#চোরাবালি
#পর্বঃ১২
#আহিয়া_আমান_অণু
২৬,
“আমি না হয় ধৈর্য ধরিনি,আপনাকে সময় দেইনি সবকিছু প্রকাশ করার তাইনা আমান সাহেব? সো আপনি কেনো আমার চরিত্রে যে ত্রুটি নেই এটা প্রকাশ করেননি বলুন তো? হ্যা মানলাম আমি ছিলাম না; কিন্তু আপনার হাতে তো শক্ত প্রমান ছিলো উহাশী আর দুলাভাই। ওদের সাহায্য নিয়ে সবাইকে জানাতে পারতেন যে, আমি দোষী নই। কিন্তু আপনি তা করেননি। আপনি বিগত চারবছর ধরে আমার চরিত্রের ত্রুটি নিয়ে মানুষে কথা শুনেছেন; সাথে তো আপনার বাবার অপকর্মও লুকিয়ে গেছেন। উনার অন্যায় সহ্য করেছেন। এটা কি কোনো শক্ত কারণ হতে পারে না আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার?আর আমি পালাইনি, আমার জীবনে এমন একটা বাজে পরিস্থিতি এসেছিলো যে ইচ্ছে করছিলো সবকিছু থেকে মুক্তি নেওয়ার। ইচ্ছেটা সবাইকে জানাইনি কারণ পূরণ হতো না। যদি বলেন ফিরে কেনো আসলাম না সাথে সাথে! কারণটাও বলবো খুব সাধারণ। এই যে দেখছেন সমাজ, এই সমাজের মানুষগুলো আমায় নিত্য নতুন প্যারা দিতো। যদিও বা আমান সত্যিটা প্রকাশ করতো তারপরও তারা পথেঘাটে আঙুল উচিয়ে দেখাতো, মির্জা বাড়ির বউ তার ননদের স্বামীর সাথেই বাজে ভাবে ধরা পরেছিলো।তাও সেটা শ্বশুড়ের বুদ্ধিতে। যা আমার শুনার একদম ইচ্ছে ছিলোনা। সম্মান যা খোয়ানোর খুইয়েছি আর নয়।আর উষু আপা আপনি তো সত্যিটা জানতেন যে আমি বা দুলাভাই দুজনই নির্দোষ! জানতেন না বলুন? যদি না জানতেন তাহলে তো ঐ সংসারে পড়ে থাকতেন না! গ্রামের মানুষ আমি ফিরার পর নিশ্চয় বলতো না এক চরিত্রহীনের সংসার করছে নির্দোষ ননদ, আরেক চরিত্রহীনা আসলো সংসারে আগুন লাগাতে! তাই দয়া করে অবুঝের মতো করবেন না।এতদিনে আসছেন সব ঠিক করতে, আগে কোথায় ছিলেন? খুব তো নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ততা ছিলেন। আমি আপনাদের খবর সাইফার মাধ্যমে নিয়েছি। তাই অন্তত আমায় মিথ্যা বুঝ দিবেন না।”
আমি কিয়ৎক্ষণ দম নিয়ে আমানের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলাম সাথে উষশী আপার কথারও উত্তর দিলাম। আমান আর উষশী আপা হতাশ হলেন, আমাকে বুঝাতে না পেরে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। আপাতত কথা বলার মানসিকতা নেই আমার। যেখান হতে অপমানিত হয়ে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়া, ব্যাপারটা বিশ্রি। আমান আর উষশী আপা দুজনই থম মেরে বসে আছেন। হয়তো কথা সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছেন যে কি বলবেন আমার কথার উত্তরে।
২৭
“তুমি চলে যাওয়ার পর হয়তো পারতাম সব প্রকাশ করতে সবার সামনে কিন্তু করিনি। কারণটা কি জানো আদ্রি? ঐ যে বললে সম্মান, হ্যা সম্মানের টানেই প্রকাশ করিনি। তবে হ্যা তুমি এটা জানোনা আদ্রিজা যে; আমি কিন্তু বাবার গ্রামবাসীকে শোষনের পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিলাম। শুধু সেটা গোপন ছিলো,একটু যদি খোজ নিয়ে দেখতে গত চারবছর ধরে বাবা প্রতিটা অনুদান সঠিকভাবে মানুষকে দিয়েছে। গ্রামের মানুষের প্রতি আমার এমন ব্যবহার দেখে বাবা নিজে না দাড়িয়ে ভোটে আমায় দাড় করিয়ে দিয়েছে। প্রথমে চুপ ছিলাম শুধু মাত্র মায়ের জন্য। কারণ ঐ বাবা নামক মানুষটার সাথে আমার মায়ের জীবন জড়িত। পরে যখন দেখলাম আমার ওয়াইফও এটাতে জড়িয়ে গেছে তখন বাবার পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছি। বিগত দশবছর যাবত বাবা গ্রামের মেম্বার ছিলো। আমি তার ভিতর ছয়বছর শোষণ করেছে যেটা আমি তার শোষন করার চারবছর পর জেনেছি। মানে আমাদের বিয়ের মাত্র কয়েকমাস আগে। আমরা তো সেম এজ রিলেশনশিপ এ ছিলাম। আমাদের সম্পর্কের কথা তো গ্রামে রটেও গিয়েছিলো বাবারও অজানা ছিলোনা। বাবা মানতে চায়নি সমবয়সী কেউ ছেলের বউ হোক। তাই বলতে পারো একপ্রকার আমার মায়ের ক্ষতি আর আমাদের বিয়ে না দেওয়ার ভয় দেখিয়েই চুপ রেখেছিলো আমায়। এসব তোমাকে আগে বলা হয়নি,কারণ বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো স্মুথলি চলছিলো সব। এসবের মাঝে আমি ঝামেলা চাইনি। মানুষ মাত্রই স্বার্থপর, আমিও স্বার্থপর ছিলাম আমার জীবন নিয়ে। কিন্তু ঝামেলা তো হলোয়, আর এতদিন চেষ্টা করিনি কারণটা তুমি নিজে। আমি শক্ত প্রমাণ হিসেবে উহাশী আর দুলাভাইকে দিয়ে সব প্রমাণ করতাম, আঙুল উঠতো সম্মানের দিকে। যেটার কথা তুমি বলছো। মানুষ তো বলতো বাড়ির সম্মান বাচাতে এই কাজটা করছি। কারণ বাড়ির বউ, সে নির্দোষ তো পালালো কেনো? আর যাদের দোষী বানাচ্ছি তারা তো ঠিকই এখানেই আছে। হয়তো কারণ গুলো তোমার কাছে অযুক্তিযুক্ত। কিন্তু মানুষ তো এটাই ভাবতো। নির্দোষ প্রমান করতে তোমাকে লাগতো। তুমি আসছো, এখন সব প্রমান করার কথা ভাবছি আর তুমি কি শুরু করলা। স্পিচলেস আমি, তুমি তো এত অবুঝ ছিলে না আদ্রি! যদি তুমি না থাকাকালীন আমি তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে উঠেপরে লাগতাম, তাহলে সবাই বলতো কি! বলতো যে ছেলেটা এতটা বউপাগল, বউকে নির্দোষ প্রমান করতে নিজের বোন আর দুলাভাইকে খারাপ বানাচ্ছে সমাজের চোখে। আর যদি বোন জামাই খারাপই হয় তাদের মেয়ে সংসার কেনো করছে?প্রশ্ন উঠতোনা কি?কথায় কথা বাড়ে আদ্রি। আমার আর তর্ক করতে মন চাচ্ছে না। আমার আব্বা, তিনি তার অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে শুরু করেছেন। আমিও আমার সন্তানের থেকে দূরে থেকে আমার ভুলেরও শাস্তি পাচ্ছি। তোমার আত্মসম্মান না হয় তুমি মেনে চলো। শুধু আমাদের ছেলেটার কথা ভাবিও একটু।”
আমান একদমে কথাগুলো বলে উঠে চলে গেলো। আমি তাকিয়ে থাকা ব্যতিত কিছুই করতে পারলাম না। উষশী আপা হঠাৎই আমার হাত ধরলেন। আমি উনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। উনি কিছু বলতে উদ্দ্যোত হলেন আমি বললাম,
“আপা ভালো লাগছেনা আমার, একা থাকতে চাই।”
“যেটাই করো আদ্রিজা, ছেলেটার কথা ভাবিও। আর আমায় বললে সুখের সংসার করি। সম্পর্কটা থাকলেও সেই ভালোবাসাটা নেই যেটা আগে ছিলো। দায়বদ্ধতা থেকে সম্পর্কটা টিকে আছে। ভালোবাসার মানুষ যখন ঘৃণার উপযুক্ত কাজ করে অথচ তার সাথেই থাকতে হয় এর মতো দহন আর হয়না আদ্রি। আমাদের জীবনটা আমার বাবার লোভে নিঃশেষ হওয়ার পথে। সবাই সবার ভুলের শাস্তি পাচ্ছে। চারবছর কম নয়, এবার মনে করি এটার সমাপ্তি হওয়া উচিত। তোমাকে জোড় করবোনা। শুধু বলবো শান্ত মনে জায়নামাজে বসে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে নাও। আসি, আল্লাহ হাফেজ। ”
উষশী আপা উঠে চলে গেলেন। আমি উদাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। উষশী আপা যাচ্ছে আর আলিফ তাহিফকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকছে। তাহিফ নতুন মানুষ দেখে কেমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ঠোট নাড়িয়ে আলিফকে কিছু বলতে দেখলাম। কিন্তু কি বললো এটা বুঝলাম না দূরে থাকার দরুন।
২৮
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে জীবন। উষশী বাড়িতে গিয়ে একবার বাচ্চা দুটোকে দেখে এসেছে। তারপর তার মা-কে দেখে চলে আসে হাসপাতালে। আমানকে সে মেসেজ করে আদ্রিজাদের বাড়িতে যেতে বলেছিলো বলে আমান সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু কাজের কাজটা কিছুই হলোনা। আদ্রিজাকে বুঝানো সম্ভব হলোনা। বাবার বেডের পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছে উষশী। জীবনটা এভাবে এলেমেলো হলো যে গুছানোর মতো আর সুযোগ আসছেনা আর। ফখরুল মির্জার ব্রেইনের অনেক নিউরন অকেজো হওয়ার দরুন উনি কাউকে সবসময় মনে রাখতে পারবেন না। কখনো চিনতে পারবেন তো কখনও পারবেন না। শরীরের বাম সাইড অবশ হয়ে গেছে উনার, এজন্য তিনি চলাফেরাও করতে পারবেন না হুইল চেয়ার ব্যতিত। উষশী দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসব ভেবে। উহাশী গেছে ফার্মেসিতে ডক্টরের ধরিয়ে দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী ওষুধ আনতে। তার বাবা নিশ্চুপ হয়ে একাধারে উপর পানে তাকিয়ে আছেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। উষশীর মন চাচ্ছে যেদিকে ইচ্ছে হয় চলে যেতে। এত প্রেশার আর চিন্তা নেওয়া যায়না জীবনে। কি থেকে কি হয়ে গেলো, ঝড়ের মতো।
“আপা ওষুধ সব এনেছি। আর শুন রিসিপশনে ডাক্তারের সাথে দেখা হয়েছিলো। কথা বলেছি কাল সকালে রিলিজ হবে। এতদিন হাসপাতালে থাকতে পারবনা। সাথে একটা নার্স চব্বিশ ঘন্টা বাবার খেয়াল রাখতে নিয়ে যাবো সাথে। সেসব কথাও বলে এসেছি। তুই কিছু খাবি চল। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে খাসনি কিছু্।”
বোনের গলার স্বর পেয়ে সেদিকে তাকায় উষশী। উহাশীর কথায় তার হেলদোল নেই। উহাশী বাবার পাশেই একটু জায়গা নিয়ে বসে পড়লো। সে সময় সেখানে উপস্থিত হয় শাহীন। হাপাচ্ছে সে। উষশী ভ্রু কুচকে জিগাসা করে,
“এমন হাপাচ্ছো কেনো?”
“আমান, আমান কি করেছে দেখবে চলো।”
শাহীনের কথায় ভীতু হয়ে পড়ে উষশী, উহাশী দুজনই। খারাপ কিছু করলোনা তো আমান। উষশী তাড়াহুরো করে দাড়িয়ে জিগাসা করে শাহীনকে,
“কি করেছে আমান?”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়,