#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৪
ঘুমের ঘোরে ফোন রিসিভ করে সারফারাজ বলে উঠল, “হ্যালো।“
“ফারাজ , আমি বলছি।”
“কে আমি?”
“ফরহাত।
“কি হইছে?”
“অনেক বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেছে।”
“কি কাণ্ড।”
ফরহাতের এলোমেলো স্বর। সারফারাজের ঘুম তখনো পুরোপুরি ভাঙেনি। ফরহাত আমতা আমতা স্বরে বলল, ”একটা কাণ্ড ঘটিয়েছি। আমি আর নাজিয়া বিয়ে করে ফেলেছি।”
“ওহ, কনগ্রেচুলেশন!”
বলেই ধপ করে ফোন কেটে দিল সারফারাজ। আবারো তলিয়ে গেলো ঘুমে। ফোন বেজে উঠল আবারো। রিসিভ করে বলল, “কে?”
“আমি!
”আমি কে?”
“শা লা আমি ফরহাত।”
”কি হইছে? তোকে তো কনগ্রেস করলাম। আবার কেন ফোন দিছিস?”
“পুরো কথা না শুনে ফোন কেটে দিলি কেন? ভালো করে শোন। আমি আর নাজিয়া বিয়ে করেছি।
“শুভকাজ সম্পন্ন করিয়াছেন।”
”পালিয়ে করেছি।”
“আচ্ছা!” কথাটা নিজেই বলার পর চোখ মেলে তাকাল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। না সে স্বপ্ন দেখছে না। তার বুকের মধ্যে অর্নিলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ফোনের আলোয় তার মুখশ্রীর দেখা মিলছে। সারফারাজ ফোন আবারো কানে রেখে ধীরে স্বরে বলল, “সাব্বাস। খুব ভালো কাজ করেছিস। ট্রিট কবে পাবো?”
“শা লা আমি এখানে পড়েছি বি পদে তুই মজা নিচ্ছিস। জলদি উপায় বল। কি করবো?”
“এখন কি করছিস?”
“মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। নাজিয়া গাড়ির ভিতরে।”
“এই মাঝরাতে তোদের বিয়ে পড়ালো কে?”
”আগেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম।
”বেদ্দ্যব , শা লা খ চ্চর পাবলিক। আগের থেকে বিয়ের প্ল্যান করে রাখলি আর বিয়ের পর কি করবি সেই প্ল্যান করার জন্য আমায় ফোন করলি? মিষ্টি খাওয়ার জন্যও না!”
কথাগুলো বলেই মুখ বন্ধ করে ফেলল। অর্নিলা নড়েচড়ে উঠছে। এই না আবার জেগে যায়। সারফারাজ মুখ ওদিক ফিরিয়ে বলল, ”এখন কি চাই?”
”কি করব সেটা বল! নাজিয়ার ফ্যামিলি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো। দিনের বেলা ঘর থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিছে। তাই রাতের বেলা ওকে নিয়ে পালিয়েছি।
“দূরে পালানোর কোন দরকার নাই। ঘরের মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও ঘরে চলে যা। সিঙ্গেলের মতোই থাক আমি সকালে দেখছি।”
“আচ্ছা!”
“এতো খুশি হবার কিছু নাই। কিন্তু আমায় একটা কথা বল, তোর মতো একটা জো চ্চর বিয়ে করলি কি করে? হঠাৎ এতো ভালোবাসা তোর নাজিয়ার জন্য। আশ্চর্য!”
ফরহাত কথা শুনেও জবাব দিলো না। ধপ করে ফোন কেটে দিল। শা লা আসলেই জো চ্চর। ফোনের স্ক্রিনে দেখল ৩ টা বাজে। ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখে এদিক ফিরে অর্নিলাকে জড়িয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল সে।
.
পরদিন সারফারাজ সমস্ত কথা জানালো আরিফ হাসান কে। ব্যাপারটা এখন সে সামলে নিবে। ফরহাত আর নাজিয়ার এমন ঘটনা শোনার পরেও আরিফ হাসানের কথা বার্তায় কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। তিনি আগের মতোই গম্ভীর স্বরে কথা বলছেন। সারফারাজ কিছুটা আঁচ করতে পেরে শান্ত কণ্ঠে শুধালো, ”কিছু হয়েছে আব্বা?”
“না কি হবে? অনি মা কেমন আছে?”
”ভালো আছে। ফোন করে কথা বলে নাও। তোমার শরীর ভালো তো। পেশার মাপিয়েছো। দেখি আম্মা কে দাও, কথা বলব।”
তীব্র কণ্ঠে আরিফ হাসান বলে উঠলেন, “বললাম তো ভালো আছি।” সে নিশ্চুপ। অতঃপর মৃদু কণ্ঠে ফের বলে উঠলেন, ”অনি মায়ের দিকে একটু নজর রেখো। একা একা কোথাও বের হতে দিও না। বুঝলে?”
”জি আব্বা।”
“হুম। তোমার মা বাড়িতে নেই। শিকদার বাড়িতে গেছেন। নিয়াজ কে দেখতে। ওর করুণ অবস্থা দেখে আমি শিহরিত। রাস্তা ঘাটে সাবধানে চলাফেরা করো সারফারাজ। আর অনির দিকেও নজর রেখো। আমি রাখছি। আছো কোথায়?”
“মেডিকেলে।”
“ঠিক আছে। মন দিয়ে কাজ করো। শুনলাম তুমি নাকি ভিসার জন্য এপ্লাই করেছো।”
ওপাশ থেকে সারফারাজ নিরুত্তর। আরিফ হাসান ফের গম্ভীর মেজাজে ফিরে গেছেন। শান্ত অথচ তীব্র কণ্ঠে বললেন, “আমি চাই না তুমি অনি কে ফের একা ফেলে চলে যাও। কিন্তু তোমার দিকটাও আমি ভুলতে পারছি না। আমি বাবা সারফারাজ। স্বার্থপর হতে পারিনা। তোমার একটা ভালো ক্যারিয়ার হোক সেটা আমিও চাই। কিন্তু অনি মা কষ্টে থাকবে সেটাও দেখতে পারব না। অনির সাথে কথা বলেছো?”
“এখনো না।”
“তবে বলে ফেলো। সবটা জানাও। আবারো ভাবো। ভেবে চিন্তে দেখো কি করবে? আমি রাখছি।
“আচ্ছা।”
“হ্যাঁ, অনির দিকে নজর রেখো। বিশেষ ভাবে তাকে বাইরে একা বেরুতে দিও না বুঝেছো।
“বুঝেছি।”
আরিফ হাসান ফোন কেটে টেবিলের উপর রাখলেন। চোখ বন্ধ করে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। কিছু ভাবছেন খুব মনোযোগ দিয়ে। কোন বিপদের আঁচ করতে পারছেন। বিপদ খুব সাং ঘাতিক! ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছেন তবে এখনো ঠান্ডা মাথায় ভাবছেন কি করবেন।
.
অর্নিলা সবে ভার্সিটি থেকে ফিরে ঘরে ঢুকল। টানা বেশ কয়েকদিন ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ভাগ্যিস বৃষ্টির আগেই বাসায় ঢুকে পড়ল। অসময়ে বৃষ্টি মন ভালো করে দেয়। অর্নিলা পরনের জামা ছেড়ে নিলো। ফ্রেস হয়ে এসে দাঁড়াল বসার ঘরে। তার ঘরটা কেমন একটু উল্টো ধরণের। দক্ষিণ দিক হচ্ছে বসার ঘরের দিকে। বিশাল বড় এক জানালা। বাইরে বৃষ্টির তেজ না থাকলেও হাওয়ার বেগ ভালোই বইছে। দমকা হাওয়ায় হালকা হলদে রঙের পর্দা শূন্যে দোল খাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া এসে লাগল অনির গায়ে। কাঁপুনি উঠে গেল তার। একটু ঘোরের মধ্যেই ছিলো সে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এখন আবার কে হলো? খানিকক্ষণ আগেই তো ফারাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে। তার আসতে নাকি ঢের দেরি হবে। তবে?
দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি মারল প্রথমে। চেনা মুখখানি দেখে খানিকটা গম্ভীরতা এসে ঠেকল কপালের আনাচে কানাচে। কমিশনার সালাউদ্দিন সাহেব! আশ্চর্য! তিনি তাদের বাসার ঠিকানা জানলো কি করে? যদিও পুলিশের পক্ষে কিছুই অসম্ভব না যদি তারা ঠিক করে কাজ করে তখন। সাথে আরেকজনকেও দেখা যাচ্ছে। দুজনেই নরমাল গেটাপে। অর্নিলা দরজা পুরোপুরি ভাবে খুলে লম্বা করে সালাম দিলো।
“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার!”
কমিশনার সাহেব মৃদু হেসে জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম ম্যাম। ভালো আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা? হঠাৎ আমার বাসায়।”
”হ্যাঁ, এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি ভাবলাম আপনার এখানে একটু চা ই খেয়ে যাই।”
“অবশ্যই, আসুন। ভেতরে আসুন।”
দুজনেই ঘরে ঢুকছিলো। অর্নিলার খোঁচা মারার স্বভাব দীর্ঘকালের। এবারও সেটা হাতছাড়া করল না। বলেই ফেলল, ”তা আমাদের ওপর বোধহয় গোয়ান্দা লাগিয়েছেন। না মানে? বাসা চেনার তো কথা না!”
সালাউদ্দিন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “ঠিকানা তো ছিলো আমাদের কাছে ম্যাম।”
অর্নিলা মুচকি হাসল। জবাব দিলো না। তার বেশ মনে আছে, বলার সময় ঠিকানায় সে ভুল রাস্তা বলেছিলো। উত্তেজনায় বলেছিলো, ইচ্ছে করে না। পরিস্থিতি টাই এমন ছিলো। তাদের বসার ঘরে বসতে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গিয়ে চুলোয় চায়ের পানি বসাল। বোয়াম থেকে বিস্কুট বের করতে গিয়ে উঁকি মারল বসার ঘরের। হুম, ঠিক ধরছে। একজন বসে আছে আর সালাউদ্দিন সাহেব ঘরে হেঁটে হেঁটে দেখছেন। কি জানে কি খুঁজছেন?
সালাউদ্দিন সাহেব চা খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ! তার সাথের জন চুপচাপ চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছেন। সালাউদ্দিন সাহেব বলতে শুরু করলেন, ”আপনার হাসবেন্ড কি এখনো মেডিকেলে?”
“জি!
“আসে কখন? মানে নির্ধারিত কোন সময়?”
“সন্ধ্যার পর পরই বাড়ি ফিরে আসেন। কেন বলুন তো?”
”না তাহলে আপনি বলছেন সেদিন নিয়াজের সাথে আপনার হাসবেন্ডের দেখা হয়নি। কারণ নিয়াজ তো প্রায় বিকেলের দিকেই এসেছিলো তাই না মিসেস অর্নিলা?”
অর্নিলা চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল। সালাউদ্দিন সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন, ”শান্ত হন মিসেস অর্নিলা। আমি তো শুধু বললাম জিজ্ঞেস করিনি। কিছুদিন আগেই তো মোহনগঞ্জ যাওয়া হলো। সেখানেই সব শুনলাম।”
অর্নিলা চোখে মুখে কোমলতা ফিরতে শুরু করল। কিঞ্চিত হেসে বলল, ”হ্যাঁ, সে এসেছিলো। কিন্তু তার সাথে ফারাজ ভাইয়ের কোন দেখা হয়নি?”
“ফারাজ ভাই? ওহ হ্যাঁ, সারফারাজ শেহদাত তো আপনার মামাতো ভাই হয়। তা এখনো ভাই বলে ডাকেন দেখছি?”
”যেটা বলে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সেটাই।”
”হুম, আপনাদের পার্সোনাল বিষয়। ওসব জানতে চাইবো না।” বলেই চায়ের কাপে চুমুক দিলো। অতঃপর ঠান্ডা গলায় বলল, “মোহনগঞ্জ থেকে অনেক কথাই জানতে পেরেছি। এই যেমন আপনার চাচাতো ভাই, মানে নিয়াজ আপনাকে একবার রে প করার চেষ্টা করেছিলো? কথাটা কি সত্য মিসেস অর্নিলা? আপনার হাসবেন্ড অবশ্যই অবগত এই ব্যাপারে। এর পরেও এমন একটা লোককে আপনার স্বামীর অজান্তে, তার অনুপস্থিতিতে নিজের বাসায় ঢুকতে দেবার কারণ কি হতে পারে মিসেস অর্নিলা?”
অর্নিলার নির্লিপ্ত চাহনি। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি। তার শুষ্ক রুক্ষ মুখের কোন ভাবের ছায়া নেই। কি ভাবছে? মস্তিষ্কে কি বিরাজমান তা টের পাবার কোন অবকাশ নেই। তবুও সালাউদ্দিন সাহেব অর্নিলার ভাব দেখার জন্য চির আগ্রহে বসে আছে। তার ধারণা, না না আত্মবিশ্বাস, সম’স্যা এই পরিবারের মধ্যেই আছে। খু’নি এখানেই। অর্নিলা এখনো ভাবছে। শুকনো ঢোক গিলছে। শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে খুব স্বাভাবিক ভাবে। হঠাৎ কাশির শব্দে চমকে উঠল। দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “আমি পানি নিয়ে আসছি!”
সালাউদ্দিন সাহেব শান্ত কণ্ঠে বললেন, “সাথে উওর নিয়ে আসবেন!” অর্নিলার বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। আশ্চর্য! কথাগুলো তার কাছে বড্ড ক ঠোর শুধালো।
#চলবে….
#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৫
অর্নিলা পানির গ্লাস এনে রাখল সামনে। পাশের অজ্ঞাত ব্যক্তি ঢকঢক করে পানি খেল। সালাউদ্দিন সাহেব শান্ত শীতল দৃষ্টি রেখে শুধালেন, “উত্তর কি তৈরি মিসেস অর্নিলা?”
অর্নিলা কিঞ্চিত হাসল। তাকে এখন আগের থেকে অনেকটা শান্ত দেখতে লাগছে। শান্তশিষ্ট ভাবে সোফায় বসে কোমল কণ্ঠে বলল, “উত্তর আলাদা করে আর কি হতে পারে? সে তো তার বোনের বাড়িতে আসতেই পারে তাই না। নাকি সেটাও বারণ?”
“বারণ বলছি না মিসেস অর্নিলা। একটু খটকা লাগছে। বুঝতেই পারছেন পুলিশের লোক। স ন্দেহ করাই তো আমাদের কাজ। হা হা ( উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন তিনি। )
অর্নিলার অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো। সে চাইছে না সেদিনকার কোন কথা বলে ফেলতে। মুখ ফসকে বলে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। যদি তারা ভাবে, এই কারণেই সে নিয়াজের সাথে এমনটা করেছে। কি দরকার আগ বাড়িয়ে ঝামেলাকে দাওয়াত দেবার। তার মন বলছে, নিয়াজের উচিত শিক্ষা সে পেয়ে গেছে। পা হারিয়ে ঘরে বসে আছে। এখন আর কোন মেয়ের দিকে নজর দিতে পারবে না সে। অর্নিলা দম নিল। শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “সে শুধু এসেছিলো দেখা করতে। ফারাজ ভাইয়ের সাথে কি কথাবার্তার জন্য জন্য এসেছিলো। ফারাজ ভাই না থাকায় চলে গেছে। বসে নি! কিন্তু সে তো সন্ধ্যার সময়ই চলে গেছিলো। এরপর মাঝরাতে প্রায় ভোরের দিকে তার এক্সি ডেন্টের খবর পাই।”
সালাউদ্দিন সাহেব তার চায়ের কাপের শেষ চুমুক দিয়ে চা খাওয়া সমাপ্ত করলেন। অতঃপর গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন। কথাগুলো যেন মিলে যাচ্ছে নিয়াজের সাথে। তাহলে কি নিয়াজ সত্যি কথাই বলছে। হালকা কেশে বললেন, “এক্সি ডেন্ট হয়েছিল রাতের দিকেই। বৃষ্টির মধ্যে! এরপর হাসপাতালে নিয়ে পরিচয় খুঁজে পেতে পেতে সময় লেগেছিলো বেশ। এসব হাসপাতালের থেকে জানা কথা। যাক আজ তাহলে আমরা উঠি!”
সালাউদ্দিন সাহেব আর তার সহকর্মী উঠে দাঁড়ালেন। অর্নিলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। স্বস্তির শ্বাস কেবল নিতেই যাবে অমনি সালাউদ্দিন সাহেব চমকিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “ওটা কি? সি সি ক্যামেরা না?”
সহকর্মী সাহেব চোখে ডাবল পাওয়ারের চশমা পড়েছিলেন। চশমা নড়েচড়ে ভালো ভাবে তাকালেন দেওয়ালের এক কোনে। ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না ওতো। পাশেই একটা ওয়ালম্যাটের পাশে একটা সি সি ক্যামেরা। বেশ সূক্ষ্ম আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না হলে ওদিকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা সকলের হয় না। অর্নিলা ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে তাও যেন দেখতে পারছে না। অবশেষে তার চোখে ধরা পড়ল। বিস্মিতবিমূঢ় হয়ে গেল তার। স্তব্ধ তার মুখস্রী। নির্লিপ্ত চাহনিতে চেয়ে রইল শুধু। তার অবাক চাহনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে কতটা হতবাক। তার ঘরের কোণে একটা সি সি ক্যামেরা অথচ সে জানত না। কি আশ্চর্য জনক! ব্যাপারটা ধরতে পেরে সালাউদ্দিন সাহেব মশকরা শুরু করলেন। দু পাটি দাঁত মিলিয়ে হেসে উঠলেন। বললেন, ”কি ব্যাপার মিসেস অর্নিলা, আপনাকে বাকরুদ্ধ মনে হচ্ছে। ঘটনার ব্যাপারে কি আপনি অবগত নন? আপনার অগোচরে এমন কাজ কার হতে পারে? ওহ, এই বাসায় দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে তো একজনই আছে। আপনার স্বামী! কাজটা বোধহয় তারই। তৃতীয় পক্ষের এই কাজের সাহস হবে বলে মনে তো হচ্ছে না। বউ কে চোখে চোখে রাখার ভালো ফন্দি এটেছে কিন্তু ডা. সারফারাজ শেহদাত।”
অর্নিলা হতবুদ্ধির মতো কথাগুলো শুনছিলো। তার মস্তিষ্কে যেন বসে গেল কথাটা। তার স্বামী তাকে এভাবে নজরবন্দি করে রেখেছে। অবিশ্বাস্য কথা। ঝিম মেরে থাকা পুরো শরীর হঠাৎ সোচ্চার হয়ে উঠল। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলল না সে। সালাউদ্দিন সাহেব হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। বুঝে গেলেন এখানে কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। কথা বলতে হবে ডা. শেহদাতের সঙ্গে। তবে আজ না, অন্যদিন!
.
অর্নিলা দৃঢ় মনে অপেক্ষা করতে লাগল ফারাজ ভাইয়ের জন্য। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। পুরো শরীর কাঁপছে যন্ত্রণায়। শারীরিক যন্ত্রণা নয় সেটা। মানসিক যন্ত্রণা! নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। কান্না এসে ঠেকছে গলা অবধি। এই যেন হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে সে। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোন শব্দের প্রতিঘাত পাওয়া যাচ্ছে না। দরজায় করাঘাত শুনে অর্নিলা দাঁড়িয়ে রইল। নিষ্প্রাণ মানবীর ন্যায় উঠে এসে দরজা খুলল। সারফারাজ মুখে মৃদু হাসির রেখা। সারাদিনের ক্লান্তির দেখা মিলছে না। দেখে অনেক প্রাণ উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। হাতে আইসক্রিমের বক্স। চকলেট ফ্লেভার। অর্নিলার বেশ পছন্দ। এটা দেখে সে ভীষণ খুশি হবে ভেবেই কিনা। কিন্তু একি? তার অনির মুখের হাসির বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। ছাপ পড়েছে কষ্টের, যন্ত্রণার। অশ্রুসিক্ত নয়নের অশ্রু টলমল। সারফারাজ যেন ভেঙে পড়ল মূহূর্তে। কি হলো কি হলো? এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরল তার বাহু। চেঁচিয়ে উঠে বলে উঠল, ”এই অনি? কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? সবকিছু ঠিক আছে? কি হয়েছে বল আমায়?”
সে মুখ ফুটে বলে উঠলো, ”কিছু না!”
“কিছু না! তবে কাঁদছিস কেন?”
কান্না থামানোর সর্বস্ব চেষ্টা। ভারী কণ্ঠে বলে উঠল, ”আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি ফারাজ ভাই।”
“কষ্ট পেয়েছিস? কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে। আচ্ছা মন খারাপ করিস না। দেখ আমি আইসক্রিম এনেছি। বোকা মেয়ে! কিছু হলে এভাবে কাঁদতে হয়?”
বলতে বলতে কাঁধের ব্যাগটা চেয়ারে রাখল। আইসক্রিম বক্স খুলে চামচে করে সামান্য একটু নিয়ে বলল, “দেখ , আইসক্রিম খেলে মন ভালো হয়ে যাবে। তোর প্রিয় চকলেট ফ্লেভার!”
অনি হাত ছুড়ে ফেলে দিল আইসক্রিম বক্সটা। দূরে ছিটকে পড়ল সে। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই আইসক্রিম! আকস্মিক ঘটনায় সারফারাজ কিৎকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল। টপ টপ করে অশ্রু বেয়ে পড়ল গাল বেয়ে। চিবুক ছাড়িয়ে জামায় গিয়ে মিশ খাচ্ছে তা। চোখ মুখ খিচে রইল অর্নিলা। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, ”হ্যাঁ, আমি বোকা! বোকা বলেই আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারলেন।”
“কি করেছি আমি?”
”কি করেছি জিজ্ঞেস করছেন? ওটা কি? আপনি আমার দিকে নজর রাখছেন ফারাজ ভাই! কেন ? কি কারণে? আমায় বিশ্বাস করেন না আপনি? বিশ্বাস যদি নাইবা করবেন তবে কেন বললেন ভালোবাসি। ছলনা করলেন আমায় নিয়ে। এভাবে কষ্ট দিলেন।”
সারফারাজ স্তব্ধ হয়ে রইল। দক্ষিণ দিকের জানালা এখনো খোলা। সেখান থেকে মৃদু বাতাস ছেয়ে গেল ঘরের মধ্যে। পর্দার উলোটপালোট শব্দ। অর্নিলা চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে আজ ভালোবাসার দেখা মিলছে না। ভয়ং কর ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে সারফারাজ। তার ঠোঁট নড়ছে। ঘটনাটা এমন বিশ্রী রূপ ধারণ করবে সে স্বপ্নে ভাবেনি। ঢোক গিলে শান্ত স্বরে বলে উঠল, “অনি, তুই যা ভাবছিস ব্যাপারটা তেমন নয়। এটার কারণ অন্য কিছু।“
“কোন কারণ ফারাজ ভাই? আপনিই তো বলছিলেন রক্ত কখনো রক্তকে ভুলে না। আমার শরীরে তো আমার বাবার রক্তই বইছে। তাই আমায় বিশ্বাস করতে পারলেন না। ধোঁকা দিলেন আপনি আমায়!”
সারফারাজ সারা শরীরে যেন হুট করেই ক্লান্তি অনুভব করল। এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে তার হাত দুটো ধরে ফেলল। কোমল স্বরে বলল, ”এমন না অনি। আমি সত্যিই তোকে বিশ্বাস করি।”
“তাই!” দুই হাত দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে নিল। শক্ত কণ্ঠে শুধালো, ”তবে বলুন? কেন লাগিয়েছেন এটা এখানে? কোন কারণে?”
সারফারাজ নিশ্চুপ। জবাব দেবার মতো কথা গুছিয়ে নিতে পারছে না সে। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। অর্নিলার চোখে মুখে কঠোরতা ছেয়ে গেল। নিচুস্বরে বলে উঠল, ”আমার জবাব আমি পেয়ে গেছি!” বলামাত্র বাসার দরজা খুলে বেরিয়ে গেল তার। তার অন্ধ্র রন্ধ্র সব যেন প্রতিবাদী হয়ে উঠল। থাকবে না সে এখানে। ফারাজ ভাইয়ের এমন কাজ তার মনকে পিষিয়ে দিয়েছে। ধূলি সাৎ করে দিয়েছে তার ভালোবাসাকে।
সারফারাজ কিয়ৎকাল থমকে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ঘোর ভাঙল। মনে পড়ল অর্নিলা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কঠিন পদার্থের আইসক্রিম তখন তরল পদার্থে ধারণ নিয়েছে। সারফারাজ ছুটে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। বাইরে এসে এ গলি, ও গলি ছুটল। বেশিক্ষণ তো হয়নি। এতোটুকু সময়ে মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল? তাদের এলাকা আবাসিক এলাকা। রীতিমত সন্ধ্যার পর পুরোটা এলাকা জুড়ে নিস্তব্ধ রূপ ধারণ করে। মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সারফারাজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই ঢাকা শহরে অনির পরিচিত কেউ নেই যার বাসায় গিয়ে সে উঠবে। এক হতে পারে মোহনগঞ্জ! সেখানে চলে যায়নি তো আবার। গাড়ি নিয়ে চারদিক ভালো করে খুঁজতে খুঁজতে রেলস্টেশনে এসে পৌঁছাল। অস্থির হয়ে টিকেট কাউন্টারে এসে ছুটতে লাগল। মোহনগঞ্জের লাস্ট ট্রেন মিনিট দশেক পর ছাড়বে। সারফারাজ ছুটছে। পুরো স্টেশন খুঁজছে। অথচ খুঁজে পাচ্ছে না তাকে। ডান হাতে বারান্তরে ফোন নাম্বার ডায়াল করে যাচ্ছে। ফোন এতোক্ষণ বোধহয় বাজছিলো। এখন আর বাজছে না। হঠাৎ করে এখন থেকেই বন্ধ বলছে। সারফারাজ দাঁড়িয়ে গেল হুট। তার পুরো শরীর কাঁপছে। কিছু একটা গোলমেলে ঠেকছে।
পরনে তার বাদামী রঙের টি শার্ট ঘামে পুরো ভিজে উঠেছে। মাথার ঘন চুলগুলো অবধি ঘামে আঠালো হয়ে উঠছে। অনির হঠাৎ ফোন বন্ধ থাকার বিষয়টা ভালো ঠেকছে না তার কাছে। মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে লাগল। অথচ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছে না। নার্ভ কাজ করছে না। অর্নিলা বাসা থেকে বের হয়েছে এক ঘণ্টার কম সময়। এর মধ্যে রেলস্টেশনে সে এসে পৌঁছাতে পারবে না। পারলেও তার আর সারফারাজের মধ্যে ব্যবধান বেশি নয়। কারণ সারফারাজ সিগন্যাল ভে ঙে হম্ভি তম্ভি করে গাড়ি চালিয়ে এদিকে এসেছে। হঠাৎ স্থির নয়নে পুরো স্টেশনে দৃষ্টিপাত করল। অনি এখানে থাকলে তার আর অনির সাক্ষাৎ না হওয়ার বিষয়টা কাকতালীয় হতেই পারে না। ট্রেন ছেড়ে দিবে এখন। ধীরে ধীরে ট্রেন আগাচ্ছে। সারফারাজ নিশ্চুপ নয়নে খোঁজ চালাচ্ছে। তার মন বলছে অর্নিলা এখানে নেই। এখানে কেন? কোথাও নেই। তার আশপাশে কোথাও অনি নেই? তবে অনি গেলো কোথায়?আচমকা ফোনটা বেজে উঠলো। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে রিসিভ করে কানে দিল। ওপাশ থেকে আরিফ হাসান হম্ভিতম্ভি করে বলে উঠলেন, “সারফারাজ! সারফারাজ অনি কোথায়?”
সারফারাজ নিরুত্তর। তার কাছে কোন জবাব নেই। নিশ্চুপ হয়ে রইল সে। আরিফ হাসান বিরক্তি স্বরে আবারো জিজ্ঞেস করলেন, ”সারফারাজ। এনসার মি? হোয়্যার ইজ অনি? ও কি তোমার সাথে নেই!”
সারফারাজ অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ”না!”
ওপাশ থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ। আরিফ হাসান বোধহয় হত’ভম্ব হয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ধীর স্বরে বলে উঠলেন, “তাহলে কি সত্যি সত্যি তারা অনিকে কিড ন্যাপ করে ফেলল!”
সারফারাজ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। কি বলল বাবা! অনি কিডন্যাপ হয়ে গেছে। বাবা ভুলভাল কি বলছে? নাকি সত্যিই অনি… সারফারাজ ফোনটা নামিয়ে রাখল। তার পাশ বেয়ে দ্রুত গতিতে ট্রেন চলে গেল!
#চলবে….