চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-২৩

0
499

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৩

পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। ইয়াতিম শিকদার শুধু পারেনি তাদের শাসিয়ে যেতে। যেভাবেই হোক না কেন, তার ছেলের এমন হাল যে করেছে তাদের খুঁজে বের করতেই হবে। যেভাবেই হোক। পুলিশ কমিশনার সালাউদ্দিন সাহেব কে এই অবধি বোধহয় ৫ বারের মতো ফোন করে ফেলেছেন। সালাউদ্দিন সাহেব রেগে এখন আর ফোন তুলছেন না। ঘটনাটি খুব মর্মা ন্তিক, ছেলের এমন অবস্থায় বাবার অস্থির হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তারাও তো বসে নেই। নিয়াজ শিকদারের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল ও তারা পরিদর্শন করেছে। লাভ হয়নি তেমন। গতরাতের বৃষ্টির পানিতে সব ধুয়ে মুছে গেছে। হতে পারে খু’নির পরিকল্পনীয় ঘটনা। তবে বৃষ্টি আসার ব্যাপারটা কাকতালীয়। নাকি পুরো ঘটনাই কাকতালীয়। মে রে ফেলার ইচ্ছে হলে পুরোপুরি মে রে ফেলতে পারত। আধমরা করে রেখে কোন লাভ হয়নি। নিশ্চিত কোন নেশা ঘোর গাড়ি চালিয়ে আচমকা তু লে দিয়েছে। হ্যাঁ, এটাই হবে হয়তো। কিন্তু ধারণার উপরে সব কিছু ছেড়ে ফেলা যায় না। মিস্ট্রি! জল অনেক ঘোলাটে। নিয়াজ শিকদারের কথাবার্তা আরো অস্পষ্ট। কোথায় গিয়েছিলো? কোথা থেকে এলো কিছুই জানা গেলো না। সালাউদ্দিন সাহেব ফাইল ঘাটছে। ভিক্টিমরা এখানকার নয়। ছেলের বিয়ে ঠিক করতে এখানে এসেছিলো। যাক বিয়ে ঠিক হলেও বিয়ে হবার অবস্থাতে নেই। হাসপাতালে ফোনের মধ্যেই বিয়ে ক্যান্সেল। এক্সি ডেন্ট হতে দেরি বিয়ে ভাঙতে দেরি নেই। সাব্বাস। বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায়। এখানে চেনা জানার মধ্যে আছে কেবল এক আত্মীয়র বাড়ি, যেখানে তারা থাকার জন্য ছিলো। আর এক হচ্ছে ভাইয়ের মেয়ের বাসা। যেখানে তারা দুজন দম্পতি থাকে। ঘটকা লাগার মতো কিছু পাচ্ছে না, অথচ ঘটকা থাকার মতো অনেক কিছু্ই আছে। এই যেমন, সারফারাজ শেহদাত। পেশায় একজন ডাক্তার। ছেলের চাচাতো বোনের জামাই। তাকে দেখে কেমন সন্দেহ হলো। অথচ কোন প্রমাণ নেই। এতো বড় ঘটনায় ভদ্রলোক একদম নিষ্প্রাণ। এখানে খোঁজাখুঁজি করে কোন লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এখানে তেমন কিছু নেই। আশেপাশে সিসি ক্যামেরাও ছিলো না। মোক্ষম জায়গায় মে রে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার বলছে খু ন! হ্যাঁ, খু নের চেষ্টা। এরও কারণ আছে বৈকি। গাড়ি চা পা দিয়ে সোজা চলে যায় নি। আবারো ব্যাক এসেছে। এ কারণে ঘটনাস্থলেই তার পা দুটো আ লাদা হয়ে গেছে। প্রাণে বেঁচেছে এই ঢের। ঢের বলে কি লাভ? কোন ভবিষ্যৎ নেই। কে জানে কত্তদিন এভাবে বসিয়ে খাওয়াবে। দুদিন পর দেখা যাবে মসজিদের সামনে চেয়ার বসিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে!

সন্দেহের তালিকায় আরো আছে। নিয়াজের ভাবী! ভদ্রমহিলার নাম মনে পড়ছে না। হাসপাতালে আসার পরপরই কান্নাকাটি শুরু। ম রে তো যায় নি তবুও ম রা কান্না। এযেন দেখানোর জন্যই কাঁদছে। ভিতরে ভিতরে সমস্যা আছে। সম্পত্তির বিষয় হতে পারে। আবার নিয়াজের বিয়ের কথা চলছে। হতে পারে প্রাক্তন প্রেমিকা রেগে গিয়ে এমনটা করেছে। হতেই পারে, এই পৃথিবীতে কি আবার অসম্ভব। খোঁজ আরো চালাতে হবে। মোহনগঞ্জ যেতে হবে। নিয়াজের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল। পেটে কিছু পরেনি। এবার লাঞ্চ সেরে ফেলা দরকার। যাক উঠতে যাবে,‌আবারো ফোন বাজে। আবার কে? ওহ, ইয়াতিম শিকদার! থাকুক তার ফোন আর তুলছি না। কি ভাবে? পুলিশরা কি মিরাক্কেল জানে। ৮ ঘন্টার মধ্যে কেস সলভ করে দিবে? হুঁ! এতো সোজা নাকি! সময় লাগবে,‌ ধৈর্য্য লাগবে। দই জমাত বাঁধলে খেতে মজা লাগে। পানসে দইয়ের সাধ আছে নাকি আবার? বেরিয়ে গেল সালাউদ্দিন সাহেব। ক্ষিধে এবার ভালো মতোই পেয়েছে!
.
সারফারাজ দীর্ঘ ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ঢুকল। অর্নিলা ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। সেই ভোরে বের হয়েছিল। এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে। ক্ষিধেয় পেট চু চু করে করছে। সারফারাজ তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ফ্রেস হয়ে নে। খাবার তো কিনেই এনেছি। ওগুলো খেয়ে ফেলব।”

“গরম করে দেবো?”

“না, গরমই আছে। তুই ফ্রেস হয়ে নে। বেশি খারাপ লাগলে গোসল সেরে নে। তবে তাড়াতাড়ি!”

অর্নিলা মাথা দুলাল। সারফারাজ বাথরুমে ঢুকে পড়ল। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল সে। সারা শরীর ব্যাথা করছে। হাসপাতালে থাকলে যেন খুব ক্লান্ত লাগে। কেন লাগে সে জানে না! তবে ভীষণ ক্লান্ত। চোখ দুটো যেন গর্তের মধ্যে চলে গেছে। মুখে কালচে ভাব। কি কুৎসিত লাগছে দেখতে! আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে বিরক্ত হলো। এগিয়ে যাবে অমনি ফোন বেজে উঠল। কার ফোন বাজে? ফারাজ ভাইয়ের! হাতে তুলে নিল ফোনটা। ডা. সাবিনা ইয়াসমিন! রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠসর। থামবার ফুরসত নেই। এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছে, ”ডা. শেহদাত। আপনি আজ হাসপাতালে এলেন না কেন? ইনফর্ম ও করেননি? কারণ কি? ডা. শেহদাত!আমার কথা শুনতে পারছেন? আনসার মি!”

”জি!

“কে?

”আমি। ড. শেহদাতের স্ত্রী বলছি।

”ওহ, হ্যাঁ একটু বরের দিকে নজর দিন। এতো উদাসীন হলে চলে না। কোন রিসপনসিবিলিটি নেই নাকি?

“দু্ঃখিত, আসলে আমার এক আত্মীয় এক্সিডেন্ট করেছিলো। সেখানে গিয়েছিলেন তো তাই আজ যেতে পারেনি।”

“গ্রেট! সেখানে গিয়ে অবশ্যই তিনি রোগীকে বাঁচায় নি। তেমন তো হবার কথাও না। ডাক্তার হিসেবে তাকে এখানে দরকার ছিলো নাকি ওখানে।”

অর্নিলা ভ্রু কুঁচকে নিল। এই মহিলা তো অনেক বকবক করে। ইচ্ছে করে ধপ করে একটা ঝারি দিতে। মাথা যন্ত্রণা উঠে গেছে তার কথা শুনে। বিরক্ত হয়ে সে ধপ করে ফোনটা কেটে দিলো। ওপাশে থাকা ডা.সাবিনা হত’ভম্ব হয়ে গেল। এ কি ধরনের অভদ্রতা। সে তো এখনো কথা শেষ করেন। আবারো ফোন করল ফের। আশ্চর্য! ফোনটাই বন্ধ করে দিয়েছে। রাগ চেপে নিল মনের মধ্যে। ডা. শেহদাতের দেখা পাক, তাকেই বোঝাবে।

খাবার টেবিলে দুজন বসে। অর্নিলা একটু খেয়ে আর খাচ্ছে না। সারফারাজ খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”

“কিছু না। ভাবছি। খুব আশ্চর্য লাগছে?”

“কোন ব্যাপারে আশ্চর্য লাগছে?”

“এই‌ হঠাৎ করে এক রাতের মধ্যে কতো কিছু হয়ে গেলো বলুন।”

“যে যেমন কর্ম করে, তেমন ফল পায়। কথাটা শুনেছিস।”

“হ্যাঁ, জানি।”

“তাহলে এসব ভাবা বন্ধ দিয়ে চুপচাপ খেয়ে নে। আমার ঘুমাতে হবে। কাল মেডিকেল ও যেতে হবে।

“তো আপনি ঘুমান। আমায় কেন বলছেন?”

“ আশ্চর্য! একা একা ঘুমাবো নাকি?”

“ঘুমাতে বুঝি সঙ্গী লাগে!”

”অবশ্যই লাগে। দু মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে আয়। দু মিনিট মানে দু মিনিট!

“না এলে কি করবেন ফারাজ ভাই? ঘরে ঢুকতে দিবেন না বুঝি?”

“তোকে তুলে নিয়ে যাবো।”

”অ্যাহ, আসছে। হইছে যান আপনি এখন।”

সারফারাজ খাওয়া শেষ করে উঠে রুমে গেল। অর্নিলা দ্রুত খাওয়া শেষ করল। যা ছিলো ফ্রিজে রেখে দিয়ে হাত ধুতে বেসিনের দিকে গেল। হাত ধুয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠল। আচমকা সারফারাজ তাকে কোলে তুলে নিল। অর্নিলার দৃষ্টিতে বিস্ময় ঘেরা। সারফারাজ মিটিমিটি হেসে বলল, “বলেছিলাম নাহ, না এলে তুলে নিয়ে যাবো।”

অর্নিলা তার গলা জড়িয়ে ধরে হেসে উঠল। এই প্রথমবার ফারাজ ভাই তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। বেচারী শরমে প্রায় অস্থির হয়ে উঠল। কুণ্ডলী পাকিয়ে তার বুকের মধ্যে লুকিয়ে গেল। সারফারাজ তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
.
পরদিন মেডিকেলে ডা. সাবিনা পেশেন্ট দেখছে। পাশে সারফারাজ দাঁড়িয়ে থেকে খাতায় নোট করছে। লাস্ট পেশেন্ট। প্রায় গত দু ঘন্টা ধরে এই কাজ চলছে। পেশেন্ট দেখে কেবিন থেকে দুজন বেরিয়ে গেলো। দুজনেই পাশপাশি হাঁটছে। ডা. সাবিনা জিজ্ঞেস করলেন, ”আত্মীয় কেমন আছে? যার এক্সি ডেন্ট হয়েছিলো?”

সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ডা. সাবিনা কিভাবে জানল সে বুঝতে পারছে না। তিনি আবার শুধালেন, “কে এক্সি’ডে’ন্ট করেছে? আপন কেউ?”

”না, তেমন কেউ না। আমার স্ত্রীর চাচাতো ভাই।

”‌বেঁচে আছে?”

“হ্যাঁ, পা দুটো নেই।

“ওহ আচ্ছা।

অতঃপর ডা. সাবিনা নিজের কেবিনের দিকে গেলেন। সারফারাজ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। এই মিস্ট্রি সে সলভ করতে পারছে না। ফোন বের করে কললিস্ট ঘেঁটে দেখল। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। ডা. সাবিনা কল দিয়েছিল আবার কথাও হয়েছে! কখন? অনি কি তবে কথা বলল। হতে পারে। ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সে।

নিয়াজকে নিয়ে ইয়াতিম শিকদার মোহনগঞ্জ ফিরে গেছে আজ দুদিন। শুনল সেখানে তাদের সাথে কমিশনার সালাউদ্দিন ও গেছে। তদন্ত বোধহয় ভালো ভাবেই চলছে। তবে সারফারাজের কোন চিন্তা নেই। সে নিশ্চিতে তার রাতের খাবারের পর এক কাপ কফি বানালো। এই কফি শেষ করে ওই দিকের ঘরের দরজায় নক করবে। সেখানে অর্নিলা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। দরজা খুলবে না। আজ নাকি সে আলাদা ঘুমাবে। কি অলক্ষণে কথা। মেয়েটার মাথায় সারাদিন কি যে ঘুর ঘুর করে সে জানে না। কফি টুকু শেষ করে দরজায় টোকা দিল। ওপাশ থেকে অর্নিলা বলে উঠল, “আমি দরজা খুলব না।

“তুই কি সত্যিই আমার সাথে ঘুমাবি না অনি?”

“না, আজ আমি একাই ঘুমাবো।

“কেন?”

অর্নিলা মুখে চানাচুর ঠুসে বলল, “কারণ , কাল আমার এক্সাম।”

“রাতভোর তুই পড়াশোনা করবি? একথা আমায় বিশ্বাস করতে হবে? দরজা খোল।”

“একদম না।

”বেশ, আমি তবে যাচ্ছি। আর সাধবো না তোকে।“

সারফারাজ চলে গেল। অর্নিলা দরজায় আড়ি পেতে শুনল। সত্যি সত্যিই কি চলে নাকি? মুখে চানাচুর চিবুতে চিবুতে দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিল। ওপাশে দরজায় সারফারাজ কে উঁকি মারতে দেখে তার বুক কেঁপে উঠল। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। দরজা খুলে সারফারাজ ঘরে ঢুকে গেল। আচমকা তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “কি ভেবেছিলি? এতো সহজে ছেড়ে দিবো নাকি?”

“আপনি আমায় এভাবে ঠকালেন ফারাজ ভাই? না এটা হবে না।”.

“বসে বসে চানাচুর খাওয়া হচ্ছিল? এই না তুই পড়াশোনা করছিলি?”

অর্নিলা দাঁত বের করে হেসে বলল, “এই খেয়ে দেয়ে পেট শান্তি করে পড়তেই বসব।

“উহু হচ্ছে না সেটা।”

ফট করে কোলে তুলে নিল। অর্নিলা খুশি মনে তাল গলা জড়িয়ে ধরল। সারফারাজ তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, “তুই ইচ্ছে করে এমনটা করিস, তাই না! যাতে আমি তোকে কোলে তুলে নিই।”
অর্নিলা দাঁত বের করে হেসে মাথা দুলাল। সারফারাজ চোয়াল শক্ত করে বলল, ”বেশ, এরপর থেকে দেখিস কি করি?”

“কি করবেন ফারাজ ভাই?”

ফারাজ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসয়ে বলল, “সারাদিন যেন তোর কাউকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হয় সেই ব্যবস্থা করব।”
অর্নিলা কিছুক্ষণ চোখের পলক ফেলে পিট পিট করে চেয়ে দেখল। তার কান দিয়ে কেন মনে হচ্ছে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। ইশ, ফারাজ ভাই ইদানিং এমন এমন কথা বলে লজ্জায় সে ম রে যায়।
রাত তখন আড়াটে কি তিনটা। সারফারাজের বুকের মধ্যে জায়গা দখল করে ঘুমিয়ে আছে অর্নিলা। সেও ঘুম। কোন হুদিশ নেই। এর মধ্যেই ফোনের টুং টিং শব্দ। ঘুমের ঘোরে ফোনটা রিসিভ করে কানে কানের কাছে নিল। শুধালো, “কে?”

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে