#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৮
প্রায় দু বছর অনি কে দেখে খানিকটা চমকে উঠল সারফারাজ। সে আশা করেনি অনি তাকে চিনবে। চেনার কথাও না। এতো বছর দুজনের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মুখোমুখি তে অনিও কিছুটা ঘাবড়ে গেল। সারফারাজ লক্ষ্য করল অনির চোখের পাতা কাঁপছে। ঠোঁট জোড়াও নড়ছে কেমন। দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল সে। কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অনি কি তাকে পছন্দ করে না। ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তবে এই ঘৃণার ভার সইতে তার বড্ড কষ্ট হবে। অর্নিলা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় নি। পেছন থেকে শাহিনুর বেগমের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ সময়ের পর ছেলেকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে বিস্মিত শাহিনুর বেগম। “নিকুঞ্জ নিবাস” যেন হঠাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে উঠল। সারফারাজ মায়ের দিকে ফিরে হাসার চেষ্টা করল। অর্নিলার ঘোর কাটল। একটু সরে দাঁড়াতেই শাহিনুর বেগম ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি কাঁপছেন, চোখের অশ্রু টলমল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। দুহাতে ছেলের মুখখানি আগলে ধরলেন তিনি। মৃদু হেসে সারফারাজ বলে শুধালো, “কেমন আছো মা?”
অর্নিলা খানিকটা বদলে গেছে। খানিকটা না অনেকটাই। ওর মধ্যে এবার ম্যাচুরিটি একটা ভাব এসেছে। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। এবারও সারফারাজ কে চমকে দিয়ে অর্নিলা এ+ পেয়ে দেখাল। সারফারাজ সত্যিই খানিকটা হতভম্ব। আরাফাতের এ+ পাওয়ার বিষয়টা ওতো আকৃষ্ট করল না। যেন এটা তার কাছে পাওনাই ছিল। তবুও আরাফাত একটা নতুন ল্যাপটপের আবদার রাখল। সারফারাজ কথা দিলো সে কিনে দিবে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার বেশি দেরি নেই। আরিফ হাসানের সাথে কথাবার্তা শেষে সারফারাজ স্টাডি রুম ছেড়ে বের হলো। আশ্চর্য! বাড়ির প্রতিটা জিনিসই যেন একরকমই আছে। কিছু বদলায়নি। শুধু অনিই যেন বড্ড বদলে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে ঘরের কাছে পৌঁছাল সারফারাজ। দরজার বাইরে অনি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু জড়োসড়ো হয়ে গেল সে। শুধালো, “তুই এখানে?”
ভূত দেখার মতো চমকে উঠল অনি। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তার। সামনে ফিরে দাঁত বের করে হাসল। সারফারাজের মনে হলো, না অনি বদলায় নি। আগের মতোই আছে। ও হাসি এখনো আগের মত। তাহলে বদলে গেলো কি? সূক্ষ্ম চাহনিতে পরখ করতে লাগলো। অবশেষে টের পেলো। অনি অনেকটা শুকিয়ে গেছে। ঠিক শুকিয়ে গেছে বলাও চলে না। শেষবার ওর ওজন প্রায় ৮০ কেজির বরাবর ছিল। এখন দেখে মনে হচ্ছে সেটা ৬০ এ এসে ঠেকেছে। স্বাস্থ্য কমার কারণে অনি কে একটু লম্বা লাগছে। একটু অন্যরকম। মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো সারফারাজ। অনি তার সামনে চুটকি বাজিয়ে বলল, ”ফারাজ ভাই, হা করে কি দেখছেন?”
ফারাজ হাসলো। ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, ”তুই এখানে কি করছিস অনি? চো/রের মতো ঘরে উঁকি দিচ্ছিলো কেন?”
”বাঃ রে? চো/রের মতো উঁকি দিলাম কোথায়? এতোদিন তো এই ঘর আমার ছিল। আমি ঘুমাতাম।”
সারফারাজ বিভ্রান্ত হলো। ভাবলো অনি ওর সাথে মজা করছে। কথাটার গুরুত্ব না দিয়ে শুধায়, ”তুই এতো শুকিয়ে গেছিস কেন রে অনি?”
”আপনার জন্য ফারাজ ভাই!”
না, এবার অবাক না হয়ে পারল না ফারাজ। ভ্রু কুঁচকে ফিরে দেখল অনি হাসছে। ওর হাসিতে কেমন একটা রহস্য আছে। খুব হেঁয়ালি কথাবার্তা বলছে।
”আমার জন্য? কেন রে? আমি কবে তোকে বললাম তুই খুব মোটু। একটু শুকিয়ে যা।”
”বলেন নি। কিন্তু আমার মনে হলো আপনি চিকন মেয়েদের পছন্দ করেন।”
”কেন? আমি তোকে কখনো বলেছিলাম একথা?”
অর্নিলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে মাথা দুলিয়ে বলল না। সারফারাজের খাতা কলম নিয়ে কি ভেবে বিছানার উপর আসন পেতে বসল। অর্নিলা এখনো সেখানে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারফারাজ তার দিকে ফিরে তাকায় নি অথচ অর্নিলার উপস্থিতি তাকে বিচলিত করছে। আগে কখনো অনি আশেপাশে এভাবে ঘুরঘুর করেনি। আজ একটু বেশিই করছে নাকি সেই বেশি ভাবছে। অনেকদিন পর অনি কে দেখতে পেয়ে বোধহয় তার মন বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।
অনি মলিন কণ্ঠে বলে উঠল, ”বসলেন কেন ফারাজ ভাই? খেতে আসবেন আসুন। মামনী ডাকছে আপনাকে।”
”তুই যা, আমি আসছি!”
অনি নিশ্চুপ হয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। দরজার কাছে এসে ফিরে তাকাল সারফারাজের দিকে। সে জানে, ফারাজ ভাই মোটা মেয়েদের পছন্দ করে না। কারণ জান্নাত আপু মোটেও মোটা না। সে খুব স্মার্ট আর চিকন। উচ্চতায় অনেক লম্বা আর ফারাজ ভাই জান্নাত আপুকে ভালোবাসতো। সে তো আর চাইলেও জান্নাত আপু হতে পারবে না কিন্তু সে চেষ্টা করবে। চেষ্টার কারণেই তো এতো সময়ের মধ্যে এতোখানি শুকিয়ে গেছে। চালচলনে পরিবর্তন এনেছে। আগে সবসময় জিন্স টপস পরে ঘুরাঘুরি করত কিন্তু এখন আর এসব সে পরে না। সুন্দর সুন্দর কামিজ, থ্রি পিস পরে। সুন্দর একটা উড়না গলায় জড়িয়ে রাখে। তার বেশ মনে আছে, জান্নাত আপুও এমন ভাবে তাদের বাসায় আসত। ফারাজ ভাই তখন আড়চোখে আপুকে দেখত। এসব তার জানা। সে তো সবসময় ফারাজ ভাই কে চোখে চোখে রাখত। তার এতো পরিবর্তন কি ফারাজ ভাই লক্ষ্য করেনি। সে যে আজ ফারাজ ভাইয়ের পছন্দের রঙ আকাশী রঙের একটা উড়না গায়ে জড়িয়েছে, ভাই তো একবারও ফিরে তাকায় নি। ভাই ভাবছে সে মিথ্যে বলছে, কিন্তু মিথ্যে না। এতোদিন এই ঘর তার অধীনে ছিল। খুব যত্ন করে ঘরটা গুছিয়ে রেখেছে। একটা জিনিস এখান থেকে ওখানে করেনি তাও ফারাজ ভাই কিছু বুঝল না। এতো বোকা তুমি ফারাজ ভাই!
খাবার টেবিলে বসতেই দেখল বিরাট আয়োজন। সবাই একসাথে খেতে বসেছে। আরিফ হাসান, আরাফাত, শাহিনুর বেগম আর সারফারাজ। সারফারাজ খেয়াল করলো অর্নিলা বসে নি। আগে কখনো এমনটা হয়নি। খাবার টেবিলে সবার আগে অনি বসতো। ওকে খাবার বেড়ে না দেওয়া অবধি কেউ খাবার ছুঁতে অবধি পারত না। সেই মেয়ে আর সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সারফারাজ যেন দেখেও না দেখার ভান করছে। তৃপ্তি করে খেলো সে। শাহিনুর বেগম গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন, “আরেকটু নাও সারফারাজ।”
”না, মা পেট ভরে গেছে। অনেক খেয়েছি।
”অনেক খেলি কোথায়? খাবার কেমন হয়েছে?”
”ভালো হয়েছে। অনেক দিন পর তোমায় হাতের রান্না খেয়ে মুখে রুচি ফিরেছে।”
শাহিনুর বেগম মুখ টিপে হাসলেন। আরাফাত শব্দ করে হেসে বলল, ”মা রান্না করেনি। বুড়ি রান্না করেছে।”
হকচকিয়ে উঠল সারফারাজ। হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আশপাশ চেয়ে দেখল অনি নেই। রান্নাঘরের গেছে। আরাফাত খাতের লোকমা তুলে বলল, ”এখন থেকে বুড়িই রান্না করে। খুব ভালো রান্না করে।”
আরিফ হাসান মলিন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ”মেয়েটা বড় হয়ে গেছে।”
সারফারাজ অবাক কণ্ঠে বলল, “এতো পরিবর্তন কি করে?”
শাহিনুর বেগম বললেন, “মেয়েদের পরিবর্তন হঠাৎ করেই হয় সারফারাজ। ওসব তুমি বুঝবে না। ওই তো অর্নিলা পায়েস নিয়ে এসেছে। একটু খেয়ে দেখো।”
পায়েসের বাটিটা সারফারাজের সামনে রাখা হলো। সারফারাজ কিয়ৎকাল বাটির দিকে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমার পেট পুরোপুরি ভরে গেছে মা। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”
”কিন্তু ফারাজ…
সারফারাজ দাঁড়াল না। চলে গেল ঘরের দিকে। অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফাত উঠে পায়েসের বাটিটা হাতে নিয়ে বলল, ”দে বুড়ি আমি খাই। তোর রান্না করা পায়েসের টেস্ট সেই হয়।”
আরিফ হাসান ও তাল মিলিয়ে বললেন, ”মা আমায় ও একবাটি দে।
”তোমার মিষ্টি খাওয়া বারণ মামা। তুমি খেতে পারবে না।
”দে দে, একটু খেলে কিছু হয় না।”
”একদম না। যাও ঘরে যাও। একটু হাঁটাচলা করে ঘুমাতে যাবে। স্টাডি রুমে থাকবে না একদম। কাল মাঝরাতে তোমার ঘরের আলো জ্বলে থাকতে দেখেছি আমি।
শাহিনুর বেগম বললেন, ”পাশেই তো শুয়ে থাকে। কোনসময় উঠে যে স্টাডি রুমে চলে যায় সজাগ পাই না। হ্যাঁ গো, ওখানে এতো রাতে কাজ কি তোমার? ঘুমাও না কেন?”
আরিফ হাসান জবাব দিলেন না। নিশ্চল চাহনিতে অর্নিলার মুখের পানে চেয়ে শুধালেন, ”মাঝরাতে তুই কি করছিলি মা?”
অর্নিলা জবাব দেয়নি। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মামার মুখের দিকে। এই প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।
.
রাত তখন অনেক। সারফারাজ বিছানার এদিক থেকে ওদিক ঘুরপাক খাচ্ছে। তার ঘুম আসছে না। ওভাবে পায়েসের বাটি থেকে মুখ সরিয়ে ফেলা যেন মোটেও উচিত হয়নি। অর্নিলার খারাপ লেগেছে নিশ্চয়ই। কে জানে? এমনটা সে কেন করল? কোন কারণে?
বিছানা থেকে এক ধরণের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। খুব পরিচিত লাগছে। হঠাৎ উঠে বসল। হাত দিয়ে বিছানা ছুঁয়ে দেখল। চমকে উঠল সে। অর্নিলা মিথ্যে বলে নি। রাতের পর রাত অনি এইখানেই ঘুমিয়েছে। তার অস্তিত্ব মিলছে। কিন্তু আজ রাতে অনি তার ঘরে ঘুমায় নি। সে বোধহয় ওই পাশের ঘরেই আছে। ঘর তো অনেক ছিল, তাহলে রাতের পর রাত এই ঘরে অনির থাকার কারণ কি? কেন করছে সে এমন? এমন আহ্লাদী করে পায়েস রেঁধে খাওয়ানো, ঘরোয়া মেয়ে হয়ে উঠা, নিজের স্বভাব সাজগোজ সব বদলে ফেলা এসব অনি কার জন্য করছে? তার জন্য? ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারছে না সে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরে খানিকক্ষণ পায়চারি করে বের হয়ে গেল। বাড়ির সব আলো বন্ধ। বাবার স্টাডি রুমের আলোও বন্ধ। সারফারাজ একা একা ঘরে পাইচারি করছে। কি মনে করে রান্নাঘরের কাছে ঠেকল সে। আলো জ্বেলে আশপাশ খুঁজতে লাগল। পায়েসের বাটি পাওয়া গেল। একটা চামচ দরকার। চামচে করে খানিকটা মুখে দিয়ে সামনে ফিরতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল সারফারাজ। ইতস্তত বোধ করতে লাগল সে। সামনেই অনি দাঁড়ানো। তার হাতে পায়েসের বাটি। মুখে চামচ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অনি অতি মিষ্টি স্বরে বলে উঠল, ”ফারাজ ভাই, কি করছেন?”
#চলবে….