#ছায়াতরু
#সূচনা_পর্ব
–জুনানী চাকমা
হবু স্বামীর সাথে নিজের সৎ বোন রাহাকে এক বিছানায় বাজে অবস্থায় দেখে চমকে গেলেও মনে মনে খুশি হলো স্মরণ । এবার তাহলে বিয়েটা আটকানো যাবে, মানে একদম দৌঁড়োবে। টুপ করেই ছবি তুলে নিলো সে। এরপর চমকানো ভাবটা মুখে রেখে আর চোখের সামনে এমন পাপকাজ দেখে রেগে চেঁচিয়ে বললো,“ এসব কি?ছি!”
হিমেল তখন স্মরণকে দেখে শার্ট পড়তে ব্যস্ত। আর রাহা ওড়না নিজের জামা ঠিক করতে ব্যস্ত। স্মরণ সুযোগে সদ্ব্যবহার করতে ভুললো না। হিমেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে গালে সপাটে একটা চড় মেরে বসলো আর মনে মনে বললো ‘আহা শান্তি। আরও দুটো মারা উচিত।’ যেই ভাবা সেই কাজ, পরপর আরও দুটো চড় মেরে ক্ষান্ত হলো স্মরণ।
এদিকে গালে একটা চড় পড়তেই হিমেল এতটাই হতবম্ভ হয়েছিলো যে পরপর আরও দুটো পড়ে সেই হতবম্ভতা দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ওপাশে দাঁড়ানো রাহা নিজেও হতবম্ভ হলো। হিমেলকে চড় মারতে দেখে স্মরণের দিকে এগিয়ে এলো স্মরণকে মারার জন্য। স্মরণের অতি নিকটে এগিয়ে এসে হাত উঁচিয়ে চড় মারতে প্রস্তুত হতেই স্মরণ খুব সহজেই হাতটা ধরে ফেললো। মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বললো,“ আকাম করবি তুই! আর মার খাব আমি? এটা কি করে হয় রাহা?”
রাহার হাত দিয়ে রাহাকেই চড় মারলো স্মরণ। চড়ের বেগ এতটাই ছিলো যে রাহার বিশুদ্ধ মস্তিষ্ক গাণিতিক সমাধানে নিউটনের প্রয়োজনীয় সূত্রাবলি হিসেব মনে করতে লাগলো। হিমেল নিজের হতবম্ভতা কাটিয়ে শক্ত গলায় ধমকে বললো,“ হাউ ডেয়ার ইউ?”
স্মরণ পেছনে ঘুরে মাথাটা ডান দিকে হেলিয়ে ডান হাত ডান চোখের সামনে এনে তর্জনী আর মধ্যমা ভি আকৃতির করে ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে শান্ত স্বাভাবিক আওয়াজে বললো,“ হাউ ডেয়ার মি?”
হিমেল এতটাই রেগে গেলো যে স্মরণকে মারার জন্য নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলতে লাগলো। স্মরণ ভীষণ বিরক্ত হলো। একে খুব বড়সড় শায়েস্তা করতে হবে মনে মনে ঠিক করে নিলো। হিমেল বেল্টটা হাতে নিয়ে স্মরণকে মারার জন্য উদ্যত হতেই স্মরণ সেটা ধরে ফেললো। হিমেলের মেইন জায়গায় একটা লাথি মারতেই হিমেল সে জায়গায় ধরে কাচুমাচু হয়ে গেলো আর পুরো মুখ লাল হয়ে গেলো। স্মরণ গায়ের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে হিমেলের থেকে কেড়ে নিলো বেল্টটা। হিমেলের গায়ে এক ঘা বসিয়ে দিতেই আর্তনাদ করে উঠলো হিমেল। পেছন থেকে রাহা স্মরণকে আটকানোর জন্য এগিয়ে এলো, স্মরণ সড়ে গিয়ে রাহাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো হিমেলের কাছে। রাহার গায়েও এক ঘা বসিয়ে দিলো স্মরণ। আর ভাবতে লাগলো এই মেয়ে আর তার মা মিলে তাকে ছোটবেলা থেকে ঠিক কি কি ভাবে হেনস্তা করেছে। আর স্মরণের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও কিভাবে স্মরণের হবু স্বামীর সাথে এমন অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। অবশ্য স্মরণের নিজেরও এই বিয়েতে কোনো মত ছিলো না তবে বাবার কঠিন অসুস্থতার কথা চিন্তা করেই রাজি হয়েছিলো। তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ রাহাকে নোটিশ করছিলো স্মরণ ।
হিমেল যেদিন স্মরণের সাথে দেখার করার সিদ্ধান্ত নিলো সেসময় রাহাও কেন যেন স্মরণের সাথে যাওয়ার বায়না ধরে। আর ঠিক সেদিনই স্মরণ টের পায় এদের দুজনের মাঝে গভীর সম্পর্ক চলছে। স্মরণ জানে রাহা তার সমস্ত কিছু কেড়ে নিতেই অভ্যস্ত এবং ভালোবাসে। তবে হিমেলের সাথে এমন বাজে কাজ করবে তাও অবিবাহিত দুজন; এমন কিছু কল্পনার বাইরে ছিলো।
তাই আজ এদের একটা উচিত শিক্ষা দিয়েই তবে বাড়িতে ফিরবে স্মরণ। আজ বাড়িতে আগুন লাগাক এই রাহা। তবুও স্মরণ মোটেও ছেড়ে দেবে না একে। আগুন যদি লাগেই তবে আজই বাড়ি ছাড়বে স্মরণ। পনেরোটা বছর যাবৎ সহ্য করে আসছে, এই মা মেয়ের ঈর্ষা, অত্যাচার। আর কত?
স্মরণ মুখ ফুলিয়ে দাতে দাত চেপে কয়েক বার আঘাত করলো দুজনকে। সেসময় হোটেলের একজন কর্মচারী এসে স্মরণকে আটকালো।
‘‘ ম্যাম একি করছেন আপনি?’’
স্মরণও থেমে গেলো। বাইরে কয়েকজন লোক জড়ো হয়েছে। রাহা আর হিমেল আর্তনাদ করছে দুজন। ব্যথা পেয়েছে। এটাতো তাদের প্রাপ্যই ছিলো। আরও যখম করা উচিত এদের। সমাজের নোংরা কিট এরা। যারা প্রতিনিয়ত পাপ করে চলেছে আর ভবিষ্যতেও করবে।
স্মরণ হাটুগেড়ে কান্না করতে থাকা রাহার নিকট বসলো। রাহা জলন্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে স্মরণের দিকে। ওপাশে হিমেল অর্ধ উন্মুক্ত শরীরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাহা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রাগান্বিত গলায় স্মরণকে বললো,“ এর হিসেব আমি একদম হাড়ে হাড়ে নেবো স্মরণ।”
স্মরণ মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ালো। এমন হুমকি রাহা ছোট থেকেই তাদের দিয়ে আসছে। অবশ্য রাহার মা মিসেস রাবিনা নিজেও স্মরণকে ভীষণ মারধোর করেছেন নিজের মেয়ের জন্য। যখন স্মরণ কলেজে উঠলো, এরপর থেকেই মিসেস রাবিনার এসব কর্মকাণ্ড কমতে লাগলো। তবে মুখ হতে নিঃসৃত সেই বাজে, বিশ্রি কথাগুলো আর দু একটা চড় এখনও চলমান। স্মরণ ছোট থেকে এতটাই সাফার করেছে যে এখন সে সমুদ্রের তীরে থাকা শক্ত পাথরের ন্যায় হয়ে গেছে। মিসেস রাবিনা কিছুদিন আগেই একটা চড় মেরেছে স্মরণকে। স্মরণ গায়েও মাখে নি। নিজেকে ইস্পাতের কাঠামোয় এমন নিখুঁতভাবে তৈরি করেছে যে এখন এমন জলন্ত খনি সে খুব একটা গায়ে মাখে না। ছোটবেলার সেই অনুদিত তেজটা যেন হঠাৎ করেই স্মরণের মাঝে উদীয়মান।
স্মরণ কণ্ঠে তেজ মিশিয়ে রাহার কথার প্রত্যুত্তর করলো,“ তা না হয় নিয়ে নিস। তবে তোর এই কুকর্ম আমি বাবার কাছে ফাস করে দেবো আজ।”
হিমেলের দিকে তাকালো স্মরণ আর বললো,“ বাবাকে বলবো এমন এক নোংরা কিটের সাথে নাকি আমার বিবাহ ঠিক করেছেন তিনি। যে কিনা হবু স্ত্রীর সৎ বোনের সাথে সবকিছু করে ফেলেছে। সবাই জানুক নবনী এসব আবর্জনা পা দিয়ে পিষে মারে।”
“ মুখ সামলে কথা বল স্মরণ।”
রাহার কথা শুনে স্মরণ হাসলো,“ মুখ সামলেছি বহুবার। তবে শেষবারে আর নয়।”
“ বাবাকে এসব কিছুই দেখাবি না তুই।”
খুব জোড়ে জোড়ে হাসলো স্মরণ। ওদিকে কর্মচারী দুজন আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে এসব। যেন কোনো মুভি চলছে এখানে। স্মরণ হাসি থামিয়ে বললো,“এককথার মানুষ আমি।”
উঠে দাঁড়িয়ে বেল্টটা হিমেলের দিকে ছুড়ে মারলো। এরপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। এদিকে রাহা পাগলপ্রায় হয়ে গেলো। তার মা জানলে তাকে মেরেই ফেলবে। কারণ তার মা আগে থেকেই সাবধান করেছিলো যে এইবার আর নয়। স্মরণের বিয়ের ব্যাপারে কোনো কিছু না করতে। তবে রাহা হিমেলকে দেখে পছন্দ করে ফেলেছিলো। তাইতো এতদূর। চেঁচিয়ে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বললো। উঠে দাঁড়ালো কোনোভাবে। হাতে পায়ে পিঠে সর্বাঙ্গে ব্যথার প্রখরতা বুঝলো। খুড়ে খুড়ে হেঁটে গিয়ে টেবিলের কাছে গেলো। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিলো। আর মায়ের নাম্বারে কল করলো। কয়েক সেকেন্ড বাদে কল রিসিভ হতেই নানা মিথ্যে কথা শোনালো মা–কে স্মরণের নামে। আর তাকে মারার বিষয়টা রসিয়ে কষিয়ে বললো। কলের অপরপ্রান্তে থাকা মিসেস রাবিনা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। বোঝা গেলো আজ বাড়িতে কিছু একটা হবে।
___________________________
শীতের মিষ্টি দুপুর। বাতাসের বেগ সর্বোচ্চ মাত্রায় রয়েছে। যেন ক্ষণবাদেই বৃষ্টি পড়বে। তবে আকাশের উজ্জ্বলতা আর সূর্যের মিষ্টি হাসি যেন অন্য কথা বলছে। তাদের বচন যেন এমন ‘বৃষ্টি নয়, বরং এটা শীতের একছত্র আবহাওয়া মাত্র’। স্মরণ হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো। সকালে রাহাকে কথা বলতে শুনে ফেলেছিলো স্মরণ। তাইতো আজ একদম অ্যাকশন নিতে পারলো সে।
এসব বলেই মেজাজ ফুরফুরে হয়ে হাঁটছিলো সে। সেসময় সামনে থেকে কোনো এক শক্তপোক্ত ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খেলো স্মরণ। স্মরণ থেমে গেলো। স্মরণ তো দেখেই হাঁটছিলো কিন্তু সামনের জন্য চোখ ত্যাড়া করে হাঁটছিলো বলেই অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা। স্মরণ মেজাজ ঠিক রেখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শুধুমাত্র শক্ত গলায় বললো,“ নেক্সট হতে দেখে হাঁটবেন।”
মুখটা দেখা গেলো না। পিঠ দিয়ে কেমন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো ছেলেটা। স্মরণ তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো। রাস্তার মোড় ঘুরিয়ে বাম দিকে হাঁটা শুরু করলো। সেই ছেলেটি পেছনে তাকিয়ে দেখলো না মেয়েটাকে। তবে মেয়েটার কথা কানে বাজতে লাগলো। তার সামনে অন্য এক ছেলে বললো,“ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।”
ছেলেটা চলে গেলো।
স্মরণ পুরোটা রাস্তা হেঁটে বাসায় এসে পৌঁছালো। একটি তিনতলা বিল্ডিং এর দোতলায় ভাড়া থাকে স্মরণের পরিবার। স্মরণের মা সায়নিকা বেগম ষোলো বছর আগে কার এক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর এক বছরের মাথায় স্মরণের বাবা অনিল মহান রাবিনাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। রাবিনা ডিভোর্সি ছিলেন। স্মরণের সমবয়সী এক মেয়েও ছিলো।
তিনি বাড়িতে আসার পর স্মরণের জীবন নরক হয়ে গেলো। ছোট থেকেই মারধোর, লাঞ্চনা-বঞ্চনায় স্মরণের জীবন অতিষ্ট।
স্মরণ কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন মিসেস রাবিনা। অগ্নিচোখে স্মরণের আপাদমস্তক দেখে ঠাটিয়ে চড় মেরে বসলেন স্মরণের গালে। আকস্মাৎ আক্রমণে স্মরণ চমকালো, থমকালো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মিসেস রাবিনা উচ্চৈঃস্বরে রাগী গলায় বললেন,“ আজ তোকে মেরেই ফেলবো আমি।”
#চলবে