চোরাবালি পর্ব-১১

0
1318

#চোরাবালি
#পর্বঃ১১
#আহিয়া_আমান_অণু

২৩,
“তুমি আমানকে ছাড়বে নাকি সংসার করবে কোনটা?”

আব্বার প্রশ্নে চমকে তাকালাম। শেষমেশ আব্বাও এই প্রশ্ন করলো! এই দোটানায় ভাসছি আমি, তারমাঝে আব্বাও এই সিদ্ধান্ত আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। আমি কিছু বলবো; সেই ভাষাটুকু জানা নেই আমার।

“কি হলো? বলো কিছু!”

আব্বা ফের প্রশ্ন করলেন। আমি সময় নিলাম মিনিট দুয়েক। তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললাম,

“আমি বুঝতে পারছিনা আব্বা কি করবো? একদিকে মন বলে ছেলের সাথে অন্যায় করছি অন্যদিকে মনে হয় আমান যে আমায় কষ্ট দিয়েছে তার বেলায়?”

“তোমার আম্মা সব বলেছে আমায়। দোষ দুজনেরই ছিলো, তোমার ধৈর্য নেই আর আমানের ভুল সময়ে ভুল পদক্ষেপ। যা হোক জীবন তোমার, সিদ্ধান্তও তোমার। এরআগে কখনও মতামত চাপিয়ে দেইনি এবারও দিবো না। এরআগে এসে বলছিলে আব্বা এই মানুষকে পছন্দ, ব্যাস পড়ালেখা শিখে নিজে আত্মনির্ভরশীল না হয়ে সংসারে মনোযোগ দিলে। বলছিনা খারাপ ছিলো সেটা। কিন্তু আরও যাচাই-বাছাইয়ের দরকার ছিলো। ”

আব্বা আমার কথার উত্তর দিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। আমি আর আম্মা সেখানেই দাড়িয়ে আছি। আব্বার যে আমার উপর আগের মতো মায়া-মমতা নেই বুঝতে পারি। পরিবারটাকে ফেলে চলে গিয়ে সত্যিই ভুল করেছিলাম। আম্মা এগিয়ে এসে কাধে হাত রাখায় সেদিকে তাকালাম। আম্মাও কেমন যেন হয়ে গেছেন, আগের মতো শাসন করেন না, বকেনও না। আমার এই আব্বা-আম্মাকে বড্ড অচেনা লাগে। চোখে পানি এসে গেছে, কখন জানি গড়িয়ে পড়ে।আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম।কাদতে মন চাইলো খুব,কেদেও দিলাম। মায়ের বুকটা সন্তানের কান্নার জন্য হয়তো উপযুক্ত জায়গা। অন্যদের সামনে কাদলে তারা দুর্বলতা ধরে নেয়। কিন্তু মা-ই একমাত্র মানুষ হয় যার সামনে কাদলে হয় সে শক্ত করে গড়ে তুলবে নয়তো আগলে রাখবে। আম্মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার।

“মনখারাপ করো না আদ্রিজা; তুমি হয়তো জানো না! তুমি চলে যাওয়ার পর তোমার বাবা তোমার ঘরে গিয়ে এমন একটা দিন নেই কাদেননি। উনার কান্না দেখে আমারই কান্ন পেতো। কিন্তু সংসারটা তো বাচাতে হতো, তাই নিজেকে একটু শক্ত করে নিয়েছিলাম। আর আলিফ তোমার ভাইটা সে তো বোনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো। নিজেকে ধীরস্থির করো, সব সমস্যার সমাধান হবে।”

আম্মা কথাটা বললেন, তারপর আমায় ছেড়ে থালাবাসন গুছিয়ে নিলেন। আমি বললাম,

“আপনি খেলেন না আম্মা?”

“মেয়ে না খেয়ে, আর মা খাবে?ব্যাপারটা হাস্যজনক নয়!”

“হাস্যজনক হবে কেনো আম্মা?”

“আমার কাছে তাই লাগলো; এজন্য বললাম। আমার মেয়ে তুমি, তোমায় শক্ত হবে। এমন দুর্বলতা প্রকাশ করে কি বুঝাচ্ছো আমাকে? তুমি অবুঝ নও আদ্রি, আগের মতো ধৈর্যহীন হয়ে অন্তত আমায় নিরাশ করো না। তোমাকে সবসময় বলেছি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে ধৈর্য ধারণ করে নিজেকে ধীরস্থির করে নাও। তারপর দেখবে সমস্যার সমাধান নিজে এসে ধরা দেবে।”

“আমার মাথায় কিছু ঢুকছেনা আম্মা। আপাতত আমি এসব থেকে বেরুতে চাই। ঢাকায় চলে যাবো আমি।”

“সময় নিয়ে ভাবো। খাবার না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানে হয়না। আসো খেয়ে নাও।”

কথাগুলো বলে আম্মা আমার হাত টেনে বসালেন পিড়িতে। খানাডুলি থেকে ভাত তরকারি বেড়ে রাখা একটা প্লেট বের করলেন। হয়তো আমার জন্য রেখেছিলেন। প্লেটের পাতে আমার প্রিয় চিংড়ি মাছ দেখা যাচ্ছে। আম্মা হাত ধুয়ে তুলে খাওয়াতে লাগলেন। আমিও আর না করলাম না। মায়ের আদর মাখানো হাতে খাওয়ার লোভ আমার আজীবনই। কিন্তু পূরণ হয়নি কতগুলো দিন। চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে খেতে লাগলাম।

২৪,
“আপা ডাক্তার বলেছে দুদিন পর আব্বাকে রিলিজ করবে।”

উহাশীর কথায় উষশী টুল থেকে উঠে দাড়ায়।হাসপাতালের কেবিনে বাবার কাছে বসে ছিলো সে আমান বাড়িতে একা, মায়ের খেয়াল রাখছে। হাসপাতালে পৌছে দিয়ে চলে গেছে। কাল রাতে ফখরুল মির্জা ব্রেইন স্টোক করে বসেন। অতিরিক্ত চিন্তা আর চাপ উনার ব্রেইন নিতে পারেননি।রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় ব্রেইনের সাথে শরীরের নানান অঙ্গের। হাসপাতালে নিয়ে আসা তৎক্ষনাৎ, উপজেলা সদর হাসপাতালে আনার পর ডাক্তার জানান ইসকেমিক স্ট্রোক করেছেন ফখরুল মির্জা। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আনার জন্য বেচে গেলেও উনি হয়তো ঠিকমতো চলাফেরা বা কথা বলতে পারবেনা অথবা কাউকে ঠিকঠাক চিনতে পারবেন না।উনি নিজের খেয়াল রাখতেন না,খাওয়াদাওয়ায় উদাসীনতা তো আছেই সাথে যে ফলমূল বাড়তি খাবার খাওয়া সেটা তিনি খান না। বয়স তো কম হয়নি; সেই হিসেবে উনি নিজের খেয়াল একদমই রাখেন না। উষশী হাফ ছেড়ে বাচলো যে এই যাত্রায় তার বাবা বেচে গেছে। ঘৃণা যতই করুক দিনশেষে উনিই জন্মাদাতা তো, মায়ার টান থেকেই যায়। বাবা শব্দটাতেই মায়া জড়ানো, সেখানে তাকে ছাড়া একটা দিন কল্পনা করাও যেন কঠিন। ফখরুল মির্জাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে, উনি ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠলেই উনার ক্ষতির লক্ষণ বুঝা যাবে। উষশীকে উঠে দাড়াতে দেখে উহাশী বলে,

“কোথায় যাবি আপা?উঠে দাড়ালি যে?”

“সকাল পেরিয়ে যাচ্ছে, খাবার খেতে হবেনা তোর? আব্বা উঠলে উনারও তো খাওয়া দরকার। তুই খেয়াল রাখতে পারবিনা? আমি একটু বাড়িতে যেতাম আর আসতাম।”

উহাশী উত্তর দিলো না। বাবা নামক মানুষটার প্রতি কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট নেই তার। চুপ করে টুলে বসে পড়লো। উষশীও কিছু না উহাশী আর বাবাকে একপলক দেখে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাতে একবার শাহীন এসে হাসপাতালের বিল মিটিয়ে গেছে। শাহীনের সাথে কথা বলতে হবে। তার সাথে আরও একজন আছে। সমস্যার যেখানে শুরু সেখানেই ইতি টানতে হবে। বড় বোন সে ভাইয়ের জীবনটা অগোছালো তার জন্য। তাই গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও তার। উষশী থমথমে মুখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রিকশা ধরলো। প্রথমে নিজের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবলো। পরে হাতের পার্স থেকে ফোন বের করে শাহীনকে ফোন করলো। শাহীন ফোন রিসিভ করার পর উষশী তাকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে বলে,

“আম্মাকে পাতলা কিছু খাবার আর উহাশীর জন্য ভাত আর তরকারী সাজিয়ে দিতে বলো। তারপর সেগুলো নিয়ে হাসপাতালে চলে যাও।”

শাহীন স্ত্রীর কথায় কিছু বুঝতে না পেরে বলে,

“কেনো তুমি হাসপাতালে নেই নাকি?আর তোমার খেতে হবে না নাকি?”

” হুম আমি হাসপাতালে নেই। তুমি চলে যাও সেখানে চমার কাজ আছে কিছু দরকারী।”

“কি কাজ?”

“ঝামেলা বাধিয়েছো সেটার কি সমাধান খোজা উচিত না এবার?”

“মানে?”

“মানেটা পরে বুঝবে।রাখছি।”

উষশী কলটা কেটে দেয়। ওদিকে শাহীন উষশীর কথা অনুযায়ী তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে সব তৈরি করে দিতে। শাহীনের মা বড় নাতনী অর্থাৎ শাহীনের মেয়ে বিন্দিকে নিয়ে খাবার বানাতে থাকে। এদিকে উষশী রিকশা ওয়ালাকে সোজা আদ্রিজাদের গ্রামে যেতে বলে।

২৫
তাহিফকে নিয়ে বৃষ্টি আর আমি বসে ছিলাম নাজমুল চাচার আমবাগানে। এই সময়টায় আমের মুকুল এসেছে আমের গাছে। চারদিকে আমের মুকুলের গন্ধ মো মো করছে। বৃষ্টি আর আমি দুজনই নিশ্চুপ। তাহিফ ছোটো একটা বল নিয়ে খেলছে বৃষ্টির ভাইয়ের ছেলের সাথে। দুজনই প্রায় সমবয়সী। নিরবতা ভেঙে আমিই বললাম,

” এত কি চিন্তা করছিস?”

“কিছু চিন্তা করছিনা। ভাবছি তোর নিয়তিতে এমন কেনো হলো? ”

“নিয়তির লিখন, যায়না করা খন্ডন। তুই চিন্তা করে কি এটার কিনারা খুজে পাবি? ”

“সবকিছুর পিছনেই তো উদ্দেশ্য থাকে, তোর সাথে এমন হওয়ারও তো উদ্দেশ্য আছে। সেটা খুজার চেষ্টা করলাম। ”

“যাই হোক বাদ দে, এটা বল বিয়ের তো হলো বছর দুয়েক, বাচ্চা নিবিনা।”

“দুমাস চলছে প্রেগ্ন্যাসির। ”

বৃষ্টির কথা শুনে খুশি লাগলো অনেক। মা হওয়ার অনুভূতিই আলাদা। বৃষ্টিকে দেখলাম সলজ্জ্য হাসতে।

“আপা কেউ একজন ডাকছে তোকে। বাড়িতে আয়।”

আলিফের গলার স্বর পেয়ে পিছন ফিরে তাকাই। আলিফ পিছন থেকে কথাটা বলে। আমি আর বৃষ্টি একে-অপরের দিকে তাকালাম। কে আসবে এখন! আলিফকে বললাম,

“কে এসেছে?”

“উষশী আপা।”

উষশীর আপার নাম শুনে থমকে গেলাম। মানুষটাকে দেখিনা কতদিন হলো, সাথে তো মা-ও আছে। উহাশী আর আমানকে দেখলেও এই মানুষ দুটোকে দেখিনা অনেক দিন হলো। মানুষ বলে শ্বাশুড়ি-ননদ খারাপ হয়। আমার ধারণা পাল্টে উনারা আমায় আপন করেছিলেন। জানতে ইচ্ছে করে এসবের পিছনে কি উষশী আপাও ছিলো কি ছিলো না!

“এই আপা! চল, কতক্ষণ বসিয়ে রাখবি উনাকে।”

আলিফ আবারও ডেকে উঠে৷ আমি বৃষ্টিকে বললাম,

“তাহিফের দিকে নজর রাখিস। বড়দের কথার মাঝে ওকে না নেওয়ায় ভালো। আমি আসছি।”

বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। আমি আলিফের সাথে হাটা ধরলাম। তারপর কি মনে করে জানি আলিফকে বললাম,

“ভাই তুইও থাক এখানে। তাহিফ কান্না করলে বাড়িতে নিয়ে যাবি।”

আলিফ আমার কথায় পিছন ফিরে চলে গেলো। আমি একাই হনহনিয়ে হেটে বাড়ি আসলাম। উঠোনের গেট খুলে বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলাম উষশী আপা বসে আছে বারান্দায় চেয়ারে। আম্মা তার পাশে বসে কথা বলছে। কি কথা বলছে জানিনা, এতক্ষণ জোড়ে হাটলেও এখন কেনো জানি হাটার শক্তি পাচ্ছি না। তবুও জোড় করে নিজের শরীরটাকে টেনে দাড় করালাম উনার সামনে। সালাম দিলাম,উনি মুচকি হেসে সালামের জবাব দিলেন। আমি বললাম,

“কেমন আছেন আপা?”

“মনে আছে আপার কথা?”

“কেনো থাকবেনা বলুন তো?”

“ভুলে তো থাকছো কতবছর পেরিয়ে গেলো।”

“তোমরা কথা বলো আমি আসছি।”

আমার আর উষশী আপার কথার মাঝে কথাটা বলে চলে যান আম্মা। উষশী আপার দিকপ তাকালাম। উনি ইশারা করলেন আমায় বসার জন্য। আমি উষশীর আপার ইশারায় বসলাম আম্মার রেখে যাওয়া চেয়ারে।

“দোষ আমি করেছি,আমার বর করেছে, মূল কথা আমার আব্বা করেছে। তার শাস্তি আমানকে কেনো দিচ্ছো।”

মনে মনে ধারণা করেছিলাম এমন কিছুই শুনবো। তাই নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তরগুলো গুছিয়ে নিতে মিনিট পাচেক নিরবতা পালন করলাম।উষশী আপা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাই উত্তর দিলাম,

‘প্রথমত দোষী কে এটা আমার ভাববার বিষয় নয়। আমি দোষী কে এটা খুজে কি করবো? আমার দরকার এটাতে যে আমার স্বামী আমায় বিশ্বাস করে পাশে থাকলো কিনা! কিন্তু আমান তো।বাকিদের মতোয় আমাকে অবিশ্বাস করে বিচার সভার আয়োজনে সম্মতি দিয়েছিলো। আমার কোনো কিছু মানতে বাধেনি,শুধু এটাই মানতে গিয়ে মনের মধ্যে ভালোবাসার খাদ তৈরি হয়েছে। যে খাদে আমি পড়ে বর্তমানে হারিয়ে গিয়েছি ওর জীবন থেকে।”

“কিন্তু কেনো বিচার সভা করতে চেয়েছিলো এটা কি জানো না তুমি?”

আমি থামতেই উষশী আপা কথাটা বলেন।আমি হাসলাম, তারপর উত্তর দিলাম,

“তাহলে এই যে চারটা বছর পেরিয়ে গেলো, সে তো পারতো সব সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে আমার পাশে থাকতে। সাইফা আমার বান্ধবী; ওর তে গ্রামপ আসতো। আমি কি জানতাম না ওর থেকে সব?”

“যাকে ঘিরে এত কিছু সে-ই যদি না থাকে, তবে কাকে নির্দোষ প্রমাণ করবো?যত হোক প্রমাণের শক্ত খুটি হিসেবে আসল মানুষটাকে তো প্রয়োজন সত্যি মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য। আমি বুক ফুলিয়ে বলবো আমার বউ নির্দোষ, তখন মানুষ বলতে ভুলতোনা যে, এত উচু গলায় বলছো; তোমার বউ নির্দোষ তো পালিয়ে কেনো গেলো?তখন কি উত্তর দিতাম আমি? এটা যদি বলো তুমি? চলে গেলে একা করে দিয়ে, ঠকালে আমায় আমার সন্তানের কথা আমার থেকে লুকিয়ে।বেইমানি করলে আমার সাথে সন্তানকে আমার পরিচয় না দিয়ে।আচ্ছা ফিরবেই যখন পালিয়েছে কেনো?”

আমার কথা শেষ হতেই আমান কোথা থেকে জানি এসে একদমে হড়হড়িয়ে কথাটা বললো। আমি এত প্রশ্নের কি উত্তর দিবো খুজে পাচ্ছিনা। ওদের দুই ভাইবোনের মুখের দিকে তাকালাম। ওরা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনীতে তাকিয়ে আছে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে