#চোরাবালি
#পর্বঃ১৪
#আহিয়া_আমান_অণু
৩০,
সময় কত দ্রুত চলে যায় তাইনা! কারোর জন্য অপেক্ষা করেনা সময়, তেমনি ভাবে আমান,আমার আর তাহিফের সময়টাও চলে যাচ্ছে খেয়ালে-বেখেয়ালে।মাঝখানে কেটে গেছে একটামাস।তারমাঝে আমার আর আমানের সম্পর্কেরও উন্নতি বা অবনতি কোনোটাই হয়নি। সব আগের মতোয় আছে। সাইফার সাথে কথা হয়েছিলো। ও সব সামলে নিচ্ছে; গ্রামের আসার কথা আছে ওর। মাঘ মাসের শেষ সাথে শীত পেরিয়ে বসন্তের শুরু। এই সময়টায় ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার গ্রামে মেলা হয় এখানে, শুক্রবার পর্যন্ত থাকে। আজ রবিবার, মাত্র তিনদিন আছে। আমান ভোটেও জিতেছিলো বিধায় সেসব নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। তাহিফ ঘুমাচ্ছে, সকালের খাবার রান্না হচ্ছে রান্নাঘরে। কিন্তু আমি ঘরের জানালার ধারে দাড়িয়ে আনমনে এসব ভাবছি। আম্মা আব্বাকে দেখতে মন চাচ্ছে খুব। কিন্তু যেতে দেয় কিনা সন্দেহ,কারণ এদের মনে ভয় আবার যদি পালিয়ে যাই। সত্যি বলতে আমিও তো পালিয়ে গিয়ে ভুলই করেছিলাম। ধৈর্য ধরে নিজের সম্মান বাচাতে আমার লড়াই করতেই হতো। যাক সেসব যা হয়েছে অতীতে হয়েছে, এখন বর্তমানটাকে মেনে নিয়ে মানিয়ে চললে জীবনে হয়তো সুখ শান্তির দেখা মিলবে। রেষারেষি রেখে শুধু নিজের জীবনের ক্ষতি ব্যতিত কিছু হবেনা। সবকিছু পজিটিভলি নিয়ে যদি চলতে পারি তাহলে সমস্যা গুলো মিটে যাবে। ভালোবাসা মানুষকে বেহায়া বানিয়ে ছাড়ে। যতই বলি ভালোবাসিনা কিন্তু ঐ মানুষটাকে ছাড়া তো আমার চলেনা। ভালো লাগে তার উপস্থিতি আজকাল। কায়া দেখলে মায়া বাড়ে, এই কথাটা ফলে যাচ্ছে জীবনে।
“আদ্রি!”
পিছন থেকে কারোর ডাক শুনে তাকালাম সেদিকে। সাইফা দাড়িয়ে আছে। ওকে দেখে একপ্রকার অবাক হলাম। ওকে বললাম,
“কখন আসলি? না জানিয়ে আসলি,আমি তো রীতি মতো অবাক।”
“আমান জিজু খবর দিয়েছিলো, কাল রাতে গাড়িতে উঠেছিলাম। আজ পৌছে প্রথমে বাড়িতে গিয়ে এখানে এসেছি, ইউ নো তাহিফকে প্রচুর মিস করেছি আমি, তাই চলে আসলাম। মেলার দাওয়াত খেয়েই যাবো।”
আমি হাসলাম, মেয়েটা তাহিফ বলতে পাগল। কারণ ওর বিয়ের সাড়ে পাচ বছর হতে চললো কিন্তু বাচ্চা হয়নি। ওর স্বামী বড্ড ভালো, নয়তো মানুষের এত কথা শুনেছে যে বাচ্চা হয়না ছেড়ে দাও। কিন্তু উনি ছাড়েননি।ভালোবাসার জোড় এতই কি ঠুনকো হয় নাকি!
“হাসি বাদ দে, তাহিফ কোথায় তা বল।”
সাইফা কথাটা বললে আমি ইশারা করলাম খাটের দিকে তাকাতে। শীত নেই বিধায় এখন পাতলা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। দিনে রোদ আর রাতে হালকা ঠান্ডা আবহাওয়াটা এমন। আর এই আবহাওয়া দারুণ লাগে আমার কাছে। সাইফা আমার ইশারায় খাটে গিয়ে বসে ঘুমন্ত তাহিফের কপালেই চুমু খেয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে শুরু করে। আমি বললাম,
“ঘুমের বাচ্চাকে চুমু খেয়ে পাজি বানাতে উৎসাহিত করিস না। তোর বর কই? তারে কেনো দেখিনা?”
“বর আমার শ্বাশুড়ি মা-কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। অসুস্থ তিনি জানিসই তো। এখন সুস্থ অবশ্য, তাই চেকআপ করে কেমন অবস্থা সেটা দেখতে গেছে।”
সাইফা ঘুমন্ত তাহিফকে জড়িয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে উত্তরটা দিলো। আমি তা দেখে বললাম,
“খাওয়াদাওয়া করা লাগবেনা তোর? শুয়ে পড়ছিস যে! যা ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবার খাবি আগে, উঠ।”
“রাখ তোর খাওয়া, আগে আমার বাচ্চাটারে তুই আদর করতে দে। যা তো তুই এখান থেকে।”
“যাক বাবা যার ছেলে তারই পাত্তা নাই।অদ্ভুত তোরা খালা-ভাগ্নে। আমি যাচ্ছি তোর খাবার রেডি করতে। উঠে আসিস ডাকলে।”
কথাটা বলেই বাইরে পা বাড়ালাম। ঐ সময় আমান ঘরে ঢুকতে পা দেয়। দুজনেই ধাক্কা খেলাম দুজনের সাথে। সাইফা তা দেখে হাসছে, হাসির শব্দে ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। ও কম্বলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে নিলো।
“সরি।”
আমান মৃদু স্বরে কথাটা বলে পাশ কেটে ঘরে ঢুকে। আমানকে বলে দিয়েছিলাম আপনি আপনার মতো থাকবেন, আমি আমার মতো; কোনো ব্যাপারে জোড় করবেন না। তাই আমান আর আমায় কোনো ব্যাপারে জোড় করেনা। আমি বাইরে আসবো এমন সময় আমাডন ডেকে উঠে। আমি তাকিয়ে বললাম,
“কিছু বলবেন?”
“মেলা সামনে, বাড়িতে মানুষজন আসবে। তাহিফের তো শীতের কাপড় ব্যতিত তেমন কাপড় দেখিনা। আজ মার্কেটে যাবো। রেডি হও, সাথে ছেলেকে তুলে রেডি করে দাও।”
আমি কথা বাড়ালাম না। আচ্ছা বলে চলে আসলাম সেখান থেকে।
৩২,
“জিজু বউ তো গেলো এবার শালীর দিকে নজর দেন একটু! আমার খোজ খবরও নেন।”
সাইফার কথায় হেসে উঠলো আমান। তারপর বললো,
“শালীকে ফোন করে আনলাম, আলিফের সাহায্যে নাম্বার নিয়ে। তা শালীকে ভুলার মতো কিছু হলো কি? শালী যদি আমায় আগেই বউয়ের খোজ দিতো তাহলে এত দূরত্ব সৃষ্টি হতো না। ”
আমানের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সাইফা। তারপর মিহি হেসে বললো,
“কি করবো জিজু বলুন তো? ঐ জেদি মেয়েটা না আমায় বলতে দেয়নি কাউকে।এই যে জানবাচ্চাটা আমার এটার কসম দিয়ে দিয়েছিলো। যা হবার হয়ে গেছে, নিয়তিতে ছিলো হয়ে যায় এমন ঘটনা৷ এবার সংসারে মনোযোগ দেন।”
” সংসার! তোমার বোনের কোনো হেলদোল নেই আমার প্রতি। এমন একটা অবস্থা থেকেও যা না থেকেও তা। শুধু ছেলের খুশির জন্য রয়ে গেছে সে।”
আমান সাইফার কথার উত্তরে কথাটা বলে। সাইফা উত্তরে আর প্রতিত্তোর করেনা। তাহিফ আড়মোড়া ভাঙছে দেখে সে তাহিফের দিকে খেয়াল দেয়। আমান কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কলপাড়ে যাওয়ার জন্য। গোসল দিবে আগে তারপর বাকিসব। গ্রামের মানুষের জন্য রেশনের চাল-ডাল, আলু এসব এসেছে। ওগুলো কাগজপত্র ঠিক করে আনতে গিয়ে অবস্থা খারাপ তার। কাল আবার সব বিলি করতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী একজন ছিলো বলে সে ভোটে জিতে ফিরেছে। উহাশী,তার মা, দাদী সবাই সবার মতো আছে। কারোর মাঝে আগের সেই টান আর নেই। ফখরুল মির্জারও খেয়াল ঠিকঠাক কেউ নেয়না। নার্স নিয়োগ করে রাখা,তিনিই সব করেন। শুধু খাবারটা উহাশী রেধে দেয়। আদ্রিজা সে তো ছেলের কাজ ব্যতিত কিছু করে না।নিজেও ঠিকমতো নিজের খেয়াল রাখেনা। কলপাড়ে যেতে যেতে এসব ভাবছে আমান। ভালো লাগেনা আর। বাড়িটা আবার কবে প্রাণ ফিরে পাবে এই চিন্তায় তার ঘুম হয়না।
৩৩,
খাবার টেবিলে পরিবারের সবাই বসে পড়েছে খেতে। আমি সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি। আমার শ্বাশুড়ি মা বেজায় খুশি। কারণ এই প্রথম এই সংসারে ফেরার পর কাজ করছি নিজ আগ্রহে। তাহিফও ওর সাইফা আন্টিকে পেয়ে হাসিমুখে গল্প করছে,খাচ্ছে।সাইফা তুলে খাওয়াচ্ছে তাকে। আর সে সাইফার কানের পোকা নড়িয়ে দিচ্ছে তার বাবা তাকে এটা এনে দিয়েছে, ওটা এনে দিয়েছে। হাসিখুশি ছেলেটাকে দেখে আমার জীবনের সব কষ্ট ধুয়েমুছে দিচ্ছে।আধাঘন্টা পর খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে রেডি হয়ে নিলাম মার্কেটে যাওয়ার জন্য। সাইফাও যাবে আমাদের সাথে। তাহিফ লাফাচ্ছে আনন্দে। ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে সে অনেক খুশি। আমানকে দেখলাম ব্ল্যাক জিন্স,সাদা শার্ট তারউপর কালো ব্লেজার।ছেলেকেও তেমন করে কাপড় পড়িয়ে কোলে নিয়েছে, ভালোয় মানিয়েছে বাবা-ছেলেকে। ফর্ষা মানুষটাকে কালো রঙ এ মানাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি বোরখা পড়ে নিলাম, আজকাল থ্রিপিস পড়া শুরু করেছি। শাড়ি সামলাতে ইচ্ছে করেনা। সবাই রেডি হওয়ার পর বেরিয়ে পরলাম মার্কেটের উদ্দেশ্যে। উহাশীকেও সাথে নিয়ে নিলাম পরে,বের হবো এমন সময় সামনে এসে পরে সে। লজ্জা বা অসস্তিতে যেটাতেই হোক সে সামনে আসেন তেমন একটা।শুধু তাহিফের সাথে খেলাধুলা করে মাঝে মাঝে। ফফু দৌড়ায়, ভাস্তে তাকে ধরতে পেছনে ছুটে। ভালোয় লাগে দেখতে মুহুর্তটা।
বাজারে এসে অটো রিকশায় উঠলাম,দুই রিকশায় দুজন করে চারজন উঠে পড়লাম। রিকশা ছাড়তেই সাইফা বললো শাপলা চত্বরে যাবে আজ,সেখান থেকেই মার্কেটে। তারপর সময় হলে রংপুর চিড়িয়াখানায় যাবে। কথা অনুযায়ী সেটাই হলো। মার্কেটে পৌছে প্রায় চারঘন্টা সময় লাগিয়ে সবার জন্য মার্কেট করা হলো। সময়টা তখন বিকেল গড়াবে। চিড়িয়াখানায় ঘুরতে সময় লাগবে বলে আমি বললাম,
“টায়ার্ড লাগছে, ঘুরাঘুরি আজ থাক, বাসাই যাই।”
“মাম্মা প্লিজ আজ ঘুরতে যাই চলো!”
তাহিফ আমার কথায় উত্তর দেয়। আমি আমানের মুখের দিকে তাকালাম। সেও বুঝালো ছেলের কথাই রাখতে। আমি মুচকি হেসে তাহিফকে বললাম,
“আচ্ছা বাবা চলো তবে।”
আমান বাসে করে যেতে হবে বলে আমাদের রোডের ধারে দাড় করিয়ে বাস খুজতে গেছে।এরমাঝেই তাহিফ আমাকে চিপসের দোকান দেখালো।রোডের ওপাশে দোকান, যেখানে দাড়িয়ে আছি আশেপাশে তেমন দোকান নেই। আমি সাইফার কোলে তাহিফকে দিলাম। তারপর দুপাশে দেখে নিয়ে রোড ক্রস করে ওপাশে যেতে ধরলাম। একটু যেতেই আমানের চিৎকার শুনলাম।আমার নাম ধরে ডাকছে, আমি সেদিকে তাকালাম।আমান ইশারা করছে সরে যেতে, সাথে দৌড়ে আমার দিকে আসছে। ওর ইশারা দেখে সামনে তাকালাম।একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমি সরবো কিন্তু পায়ে মনে হচ্ছে কেউ পাথর বেধে দিয়েছে। শরীর কাপছে আমার।
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।