#ছায়াতরু ‘০২’
স্মরণের চুলে মুঠি করে ধরে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন রাবিনা বেগম। ফ্লোরে এমনভাবে ছুড়ে মারলেন যেন স্মরণ কোনো ফেলনা। স্মরণও দাতে দাত চেপে সহ্য করে নিলো। উল্টো ফ্লোরে ছুড়ে মারার পরই এমনভাবে হাটু ভাঁজ করে বসলো যেন কিছুই হয় নি। দৃষ্টি তার শীতলভাবে পরখ করলো রাবিনা বেগমকে।
দরজা খোলা রাখা ছিলো। রাবিনা বেগম গিয়ে দরজা লাগালেন। পিছে ঘুরে আবারও জলন্ত চোখে স্মরণের দিকে তাকালেন। স্মরণকে এমন শান্ত আর ওভাবে বসে থাকতে দেখে বিস্ফোরিত হলো চোখজোড়া। মাথায় লেগে গেলো আগুন। রাহা ফোন করার পর থেকেই তিনি এতটাই রেগে ছিলেন স্মরণের প্রতি সেটা রাবিনা বেগম নিজেও কল্পনা করতে পারছেন না। গা দিয়ে আর মাথার চামড়া ফেঁটে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ঘরটিতে যেন মুহুর্তের মাঝেই সেই উষ্ণতা দাবনলের মতো ছড়িয়ে পড়লো।
তবে স্মরণের মস্তিষ্ক যথেষ্ট রকমের শীতল। সেই শীতলতায় যেন কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে সক্ষম রাবিনা বেগমের ওপর। তাই স্মরণের দিকে তেড়ে গিয়ে পরপর এলোপাতাড়ি কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন স্মরণের গালে। মারতে মারতে রাবিনা বেগমও হাঁপাচ্ছেন। তবে স্মরণের মূর্তির মতো বসে থাকাতে নিজেও চমকে গেলেন। স্মরণের চুল মুঠি করে টেনে ধরে বললেন,“ কোন সাহসে তুই আমার মেয়েকে চড় মেরেছিস?’’
স্মরণ যেন উত্তর প্রস্তুত রেখেছিলো
তাইতো সঙ্গে সঙ্গেই রাবিনা বেগমের কথার প্রত্যুত্তর করলো,“ আপনি যে সাহসে আমাকে মারছেন।’’
চমকে গেলেন রাবিনা বেগম। কোমড় ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। স্মরণকে তিনি আগে অনেক মারধোর করেছেন। তবে মেয়েটা শুধুই কান্নাকাটি করতো কোনো প্রত্যুত্তর করতো না। তবে আজ এমন কথা বললো এতে রাবিনা বেগমেরই মাথা খারাপ হয়ে গেলো যেন। আবারও একটা চড় মারলেন তিনি। চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,“ মুখে মুখে তর্ক করছিস? মুখে মুখে তর্ক করছিস হ্যা? আজ তো আমি তোকে মেরেই ফেলবো?’’
স্মরণ এতোগুলো চড় থাপ্পড় খেয়েও স্বাভাবিক ছিলো। যেন রাবিনা বেগম স্মরণের কোমল গালে নয় কোনো লোহায় চড় মেরেছেন। অবশ্য রাবিনা বেগমের হাতও জ্বলছে এখন স্মরণকে চড় মারতে মারতে। রাবিনা বেগমের শেষোক্ত কথায় স্মরণ বিচলিত হলো না বরং ঠোঁটে বাকা হাসির রেখা টেনে নির্বিকারভাবে বললো,“ কি মারবেন আর আমায়? আমি তো ভেতরে ভেতরে অনেক আগে থেকেই মৃত।’’
চোখ বড় বড় হয়ে গেলো রাবিনা বেগমের। স্মরণের চোখ দেখে তিনি নিজেই ভয় পেলেন। এই মেয়ে তো আগে এমন ছিলো না। চোখে ভয় দেখা যেতো আগে আর এখন চোখজোড়ায় যেন আগুন জ্বলছে নিরবে। আগে কথা বলতে গলা কাঁপতো এই মেয়ের আর এখন কি নির্দ্বিধায় এসব কথা বলে যাচ্ছে। চোখেমুখে ভয় নেই, নেই কান্না কান্না ভাব।
“ মারবেন না আর? তাহলে আমি উঠি।’’
বলেই উঠে দাঁড়ালো স্মরণ। আরও বেশি হতবাক হলেন রাবিনা বেগম। স্মরণ তার সাইড ব্যাগটা খোঁজা শুরু করলো। কোথায় ছিটকে পড়েছে। তার এহেন কাজে রাবিনা বেগমের নির্বাকতা,হতবম্ভতা কাটছে না বরং আরও বাড়ছে।
স্মরণ একটা সময় তার ব্যাগটা খুঁজে পেয়ে খুশি হয়ে গেলো। রাবিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে গলার ঝাঝ কমিয়ে বললো,“ আপনি আপনার আপন মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেন নি।’’
এবার নিজের নির্বাকতা ছাড়িয়ে দাত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,“ তোর বাপ আসুক আজকে। তোর বাবাকে জানাবো তার আগের বউ কি পরিমাণ নোংরা মানসিকতার ছিলেন। তার মেয়েও যে তেমনই হয়েছে।’’
ঘর কাঁপিয়ে হাসলো স্মরণ। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে বললো,“ আমার মা যদি নোংরা মানসিকতার হয় তাহলে ছোট মুখে বড় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনিও চরিত্রহীন ছিলেন তবে। তাই আপনার মেয়েও আপনার মতোই হয়েছে। ’’
তীব্র ঘৃণা নিয়ে স্মরণ কথাটা বললেও রাবিনা বেগম বুঝলেন না। উল্টো কথাটা শোনামাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন রাবিনা বেগম। স্মরণের দিকে তেড়ে গেলেন তবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। থেমে গেলেন তিনি। চোখের তীব্র রাগই যেন স্মরণকে বুঝিয়ে দিলো ‘ তোকে আমি ছাড়বো না ’। দরজা খুলতে চলে গেলেন তিনি। স্মরণ ব্যাগটা হাতে নিয়ে পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রাবিনা বেগমের ছুড়ে মারার কারণে পায়ে কিছুটা আঘাত পেয়েছে স্মরণ।
রাবিনা দরজা খুলতেই বাইরে অনিল সাহেবকে ক্লান্ত অবস্থায় দেখলেন। এদিকে রাবিনা বেগম তখনও রীতিমতো হাপাচ্ছেন। মুখ লাল রয়েছে তখনও। রাস্তা দিলেন অনিল সাহেবকে ঢোকার জন্য। অনিল সাহেবও ভেতরে ঢুকলেন। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন,“ স্মরণ কোথায়?’’
আজ হঠাৎ মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করায় রাবিনা বেগম অবাক হলেন। দরজা লাগিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,“ তোমার গুণধর মেয়ে আমার মেয়েকে তিনটে চড় মেরেছে আজ। ওকে কিছু বলো তুমি। দিন দিন বেশিই করছে সে।’’
অনিল সাহেব টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসে জগ থেকে পানি ঢেলে পান করলেন। আর রাবিনা বেগমের বলা সমস্ত কথাও শুনলেন। পানির গ্লাসটা জায়গা মতো রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,“ সত্যিই মেরেছে? আর কি কারণে মেরেছে?’’
তেঁতে উঠলেন রাবিনা।
উচ্চৈঃস্বরে মেজাজ দেখিয়ে বললেন,“ তোমার কি মনে হয়, আমি মিথ্যে বলছি!’’
থামলেন রাবিনা। বলা শুরু করলেন,“ তোমার নবাবজাদী মেয়ে আমার মুখে মুখে কথা বলে। আজ শুধু বারণ করায় পারে তো আমাকেই মারে। এই বয়সে এসে এসব দেখতে হবে কল্পনাতীত ছিলো।’’
অনিল সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। আর জিজ্ঞাসা করলেন,“ স্মরণ কোথায়?’’
রাবিনা চিন্তিত হলেন যদি স্মরণ বলে দেয় রাবিনা তাকে মেরেছে। চুপ রইলেন তাই। কিন্তু অনিল সাহেবই জোরে জোরে স্মরণকে ডাকা শুরু করলেন। স্মরণ সবে বিছানায় গা এলিয়ে দিচ্ছিলো ঘুমানোর জন্য। সেসময় বাবার ডাক পেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। স্মরণকে দেখে অনিল সাহেব অবাক হলেন। দুই গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে আছে। বোঝা যাচ্ছে কেউ চড় মেরেছে। অনিল সাহেব রাবিনার দিকে তাকালেন। রাবিনা চোখ লুকাচ্ছে।
অনিল সাহেব উঠে মেয়ের নিকটে গেলেন। এক হাত মাথায় রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,“ কি হয়েছে?’’
বাবার আজকের এমন ব্যবহারে ভীষণ রকম চমকে গেলো স্মরণ। চোখ বড় বড় করে বাবাকে উপরনিচ দেখলো। হতবম্ভাবস্থায় বললো,“ আজ সূর্য কোনদিক থেকে উঠেছে বাবা? পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে নাকি মাটি ফেড়ে উঠেছে?’’
স্মরণের এমন কথার মানে বুঝলেন অনিল সাহেব। প্রথম স্ত্রীর সমাধিস্থলে গিয়েছিলেন আজ। সায়নিকা মৃত্যুর আগে বার বার অনিল সাহেবকে নিজের মেয়েকে দেখে রাখার কথা বলেছিলেন। অথচ অনিল সাহেব এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে মেয়ের কথাই ভুলে গিয়েছেন। মেয়ের ভালোর জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন অথচ তিনি নিজেও জানতেন না যে মেয়েকে সেচ্ছায় আগুনে ফেলে দিয়েছেন। আসার সময় যখন দেখলেন স্মরণের হবু বর হিমেল আর রাহা একসাথে একটা হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেসময় তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিলো। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। এতবছর এই মা মেয়ের প্রতি যেন কিছুটা অন্ধভক্তি চলে এসেছিলো উনার যা কয়েক সেকেন্ডেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
বাবাকে ভাবুক দেখে স্মরণ সড়ে গেলো। আর মাথা নিচু করে নরম গলায় বললো,“ ক্ষমা করো বাবা, আমি তোমাদের ঠিক করা সেই হিমেলকে বিয়ে করতে পারবো না।’’
তাদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাবিনা যেন আবারও ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো ফুঁসে উঠলেন। চড়া মেজাজে বললেন,“ কেন রে নবাবজাদী? বাবার ঘাড়ে বসেই আজীবন খাবি নাকি?’’
স্মরণ একবার রাবিনা বেগমের দিকে তাকালো। তবে উনার কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বললো না। শুধু বাবাকে নম্রভাবে বললো,“ আমি জানি আমার কথায় তোমার রাগ উঠবে। তবে আমি সস্তা নই যে ওমন এক চরিত্রহীন ছেলেকে বিয়ে করবো।’’
অনিল সাহেবের চোখের সামনে আবারও রাহা হিমেলের একসাথে হাঁটার ছবি ভেসে উঠলো। বিরোধিতা না করে রাবিনা বেগমেরও কোনো কথা না শুনে মেয়েকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,“ ঠিক আছে মা, আমিও তোমার কথায় সহমত প্রকাশ করছি।’’
বাবার হঠাৎ এরূপ পরিবর্তন মানতে না পারলেও স্মরণ খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না সেখানে। রেগে থাকা রাবিনা বেগম কিছু বলার আগেই নিজের ঘরে চলে গেলো। ভেতরে এসে বুঝতে পারলো রাবিনা বেগম তার বাবাকে চেঁচামেচি করছেন।
_________________________
নিস্তব্ধ রজনীর মাঝে গাড়ির হর্ণের শব্দ আর গাড়ি চলাচলের শব্দ যেন বেমানান। জোনাকিদের আওয়াজ আর এক তিমিরেও শোনা যায় না। বছর ছয়েক আগে শহরেও জোনাকিদের চলাচল ছিলো তবে এখন জোনাকিরা বিলুপ্তপ্রায়। গ্রামেও তাদের আর দেখা যায় না। জ্বলজ্বল করে ওঠে না তাদের আলো। পৃথিবীর কতকিছুই না পরিবর্তন হয়ে গেছে।
সউচ্চ প্রাচীরের ভেতরের মাঝ বরাবর বিশাল এক শুভ্ররঙা তেতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে নিজ অবস্থানে। বাড়ির গরন আর কারুশিল্প দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়ি যে তৈরি করেছেন আর যে তৈরি করিয়েছেন দুজনই শৌখিন। বাড়ির ভেতরের অসংখ্য সাদা লাইটের সমাহারে বাইরের অবস্থাও ঝকঝকে ঝলমলে। দূর আকাশের চাঁদের আলোর যেন কোনো প্রয়োজনই নেই বাড়ির চারিপাশ আলোকিত করার। অবশ্য এমন আলোর সমীপে কোনো পোকাও আসতে চাইবে না। জানান দিতে চাইবে না নিজের উপস্থিতি। তেতলা ভবনের এই বাড়ির ছাদে কিছুটা আবছা অন্ধাকারাচ্ছন্ন জায়গায় রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। তারই সামনে কয়েক হাত দূরে বেতের সোফায় বসে আছে আরও তিনজন যুবক। বয়স জানা না থাকলেও শরীরের বলিষ্ঠতা আর মুখের স্নিগ্ধ-শুদ্ধতা যেন তাদের সুপুরুষতার আলাদা প্রতীক।
“ সারাদিন কি এতো ভাবিস?’’
সামনে হতে বন্ধু শায়নের এরূপ প্রশ্নে মোটেও উচ্ছুক দেখালো না যুবকটিকে। বরং সে নিগুঢ় চিত্তে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে গাঢ় ভাঁজ ফেলে সাদা টাইলসের ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে আলাদা গাম্ভীর্যতার ধারালো ছাপ। এদিকে শায়নের কথার প্রেক্ষিতে অন্য আরেকজন বলে উঠলো,“ বাই এনি চান্স ও কি সকালের সেই মেয়েটার কথা ভাবছে?’’
উৎসুক দেখালো শায়নকে। জানতে চাইলো,‘‘ কোন মেয়ের কথা বলছিস অভ্র?’’
“ সকালে একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো ওর। মেয়েটা কেমন করে যেন গম্ভীর স্বরে বলে ‘নেক্সট হতে দেখে হাঁটবেন’। আমি শিওর মেয়েটার প্রচুর রাগ উঠছিলো তখন।’’
“ চেহারা যতই সুদর্শন হোক না কেন ওর প্রতি সবারই রাগ থাকবে। এমন খিটখিটে পুরুষকে কে বিয়ে করবে?’’
রিয়াদ কথাটা বলতেই ছোটখাটো একটা হাসির রোল পড়ে গেলো সেখানে। এদিকে এরই মাঝে পেছনে হতে একজনের গলার আওয়াজ শোনা গেলো,“ আমার হবু শালা যতই খিটখিটে মেজাজের হোক না কেন লাইন ধরে হাজারও মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তাকে বিয়ে করার জন্য।’’
তার কথায়, তার উপস্থিতি টের পেতেই সবাই একেক করে তাকালো তার দিকে। কেউ চিনলো না।
তবে বুঝতে পারলো এই ছেলেটাই এই বাড়ির বড় মেয়ের জামাই হতে চলেছে।রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে এগিয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে বললো,
“ আমার নাম অন্তর। বীথীর হবু স্বামী। আপনার নামটা যেন কি ভুলে গেছি?’’
যুবকটি এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো। হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই সেও হাত মেলালো। হ্যান্ডশেক করতে করতেই গম্ভীর স্বরে নিজের নাম বললো,
“ বাহারাজ। ’’
#চলবে
–জুনানী