চোরাবালি পর্ব-০৮

0
1194

#চোরাবালি
#পর্বঃ৮
#আহিয়া_আমান_অণু

১৭
পরেরদিন সকালবেলায়,
ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসছি। আটটা বাজে হয়তো, তাহিফ ঘুমে এখনও। শীতকালের এই দীর্ঘরাতের দরুণ ভোর হতেই কেন জানি আজ ক্ষুধা লেগে গিয়েছিলো। উঠেই আম্মাকে বললাম খেতে দাও ক্ষুধা লাগছে। আম্মা ঠান্ডা ভাতই মরিচ,পেয়াজ তেল দিয়ে গরম করে দিয়েছে৷ শীতের এই সময়টা গ্রামের অনেকেই এমন করে ঠান্ডাভাত গুলো খায়। ঘরেও শুকনো খাবার ছাড়া কিছু ছিলোনা, কিন্তু আমার তো ওসব খাওয়ার তেমন একটা অভ্যাস নেই। এসিটিডির সমস্যা হয়। আর অন্যদিকে এত তাড়াতাড়ি তো রান্না করাও সম্ভব না, সেজন্য আম্মা এমন করে ভাত গরম করে দিয়েছে। খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে দাড়ালাম। আম্মা ভাত নামিয়ে তরকারি বসিয়ে দিলে মাটির চুলায়। লাকড়ি লাগিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি পিছন থেকে আম্মার গলা জড়িয়ে বসে পড়লাম। কতদিন পর আম্মার সাথে এমন করে গলায় জড়িয়ে বসলাম। আগে প্রায়ই এমন করতাম আম্মার সাথে। আম্মা মুচকি হাসলেন। আমার হাতের উপর হাত রাখলেন। আমি বললাম,

“আম্মা আগের দিনগুলো অনেক মিস করি। কত আনন্দ ছিলো বলো! এখন সবকিছুতে এত বিষাদ কেনো আম্মা?”

“জীবনের মানেটা যতটা বুঝবে দিনদিন ততটাই বিষাদ ঘিরে ধরবে মনকে। কিন্তু তোমার আনন্দ-খুশি তুমি যদি খুজে নিতে পারো; তাহলে জীবন সুন্দর। ”

আম্মার মৃদু স্বরে উত্তরটা দিলেন। আমি জানি জীবনটা এমনই। কিন্তু আমার আনন্দ, আমার খুশি খুজে পেয়েও তো হারিয়ে ফেললাম। আম্মা আমাকে চুপ হতে দেখে মাথায় বুলালেন আমার দিকে ফিরে। আমি শুকনো হাসি হাসলাম। এই হাসিতে প্রাণ নেই। এই হাসিটা জোড় করে হাসা। এমন হাজারও মানুষের জীবনটা যায় এই লোক দেখানো হাসি দেখিয়ে। কিন্তু তাড়া ভিতরে ভিতরে গুমড়ে শেষ হয়ে যায়। আম্মা বললেন,

“ভুল বুঝোনা আদ্রি, কাল তোমার আর বৃষ্টির কথা অনেকাংশই আমি শুনে ফেলেছি। আসলে তোমাদের জন্য পানি নিয়ে গিয়েছিলাম; তখনই সব শুনে ফেলি। আমি মা আমার সাথে তুমি শেয়ার করতে হয়তো লজ্জা পাও। সেজন্য আমি সামনে না গিয়ে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে শুনেছি সব। এটা অন্যায় হলেও আমার মেয়ের জীবনের সুরক্ষা আর আনন্দের জন্য সব শুনতে হলো। যাই হোক শুনো একজন মা যদি মেয়ের সবথেকে সেরা বন্ধু হতে পারে তাহলে সেই জীবনে দুর্ভোগ হয়তো অনেকটা কম থাকে। তুমি আমাকে নিজের সেরা বন্ধু ভেবে যদি সব শেয়ার করতে তাহলে এতদিন আমাদের ছেড়ে থাকতে হতোনা। মূল কথায় আসি, আমার কেনো জানি সব শুনে মনে হলো এগুলো পূর্ব পরিকল্পিত চিন্তা করা কর্ম। নয়তো সব ঠিক থাকতে থাকতে হুটহাট এমন কেনো হবে? দেখো আদ্রিজা তুমি আমার মেয়ে হিসেবে তোমার ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার। তাই আমাকে শুরু থেকে শেষ সবটুকু বললে খুশি হবো।”

“আপনার মেয়ে আমার আব্বার অনেক অন্যায় কাজের খোজ পেয়েছিলো আম্মা। সেজন্য আমার বাবা সব পরিকল্পনা করে আমার পরিবারের মানুষকে ব্যবহার করে আদ্রিজাকে অপবাদ দিয়েছে,যেন আদ্রিজা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।হয়তো চেয়েছিলেন আদ্রিজা লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করতেও দ্বিধা না করে। আর আমার আব্বাও সফল হয় উনার কাজে। আদ্রিজা গ্রাম থেকে চলে যায়। কিন্তু এতদিনে ফিরে আসায় আব্বার আবার অসুবিধা হয়ে দাড়ালো। সেজন্য আমাকে আর আদ্রিজাকে আলাদা করতে উঠেপরে লেগেছেন।”

আম্মার কথা শেষ হতেই আমান হঠাৎই কোথা থেকে এসে কথাগুলো বললো। ও কথা বলছিলো বলে আমি বা আম্মা কেউ কিছু বললাম না। আমান কথাগুলো বলে থেমে এগিয়ে আসে আমাদের বসায় জায়গায়। আম্মাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে। আম্মাও মুখে হাসি রেখে উত্তর দিচ্ছে ওর প্রশ্নের। আমার রাগ লাগছে খুব এই লোকটা এখানে কেনো? আম্মা কথার মাঝেই আমানকে বললেন,

“উঠোনে কে কখন এসে যায় ঠিক বাবা। তুমি আমার সাথে ঘরে চলো, সেখানেই আলোচনা করা যাবে সব। তুমি চলো আমার সাথে। ”

আম্মা কথাটা বলেই তরকারির পাতিল নামিয়ে রেখে আমায় সহ আমানকে ঘরে যেতে বলে ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। আমান সম্মতি জানিয়ে আম্মার পিছু পিছু ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। আমি হতভম্ব হয়ে আগের জায়গায় বসে রই। এটা কি হলো? এই লোকটা এখানে কেনো? এসেছে তো এসেছে আম্মাও আদর করে ঘরে নিয়ে গেলো। এই লোকটাকে দুমিনিটও সহ্য হচ্ছে না আমার। আমিও উঠে হনহনিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

১৮
সকালের খাবার শেষ করে বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় উহাশী। উদ্দেশ্য বাবার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা আলোচনা করা। কাল আমানের প্রশ্নের তোপে পড়ে সে দ্বিধান্বিত যে কি করবে সে। আনমনে এই কথা ভাবতে ভাবতে বাবার ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত হয় উহাশী। চারদিকে নজর বুলায় একবার যে বাড়ির লোকজন কে কি করছে দেখে নিতে। তার মা হেঁশেল ঘরে, দাদী নিজের ঘরে আর বাড়ির কাজের লোকগুলো তো বাইরের উঠোনে ধানের কাজে ব্যস্ত। উহাশী দরজায় কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে বাবার সাড়া পেয়ে ঘরে ঢুকে বাবার সামনে দাড়ায়। উহাশীকে দেখে ফখরুল মির্জা ভ্রু কুচকে তাকায়। উহাশী বাবার পাশে বসে। ফখরুল মির্জা ছোট কন্যা বিধায় উহাশীকে যথেষ্ট ভালোবাসে; সেজন্য উহাশীর এমন আচরণে উনি কিছু বলেন না। উহাশী স্বর খাদে নামিয়ে বলে,

‘আব্বা কালকে ভাইয়াকে সব বলে দিয়েছি। ভাইয়া তো আপনার সব অন্যায় কাজ সম্পর্কে আগে থেকেই জানতো। শুধু প্রকাশ করেনি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। ঐ মানুষটা আপনাকে ভালোবেসে এই সংসার আগলে রেখেছে আর আপনি মা-কে নূন্যতম সম্মান দেন না। এবার আমাদের মা-কে আমরাই সামলে নেবো। আপনি আপনার ওয়াদা রাখেননি আব্বা। তাই মাফ করবেন আমিও আপনাকে দেওয়া ওয়াদা রাখতে পারি নাই।”

ফখরুল মির্জা মেয়ের কথায় চমকে তাকান উহাশীর দিকে। উহাশী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আগের মতোয় বসে আছে। ফখরুল মির্জা কাপা স্বরে বলেন,

“আমানকে কি বলেছো তুমি? কি জানে আমান?”

“কেনো আপনি জানেন না আমি ভাইয়াকে কি বলতে পারি? তাহলে জানাচ্ছি আমি এটাই বলেছি যে আপনি সেই পর্যায়ের মানুষ যার নিম্ন শ্রেণিরও আত্মসম্মান বোধ নেই; আপনি সেই পর্যায়ের স্বামী হয়েছেন একটা নারীর যিনি আমাদের মা, যাকে আপনি নিম্ন পর্যায়ের সম্মান টুকুও দেননি সংসার জীবনে। আপনি সেই পর্যায়ের বাবা যিনি নিজের স্বার্থে সন্তানদের ব্যবহার করতেও ছাড়েন নাই। আপনি তো সেই বাবা যিনি নিজের বড় মেয়ের স্বামী সংসার কেড়ে নেওয়া ভয় দেখিয়ে এই মির্জা বাড়িতে আসা বন্ধ করেছেন আমান ভাইয়ার সামনে দুলাভাইকে খারাপ বানিয়ে। কারণ দুলাভাইও আপনার অন্যায় কাজের সাক্ষী। আদ্রিজা ভাবী তো মায়ার অধিকারী, তার মায়ায় এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ প্রাণবন্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ভাবী ভুল করেছিলো আপনার কাজকর্ম সন্দেহের তালিকায় যুক্ত করে আপনার এই গ্রামের প্রতিটা মানুষকে ঠকানোর কার্যক্রমটা দেখে ফেলেছিলো। এটাই হয়তো ভাবীর অন্যায় ছিলো, যার দরুণ মিথ্যা অপবাদের বোঝা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে ভাবী। আমাকে যখন এই অন্যায় কাজে যুক্ত করেছিলেন বুঝিনি সেটা অন্যায়। কিশোরী বয়সে উপনীত হওয়া এই আমি টাকে ব্যবহার করেছেন আপনার অন্যায় কর্মে। জানেনই তো আব্বা মেয়েদের কাছে তার বাবার জন্য সম্মান আর মায়া দুটোয় বেশি; কারণ বাবারা তো মেয়েকে মায়ের জায়গায় বসিয়ে আদর করে। আপনিও আমার প্রিয় ছিলেন, কিন্তু সেদিনের সেই কাজের পর আর আপনি আমার প্রিয় নেই আব্বা; যেদিন আপনি আমার কাছে নিজের স্বার্থের জন্য বাবা হয়ে দাবী করেছিলেন সবাইকে মিথ্যা বলতে যে আদ্রিজা ভাবী আর দুলাভাইয়ের অবৈধ সম্পর্ক আছে। আমি যদি না বলি দুলাভাই আর আপাকে আলাদা করে দিবেন। বাচ্চাগুলোকে মা হারা করে দিবেন। কারণ আইনত বাচ্চাগুলো দুলাভাই পেতো। আমি চাইনি আমার ভাগ্নে-ভাগ্নী গুলো মা হারিয়ে ফেলুক। আপনি তো আমার মগজ ধোলাইও করেছিলেন এটা বলে যে, বাবা-মা মারা গেলে বড় বোনই ছোটো বোনকে দেখে। ভাই তো তার বউয়ের কথায় কান দিয়ে বোনদের উপর টান রাখেনা। আদ্রিজা গেলে ভাইয়ার বউ পাওয়া যাবে। কিন্তু আপা দুলাভাই আলাদা হলে বাচ্চাগুলোর যে অবহেলা হবে সেগুলোর দায় কে নেবে! আপার কথা ভেবে কিশোরী বয়সে উপনীত হওয়া আমিটা ভাল-মন্দ না বুঝে আপনার কথা শুনে যে কি পরিমান ভুল করেছি তার মাশুল আমার জীবন দিয়েও হয়তো শুধরানো যাবেনা। আপনার প্রতি দিনদিন ঘৃণা বেড়েই চলছিলো আব্বা। কিন্তু কাল ভাইয়া আপনার গ্রামবাসীর সাথে করা অন্যায়ের কথা জানিয়ে ঘৃণার পরিমানটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ভালো হয়েছিলো ভাই কাল আপনারা ঘুমানোর পর আমার আমাকে সব জানিয়েছিলো; এজন্যই ভাইয়াকে সব জানানোর সাহস পেয়েছি। আপনি ওয়াদা দিয়েছিলেন আব্বা মায়ের কোনো অসম্মান বা অবহেলা আপনি হতে দেবেন না, আপা দুলাভাইয়ের সুখের সংসার থাকবে! কিন্তু আপনি আপনার কথার এক কানিও পূরণ করেননি আব্বা। আমিও আমার কথা রাখলাম না। অনেক ভয় করেছি আর করবোনা। সবাই জানুক ফখরুল মির্জা মানুষের সেবা নামে গ্রামের মেম্বর হয়ে সরকার প্রদত্ত যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নিজে ভোগ করতো। জনগনের জন্য দেওয়া রেশন, বয়স্ক মানুষদের কার্ড, প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য দেওয়া অনুদান সব আপনি নিজে আত্মসাৎ করতেন। মানুষকে ঠিকই বলতেন সরকার সাহায্য করবে, জনগনের থেকে কাগজ নিয়ে আপনি সেগুলো নিজের কাছে রেখে দিতেন। গ্রামের মানুষ অশিক্ষিত কিছু বুঝতোনা, আপনি যা বুঝাতেন তাই বুঝতো। ভালো হয়েছে ভাইয়াকে এবার দাড়িয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ চায় তো ভাইয়া জিতলে এবার অন্তত গ্রামের মানুষের উন্নতি হবে। আপনি এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে মানা যেত; কিন্তু আপনি তো এতটুকু অব্দি থেমে থাকেননি। গন্জে সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করে সেখানেও মানুষকে ভালোমানের জিনিস দেওয়ার কথা বলে চড়া দামে বিক্রি করতেন, অথচ দাম তার তিনভাগের একভাগ হবে। গ্রামে দুএকবার সবার জন্য চাল-ডাল দিয়ে, গ্রামের এতিমখানায় দান করে সবাইকে বুঝাতেন ফখরুল মির্জা মহৎ মানুষ অন্যায় কাজ করতেই পারেনা। কিন্তু আপনার আসল রুপ তো ভাই আর আমি জানলাম। ভাইয়া কেমনে জানছে জানিনা, কিন্তু আমাকে জানিয়ে ভালো করেছে। একজন পিতা তার সন্তানের ঘৃণার উপযোগী।এর থেকে বড় লজ্জা পিতার কাছে কি-ই বা হতে পারে। অপেক্ষা করুন আপনার ধ্বংশের জন্য। মাফ করবেন এত কথা বলে ফেললাম।”

একনাগারে কথাগুলো বলে থামে উহাশী। ফখরুল মির্জা ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে উহাশীর দিকে। বাচ্চা মেয়েটা তাকে এত কথা শুনালো। সন্তানের ঘৃণাতে তার যেন কিছুই যায় আসেনা। উহাশীও বাবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে যেতে উঠে দাড়ায়। দরজার কাছে যেতেই নিজের মা-কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উহাশীর মনের মধ্যে ভয় ঢুকে যায়। তার মা কিছু শুনলো না তো। উহাশী এই চিন্তায় অস্ফুটে মা বলে ডাক দিলো। আমেনা বেগম পাথরের মতো দাড়িয়ে আছে তো আছে উনার কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটু পর ঢলে পড়লেন মেঝেতে। উহাশী চিৎকার করে মা বলে ডাক দিলো।ফখরুল মির্জা বিছানায় বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে এগুলো?

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে