চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-৩০

0
456

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩০

অনি সারফারাজের বুকের উপর শুয়ে আছে। আধশোয়া সারফারাজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “অনি,‌‌কি হয়েছে তোর?”
“ভীষণ ভয় লাগছে ফারাজ ভাই।”
“কেন? ভয় করছে কেন?”
“ওরা মা/রা গেল! কিভাবে মা/রা গেলো? কি আশ্চর্যজনক মৃ/ত্যু তাদের।”
“এতে তুই কেন ভয় পাবি? তোর কি কিছু হয়েছে?”
“জানি না ফারাজ ভাই।‌ আমি কেবল জানি আমার খুব ভয় হচ্ছে।”

ভয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিল অর্নিলা। রাত তখন বেশ গভীর। খাটের কোনে ল্যাম্পশেডের আলোখানি জ্বলছে। সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে গেল। অনির দিকে ফিরে ভাবতে লাগল।‌ মৃদু স্বরে হেসে বলল, “ঘুমিয়ে পড় অনি। এখন আর ভয়ের কোন কারণ নেই। তারা বেঁচে নেই। আর কেউ তোকে ভয় দেখাতে পারবে না।”
অনি মাথা তুলে এদিকে ফিরে চাইল।‌ সারফারাজ মৃদু হেসে চুল গুলো কানে গুঁজে দিল। এই যে এতোখানি ভালোবাসা! উন্মাদনা! এসব কি অনি টের পাচ্ছে? তার চোখের পাতা কেমন অদ্ভুত ভাবে নড়ছে। টের না পাওয়াই ভালো। অনি ভয় পেয়ে যাবে। তার এই ভদ্র, সহজ, সরল ফারাজ ভাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ। সে কি আর জানে, ফারাজ ভাই তার জন্য কি কি করতে পারে। না জানাই ভালো। সুস্থ মানুষের কাছে এসব অসুস্থতা বলে প্রমাণ পায়। কিন্তু সে তো অসুস্থ নয়। শুধু সহ্য হয় না। তার অনিকে কেউ কিছু বললে তার সহ্য হয় না।‌ এমন তো আগে ছিলো না! অনির ভালোবাসা তাকে উন্মাদ করে ছেড়েছে! “অনি! অনি আমি তোকে বলেছি, আমার ভালোবাসা হচ্ছে চৈত্রের মতো! তার মতোই ভয়ং/কর চারদিক। সবাই তৃষ্ণার্ত হয়ে রয় চৈত্রের রোদে।‌আমার‌ ভালোবাসা মুক্তি পায় সে রোদে।‌ ঝলসানো সেই রোদের তাপে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভালোবাসা পুড়ে হয় আরো পবিত্র। সেই ভালোবাসার উন্মাদনা ছড়িয়ে যায় সমস্ত শরীরে! আমি যে ভালোবাসি! ভয়ং/কর ভাবেই ভালোবাসতে জানি। অনি!”

“কিছু বললেন?”
“হ্যাঁ, কি?”
”বললাম কিছু বললেন/? মনে হলো আপনি‌আমায় ডাকলেন!”
“না তো? এমন কিছু না।”
”এমন করে কেন চেয়ে থাকেন?”
“কেন? তোর ভয় হয়?”
অর্নিলা মুখ টিপে হাসে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ”না তা কেন? বরং আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে করে। জানেন, এতোদিন তারা আমার স্বপ্নে এসে ভয় দেখাত। এখন আর আসবে না বলুন।”
“একদম আসবে না। আমি আসতে দিবো।”

অনি শব্দ করে হাসে। সেই হাসির স্বরে তার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। হৃৎস্পন্দন চলে নিম্নগতিতে। এ যেন ম/রে গিয়েও সুখের দেখা মিলে।
.
পরদিন চারজন মিলে জড়ো হলো নিকুঞ্জ নিবাসে। আরিফ হাসান অর্নিলা কে স্বচোখে দেখে শান্তি পেলেন। শাহিনুর বেগমের চোখ জুড়াল। ছোট ফুপুর কবিরাজিতে ভয়া/বহ বিশ্বাস। কি সব তাবিজ আনিয়ে অর্নিলা কে পড়িয়ে দিচ্ছে। বড় ফুফু গালমন্দ করে বলছে,‌“ধু্র ধুর! ছাড়তো। কি আনলি এসব? এসবে কোন কাজ হয়? টাকা নষ্ট সব।”

“না গো আপা। এ অনেক বড় একখান কবিরাজ। ঢাকা শহর থেকে আনাইছি।”
“কেন রে? এখানে কি কম পড়ছে নাকি? বেক্কল একটা!“
ছোট ফুফু মুখ ভার করে ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখেতে অশ্রু টলমল।‌এই রে, কেঁদেই না ফেলে। সবার সামনে এভাবে না বললেও পারতে ফুফু। বড় ফুফু মুখ ভেংচি কাটলেন। ফরহাত মুখ টিপে হাসছে। অর্নিলা চোখ বড় বড় করে না করছে। এই হাসির স্বর ফুফুর কানে গেলেই এখন সর্বনাশ ঘটবে। তিনি কেঁদেই ছাড়বেন। বড় ফুফুও কম না। তার সামনে বসিয়ে দোয়া দরুদ পড়ে মাথায় ফু দিয়ে চলছেন। অর্নিলার বেশ মজা লাগছে। মায়ের অভাব মাঝে মাঝে হলেও এই ফুফুদের জোরে তার পুষিয়ে নেওয়া যায়। অর্নিলা খুব ভাব করে ফুফুর গলা জড়িয়ে ধরল। ফুফু ছ্যাত করে উঠল।‌

“একি? কি করিস?”
“ফুফু, ও ফুফু! আমায় খুব ভালোবাসো না তুমি।”
“দেখ দেখ, দামড়া ছেড়ির কাহিনী দেখ। কেমনে গলা জড়িয়ে ধরে। দেখি ছাড়, দম বন্ধ হইয়া আসে।”
“এমন করো কেন ফুফু? তোমাগো ওইখানে তো গালে চুম্মা ও দেয়। দাও আমি একটা চুম্মা দেই।”
”এই সর সর। আমার লগে একদম এমন ছেচড়ামি করবি না কইলাম। চুম্মা চাটি করা লাগবে না, সর এখান থেকে। সোহাগ যা করোস তোর জামাইয়ের লগে কর।”
অর্নিলা ও বড় মুখ করে বলে ফেলল,
“তা তো করিই!”
বড় ফুফু পিঠে চড় মেরে বললেন,‌”ছিঃ শরম লজ্জা কিছু নাই। বেত্তুমিজ!”

অর্নিলা হেসে উঠল।‌ফরহাত এবার হো হো করে হাসা শুরু করল। শাহিনুর বেগম চা নিয়ে হাজির হলেন।‌সোফায় বসে বললেন, ”নিয়াজ কেমন আছে আপা? ভাইজানের খবর কি?”
“সে আর কি? ভালোই আছে। ছেলের শোক এখনো ভুলতে পারেনাই। পারব কেমনে? দুইটা মাত্র ছেলে। ছোট ছেলেটার এই হাল দেখলে আমারো কষ্ট লাগে। কি যে হইবো ভবিষ্যৎ?”

সারফারাজ ঘরে ঢুকতেই কথা গুলো কানে গেল। ছোট ফুফু দাঁড়িয়ে ধপ করে বললেন, ”এর চেয়ে ভালো হইত মই/রা গেলে। বাইচা থাকাই এখন বড় কষ্ট। এমন পঙ্গু হইয়া থাকা যায়।“
বড় ফুফু ধমকের স্বরে বললেন, “চুপ কর। আমরা এখনো ম/ইরা যাই নাই। দিনশেষে ও আমার ভাই পুত। আমি ছেড়ে দিই কেমনে? তুই পারবি ছাড়তে?”
”তা পারমু না। কিন্তু আপা, তুমি আর যাই কও, নিয়াজ পুরা ভাইয়ার মতোই হইছে। দেখো, বাপের পাপ এখন পোলায় নিছে। বিয়েটা ভাঙছে।”
বড় ফুফু মুখ সরিয়ে নিলেন। আর ভালো লাগছে না এসব নিয়ে কথা বলতে। প্রসঙ্গ বদলিয়ে বললেন, “ভাবী? ভাইজান আসছিলো একবারও?”

“না আপা। ফোন করে তো সবটাই বলেছিলো তিনি। এরপর অনিকে পাবার পরেও তা জানিয়েছে। এই তো, এরপর আর ফোন দেয় নি।”
“ছেলেকে নিয়েই তো আছে মহা ঝামেলায়। কিভাবে আর ফোন দিবে বলো? আমার সাথেও কথা হয়েছিল। যাক, অনি সুস্থ মতো চলে এসেছে। বাড়িতে একটা মিলাদ পড়ালে কেমন হয়?“
“ভালোই হয়।‌ আমিও ভাবছিলাম। ওই এলাকার এতিমখানা থেকে কিছু বাচ্চাদের আনিয়ে খাইয়ে দিতাম।”
“হ্যাঁ, দাও।”
কথাবার্তা শুনে অর্নিলা একগাল হাসে। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান মানেই সবাই আসবে। হ্যাঁ, তার দারুণ লাগছে এসব শুনে।
.
মামা মামী এসেছে। সাথে শ্রেয়মী। রুদমিলা আর তার বর আশিক ও এসেছে। রুদমিলার একটু স্বাস্থ্য হয়েছে। ইরা আপুও এসেছে। নাজিয়া এসেছে। সে কেমন ভয়ে ভয়ে আছে। বিয়েটা ভেঙেছে কিন্তু তার আর ফরহাতের বিয়ের কথা এখনো কেউ জানে না। বাবা জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না। তখন ঝোঁকের বশে বিয়ে করে এখন পস্তাতে হচ্ছে। এছাড়া আরো একজন এসেছে। আনিতা। আনিতা হচ্ছে বড় ফুপুর মেয়ে। বাড়ির বড়রা রান্নাঘরে কাজ করছে। বিশাল আয়োজন। অর্নিলা চোখের পাতা ফেলে ফেলে রুদমিলা কে দেখছে।‌ ইরা আপু জিজ্ঞেস করল, “কি দেখছিস?”

“রুদমিলার স্বাস্থ্য হয়েছে তাই না বলো!”
“শুধুই কি স্বাস্থ্য?”
“মানে?”
চকচক করে উঠল অর্নিলার চোখ। ইরা আপু হেসে উঠল। রুদমিলাও মিনমিনিয়ে হাসছে। শ্রেয়মী এসে অর্নিলার গাল টিপে বলল, ”তুমি ফুপু হতে চলেছো!”
“কি? বিয়েই তো হলো এই ক মাস! মানে..
হাত দিয়ে গুনতে শুরু করল। ইরা আপু থামিয়ে দিয়ে বলল, “থাম! ও তোর ফারাজ ভাইয়ের মতো না ঠিক আছে। কিছুদিন পর দেখবি ও কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে আর তখনো সারফারাজ তোকেই কোলে নিয়েই ঘুরছে!”

অট্টহাসিতে মেতে উঠল তারা। অর্নিলা অভিমানি স্বরে বলল, “আপা!”
“তো আর কি? তুই এখনো পিচ্চি আর তোর বর তোকে সামলাচ্ছে। তা না হলে এখনো একটা বাচ্চা নিচ্ছিস না কেন? মগা কোথাকার!”
মুখ ফুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। যাও! কথা নেই তোমাদের সাথে। ধপ ধপ করে পা ফেলে বেরিয়ে গেল অর্নিলা। বাড়ির দ্বিতীয় তলা প্রায় খালি। সবাই নিচতলায়। বাচ্চারাও সেখানে। যাবার সময় কারো ফিসফিস কথাবার্তায় থেমে গেল সে। এদিক ওদিক ফিরে তাকাল। আওয়াজ আসছে কোথা দিয়ে? এক দরজার পাশে কান পাতল। ভেতর থেকে কারা যেন কথা বলছে মনে হচ্ছে। ফরহাত ভাই না! সাথে কে? কোন মেয়ে? নাজিয়া! মনোযোগ দিয়ে কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে অর্নিলা। নাজিয়া আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ”হাত ছাড়ো। আমি আর নিতে পারছি না।”

“নিতে পারছো না মানে? কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে বলছো? তুমি কেন বুঝোনা ফরহাত। এরপর আমাদের বাচ্চা হয়ে গেলে আমি কি করব?“
“বাচ্চা! আসতাগফিরুল্লাহ! আমি তোমার সাথে এমন কি করব যাতে বাচ্চা হয়ে যাবে।‌ কি বলছো এসব?”
“তুমি জানো না কিছু। আমি অনেক শুনেছি, এমন গোপনে বিয়ে করে এরপর বাচ্চা… এরপর আর ছেলেটা মেয়েকে স্বীকার করেনি।”
“তুমি আমায় তেমন ভাবছো? নাজিয়া!”
নাজিয়া থতমত খেয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল, “না মানে..
ফরহাত তার হাত দুটো ধরে বলল, “আমায় বিশ্বাস করো তুমি। আমি তোমার সাথে এমন কিছুই করব না। আর করার প্রশ্নই নেই। সারফারাজ জানে বিয়ের কথাটা আর তার সাথে মামা ও জানে!”
“কি! আঙ্কেল ও জানে বিয়ের কথা।”
”হ্যাঁ, তিনিই তো তোমার বিয়েটা ভেঙে দিল। তুমি নিশ্চিত থাকো,‌আমি তোমায় ঠকাবো না। আর এমন কিছুও করব না যাতে তোমার…. সে যাই হোক। আমি তোমায় এখন শুধু চুমু খাবো। দেখি এদিক আসো।”
”একদম না। ছাড়ো বলছি।”
“আরে একটা চুমুই তো। এতে বাচ্চা হয়না কারো। শুনো না।”
“না বললাম তো!”
”নাজিয়া! নাজিয়া শোন..
এরমধ্যে ফট করে দরজাটা খুলে গেল। ফরহাত আর নাজিয়া হত’ভম্ব হয়ে পিছন ফিরল। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা মাথা বেরিয়ে এলো। অর্নিলার মাথা! সে দুজনের দিকে ফিরে বলল, “তোমার বিয়েও করে ফেলেছো!”

দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। ফরহাত মাথা দুলাল। অর্নিলা নিজেও মাথা দুলিয়ে বলল, “ওহ, কনগ্রেচুলেশন! কবে করলে?”
“তোর কিডন্যাপ হবার একদিন আগে!”
“একদিন আগে। হুমম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কেন বাচ্চার কথা বলছো?“
নাজিয়া দ্রুত মাথা নেড়ে বলে, “না না! কোন বাচ্চা নেই!”
অর্নিলা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। মাথায় বারি মে’রে বলল, ”ধ্যাত! সবার বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। শুধু আমার আর ফারাজ ভাইয়ের কোন বাচ্চা হচ্ছে না। এই ফারাজ ভাই কোথায়? ফারাজ ভাই!” চেঁচিয়ে উঠে সামনে হাঁটা ধরল।

নাজিয়া ফট করে এসে দরজা বন্ধ করে বলল, “ও কাউকে বলবে না তো।”
“একদম না!“ বলেই হাত ধরে হেঁচকা টান মারল ফরহাত!

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে