#চোরাবালি
#পর্বঃ১০
#আহিয়া_আমান_অণু
২১
রাস্তায় এলেমেলো পায়ে হাটছে আমান। বাড়িতে পৌছাতে আর দশ কি বারো মিনিট লাগবে। রাতের প্রায় নয়টা বাজে এখন। সে শতচেষ্টা করেও আদ্রিজা আর তাহিফকে নিয়ে ফিরতে পারেনি। চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আদ্রিজা বা ওর বাবা কেউই রাজী হয়নি। আমান আজ একা ছিলো বলে চুপচাপ চলে এসেছে। ভালো মতো যদি আসতে না দেয় তাহলে আইনের সাহায্য নেবে সে। আদ্রিজা আইনত আর সামাজিক দুইভাবেই তার বউ। আমান তো কোনো চেষ্টা করেনি তালাক দেওয়ার; আর আদ্রিজাও তাকে অহেতুক তালাক দিতে পারবেনা। আইনত স্বামীকে তালাক দেওয়ার যে ধারা গুলো আছে, সেগুলোর একটা দোষও আমান করেনি।তাহলে আদ্রিজা বললো তার তালাক হয়ে গেলো! এতই কি সহজ সব। আমান রাস্তায় হাটতে হাটতে এসব ভাবছিলো। পকেটে থাকা মুঠোফোনটা বেজে উঠলে সে পকেট থেকে ফোন বের করে। উহাশীর নাম্বারটা ভাসছে ফোনের স্কিনে। আমান রিসিভ করলো। রিসিভ করে বললো,
” কি হয়েছে ফোন করছিস কেনো?”
“ভাইয়া কোথায় তুই? বাসায় আয়, মায়ের অবস্থা খারাপ খুব। সেন্স হারিয়েছিলো, এখন আবার হাইপার হয়ে যাচ্ছে। মা সব জেনে গেছে ভাইয়া।”
এটা হওয়ারই ছিলো, আমান অবাক হলোনা। ফোনটা কেটে দ্রুত হেটে বাড়ির দিকে গেলো।
আমেনা বেগম সেন্স ফিরে আসার পর থেকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য জেদ করছেন। উদ্দেশ্য বাবার বাড়ি চলে যাওয়া। বাবা-মা বেচে না থাকলেও ভাইয়েরা যে আছে, তাদের কাছে চলে যাবেন। ফখরুল মির্জার মতো ঘৃণ্য লোকের সাথে তিনি থাকবেন না৷ বড় মেয়ে উষশী আর ছোটো মেয়ে উহাশী মিলেও তাকে শান্ত রাখতে পারছেনা। রুহিনা বেগমও চেষ্টা করেছেন, কিন্তু উনি বয়স্ক মানুষ; উনার পক্ষে সম্ভব হয়নি বেশি কথা বলা। তবে মনে তার একটা শান্তি বিরাজ করছে যে উষশী এতদিন পর বাড়িতে এসেছে। কাজের লোক উষশীরই খবর দিয়েছিলো। কিন্তু আমানের যে নিষেধ জারি করা ছিলো বলে; সে আগে-ভাগেই পরিচয় দেয়নি৷ দিলে তাকে গেট থেকেই ফিরে যেতে হতো। উষশী মায়ের হাত ধরে খাটের কিনারে বসে আছে। ভালো লাগছেনা তার, মনের মধ্যে অশান্তির ঝড় উঠেছে উষশীর। তার বাবার সম্পর্কে তিক্ত সত্যি গুলো সেই আগে থেকেই জানতো সে। এজন্যই শাহীনকে ছেড়ে দেয়নি সে। কিন্তু কি করবে সেই শাহীনও তো বাবার অন্যায় কাজে যুক্ত হয়েছিলো উষশীকে বিয়ে করতে। শাহীন তো পাশের গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, পরিচয়ও ছিলোনা তার বিয়ের আগে। কলেজে যেতে দেখে বাবার কাছে নাকি প্রস্তাব দিয়েছিলো। একবোন-একভাই আর বাবা-মাকে নিয়ে ছিমছাম পরিবারটা উষশীর বরাবরই পছন্দের।শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ননদ সবাই খুব ভালো।জীবনের পয়ত্রিশটা বছরের পনেরোটা বছর তো ঐ সংসারেই কাটানো তার।এজন্যই হয়তো মায়াটা কাটেনা উষশীর। শাহীন যখন প্রস্তখন উষশীর বাবা বিয়ে দেবার শর্তে শাহীনকে নিজের কাজে লাগিয়ে নেন। ভালোবাসা মানুষকে যে অন্ধ করে দেয় সেটার জলজ্যান্ত উদাহরণ শাহীন নিজেই। ভালোবাসাকে পেতে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছে সে। উষশী সব জেনেও ছেড়ে চলতে আসতে পারেনি, অন্যায়ের স্বাদ সে নিজেও দিয়েছে শাহীনের সাথে সংসার এখনও টিকিয়ে রেখে। কি-ই বা করার সন্তান দুটোকে মা হারা করতে সে ইচ্ছুক ছিলোনা। শাহীন তাকে আদ্রিজার সাথে ঘটানো ঘটনার দিনই সব বলে দিয়েছিলো। আচ্ছা উষশীর কি খারাপ? সময়, পরিস্থিতি নাকি নিয়তির লিখন যে এমন একটা বাবার ঘরে জন্ম নিতে হয়েছে। উহাশী খবর দিয়েছিলো মায়ের অবস্থা খারাপ। সেজন্য নিজের শ্বাশুড়িকে বুঝিয়ে বাচ্চা দুটোকে রেখে এসেছে সে বাপের বাড়ি। জীবনের হিসাব-নিকাশ মিলাতে পারছেনা উষশী। তার ভাগ্য না হয় খারাপ তার মতো অসহায়ত্বের স্বীকার তার ছোটো ভাই-বোন দুটোকেও কেনো হতে হলো?
“এই আপা! কি ভাবিস এত?”
উহাশীর ডাকে ধ্যান ভাঙে উষশীর। এতক্ষণ অতীত ঘাটতে ঘাটতে বর্তমানকেই ভুলতে বসেছে সে। মায়ের দিকে তাকালো আগে। আমেনা বেগমকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে সে। উহাশী দাড়িয়ে আছে উষশীর সামনে। আমান ঐ সময় মায়ের ঘরে ঢুকে। বড় বোনকে এতদিন পর বাড়িতে দেখে একদিকে আনন্দ আরেকদিকে কষ্ট হচ্ছে তার এই ভেবে যে; বাবা নিজ হাতে তার মেয়ের সাজানো সংসার কষ্টের চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছে। সেই কষ্টের চাদর যেন গায়ে আর জড়াতে না হয় সেজন্য সে উষশীর আসাও বন্ধ করেছিলো। অযুহাত দিয়েছিলো চরিত্রহীন ছেলের সাথে সংসার করা দোষের।সেটা সত্যি হলেও যে শাহীন ওমন নয় এটা আমান জানে। কিন্তু এতদিন পর বোনকে দেখে নিজেকে দমাতে পারলোনা। দৌরে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে কেদে দেয়। উষশী ভাইয়ের এমন ব্যবহারে অবাক হয়না। কারণ সে জানে আমান যতটা তাকে ঘৃণা করার চেষ্টা করে ততই বেশি ভালোবাসে। উষশীর বুদ্ধি হতেই মায়ের কাছে ভাইয়ের আবদার করেছিলো সে। আল্লাহ কবুল করে আমানকে উপহার দেয় উষশীর জীবনে। আমান যখন হয় তখন উষশীর বয়স সাতবছর ছিলো। ছোটো ভাইয়ের যত আবদারের ঝুলি সব তাকে ঘিরে। সেই ভাই তাকে ঘৃণা করবে অসম্ভব। উহাশীও বড় ভাই আর বোনকে ধরে কাদতে থাকে। ছেলেরা সহজে কাদেনা এটা বুঝদার হওয়ার পর দেখছে আমান। কিন্তু সে কেনো জানি ব্যতিক্রম সবার থেকে। কথায় কথায় নিজের আবেগ দমন করে কান্না সংবরণ করতে পারেনা সে। কাদতে কাদতেই আমান হেচকি তুলে বলে উঠে,
“আপা, আপা রে বাবা আমার জীবনটা শেষ করে দিলো রে আপা। আমার সন্তানটাকে আমি ছুয়ে দেখেও কোলে নিতে পারিনা। আদর করতে পারিনা। আদ্রিজা আমার বৈধ স্ত্রী তবুও তারে নিয়ে সংসার করতে পারিনা। এত কষ্ট লাগে কেনো আপা? বাবার এতটা লোভ না করলে কি হতোনা? কথায় তো বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। তাহলে কি বাবার লোভের শাস্তি আমরা পাচ্ছি! আমার ভেতরটা জ্বলে যায় আপা। আমি যে আদ্রিজাকে সবটা দিয়ে আগলাতে পারিনি, তার শাস্তি এভাবে পাচ্ছি। একজন বাবা হয়ে সন্তানের থেকে আলাদা থাকা, তার মুখে বাবা ডাকটা না শুনার মতো যন্ত্রণা হয়না আপা। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমায় মেরে ফেলে দে তুই।”
উষশী আর উহাশী স্তব্ধ হয়ে যায় ভাইয়ের এমন আহাজারিতে। তাদের দুবোনের খুব আদরের ভাই আমান। তার এত যন্ত্রণা সহ্য কি করে করবে দুবোন? আমানকে শক্ত করে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলাতে থাকে উষশী। দুনিয়ায় সব সম্পর্কের মাঝে ভাইবোনের এই সম্পর্কটা সুন্দরতম। সেটারই মর্যাদা রাখার প্রাণপণে চেষ্টা করছে উষশী।
ফখরুল মির্জা উহাশীর ঘরের সামনে এসেছিলেন স্ত্রীর খোজ নিতে। সন্তানদের অবহেলা আর ঘৃণা তিনি আর নিতে পারছেন না। কষ্ট হচ্ছে খুব, সত্যিই একজন বাবার কাছে সন্তানদের ঘৃণা পাওয়ার মতো কষ্ট আর দ্বিতীয়টি হয়না। কিন্তু দরজার সামনে দাড়িয়ে তিন সন্তানকে একসাথে দেখে ভেতরে আর যান না তিনি। দরজায় দাড়িয়ে আমানের আহাজারি কান্না শুনে কেমন যেন মস্তিষ্ক ফাকা ফাকা লাগছে উনার। শরীর বড্ড খারাপ লাগছে। মাথা চেপে ধরে বসে পড়েন তিনি মেঝেতে। স্টিলের দরজায় পা লেগে শব্দ হয়। উষশী আমান আর উহাশী বাবাকে এরকম মাথা চেপে ধরে বসতে দেখে এগিয়ে আসতে চেয়েও আসেনা। ফখরুল মির্জা একপলক অসহায় চোখে তাকায় ওদের দিকে। তারপর চোখ দুটো বুজে নেয়। উষশী শতহোক বড় মেয়ে তো, বাবা বলে চিৎকার দিয়ে এগিয়ে যায় বাবার কাছে।
২২,
রাতের খাবার খেতে ডেকে গেলেন আব্বা।কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করলোনা বলে আলিফকে দিয়ে তাহিফের খাবার আনিয়ে ওকে খাওয়াতে বসেছি। মাথায় শুধু বাজে চিন্তা ভাবনা কাজ করছে। ঢাকায় ফিরে যাবে নাকি আমানের ভুল শুধরানোর একটা সুযোগ দিবে? ভুল তো সেও করেছিলো। একটু অপেক্ষা করলে ক্ষতি হতো কি? ভালো লাগছেনা কিছু তার। তাহিফের মুখে একটু করে খাবার দিচ্ছি আর ওকে দেখছি। কেমন মনমরা হয়ে বসে আছে। আমাকে গম্ভীর দেখে আজ আর দুষ্টমি করছেনা। আমি খাওয়াতে খাওয়াতে জিগাসা করলাম,
“বাবাই আজ এত শান্ত যে? কি হয়েছে আমার বাবাইটার?”
“মাম্মা বাবাইয়ের কাছে যেতে দিলে না কেনো?”
আমি ছেলের এই কথার উত্তর দিতে পারলাম না। কেমন যেন অসস্তি ঘিরে ধরছে আমায়। আচ্ছা আমি আমার ছেলের সাথে অন্যায় করছিনা তো? আমান দোষ করুক বা না করুক সেটা তো হয়েছিলো আমার সাথে। আমার আর ওর দ্বন্দ্বের মাঝে ছেলেটাকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করছি যে এটা কি ঠিক? সামনের নতুন বছরে যে ওকে স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি করে দেবো তখনতো ক্লাসের সবার বাবাকে দেখে ওরও বাবার কথা বেশিই মনে হবে। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিনা।
“মাম্মা খাবোনা আর।ঘুমাবো, তুমি পানি দাও আমায়।”
চিন্তা করতে ধরে ছেলের মুখে আর খাবার দেওয়া হয়নি। ছেলের কথায় ওর দিকে তাকিয়ে খাটের সাথে লাগোয়া ছোটো টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে তাহিফকে খাওয়াই। খাওয়ানো শেষে মুখ মুছিয়ে দিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুইয়ে দেই ওকে। তারপর প্লেট নিয়ে দাড়াই। রান্নাঘরের পাশে খাওয়ার ছোট্ট ঘরটায় আব্বা,আলিফ খাচ্ছে। আমি জানি আমি খাইনি বলে মা এখনও ভাত নিয়ে বসেননি।কিন্তু আমি কি করবো! ভালো লাগছেনা কিছু। ওখানে গিয়ে প্লেটটা রেখে চলে আসতে ধরবো এমন সময় বাবার গলা খাকাড়ি শুনলাম। আব্বা মূলত কিছু বলার আগের এমন করেন। কি বলেন এটা শুনতে দাড়ালাম।
“আদ্রিজা মা তোমার সাথে কথা ছিলো কিছু।”
আমি দাড়াতেই আব্বা কথাটা বললেন। আমি মুখে হাসি টেনে বললাম,
“জ্বী বলুন আব্বা।”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।