চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-৩১

0
485

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩১

অর্নিলা হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে ছাদে এসে পৌঁছাল।ফারাজ ভাইয়ের খোঁজ তো পেলো না। কিন্তু অন্য আরেকজনের খোঁজ ঠিকই পেলো। ছাদে এক নজর ফিরে চলে যাবে অমনি নজরে এলো আরাফাত কে। আরাফাত ছাদে! কার সাথে? চোখ বুলিয়ে দেখল, পাশে এক মেয়েও আছে। এটা আবার কে? আরাফাত কে কোন মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু যেন অবাকই হলো। সচরাচর তো আর দেখা মিলে না। কিন্তু দুজন এখানে একা। নির্ঘাত কোন চক্কর আছে। তৎক্ষণাৎ লুকিয়ে পড়ল সে। ব্যাপারটা ঘেঁটে দেখা দরকার। দেখে তো মনে হচ্ছে আরাফাত মেয়েটিকে শাসাচ্ছে। হুঁ হুঁ লক্ষণ ভালো মেলছে না। দু এক সেকেন্ড পরই মেয়েটার গালে চ/ড় ও পড়ল। অর্নিলা চোখ বন্ধ করে মুখে হাত দিল। সত্যি সত্যি আরাফাত মেয়েটিকে চড়/ মারল। বিশ্বাস হচ্ছে না। ফারাজ ভাই আজ অবধি তার গায়ে হাত তুলে নি। আর এখানে আরাফাত তো দু পা এগিয়ে। আপন ভাই হলে কি হবে? দুজন দুই মেরুর। তাই বলে মেয়েটা কে এভাবে মার/বে। আরাফাত হন হন করে এদিকেই আসছে । অর্নিলা দ্রুত নিচে নেমে পড়ল।

হিসাব কষছে। মিলছে না! এখানে তার অজান্তে অনেক কিছুই চলছে। এখানে কেউ প্রেম করে বিয়ে করে ফেলেছে আরেকদিকে আরেকজন মেয়েকে চ/ড় মারছে। বাহ, চারদিকে দেখি প্রেমের মৌসুম। এরপর আবার কেউ বাচ্চার মা ও হয়ে যাচ্ছে। সে তো দেখি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওই তো! ওখানে ফারাজ ভাই। ছুটে গিয়ে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। ফারাজ চোখ দিয়ে ইশারা দিচ্ছে। কি হলো আবার? চারদিক ঘুরে দেখল সবাই গোল হয়ে বসে আছে। বৈঠক বসেছে মনে হচ্ছে। বড় ফুপু হেসে বলছে, “ছেলে আপনাদের এখানকার। ভাবলাম দেখাদেখির কাজটা এখানেই শেষ হোক। শুভ কাজে দেরি কি। আপনারা ও ছেলে দেখে বললেন, ছেলে কেমন?”

আরিফ হাসান হেসে বললেন, “বেশ, তো। আপনার মেয়ে আমার মেয়ে কি বেয়াইন। আপনি যা বলবেন তাই। মেয়ের পাকা দেখা এখানেই হবে। আপনি খালি ছেলেদের আসতে বলুন।”

অর্নিলা এদিক ওদিক ফিরে শুধালো,
“ছেলে আসবে? কাকে দেখতে?”

“কাকে আবার? আনিতা কে দেখতে।”

“আনিতা!” থতমত খেয়ে গেল অর্নিলা।‌ এরই মধ্যে আরাফাত হন হন করে নিচে এসে দাঁড়াল। পিছন ফিরে দেখল দূরে আনিতা দাঁড়ানো। চড়ের কারণ এখন বোঝা যাচ্ছে। ফারাজ ভাইয়ের হাত টেনে ধরে কানে কানে বলল, “এই শুনুন!”

“কি?
“ঘরে চলুন, কথা আছে।
“কি কথা? কি হয়েছে এখন আবার।
“চলুন না।

হেনে হিচড়ে ফারাজ কে ঘরে নিয়ে গেল অর্নিলা। দরজা বন্ধ করে ফারাজের হাত চেপে বলল, “জানেন কি হয়েছে?”
“কি?
“আরাফাত প্রেম করছে।
“হ্যাঁ, কি বললে!
“হ্যাঁ, সত্যি। ওই আনিতার সাথে। আনিতা কে দেখতে ছেলে আসবে না। মনে হচ্ছে ওদের মাঝে ঝামেলা হচ্ছে।”
“তুমি এসব জানলে কিভাবে?
“ওই আমি ছাদে দেখলাম দুজনকে। আপনি প্লিজ কিছু করুন।
“কি করবো?
“কি করবো মানে? ছেলেটার প্রেম ভেঙে যাচ্ছে। বড় ভাই হিসেবে কিছু একটা তো করুন।

ফারাজ মুখ ভেংচি কাটলো। আর কিছু! এখন ছোট ভাইয়ের প্রেম সামলাতে হবে তাকে। “দেখি” বলে বেরিয়ে গেল। ফারাজ বেরিয়ে যাবার পর বাচ্চার কথা মনে পড়ল। কপাল চাপড়ালো। ইশ! সময় থাকতে কেন যে কিছু মনে থাকে না তার!
.
ছেলেরা আজ আসবে। সকাল থেকেই গৃহিণীরা তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। দুপুর থেকে পিঠে বানানো। ছেলে তো দেখতে আসবে শুধু তবুও যেন এলাহী কাণ্ড। অর্নিলা, শ্রেয়মী নিজ হাতে আনিতা কে সাজিয়ে দিয়েছে। তার বাদামী রঙের শাড়িটা আবারো পরিপাটি করে দিচ্ছে। বেচারির মুখ শুকনো। শ্রেয়মী নিচু হয়ে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে দিচ্ছে। পর্দার আড়ালে দরজার ওপাশে কারো ছায়া যেন পড়ল। অর্নিলা উঁকি মেরে চাইল। হেসে বলল, “আরে আরাফাত! আয় দেখ দেখ, আনিতা কে কেমন লাগছে? বল তো। ছেলে পক্ষ পছন্দ করবে কি না”

আরাফাত তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোয়াল শক্ত করল। ধারালো কণ্ঠে বলল, “সে তোমরা জানো। আমি কি জানি?” বলার পর আবারো হন হন করে চলে গেল। শ্রেয়মী উঠে দাঁড়িয়ে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ওর আবার কি হলো?”
“কি জানি!” বলে ফিরল আনিতার দিকে। বেচারীর চোখ দুটো ছলছল করছে। আহা কি প্রেম!

ছেলে পক্ষ আসবে আসবে করে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা পাড় হয়ে গেল। অথচ ছেলে পক্ষের কোন নাম গন্ধ নেই। আরাফাত সোফায় গম্ভীর মুখে বসে আছে। অর্নিলা পাশে বসে বলল, “কি ব্যাপার বল তো। ছেলে পক্ষ কেন আসছে না।”

“আমি কি জানি। আমায় কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
“তাই। কিছুই জানিস না। আবার হুমকি দিস নি তো। তোকে তো আবার বিশ্বাস নেই।”
আরাফাতের চাহনি এবার খানিকটা নড়বড়ে। এদিক ওদিক ফিরে ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি কিছু করিনি।”
“সত্যিই কি তাই।”
”অবশ্যই তাই। আর ছেলে পক্ষ এলেই কি বিয়ে হয়ে যাবে নাকি?”
”হুমম তাও বটে।”

বলে পিছন ফিরল। বাড়ির বড়রা অনেক দুশ্চিন্তা করছে। ফারাজ ভাই সেই কখন থেকে ফোনে ট্রাই করছে। কিন্তু ফোন লাগছে না। কোথায় গেলেন তিনি। এদিক ফিরে আরাফাতের সাথে চোখাচোখি হতেই আরাফাত চোখ সরিয়ে নিল। অর্নিলা তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ”বুঝলি, আমার থেকে কিছু লুকানো এতো সহজ না।”
“বুড়ি! তুই কিন্তু বেশি বলছিস।
“কিছুই তো বলি নি এখনো। এবার বলব।” বলেই কান টেনে ধরল।
“এই কি করছিস!”
*তোর বড় ভাইয়ের বউ আমি। সম্পর্কে তোর ও বড়।”
“হ্যাঁ, তুই তো বুড়িই।“
“হ্যাঁ, আমার অধিকার আছে। আর যদি কখনো দেখি না ওকে চ/ড় মারতে তাহলে একদম মামার কাছে গিয়ে বলে দিবো বুঝলি!”

আরাফাত পরক্ষণেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। নিরবে মাথা দুলাল। মুচকি হাসল অর্নিলা। ফারাজ ভাই ফোন হাতে এগিয়ে এসে বলল, “ছেলেরা নাকি আসবে না। তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে।”
ছোট ফুপু মুখ ভেংচি কেটে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ”অ্যাহ অসুস্থ নাকি অজুহাত। আসবে না তাই বলে এখন অজুহাত দিচ্ছে। কেন? সকালে জানিয়ে দিলেই তো হতো। এতোক্ষণ ধরে যে বাড়ির মেয়েরা এতো কিছু করল এসবের কোন দাম নেই! কি গো আপা! এই ছেলে খুঁজলে তুমি! এ কেমন বংশের ছেলে।”

শাহিনুর বেগম তার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আহা আপা! আপনি শান্ত হন না।”
“আর শান্ত। সারাদিনের পরিশ্রম সব জলে গেল।”
“জলে কেন যাবে? বাড়ির লোক কি কম আছে। ফারাজ! কবে আসবে কিছু বলল?”
বড় ফুপু হুট করে দাঁড়িয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আর আসার দরকার নেই। এমন ছেলের কাছে আমি মেয়ে বিয়ে দিবো না। কখনোই না!” উঠে চলে গেলেন তিনি। অর্নিলা হাতে আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসাল। রুদমিলা আর তার বর কথা বলছে। তাই তো, বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে এটা তখনি জানাত। আসবে সেই বিকেল বেলা। এখন রাত পেরিয়ে গেছে। এতোক্ষণে কি সময় হয়নি কথাটা জানানোর। আরো ফোন করে জানতে হচ্ছে। সবকিছুই কেমন যেন অদ্ভুত। ছেলেরা বোধহয় আসতোই না। আরাফাত এর মধ্যে চট করে উঠে দাঁড়াল। অর্নিলা মিটি মিটি হেসে ফিসফিস করে বলল, “ছাদে আছে!”

ফারাজ আরাফাতের জায়গা দখল করে বসে পড়ল। অর্নিলা শুধায়, ”আপনি কিছু করেছেন?”
“আমার‌ ভাই থাকতে আমি কেন?”
“আরাফাত এই কাজ ও জানে।”
“হু মাল্টি টেলেন্টড!”
আচমকা হেসে উঠল দুজন। গম্ভীর এই পরিবেশে দুজনের হাসি দেখে হকচকিয়ে গেল প্রত্যেকে!
.
ছাদের এক কোনে আনিতা দাঁড়িয়ে। চোখের অশ্রু গাল বেয়ে পড়ছে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর সবোর্চ্চ চেষ্টা করছে। আরাফাত পাঞ্জাবি পকেট থেকে এক হাত বের করে আনিতার থিতুনিতে হাত রাখল। মৃদু স্বরে বলল, “সুন্দর লাগছে।”

“দেখি সরো।”
”আহা রাগ করলি নাকি।”
”কথা বলবে না তুমি। কাল কি জোরে আমায় চ/ড় মারলে।
“মারব‌ না। তুই কেন ঢং করে বলতে গেলি, জানো আমায় দেখতে ছেলে আসবে। কি খুব শখ হয়েছিল নাকি সেজেগুজে ছেলের সামনে যাওয়ার জন্য।”
”আমি মোটেই ঢং করে বলিনি। যেটা সত্যি সেটাই বলেছি। আম্মা বলেছে ছেলে দেখতে আসবে। আমি তো সেটাই বলেছি।‌আমার কি দোষ বলো।” কান্নার আওয়াজ বাড়তে লাগল। আরাফাত এবার অন্য হাত দিয়ে গাল আকড়ে ধরল। চুমু খেল ভিজে ঠোঁটটাতে। নিজের ঠোঁট চেটে বলল, “তোর ঠোঁট এতো নোনতা নোনতা কেন?”
”মানে?”
“ও কেঁদেছিস তো তাই এমন মনে হচ্ছে। যা আমার মুখের টেস্ট খারাপ করে দিলি।”
“থাক, তাহলে আর কষ্ট করে চুমু খেও না। সরো, যেতে দাও আমায়।”
“আরে আরে, আমি তো মজা করছিলাম।”
“না, আমি চলেই যাবো।”
“কোথায় যাবি? শোন না!”

বলেই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। দুজনের রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। আচমকা পাশ থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে এলো। দুজন থতমত খেয়ে তাকাল। স্বয়ং আরিফ হাসান দাঁড়িয়ে। তাকে দেখামাত্র দুজন নিস্তেজ হয়ে গেল। আরাফাত হাত ছাড়িয়ে নিল। আরিফ হাসান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “তোমরা দুজনে আমার স্টাডি রুমে আসো!”
বলামাত্র চলে গেলেন। রক্তশূন্য চাহনিতে দুজন কপোত কপোতী দেখছে দুজনকে। আজ কি যে আছে!!
.
অর্নিলার ভারী টেনশন হচ্ছে। টেনশনে সে হাতের নখ কামড়াচ্ছে। ফারাজ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “থাম না। এতো টেনশন কেন করছিস?”
“করবো না! বড় ফুপু ভেতরে। আপনি জানেন না তিনি কি মারাত্ম/ক।
”আচ্ছা দেখ না। ব্যাপারটা হ্যান্ডেল হয়ে যেতে পারে।
”কি করে? ছেলে পক্ষ আজই আসেনি। আজই ওদের ধরা পড়তে হলো। আচ্ছা, মামা যদি জিজ্ঞেস করে, আরাফাত ই কিছু করেছে কি না। তখন?”
“তখন আর কি! আরাফাত হ্যাঁ বলবে। এভাবে বাবার সামনে মিথ্যে বলতে পারে না। তবে কথা লুকাতে ওস্তাদ।
“মজা করছেন।”
“তুই থামবি।
”উফ আমার আর ভালো লাগে না। এদিকে বাচ্চার টেনশন অন্যদিকে ওদের টেনশন। ঝামেলায় পড়ে গেছি আমি।”
”বাচ্চার টেনশন?”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ফারাজ। অর্নিলার মনে পড়ে গেল কথাটা। দ্রুত উঠে এসে খাটের উপর বসে পড়ল। দু বার দম নিয়ে ফারাজ ভাইয়ের হাত ধরে বলল, ”মন দিয়ে শুনবেন হ্যাঁ!”
“কি?”
“আমি…
কলিং বেলের শব্দ। ঠোঁট চেপে ধরল। আর কথাটা শেষ করা হলো না। এখন আবার কে এলো? উঠে এসে দরজা খুলল অর্নিলা। তার পিছু পিছু সারফারাজ। স্টাডি রুম থেকে আরিফ হাসান, আরাফাত, আনিতা, বড় ফুপু তারাও বেরিয়েছেন। অর্নিলা সেদিক একবার ফিরে সামনে তাকাল। বিস্মিত সে! সালাউদ্দিন সাহেব এখানে।

“আপনি!
“কেমন আছেন মিসেস অর্নিলা!”
“কি ব্যাপার? আপনারা এখানে?”
সারফারাজ এসে দাঁড়াল পিছনে। আরিফ হাসান ও এলেন। সালাউদ্দিন সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ”আপনাকে যে আমাদের সাথে যেতে হবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আশা করি আপনিও কোওপারেট করবেন।”
“আমি!”
“হ্যাঁ, আপনি। কিছুদিন আগে আপনি কিডন্যাপ হয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ!
“ধন্যবাদ সত্যিটা বলার জন্য। নাহলে আপনার বর তো! যাক গে, এখন যখন বলেই ফেলেছেন তবে চলুন।”

আরিফ হাসান কিছু বলতে যাবেন অমনি সালাউদ্দিন সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমাদের কাছে উপর থেকে অর্ডার আছে।‌ আপনিও তো আইনের লোক। আশা করি বুঝবেন। আর ডাঃ সারফারাজ শেহদাত। স্ত্রী যেহেতু যাচ্ছে আপনিও তো আসবেন। সেখানেই আপনার সাথে কথা হবে। মিসেস অর্নিলা। আপনি চলুন!”

দুজন মহিলা এসে অর্নিলা কে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। সে কিছু বুঝল না। বার বার পিছন ফিরে চাইতে লাগল। সারফারাজ ইশারায় শেষমেষ আশ্বাস টুকু তাকে দিতে পারল না!

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে