#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৬
ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় ফিরে এলো সারফারাজ। একটু একটু করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। হঠাৎ তাদের ফ্লাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। সদর দরজা খোলা! এর মানে কি? অর্নিলা ফিরে এসেছে! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ছুট দিলো ঘরের মধ্যে। সোফার মধ্যে অর্নিলা কে বসে থাকতে দেখে প্রায় বাকরুদ্ধ সে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। নিচু স্বরে তার নাম ধরে ডাক দিলো। সোফায় পা তুলে বসে ছিলো অর্নিলা। সবসময় এভাবেই বসে থাকে সে। নিজের নাম শুনে খানিকটা হকচকিয়ে গেল সে। ফিরে তাকাল এদিকে। সারফারাজ আবারো ছুটে গেল সে। দমকা হাওয়া ঢুকল তীব্র বেগে। পর্দার উল্টানোর শো শো শব্দে থমকে গেল ফারাজ। কে? কে এখানে? না! কেউ নেই তো! সে চলে গেছে। তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভ্রম কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল তার। অতঃপর নিশ্চুপ সে। দেহ ছেড়ে দিল। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল সে। এক হাঁটুর উপর হাত ভর দিয়ে রইল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ করে এখন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। সারফারাজ মুখ খুলে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে অথচ বুকে ব্যাথা করছে। হাত দিয়ে বুকখানা চেপে ধরল। শ্বাস নিতে চাইছে নিতে পারছে না। শার্টের বোতাম খুলে ফেলল। বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মুখ খুলে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। লাভ হচ্ছে না। বেশি টেনশনের কারণে এমন লাগছে। সে কি হার্ট অ্যা’টাক করবে?ব্যাপারটা সেদিকেই আগাচ্ছে। ঝিম ঝিম করছে চারদিক। সারফারাজ চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করছে। ভারে চোখ মেলতে পারছে না। চারদিক কেমন ধোঁয়াশা। সবকিছু ঝাপসা লাগছে। একসময় চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। শূন্য বাড়িতে শূন্য হয়ে রইল সে। গত কয়েক ঘণ্টা তার জীবন যেভাবে দুর্বি/ষহ করে তুলছিলো তার ফলস্বরূপ কি এখানে এভাবেই সমাপ্ত হয়ে রইবে!
.
রাগের মাথায় বাসা থেকে বেরিয়ে গেল অর্নিলা। রাস্তার সামনে ফের ফিরে তাকাল বাসার দিকে। দু’চোখে অশ্রু টলমল। ঠোঁট কামড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে উঠল সে। ফারাজ ভাই কিভাবে পারল তার সাথে এমনটা করতে। কিভাবে? ভালোবেসে বুঝি এভাবে কষ্ট পেতে হয়? কষ্ট কি সে কম পেয়ে আসছিলো। এতোগুলো বছর ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে গেছিলো শুধুমাত্র তার ভালোবাসার জন্য। এখন এখানেও ছলনা! সহ্য না! না, এর চেয়েও যেন মৃ/ত্যু ভালো। কারো ধোঁকা তার কাছে সহ্য হয় না। কেন এতো পাষণ্ড সে?
মুখ ফুরিয়ে নিল। না বাসায় ফিরে যাবে না সে। তবে যাবে কোথায়? আছে তো শুধুমাত্র একটি জায়গা। মোহনগঞ্জ! চলে যাবে সেখানে? মন শক্ত করল। চোখের জল মুছে হাঁটা ধরল সামনের দিকে। তার মাথায় যেন ভূত চেপে বসে ছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ রইল না এই ভূত। যাকে এতো ভালোবাসে তাকে ছেড়ে কিভাবে দূরে চলে যাবে সে। সম্ভব না! তার পক্ষে আদৌও এটা সম্ভব না। ফারাজ ভাইকে একা ছেড়ে সে কোথাও যেতে পারে না। রাস্তার মোড়ে এসে দাড়িয়ে ভাবছে। ফিরে যাবে? যাওয়াই উচিত। এর মধ্যে অনেকগুলো মিসকল এসে জমা হয়েছে ফোনেতে। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভেবে পা বাড়াল ওদিকে। হঠাৎ থেমে গেল। রাস্তা ওতো অন্ধকার নয়। মৃদু আলোতে কারো গাড়ি যেন দেখতে পাচ্ছে। কি মনে করে রাস্তা থেকে সরে আড়ালে দাঁড়াল। হুঁ, ঠিক ধরেছে। ফারাজ ভাইয়ের গাড়ি। কিন্তু যাচ্ছে কোথায়? তাকে খুঁজতে? বেশ, যাক না। সারা শহর আজ তন্নতন্ন করে খুঁজে আসুক। যখন ফিরে এসে দেখবে সে বাসাতেই আছে তখন ভালো হবে। এটাই হবে উপযুক্ত শা/স্তি। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। মনস্থির করা হয়ে গেছে। বাসাতেই এবার ফিরবে সে। পা বাড়াল সামনের দিকে।
সরু গলি বেয়ে সে হাঁটছে। এই গলির মুখে মেইন রাস্তা। সেখান থেকে দু মিনিটের পথ বাসার। রাস্তায় জনমানব নেই। আছে বলতে অর্নিলা আর তার পিছন পিছন একটা কুকুরের বাচ্চা। একা হাঁটলে বোধহয় তার ভয় লাগত কিন্তু এখন আর লাগছে না। কুকুরের বাচ্চা টা একটু একটু হাঁটছে, আবার তাকে দেখছে, ঘেউ ঘেউ করছে। এমন রাগের মধ্যেও হাসি পাচ্ছে তার। কুকুরকে সে ভয় পায় না। হুট করে এই অনাকাঙ্ক্ষিত সঙ্গ তার ভালো লাগছে। গলির মোড়ে এসে দাঁড়াল। এদিক থেকে ডানে মোড় নিলো। বোধহয় মিনিটের মধ্যে অনেককিছু ঘটে গেল। একটা সিএনজি এসে দাঁড়াল তার সামনে। অর্নিলা প্রথমে সেভাবে খেয়াল করেনি। খেয়াল হতে হতে দেরি হয়ে গেছে বেশ। কেউ একজন তার মুখে রুমাল চাপা দিতেই অচেতন হয়ে গেল সে। আরেকজন এলো। দুজন এসে তুলে ধরে তাকে সিএনজিতে বসাল। সামনের ড্রাইভার ফিসফিসিয়ে বলতাছে, ”তাড়াতাড়ি, কর শা লা। কেউ দেইখা ফেলব। তাড়াতাড়ি!”
কুকুরের বাচ্চা এবার জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কিন্তু সে ছোট বলে তেমন পাত্তা পেলো না। তাও লাল রঙের শার্ট পরে থাকা লোকটা তাকে লাথি মেরে বলল, “চুপ কর কু/ত্তার বাচ্চা!” সে তবুও চুপ যায়নি। এতো তার কণ্ঠ শক্ত। তীব্র বেগে প্রতিবাদ করছে। কিন্তু নিরীহ এই প্রাণীর ভাষা বুঝল আর কয়জন? সিএনজি এবার দ্রুত গতিতে চলছে। কুকুরের বাচ্চাটা তার পিছন পিছন ছুটছে। কালো রঙের কুকুরের বাচ্চাটা অন্ধকারের মধ্যে নিমিষেই হারিয়ে গেল। অচেনা এই সঙ্গীর জন্য তার মনে ভীষণ মায়া!
.
সিএনজির মধ্যে তিন লোকের কথোপকথন। লাল রঙের শার্ট পরা লোকটা অর্নিলা কে ধরে নিয়ে বসে আছে। অন্য জন তার মুখে কস্টেপ দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ভালোই পেশাদার। হাত গুলোও বেঁধে নিল খুব জলদি। চলন্ত সিএনজি। সামনের লোকটা বলল, “কিরে? তাড়াতাড়ি কর।
“এই সবসময় তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর কইবি না একদম। করতাছি দেখোস না।
সামনের জন্য নিরুত্তর। লাল রঙের শার্ট পড়া লোকটা দাঁত বের করে হাসল। বিশ্রী হাসির শব্দ।
“নুরু দেখলি আমাগো ভাগ্যটা। মেঘ না চাইতেই জল হাজির। দূর থেকেই কইতাছিলাম এইটাই আরিফ হাসানের পোলার বউ। দেখছোস!”
নুরু হেসে কইলো, ”এইবার আরিফ হাসান বুঝবো মজা। হা/লায় বেশি বিচারগিরি দেখাইতে গেছিলো না। এখন আমরা দেখামু বিচার। এই মাইয়ার এমন বিচার করমু সারাজীবন মনে রাখব!”
শব্দ করে হেসে উঠলো নুরু। সামনের কাদের ধমকে উঠল। “ওই, চুপ কর তোরা। মাইয়ার ফোন নিছোস।”
“হ, ফোন আইতাছে বার বার। কি করমু?”
“বন্ধ কইরা দে।”
”না না, নুরু। বাইরে দিয়া ফোনটা ফালাইয়া দে। এই ফোন দিয়া নইলে পুলিশ আমাগোরে ধরব।”
কাদের হঠাৎ করে সিএনজি থামিয়ে দিলো। নির্জন জায়গায় সিএনজি থামতে দেখে নুরু নেমে পড়ল। বাইরে এসেই সিগারেট ধরাল সে। কাদের তার বাটন ফোনটা বের করে নাম্বার ডায়াল করল। নিঃসন্দেহে ফোনটা গেল আরিফ হাসানের কাছে। বেশিক্ষণ না, শুধুমাত্র ৩৯ সেকেন্ডের কথাবার্তা। এরপরেই ফোন কেটে বন্ধ করে দিলো সে। নুরু হাতের সিগারেট তার দিকে বাড়িয়ে দিল। গণি মিয়া বাইরে এসে পরনের প্যান্টটা ঠিক করতাছে। আজ সে এই নতুন প্যান্ট আর লাল রঙের শার্ট পড়েছে। নতুন নতুন জামাকাপড় পরলেই তার মন খুশি হয়ে যায়। আবারো দাঁত বের করে বিশ্রীভাবে হেসে বলল, “কাজ সাইরা আসি!”
বলেই ভেতরের দিকে গেল। কাদের কপাল কুঁচকে সিএনজির ভিতরে তাকিয়ে রইল। শুকনা চিকন চাকন মাইয়াটা। এই নাকি আরিফ হাসানের পোলার বউ। আবার তার বোনের মাইয়া। সম্পর্ক ভালো, একটা টান তো আছেই। নুরু হঠাৎ শুধায়, ”ওস্তাদ, কি করবেন? মাই/রা বস্তায় ঢুকাইয়া ফালাইয়া দিমু। ঢাকা শহরে কিন্তু খালের অভাব নাই। সব গুলাই ময়লা। একটাতে ফেললেই হইলো।”
“পরে দেখা যাইবো। এখন গ্যারেজে চল! এই গণি, আয়!”
গণি হাসতে হাসতে এসে দাঁড়াল। বার বার তার নতুন শার্ট আর প্যান্টের দিকে চাইছে। খুশিতে সে আটখানা।
.
ভোরের আলো তখনো ফুটেনি। ধীরে ধীরে সে চোখ মেলছে। মাথা ভার হয়ে আছে। সাথে তীব্র যন্ত্রণা! বড্ড ক্লান্ত শরীর। কোথায় আছে? কিভাবে আছে? বুঝতে পারছে না। হঠাৎ চোখের সামনে অদ্ভুত ভয়ং/কর এক মুখ থেকেই চিৎকার করার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই বুঝতে পারল তার মুখ বাঁ/ধা। শুধু তাই না, হাত ও বাঁ/ধা। ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ভয়ং/কর দেখতে লোকটা বিশ্রী রকম হাসছে। জোরে হাঁক দিলো, “ওস্তাদ, মাইয়া চোখ খুলছে!”
অর্নিলা অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ফিরছে। পাগলের মতো করছে। নিজেকেই ছোটানোর চেষ্টা করছে। এরমধ্যে দেখল গ্যাঞ্জি আর লুঙ্গি পরা এক লোক মুখে ব্রাশ নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। অর্নিলা বিমূঢ়! লোকটা দাঁত ব্রাশ করে থু থু ফেলে আবারো ব্রাশ করতে করতে বেরিয়ে গেল। হতবুদ্ধির মতো কেটে গেল কিছুক্ষণ। ব্যাপারটা খুব জল ঘোলাটে। এখনো পরিষ্কার নয়। সে কি তবে কিডন্যাপ হয়েছে। কখন? রাতে! এখন তার কি হবে? শুকনো ঢোক গিলল সে। শো শো শব্দ করছে কিন্তু কথা বেরুচ্ছে না মুখ দিয়ে। ভয়ং/কর দেখতে লোকটা হঠাৎ তার মুখ তার সামনে নিয়ে এলো। ভয়ে আঁ/তকে উঠল অর্নিলা। চোখ খিচে বন্ধ করে নিল সে। সে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। অর্নিলা চোখ মেলে আশপাশ দেখছে। কোথায় সে? আছে কোথায়? ফারাজ ভাইয়ের থেকে কতো দূরে সে? ফারাজ ভাই কোথায়? কেমন আছে? সে কি জানে অনির খোঁজ? চিন্তায় পাগল হয়ে যাবার উপদ্রব। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে গা কাঁটা দিয়ে উঠল অর্নিলার। সে সামনে ফিরল। এ তো নতুন লোক। অর্নিলা নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে!
#চলবে….
#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৭
অর্নিলা মুখ বাঁধা। শত চেষ্টা করেও চোখের কাপড়টা খুলতে পারছে না। অস্থির হয়ে উঠল সে। চেয়ারে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে তাকে। সেখান থেকে ছুটবার জন্য পাগলের মতো করছে। কিন্তু কোন লাভ নেই। অন্ধকার থেকে একটা হাত বাড়িয়ে আসছে তার দিকে। অর্নিলা তা জানে না। কে জানে হাতটা এসে কোথায় গিয়ে ঠেকবে। কিভাবে ছুঁয়ে দেখবে তাকে? চারদিকে স্তব্ধ নিরবতার মাঝে অর্নিলা উম উম করা শব্দ। হাতটা এসে চোখের বাঁধন খুলে দিলো। অর্নিলা আঁতকে উঠে চেয়ে রইল। গলা টিপে ধরল আচমকা। অর্নিলা চোখ মুখ সব শক্ত করে আসছে। চোখে রক্ত জমে উঠছে। ধপ করে বিছানা ছেড়ে উঠে গেল সারফারাজ। অস্থির হয়ে আশপাশ দেখতে লাগল। খুব বাজে স্বপ্ন ছিলো। ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ বোধ হলো সে বিছানায় কি করছে? বেডরুমে তো ছিলো না। দরজায় এসে করাঘাত করল কেউ। সারফারাজ চমকে ফিরে তাকাল। ওহ, ফরহাত! পিছনে এসে দাঁড়াল আরাফাতও। ফরহাত গ্লাসে পানি ঢেলে হাতে ধরিয়ে দিল।
“এসে তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। এভাবে মরা/র মতো পড়ে ছিলো মনে করেছিলাম সত্যি সত্যি ম/রে গেছিস। কি করছিস তুই?”
“অনির খোঁজ পাওয়া গেছে?”
আরাফাত দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “এখনো না। খোঁজ চলছে।”
“ খোঁজ চলছে? আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া হলো আমি টের ও পেলাম না। আমার মনে একবারও আসলো না। বাবা বার বার বলেছিলো ওর দিকে নজর রাখতে। এর পরেও আমি কিছু করতে পারলাম না। সব ফেলনা হয়ে গেল!”
“তোর কোন দোষ নেই সারফারাজ। একটু রেস্ট নে। তোকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে!”
”না রেস্ট নিলে না। আমি মোহনগঞ্জ যাবো। বাবার সাথে কথা বলব।”
আরাফাত নিচু স্বরে বলল, ”একবার পুলিশকে জানালে হতো না?”
“বাবা বলেছে?”
“না।”
“তাহলে থাক।”
সারফারাজ বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। তিন জনই সকালের মধ্যে মোহনগঞ্জ যাবার জন্য রওনা দিলো। পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা। অন্ধকার প্রহরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার পুরো বাড়ি আজ স্তব্ধ। দরজা এসে খুলে দিল সিধু। ঘরে ঢুকে দেখল অনির বড় চাচী বসার ঘরে পায়চারি করছেন। সারফারাজ কে দেখতে পেয়েই তিনি ছুটে এলেন।
“অনি, অনির খোঁজ পেয়েছো?”
সারফারাজ নিরুত্তর। তার চোখ মুখ বলে দিচ্ছে কোন কিছু এখন অবধি তিনি জানতে পারেনি। ছোট চাচী সোফায় বসে হাহাকার করতে লাগলেন। কাঁদতে শুরু করলেন। তার স্বভাবই হচ্ছে কিছু থেকে কিছু হলে কান্নাকাটি করা। ছোট চাচা অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, “তোমার বাবাকে এতো করে বললাম, পুলিশ/কে জানাতে কিন্তু কোন ভাবান্তর দেখছি না। তুমি একবার গিয়ে বুঝাও তাকে।”
সারফারাজ মাথা দুলালো। আরাফাত শুধালো, “মা কোথায়?”
“শুয়ে আছে। প্রেসার লো। দাঁড়াতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার এসে দেখে গেছে!”
আরাফাত মায়ের ঘরের দিকে আগালো। সারফারাজ গেলো বাবার স্টাডি রুমে। বাবার সাথে তার বোঝাপড়া আছে। সামনাসামনি কথা বলতে হবে। ফরহাত পিছন পিছন এগিয়ে আসলো। দুজন একসাথেই স্টাডি ঘরে ঢুকল। আরিফ হাসান চেয়ারে বসে সিগারেট টান ছিলেন। পুরো ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। আরিফ হাসান সচরাচর এতো ধূমপান করেন না। তার চিন্তিত রূপ দেখে সারফারাজ ঘাবড়ে গেল। বরাবর বাবাকে অনেক কঠিন সময়ে শান্ত দেখেছে। সেই মানুষটার এমন হাল হয়ে থাকলে বুঝতেই হবে পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাচ্ছে। আরিফ হাসান ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আর্ধেক সিগারেট টা এস্ট্রেতে ফেলে বললেন,
“এসো গেছো?”
সারফারাজ পাল্টা প্রশ্ন করল, ”অনির খোঁজ পেয়েছো?”
“না , খোঁজ চলছে। অনি ঢাকায়ই আছে।”
“তা আমিও জানি।”
কপাল কুঁচকে আরিফ হাসান শুধায়,
“তাহলে তুমি এখানে কি করতে এসেছো?”
“আমি জানতে চাই কি হয়েছে। যারা অনিকে নিয়ে গেছে তাদের নিশ্চিত তুমি চিনো। নাহলে তারা আমায় ফোন না করে তোমাকে কেন করবে?”
ফরহাত মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কথাটা আমার মাথায় ও ঘুরছে। মনে হচ্ছে আপনার শ ত্রু চাচা!”
আরিফ হাসান তুচ্ছ স্বরে বললেন, “শত্রু! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেয়ে গেল তাকে। নিচু স্বরে বলতে লাগলেন, “অন্যা/কি য়ের সাথে কখনো আপোষ করেনি। আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ কেটেছে বিচারপতির দায়িত্ব পালন করে। আমি জানি কে আর কারা কাজটা করেছে। আমিও তাদের খোঁজ চালাচ্ছি।
“পুলিশ কে জানালে ভালো হতো না।”
“না। হিতে বিপরীত হতো। ওদের কোন বড় দল নেই। তিনজনের দল। কাদের, গনি আর নুরু। কাদের হচ্ছে দলের লিডার। এরা তিনজনই একসাথে কাজ করে। কাজ হচ্ছে বড় দলের কাছে লোক পা চার। ভিকটিম কে কিছু করে না। কিন্তু একবার একজনকে কিডন্যাপ করার পর পুলিশ কোনভাবে তাদের ট্রেস করে ফেলে। তাই রেগে সেই ভিকটিম কে তারা মে/রে ফেলার চেষ্টা করে। যদিও ভিকটিম শেষমেষ বেঁচে যায়। এসব অনেক বছর আগের কথা। তখন আমি বিচারপতির দায়িত্বে ছিলাম। তাই ক্ষো/প বসত এখন আমার পিছনে লেগেছে।”
সারফারাজ চোয়াল শক্ত করল। ফরহাত হত’ভম্ব গলায় বলল, “এই কারণেই আপনি পুলিশ কে কথাটা জানাতে দিচ্ছেন না চাচা।”
“না, কিন্তু পুলিশ যে একদমই জানে না তা না। আমার এক পরিচিত ব্যাপারটা দেখছে তবে গোপনে। তিনজনের এই দলে কাদের খুব চালাক। বুদ্ধির জোরে ওর সাথে পাল্লা দেওয়া সহজ বলে মনে হয় না।“
সারফারাজ কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, ”চায় কি ওরা?”
“টাকা চায় আর কিই বা চাইবে। টাকার জন্য সব করতে পারে। আমি ওদের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি। ফোন করে টাকা চাইলেই আমি দিয়ে দিবো।“
ফরহাত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, “টাকা পেলেই কি অনি কে দিয়ে দিবে? যদি কোন ক্ষ তি করে?”
আরিফ হাসান সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে শান্ত স্বরে জবাব দিলেন, “অনি এখন ওদের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তার কিছু করবে না। টাকা পেলেই অনিকে দিয়ে দিবে। কারণ একবার জে ল খাটা আসামী দ্বিতীয় বার জে লে যেতে চাইবে না। আর কাদের কে আমি ভালো ভাবেই চিনেছি। ওর বুদ্ধি বেশ তবে তার সাথে সুবিধাবাদী। নিজের ক্ষতি হবে এমন কিছু করবে না। ওর একটাই চাওয়া আমায় হে নস্তা করা।”
“তাহলে আমাদের এখন কি করতে হবে?”
“অপেক্ষা। তবে বেশিক্ষণ না। ওরা ফোন করার সাথে সাথেই আমি তোমাকে জানাব। আপাতত তুমি এখন ঢাকায় ফিরে যাও। ফরহাত, ওর সাথে তুমিও যাও।”
“জি চাচা!“
সারফারাজ নিশ্চুপ হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ফরহাত গেলো তার পিছু পিছু। সারফারাজ এসে দাঁড়াল মায়ের ঘরের কাছে। আরাফাত খাটের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। মা ঘুমাচ্ছে। সারফারাজ আর সেখানে গেলো না। বেরিয়ে এলো। তার পাশে পাশে হাঁটছে ফরহাত। ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হুম।” নিচুস্বরে কথাটা বলে কিছু একটা ভাবতে লাগল সারফারাজ। হঠাৎ এর মধ্যে তার ফোনটা বেজে উঠলো। ডাক্তার সাবিনার ফোন। এতো কিছুর মধ্যে হাসপাতালের কথা এক প্রকার ভুলেই গেছিলো সে। ফোন রিসিভ করে নিল।
“ডাক্তার শেহদাত!”
“জি বলুন।”
“কি ব্যাপার বলুন তো? কোন কথাবার্তা ছাড়াই আপনি হুট করে হাসপাতালে আসা বন্ধ করে দেন। কারণ কি?”
“সরি ম্যাম। আমি একটু অসুস্থ। পরশু দিন থেকে হাসপাতালে যাবো।”
ডাক্তার সাবিনা এবার একটু শান্ত হলেন। ডাক্তার শেহদাতের কণ্ঠস্বর শুনেই তাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। অতঃপর মৃদু স্বরে শুধালো, “সব ঠিক আছে ডাক্তার শেহদাত?”
“জি। সব ঠিক আছে।”
“হাসপাতালে আজ পুলিশ এসেছো। আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করল আমাকে।”
“ওহ!“
“ওহ বললেন? আপনাকে অনেকটাই শান্ত মনে হচ্ছে। পুলিশের কথা শুনে আপনি একটুও ঘাবড়ে যান নি দেখছি।”
”ঘাবড়ানোর কিছু তো নেই। আমি তো কিছু করিনি। তারা তাদের কাজ করছে আর আমি আমার।”
“হুম। ভেরি গুড ডাক্তার শেহদাত। আইম ইমপ্রেস। যাই হোক, আপনার বউকে বললেন আপনার যত্ন বেশি নিতে। যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন। রাখি।”
সারফারাজ জবাব দিল না। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার সাবিনা ফোন কেটে দিলো। তাদের চোখে মুখে এবার চিন্তার দাগ ফুটে উঠল। পুলিশ হঠাৎ হাসপাতালে গেলো কি কারণে? কি ঘটছে তার চারপাশে? সারফারাজ আর ভাবতে পারছে না। তার মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। বুকের ব্যাথাটা আবারো জাগান দিচ্ছে। অনিকে ভীষণ মনে হচ্ছে। কে জানে কেমন আছে ও? ফরহাত তার দিকে আশ্চর্য জনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শুধালো, “পরশু দিন থেকে তুই হাসপাতালে যাবি? সিরিয়াসলি ফারাজ! কিরে? তোর কি আবার শরীর খারাপ লাগছে? দেখি!
”আমি ঠিক আছে ফরহাত। তুই বাসায় ফিরে যা। আমি একাই ঢাকায় ফিরব।”
“কেন? আমি তো..
“প্লিজ ফরহাত। বললাম তো আমি পারব। আমায় একা থাকতে দে।
ফরহাত দাঁড়িয়ে রইল। সারফারাজ একা একাই ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
#চলবে….