#চোরাবালি
#পর্বঃ৭
#আহিয়া_আমান_অণু
১৫
“তুই সবাইকে ছেড়ে গিয়ে ভুল করছিলি আদ্রি।কিন্তু কথা হলো কি এমন হয়েছিলো যে তুই পুরো পরিবারকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি?আমি আজও জানলাম ঠিক কি হয়েছিলো সেদিন, বলবি একটু তুই?”
তাহিফ, বৃষ্টি আর আমি বসে বসে মুড়ি মাখা খাচ্ছিলাম আর বৃষ্টির সাথে ঢাকায় কি করি, কোথায় থাকি এসব আলোচনা করতে করতে উক্ত কথাটা জিগাসা করে বসে বৃষ্টি।আমি চুপ হয়ে গেলাম এই প্রশ্নে। সেদিন কি হয়েছিলো সেটা তো আমার কাছেই স্পষ্ট নয়। কি থেকে কি হয়েছিলো সব বুঝতে পারিনি আজও।
“কি রে চুপ কি জন্য? উত্তর দে!”
“আমি নিজেও জানিনা রে, তোরে কি বলতাম আমি?”
আমি পানি খেয়ে উত্তরটা দিলাম। বৃষ্টি কেমন ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে আছে। তাহিফ ফোনে গজল দিয়ে বসে বসে শুনছে।আমি বৃষ্টির দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম। বৃষ্টি গাল ফুলিয়ে বসে আছে। তারপর ঠোট নাড়িয়ে বলে,
“মানেটা কি স্পষ্ট করে বল, নয়তো তোর পিঠ আজ পিঠ থাকবেনা। পিটিয়ে মাঠ বানায় দিমু।”
আমি স্ব শব্দে হেসে উঠলাম বৃষ্টির কথায়। ও এবার ধমকে বললো,
“ফাজলামো বাদ রেখে বল বলছি! নয়তো তোর একদিন কি আমার যে কয়দিন লাগে।”
“সত্যি আমি নিজেও জানিনা রে আপা; কি হয়ছিলো বলতে পারিনা। প্রতিদিনের ন্যায় ঘুম থেকে উঠলাম। ফজর নামাজের জন্য ওযু করতে কলপারে গেলাম। ওযু করে এসে দেখি উহাশী, আমার শ্বশুরমশাই আর বড় দুলাভাই আমার ঘরের সামনে দাড়িয়ে আছে। দুলাভাই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে বাবা রাগী চোখে। একটু পর আমানের বাবা রাগী স্বরে ধমকে বলেন আমার ঘরে বড় দুলাভাই সারারাত ছিলো। সারারাত রাসলীলা করে কলপাড়ে গেছি নাকি পবিত্র হতে; অপবিত্র শরীর নাকি যতই পবিত্র করতে চাই তা হবেনা। বেলা হতে হতে রটে যায় আমি দুলাভাইয়ের সাথে সবার আড়ালে সম্পর্ক গড়ে তুলছি। অথচ আমি এসবের আগামাথা কিছুই বুঝিনি। বেলা বাড়লো, আমান আসলো। ভেবেছিলাম কেউ না বুঝলেও ও আমায় বুঝবে। সে আশায় গুড়ে বালি। ও সবার কথা শুনে বিচার বসাতে চাইলো। আব্বা গিয়ে আমায় আনলো বাড়িতে। আমি বাড়িতে এসে সাইফার সাথে যোগাযোগ করে নিজের যা প্রয়োজনীয় সাথে নিয়ে চলে যাই।এরপর বাকিটা তো একটু আগেই বললাম; কি করছি, কোথায় থাকছি।”
“সবকিছুর মাঝেই কেমন ঘাপলা আছে মনে হচ্ছে। বাড়িতে আরও মানুষ থাকতে তোর এই ননদ আর শ্বশুরেরই এসে ধরতে হলো দুলাভাইকে। তোর শ্বাশুড়ি, দাদী শ্বাশুড়ি উনারা ছিলো না?”
বৃষ্টি আমার কথা শুনে কথাটা বলে।আমি ফুস করে দম ফেলে উত্তর দেই,
“না রে, উনাদের তখন দেখিনি। এমনকি আমানের বাবা আশেপাশের মানুষদের জানালেও ওর মাকে উঠতে দেখিনি। উষশী আপাকেও না। বাচ্চা উঠে কাদে তবু আপা উঠেনা। উহাশী গিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আমার সামনে এসে বসেছিলো। সবকিছুর মাঝেও উহাশীর চোখে পানি ব্যতিত কাউকে দেখিনি আমারক জন্য কদাতে। আমানের আম্মা তো ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো পরে। যখন দুলাভাই সবার সামনে মিথ্যা বলে স্বীকার করে উনি আমার সাথে ছিলো। অথচ আমি পুরো রাতের প্রায় দুপুররাত অব্দি জেগে আমানের সাথে কথা বলেছি।শেষ রাতে ঘুম আর ধরেনি; তাহাজ্জুদ পড়ে কুরআন পড়তে বসছিলাম। তারপর আজান দিলে উঠে ওযু করতে যাই। ”
” সবই বুঝলাম আদ্রি। কিন্তু সবকিছুর মাঝে একটা কিন্তু থেকেই যায়। এই দুলাভাইটা তোর ঘরে না থেকেও কেনো বলেছিলো সে তোর সাথে ছিলো!”
“আমি জানিনা বৃষ্টি। আমার আপাতত এসব নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই।”
তাহিফের দিকে খেয়াল দিতেই দেখি বাচ্চাআমার ঘুমিয়ে গেছে। দুপুরের দুটো বাজতে চলেছে, দেয়াল ঘড়িটায় তা দেখলাম। বৃষ্টি বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
“এতসবের মাঝে তো তোদের তালাকটা হয়নি। এটা কি বাদ রাখবি? যে সম্পর্ক ভেঙেই গেছে তা টিকিয়ে রেখে লাভ নেই।”
বৃষ্টির মুখে তালাকের কথা শুনে বুকের মধ্যে কেমন জ্বলে উঠলো। কেমন গুমড়ে মরার অনুভূতি অনুভব হতে লাগলো। সত্যিই এতদিন তবু শান্তনা ছিলো কাগজে কলমে এখনও সে আমার। তবে এবার কি সত্যি আলাদা হতে হবে। বৃষ্টি বাড়ি যাওয়ার কথা বলে চলে গেলো। আমি ছেলের মুখের দিকে তাকালাম। আচ্ছা আলাদা যদি হই এই বাচ্চাটাকে আমার সাথে থাকতে দিবে তো আমান! হাজারও চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। আমান সে তো এক চোরাবালি আমার জীবনে। চোরাবালিতে পা আটকালে যেমন বাচা দায় হয়ে পড়ে, আমার জীবনে তার মায়া কাটানোও বড্ড কঠিন।
১৬
রাতের বেলা বান্ধবীর বাড়ি থেকে ঘরে ঢুকে বড় ভাই আমানকে বসে থাকতে দেখে চমকে যায় উহাশী। আজ কলেজ ছিলোনা বলে গিয়েছিলো বান্ধবীর বাসায়। কিন্তু সে যেখানেই যাক আমানকে কখনও এভাবে নিজের ঘরে বসে থাকতে দেখেনি সে। কিন্তু আজ কেনো বসে আছে? উহাশী ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলো। আমান বিছানায় মাথা নিচু করে গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় মত্ত বলে উহাশীর উপস্থিতি টের পায়নি। উহাশীর পিছনে আমেনা বেগম এসে দাড়ান। উহাশী পিছন ফিরে একবার মাকে দেখে নেয়। আমেনা বেগম পাশে এসে দাড়ালে উহাশী আমেনা বেগমকে আস্তে করে বলে,
“ভাইয়া এখানে কি করে মা? কিছু হয়েছে কি?”
“আমি কিছু জানিনা, তোর ভাইরে জিগা।”
মায়ের কথায় ভীতু স্বরে উহাশী আমানকে ডাক দেয়। আমান উহাশীর গলা শুনে মাথা তুলে তাকায়। উহাশীকে দেখে প্রস্তর হাসি ফুটে উঠে তার ঠোটে। দুুপুরে বোনের ঘরে এসে না পেয়ে সেখানে বসে ছিলো সে। সত্যি না জানা অব্দি তার মন সায় দিচ্ছে না।তার বাবা কেমন সেটা তো তার থেকে ভালো আল্লাহ ব্যতিত কেউ জানেনা। এজন্য আমানের সন্দেহের তীরের প্রকোপটা বাবার দিকেই বেশি যাচ্ছে। উহাশীকে ইশারায় পাশে বসতে বলে আমান। আমেনা বেগম ছেলের এই শান্ত ব্যবহার মানতে খটকা লাগছে প্রচুর। ঝড়ের পূর্বাভাস প্রকৃতির নিরবতা, যেমন নিরবতা এখন পালন করছে আমান। কোন সত্যি বেরিয়ে আসে জানা নেই তার। তবে সব সহি-সালামত থাক এটাই মনে প্রাণে চাচ্ছেন আমেনা বেগম। উহাশী পাশে বসতেই আমান নরম সুরে বলে,
“আচ্ছা উহাশী তোর তো ঘুম গভীর তাইনা?”
“হ্যা তাতো তুই জানিস ভাইয়া। জিগাসা কেনো করছিস?”
“তাহলে তুই আদ্রিজার ঘর থেকে দুলাভাইকে বের হতে দেখছিস ফজরের সময়; উঠেছিলি কিভাবে? তোর তে এক ঘুমে রাত শেষ করার অভ্যাস!”
আমানের প্রশ্নে শীতের মাঝেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে উহাশীর। আমেনা বেগম পরিস্থিতি ঠিক রাখতে নিজের শ্বাশুড়ি রুহিনা বেগমকে ডাকতে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আমান যদি উহাশীর থেকে কিছু জানতে পেরে উহাশীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসে! ছোটো মেয়ে আদরের খুব। আপাতত আমানের হাত থেকে তার শ্বাশুড়িই পারবে উহাশীকে বাচাতে। এজন্য তাকে ডাকতে যাওয়া আমেনা বেগমের।
“কি হলো চুপ করলি কেনো? উত্তর দে!’
” জানিনা ভাইয়া সেদিন কিভাবে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো; উঠে কলপারে যাবো দেখলাম ভাবীর ঘর থেকে দুলাভাই বেরুচ্ছে। আব্বাও তখন নামাজের জন্য উঠেছিলো তাই আব্বাকে জানাই আমি।”
“বেরুতে দেখলি আর আব্বাকে বললি! মানে রাত বিরাতে তোর বিয়ের পর যদি তোর ননদের স্বামী এমনে বের হয় ঘর থেকে; তারমানে তোরও তোর ননদের স্বামীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক হবে তাইনা?”
“ভাইয়া! তোর আমাকে এমন মেয়ে মনে হয়?”
উহাশী ভাইয়ের কথা শুন আশ্চর্য হয়ে কথাটা বলে। আমান ফিচেল হাসি হাসে উহাশীর দিকে তাকিয়ে। তার তো আদ্রিজার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু আফসোস মেয়েটা সময় না দিয়েই চলে গেলো পালিয়ে। বিচার কেনো বসাতে চেয়েছিলো সেটা না হয় বলার অবকাশ দিতো একটু। কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিজার বাবা এসে মেয়েকে নিয়ে গেলো, পরে সে আবার নিজই উধাও হয়ে গেলো। খুজেছিলো তো আমান। চারটা বছরে না হয় কম করে হলেও শতবার চেষ্টা করেছে আদ্রিজাকে খুজে পাওয়ার। যে হারিয়ে যায় তাকে খুজে পাওয়া সম্ভব হয়, কিন্তু যে লুকিয়ে থাকে তাকে কিভাবে খুজে পাওয়া যায়! আমান এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উহাশী আমানকে নিস্তব্ধ থাকতে দেখতে পাশ থেকে উঠে চলে যেতে নিলে আমান হাত ধরে বোনকে বসিয়ে দেয়। তারপর ঠান্ডা স্বরে বলে,
“ভাই বলে যদি একদিনও মানিস আমায়; কসম দিলাম আমার সত্যটা বল।”
উহাশী কেপে উঠে ভাইয়ের এমন স্বর শুনে। আমান বরাবরই তাকে আদরে রেখেছে; বড় ভাইয়ের সব দায়িত্ব পালন করেছে। উহাশী কিভাবে পারবে ভাইয়ের এই কসম উপেক্ষা করতে! কিন্তু সে যে বাবাকে ওয়াদা দিয়েছিলো সেটার কি হবে। ওয়াদা ভাঙা তাও সেটা নিজের বাবাকে দেওয়া। তার বাবা যে তার কাছে একটা জিনিসই চেয়েছিলো; যেন সে এই মিথ্যাটা বলে যে সে তার বড় বোন জামাইকে ভাবীর ঘর থেকে বেরুতে দেখেছে এলেমেলো অবস্থায়। তার বাবা যদি আগে জানাতো উনি এটা করতে বলবেন তাহলে কখনোয় ওয়াদা দিতো না বাবাকে, যে বাবা যা করতে বলবে তাই করবে। এখন পারছে আমানকে জানাতে, না পারছে চুপ থাকতে। দোটানায় ভাসছে উহাশী।এ কোন সমস্যায় ফেললে আল্লাহ। উহাশী আনমনে এসব চিন্তা করছে।
“আমান উহাশীকে এমন প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে নিজের ঘরে যাও। মাইয়াডা সারাদিন বাড়িতে আছিলো না, তারে ছাইড়া দাও এহন।”
দরজার সামনে দাড়িয়ে রুহিনা বেগম আমানকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেন।পাশেই আমেনা বেগম দাড়ানো।ছেলের বউয়ের ডাক শুনেই উনি এসেছেন এখানে। দাদীর কন্ঠস্বর শুনে আমান আর উহাশী সেদিকে তাকায়। আমান বরাবরই দাদীকে শ্রদ্ধা করে আসে। দাদীর কথা উপেক্ষা করে এখানে বসে থাকা আর সম্ভব নয়, তবে সে সত্যিটা না জেনে যাবেনা। সেজন্য দাদীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আপনি অন্তত আমায় বুঝেন দাদী। আমি আমার বউ-বাচ্চাকে ফেরত চাই। আপনি তো জানেন একটা বাচ্চার বিকাশের জন্য তার বাবা-মা দুজনকেই প্রয়োজন হয় শুরু থেকেই।”
রুহিনা বেগম হতাশার নিঃশ্বাস ফেলেন।বুঝতে পেরেছেন উনি নাতীর মাথায় জিদ চেপে গেছে তাকে তার কাজ হতে সরানো সম্ভব না।আমেনা বেগম শ্বাশুড়ির কাধে হাত রাখেন। ইশারায় বুঝান আমানকে হাত ধরে নিয়ে যেতে তার ঘরে। তখনই সেখানে উপস্থিত হন ফখরুল মির্জা। উনাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়। উনি সবাইকে চুপ থাকতে দেখে বলেন,
“আমি আইলাম আর তোমরা চুপ হইলা; ব্যাপার কি?”
“কিছুনা ব্যাপার, আপনে হাতমুখ ধুইয়া লন, খাবার বারতেছি আমি।”
আমেনা বেগম স্বামীর কথার উত্তর দেন। ফখরুল মির্জা তখন ছেলে আর মেয়ের মাঝখানে গিয়ে বসেন। আমানের কাধে হাত রেখে বলেন,
“সামনে ভোট সেটাতেই মনোযোগ দাও। আদ্রিজা তোমার ছেলে এসবের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।আমি উকিলের সাথে কথা বলে আসছি। খুব শিগগিরই তোমাদের তালাক হয়ে যাবে। তোমার ছেলে তোমার কাছেই আসবে।”
ফখরুল মির্জার কথায় উপস্থিত সবাই অবাক হয়। সবথেকে বেশি অবাক হয় আমান। সে রাগে হাত মুঠো করে নেয়। তারপর শক্ত গলায় বলে,
“ভুল করলেন আব্বা, আদ্রিজা আমার বউ। তিন কবুলের শক্তি এত ঠুনকো না যে চাইলেন আর আলাদা হলাম। কাল সকালের অপেক্ষা তারপর দেখবেন কি হয়।”
কথাটা বলেই আমান উঠে হনহনিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। বাকিরা আমানের এহেন ব্যবহারে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
চলবে?
ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ থাকলো।