাটাস মাথায় রাখবো কেন?’’
মহিলাটি “ হ্যা তাই–ই তো।’’ বলে গাড়ি থেকে নামলো। গায়ে জড়ানো শাড়িটা দেখেও বোঝা যায় উনার আভিজাত্যের অহংকার। জৌলুশপূর্ণ আস্তরণ না থাকলেও জৌলুশে মাখা গাম্ভীর্য যেন নজরকাড়া উদাহরণ। একদম বাহারাজের সামনে বরাবর দাঁড়িয়ে আগের মতোই ঠাট্টার স্বরে বললেন,“ তাই যদি হতো তবে গতকাল রাতে নিশ্চয়ই বন্ধুদের নিয়ে দেওয়ান বাড়িতে পা রাখতে না!’’
তাচ্ছিল্য হাসলেন মহিলাটি। পুনরায় একইভাবে বললেন,“ তাও আবার আমারই অনুপস্থিতিতে।’’
রিয়াদ এগিয়ে এলো সেখানে। সে এতক্ষণ একটু আগের লোকটাকে জেরা করছিলো। লোকটা একজন মহিলার থেকে ব্যাগটা চুড়ি করে নিয়ে যাচ্ছিলো। যেটা বাহারাজরা দেখে ফেলে। তাইতো লোকটার পিছু নিয়েছিলো। মহিলাটাই বলেছিলো ব্যাগে কিছু কাগজপত্র আর টাকা ছিলো। তবে ব্যাগে শুধুমাত্র টাকাগুলোই পাওয়া গেছে। রিয়াদ লোকটাকে মারলো তবে লোকটা কিচ্ছুটি স্বীকার করলো না। রিয়াদ লোকটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে বাহারাজের কাছে আসলো। আর সেসময় বাসনা আমানের কথা শুনে তারও কিছুটা রাগ হলো।
মায়ের এমন ঠাট্টা শুনে বাহারাজ সটান হয়ে দাঁড়ালো। তার ইগোতে লাগলো কথাটা। তার কোনো ইচ্ছে ছিলো না দেওয়ান বাড়িতে পা রাখার। ছোট বোন বীথিকে পাত্র দেখতে এসেছিলো গতকাল। বাবা তো বেঁচে নেই। বড় ভাইও বাড়িতে থাকে না। তবুও অনেক রিকোয়েস্ট করায় বাহারাজও রাজি হয়েছিলো। বীথি বাহারাজের বন্ধুদেরও যেতে বলেছিলো। নয়তো বাহারাজ ওই বাড়ির দিকে ফিরেও তাকায় না। এর কারণ অবশ্য তার মা।
বাহারাজের দাদা রাসেল দেওয়ান ছিলেন একজন এমপি মহোদয়। যিনি গত হয়েছেন বছর ছয়েক আগে। রাসেল দেওয়ানের দুই পুত্র। বড় পুত্র রাজিব দেওয়ান আর ছোট পুত্র রাহান দেওয়ান। বাবা এমপি পদ থেকে সড়ে যাওয়ার পর উনার পুত্ররাও রাজনীতি পেশা গ্রহণ করেন নি। বড় পুত্র রাজিব দেওয়ান ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন আর ছোট পুত্র রাহান দেওয়ান বাহারাজের বাবা একজন জার্নালিস্ট ছিলেন। তবে তিনি বছর পনেরো আগে মারা গিয়েছেন কার এক্সিডেন্টে। স্ত্রী বাসনা আমান একজন বিজনেসওম্যান। বাসনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো ছিলো। বাসনা আমানের বাবা বিশাল আমান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। উনার একমাত্র মেয়ে বাসনা আমান। আর তারই প্রেক্ষিতে বাসনা আমান বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। স্বামীর অকালে মৃত্যুর পর ছোট ছেলেমেয়ে দুটোকে নিজেই মানুষ করেছেন। ছেলেকে নিজের ব্যবসায় লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বিদেশে পড়াশোনা করাতে। তবে ছেলে উনার কথা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে এখন আপাতত বেকার রয়েছে। রেগে ছেলেকে বাড়ি থেকেই বের করে দেন বাসনা আমান। এতে অবশ্য কেউই আটকাতে পারে নি উনাকে। উনার শ্বাশুরি দেওয়ান বাড়ির কর্ত্রী মনিকা বেগম মানা করেছিলেন তবে তাও মান্য করেন নি বাসনা। এরপর থেকেই ছেলের সাথে রাস্তাঘাটে দেখা হয়। আর ছেলেকে নানা কথা শোনান।
মায়ের কথা শুনে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না বাহারাজ। বরং রাস্তার অপর পাশে কিছু একটা দেখে হাঁটা ধরলো সেদিকে।
রিয়াদ বাহারাজকে চলে যেতে দেখে ডাক দিলো,“ এই বাহারাজ কোথায় যাচ্ছিস?’’
বাহারাজ উত্তর দিলো না। রিয়াদ একবার বাসনা আমানের দিকে তাকালো। আর বললো,“ আপনার এমন ভাবে বলা উচিত হয় নি আন্টি।’’
বাসনা আমান রিয়াদের দিকে তাকালেন,“ তাই নাকি? তা কিভাবে বলা উচিত ছিলো?’’
সেই উত্তর দিলো না রিয়াদ শুধু বললো,“ বেকার হলেও নিজের খরচ নিজেই চালিয়ে খাচ্ছে।’’
এরপর সেও চলে গেলো বাহারাজের পিছু। এদিকে বাসনা ছেলের যাওয়া দেখলেন। শায়ন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন,“ বাহারাজের খেয়াল রেখো শায়ন। আমি আসি।’’
গাড়িতে উঠে মুহুর্তের মাঝেই গাডি চলে গেলো।
এদিকে স্মরণ কিছুটা সফল হয়েছে ময়লাটা পরিষ্কার করতে। মনে মনে খুশি হলেও যে তাকে ধাক্কা দিয়েছে তার পুরো চৌদ্দ গুষ্ঠিকে গালি দিলো। তার পাশে থাকা ট্রাক ঘেষে যাওয়ার সময় কিছু একটার শব্দ পেলো স্মরণ। শব্দটা ট্রাক থেকেই পেয়েছে। ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলো কিসের শব্দ এটা? তখনই ড্রাইভার এসে চেঁচালো,“ এইহানে দাঁড়াইয়া কি করেন? সড়েন, যান। ’’
স্মরণ সন্দিহান হয়ে বললো,“ ট্রাকের ভেতরে কি মানুষ আছে নাকি?’’
“ আপনে কি পাগল নাকি? ট্রাকের ভিতরে বালু আছে। কেন আপনের ওপর ঢাইলা দিতাম?’’
স্মরণ কপাল কুঁচকে বললো,“ কোন আক্কেলে আমায় পাগল মনে হয় আপনার? আসলে আপনিই পাগল, বেক্কল, বয়রা, কানা; সব।’’
লোকটা ধমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্মরণ চলে গেলো। রাস্তা পার হলো। রাস্তার ওপারে রিকশা দেখা যাচ্ছে। তার পাশ দিয়েই বাহারাজও গেলো। তবে দুজন একে অপরকে চিনলো না। আর না দুজনের মাঝে কোনো চোখাচোখি হলো। একজন ভীষণ চিন্তিত তো অন্যজন রাগত। অথচ একজন জানেই না যে এই সেই যুবক যে বারবার তাকে ধাক্কা দেয়। আর অন্যজন জানে না এই সেই মেয়ে যে তাকে দু– দুবার চেঁচিয়েছে, রাগ দেখিয়েছে।
মুহুর্তেই দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলো।
____________________________
পাব্লিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে স্মরণ। শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে তার। কিছু জায়গায় চিনচিনে ব্যথাও অনুভুত হলো। মাথা ব্যথাটা এতক্ষণ না থাকলেও ভার্সিটিতে আসার পর কেন যেন মাথা ব্যথা শুরু হলো।
“ এই রণ, যাচ্ছিস কোথায়? আমাদের দেখতে পাস নি?’’
বন্ধু তুষারের কথায় থেমে গেলো স্মরণ। কপালে একটা হাত দিয়ে বললো,“ সত্যি বলতে, আসলেই দেখতে পায় নি।’’
তুষার সামনে তাকালো। মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলতে লাগলো,“ কোন রাজকুমারকে দেখেছিস তুই? যে আমাদের দেখতে পাস নি? নাকি তোর কানা হয়ে গেছিস? নাকি তোর চোখে ছানি পড়েছে নাকি তুই পাগল হয়ে গেছিস?’’
“ বাজে বকা বন্ধ কর। এমনিতেই মাথা ব্যথায় মাথাটা একদম ছিড়ে যাচ্ছে। আর তোর এই আজেবাজে কথাবার্তা তার মাত্রা আরও তীব্র থেকে তীব্র করে দিচ্ছে।’’
জিনিয়া, সিমানী এগিয়ে এলো। স্মরণকে ধরলো। নকিব তুষারের মাথায় গাট্টা মারলো। কাঁধে হাত রেখে ব্যঙ্গ করে বললো,“ ওর মাথাব্যথা বোঝো না তুষার?’’
“ আহ হা, চুপ থাক তোরা। এমনিতেই স্মরণের নাকি রাতে জ্বর এসেছিলো। আবার মাত্রই এলো, মাত্রই শুরু করলি।’’ নকিবকে আর জিনিয়াকে বিরক্তি নিয়ে বললো সিমানী। পুরো নাম আসমানী হলেও সবাই সিমানী বলেই ডাকে ওকে।
জিনিয়া বললো,“ চল ওকে ফার্মেসীতে নিয়ে যায়। ঔষধ খেলে কিছুটা হয়তোবা কমবে।’’
স্মরণ মুখ খুললো,“ দরকার নেই। এত উদ্বিগ্ন হবারও প্রয়োজন নেই। আমি সুস্থ আছি। ক্লাসে চল এখন।’’
তুষার ঝুকে বললো,“ আসলেই ঠিক আছিস নাকি ভান ধরছিস?’’
স্মরণ বড়সড় একটা গাট্টা মারলো তুষারের মাথায়। ঠোঁটে বেকিয়ে বললো,“ কি মনে হলো?’’
তুষার মুখ ফুলিয়ে বললো,“ হ্যা হ্যা ঠিকই আছিস।’’
ক্লাস চলাকালীন স্মরণের ফোনে মেসেজের একটা নোটিফিকেশন আসলো। স্মরণ বেঞ্চের নিচে ঝুকে দেখার চেষ্টা করলো কে কি মেসেজ দিয়েছে? দেখলো অচেনা নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজ অপশনে ক্লিক করতেই দেখলো টাইপিং অক্ষরে লেখা,
“ পান খাইতে ডাকে আমারে,
বড় বড় চোখের দিকে তাকাইরে।’’
#চলবে
– জুনানী চাকমা