#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩২
পুলিশ কমিশনার সালাউদ্দিন সাহেবের কেবিনে অর্নিলা কে বসিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন এর পুলিশ কমিশনার। তদন্তের খাতিরে মোহনগঞ্জ আসা। এখানকার থানায় অর্নিলা কে নিয়ে আসা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। এখানকার ওসি লিয়াকত হোসেন বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সালাউদ্দিন সাহেব খুবই নরম স্বরে বলেছেন, মিসেস অর্নিলার সাথে তিনি একা কথা বলতে চান। লিয়াকত হোসেন কেবিনের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে দেখল সারফারাজ শেহদাত ভেতরে এসে পড়েছেন। তাকে যথেষ্ট রাগান্বিত মনে হচ্ছে। রিটায়ার্ড জজ আরিফ হাসান কে সকলেই চেনে জানে। তার সম্পর্কে সবার ধারণা স্বচ্ছ ধরণের। তাই সারফারাজ শেহদাত কে নতুন করে চেনার কিছু নেই। লিয়াকত হোসেন এগিয়ে গেলেন তার দিকে। সারফারাজ কে চেয়ারে বসতে বলে মাথা ঠান্ডা করতে বললেন। ভেতরে তাদের কথা শেষ না হওয়া অবধি তিনি যেতে পারবেন না।
“মিসেস অর্নিলা। কি খাবেন বলুন?”
“পানি।”
“শুধু পানি। চা, কফি ঠান্ডা কিছু..
“না দরকার নেই।”
“আচ্ছা নিন।”
পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন সালাউদ্দিন সাহেব। অর্নিলা পুরো পানির গ্লাস শেষ করে ফেলল। অনেক শরীর খারাপ করছে তার। সালাউদ্দিন সাহেব মুচকি হেসে শুধালেন, “আপনি কি অস্বস্তি বোধ করছেন মিসেস অর্নিলা।”
“জি, আমার শরীরটা ভালো নেই। আপনি কি জিজ্ঞেস করবেন দ্রুত করুন।”
“অবশ্যই।” টেবিলের উপর তিনটে ছবি রাখল। “ছবি গুলো জীবন্ত তবে মানুষ গুলো মৃ/ত!” ফট করে কথাটা হেসে বললেন, “চিনেন এদের?”
অর্নিলা মাথা দুলাল। সালাউদ্দিন সাহেব অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেন। আবারো শুধালেন, “এরাই তো আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল।”
“হ্যাঁ!”
সালাউদ্দিন সাহেব মৃদু হাসলেন। চেয়ারে আরাম করে বসে বললেন, “আপনার চাচাতো ভাইয়ের কেস টা এখনো ঝুলে আছে। তার সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েই আসছে। ইয়াতিম শিকদারের কাছেই শুনলাম, আপনি কিড/ন্যাপ হয়েছিলেন। অথচ তার আগে আপনার হাসব্যান্ডের সাথে দেখা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করার তিনি বললেন, আপনি নাকি মোহনগঞ্জ বেড়াতে গেছেন। এরপর আপনাকে টাকার বদলে উদ্ধার করা হলো। আপনি সহী সালামত ফিরে এলেন। কিন্তু লোকগুলো মা/রা গেল। তিনটে লোক!”
“হ্যাঁ, তাদের মৃত্যুর খবর আমি টিভিতে দেখেছি।”
“যাক বেশ ভালো। তাহলে আপনি তো জানেনই তাদেরকে খু/ন করা হয়েছে। খু/ন করার টেকনিক কিন্তু অভিনবভ। তাদের মৃ/ত্যুর পর চারদিকে শুধু ছড়িয়ে রাখা টাকাই পাওয়া গেছে। যা হিসাব করে দেখলাম প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। আপনি কি জানেন আপনার মুক্তিপণ কতো ছিলো?”
“না।”
“জানেন না। আচ্ছা। ইদানিং খুব গরম পড়েছে খেয়াল করেছেন মিসেস অর্নিলা। এসির রুমে বসেও আপনি ঘামছেন।”
”হুম। আপনি প্রশ্ন করুন। কথা ঘুরানোর দরকার নেই।”
“না না। আমি কথা ঘুরাচ্ছি না। মৃত্যুর পর তাদের সকল জিনিস পুলিশি হেফাজতে আছে। তাদের পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে সায়ানাইড বিষ দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই বিষ আসলো কোথা থেকে?”
“সেটা বের করা তো আপনার কাজ।”
“আমরা তো সেই কাজই করছি ম্যাডাম।”
”অদ্ভুত। তিনজন ক্রিমিনাল এর খুনে/র তদন্ত করছেন এতো উতলা হয়ে।”
“অবশ্যই ম্যাডাম। যেই তিনজন খুন হয়েছে তারা ক্রিমি/নাল। তবে তাদের যে খু/ন সে আরো বড় ক্রিমিনাল। তারা তিনজন মিলে একজনকে খু/ন করেছিলো আর কোন একজন সেই তিনজনকে মে/রে ফেলার ফন্দি এঁটে ছিল। আপনিই বলুন। কে ভয়ং/কর!”
“এখানে আমার যোগ সুত্র এলো কি করে?”
“সব জায়গায় তো আপনিই ম্যাডাম। আপনার ভাইয়ের কেসে প্রথমে আপনি, এখানেও আপনি। কেনো জানো মনে হচ্ছে দুটো কেসের পেছনে একজনই আছে।
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন?”
“চটবেন না ম্যাম। আপনাকে আমরা চটাতে চাই না। এমনও হতে পারে, আপনার অজান্তে আপনার কোন পাগল প্রেমিক এমনটা করছে। যারাই আপনার ক্ষতি করতে চাইছে তাদের সরিয়ে দিচ্ছে। ভেবে দেখেছেন ব্যাপারটা।”
“আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন। কি যা তা বলছেন। আমি ম্যারিড। আমার প্রেমিক আসবে কি করে।”
”সেটাই তো। একজনই তো আছে।”
“কার কথা বলছেন আপনি?
“উত্তেজিত হবেন না মিসেস অর্নিলা। বসুন আপনি। খু/ন কি করে হলো সেটা শুনুন। খুনে/র কারণ তো সায়ানাইড বিষ। কিন্তু এই তিন কেঁচো কিভাবে এই বিষ পেলো সেটা জানবেন না।”
অর্নিলা বিরক্ত মুখে বসে পড়ল। তার গা গুলিয়ে যাচ্ছে। কেমন অস্থির বোধ হচ্ছে। খুব গরম লাগছে। অথচ রুমে এসি চলছে। কি অদ্ভুত! সালাউদ্দিন সাহেবের সব কথা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সালাউদ্দিন বলতে শুরু করলেন, “আমরা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান করে গেছি। কিছু পাই নি। শেষে যা পেলাম তা দেখে আমরা হতভম্ব। এতো বুদ্ধি এতো মাথা খাটিয়ে কাউকে মা/রার প্ল্যান করা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাদের, গনি এদের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টাকা গুলোর উপর ছড়ানো ছিল সায়ানাইড। তরল সেই বিষাক্ত পদার্থ টাকার উপর সাবধানে ছড়িয়ে দেয় সেই ক্রিমিনাল। আর যখন সেই টাকা কাদের আর ওর দুই লোক ছুঁয়ে দেখে। টাকা গুনতে দিয়ে আঙ্গুল চাটে তখন এই বিষ তাদের শরীরে ছড়িয়ে যায়। আর তাদের অজান্তেই তারা মা/রা যায়। কি ভয়া/নক মৃত্যু!”
”এসব আপনি আমায় কেন বলছেন।”
“কারণ সেই টাকাগুলো ছিলো আপনাদের দেওয়া টাকা গুলো!”
“কিসব আজেবাজে বলছেন আপনি। কতো টাকা দেওয়া হয়েছে তাও আমি জানি না। আপনি নিজের মতো একটা গল্প বানিয়ে দিলেই তো হলো না। আমি তাদের থেকে ছাড়া পাওয়ার তিন কি চারদিন পর তারা মারা গেছে। তো আপনি কি বলতে চাইছেন, এই তিন চারদিন তারা বসে ছিল। টাকা গুলো নিয়ে মাতামাতি করেনি। এমনো তো হতে পারে, এর মধ্যে তারা আরো একজনকে কিডন্যাপ করে তার থেকে টাকা গুলো হাতিয়ে নিয়েছে।”
”মনগড়া গল্প তো আপনি বানাচ্ছেন মিসেস অর্নিলা!”
“হ্যাঁ, ঠিক আপনার মতো। আপনি প্রমাণ যুক্তি ছাড়া নিজের মন মতো গল্প বানিয়ে আমায় শুনাচ্ছেন। অনেক হয়েছে। মনে হচ্ছে না আপনার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। আমি উঠলাম!”
অর্নিলা উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে এসে পৌঁছাতেই ফারাজ কে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সালাউদ্দিন সাহেব সারফারাজ কে দেখে একগাল হাসলেন।
.
থানার বাইরে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। সালাউদ্দিন সাহেব গরম চায়ের কাপে চুমুক দিলো। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। চায়ের দোকানে একটা আলো জ্বলছে। সেই আলোর তেজ আবার ওতো না। দোকানে লোকজন কম। সারফারাজ চায়ের কাপে চুমুক দিলো। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চায়ে স্বাদ নেই। না আছে চিনি না মিষ্টি। পানসে লাগছে।তবুও খাচ্ছে। সালাউদ্দিন সাহেব কেশে উঠলেন। বললেন, ”চায়ের স্বাদ নেই ডা. সারফারাজ। তবুও দেখছি ভালোই আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছেন।”
“আপনি এতো করে অনুরোধ করলেন তাই।”
”আমার জীবনে প্রথম আমি কোন ক্রিমিনালের সাথে দাঁড়িয়ে এতো ধৈর্য্য সহকারে চা খাচ্ছি। ভালো এক্সপেরিয়েন্স। মন্দ নয়,জীবনে সব রকমের এক্সপেরিয়েন্স থাকতে হয়।
সারফারাজ জবাব না দিয়ে চায়ের কাপে আবারো চুমুক দিলো। সে চাইছে দ্রুত চায়ের কাপ শেষ করতে। অর্নিলা কে গাড়িতে বসিয়ে এসেছে। তাকে কেমন জানি ঠিক লাগছে না। সালাউদ্দিন সাহেব বলে উঠলেন,
“আমি জানি ক্রিমিনাল কে? অথচ ধরতে পারছি না। ডা. সারফারাজ। আমায় একটু বুদ্ধি দিতে পারেন।”
“আপনি কি চাইছেন?”
“জানতে চাইছি। আপনি ঠিক কতো বুদ্ধিমান! বলে না চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন!”
সারফারাজ খালি চায়ের কাপ টেবিলে রাখল। শান্ত স্বরে বলে উঠল, “আপনার কাছে কোন প্রমাণ নেই। আপনি শুধু ধারণার উপর কথা বলছেন।”
”আপনিও তো সবটা ধারণার উপরই করলেন ডা. সারফারাজ। টাকার উপরে আপনি সায়ানাইড ছড়িয়ে দিলেন। মাঝের টাকাগুলোয়। ব্যাপারটা এমন তারা যেন টাকা গুলো পেয়েই খরচ করলে অন্যের ক্ষতি না হয়। এর মধ্যে অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে। সাংঘা/তিক কাজ। আপনার মনে বিন্দুমাত্র দয়ামায়া নেই সারফারাজ। ডাক্তারের দয়া মায়া থাকতে হয়।”
সারফারাজ কিঞ্চিত পরিমাণ হাসল। আলোর মাঝে তার হাসি অস্পষ্ট দেখালো। সালাউদ্দিন সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। সারফারাজ বলল, “আপনি এখনো অনেক দূরে আছেন সালাউদ্দিন সাহেব। তবে যতোই এগিয়ে যান না কেন? লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন না।”
“কি বলতে চাইছেন?”
সারফারাজ কথা বাড়ালো না। ফোন টা বেজে উঠল। আইজিপি সানাউল হকের ফোন। সালাউদ্দিন সাহেব বোধহয় ঘাবড়ে গেলেন। সারফারাজ বিদায় না দিয়ে চলে এলো। ফোন ধরতে ওপাশ থেকে কতো গুলো কথা একনাগাড়ে কেউ বলে গেল। ফোন রেখে দিলেন তিনি। হ্যাঁ, হুঁ ছাড়া আর কিছু বলার ছিলো না। বিরস মুখে বসে পড়লেন। তার সহযোগী তার পাশে এসে বললো, “কিছু হয়েছে স্যার?”
”স্যার ফোন করেছিলেন।”
“কি বললেন?”
“এই কেস থেকে আমাদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তদন্ত এবার তিনি করবেন।”
সহযোগী শব্দ করে শ্বাস ফেলে বললেন, “এটা হবার ছিলো। আরিফ হাসানের যথেষ্ট চেনাজানা আছে। নাম ডাক ও আছে।”
“তাই বলে একটা ক্রিমিনা/লকে এভাবে ছেড়ে দিবো।”
“স্যার, দুঃখ পাইয়েন না। এই ক্রিমিনাল যাদের ধরছে তারা কেউই ভালা মানুষ না। নিয়াজ শিকদারের নামেও ভালো কিছু শুনি নাই।”
*তুমিই যাই বলো। আমি তার পিছু ছাড়ছি না। ওকে তো আমি ধরেই ছাড়ব।”
সহযোগী হাসল। তার মনে হয় না স্যার কিছু করতে পারবে। কারণ এই ক্রিমিনাল খুব চালাক। তাদের থেকেও দুই পা এগিয়ে!
.
গাড়িতে অর্নিলার অবস্থা আরো খারাপ করতে লাগলো। মাঝপথে সারফারাজ গাড়ি থামিয়ে দিল। পানির বোতল বের করে দিল অনিকে। অনি মুখ হাত ধুয়ে নিল। পানি খেল। তবুও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে তার। হঠাৎ বমি করতে শুরু করল। এরপর আরো ক্লান্ত হয়ে গেল। সারফারাজ চিন্তায় অস্থির! হঠাৎ এতো অসুস্থত! সারাদিন এই তীব্র গরমের কারণে নয় তো আবার।
বাসায় ফিরে এলো। কারো সাথে কোন কথাবার্তা হয়নি। এমনকি রাতে খাবার ও খেলো না। জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। সারফারাজ সারারাত তার পাশে শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদে হাত পা ধরে দেখল। না ঠান্ডাই তো। জ্বর টর আসেনি। গালে হাত রেখে জাগানোর চেষ্টা করল। না গভীর মুখে আচ্ছন্ন। আর ঘামছে না। ভয়ের কোন কারণ নেই তবুও সারফারাজের চোখে ঘুম নেই। শেষ রাতে ঘুমালো সে। পরদিন উঠতে উঠতে সকাল ১০ টা পার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ কচলালো। এতোক্ষণ ঘুমালো। কেউ ডাকলো না তাকে। অনি কোথাও? অনি! এই অনি!
বিছানায় অনি নেই। বাথরুম থেকে আওয়াজ আসছে। সারফারাজ এগিয়ে গেল। বাথরুমের দরজা খুলে দাঁড়াল অনি। দুইজন মুখোমুখি। সারফারাজ ঘাবড়ে গেল। অনি কাঁদছে! কেন? এই অনি? কাঁদছিস কেন? আচমকা সে জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা রেখে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। সারফারাজ বুঝল না বটে। হঠাৎ করেই যেন একটু আনমনা হয়ে গেল। অনি আবারো বলল, “আপনি বাবা হবেন। শুনছেন!” কানে সেই মধুর কণ্ঠ ঠেকল। তার সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। বিস্ময়ে বিমূঢ় সে। অনি লজ্জায় হেসে কুটকুট। সারফারাজ এখনো হতভম্ব!
#চলবে