চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-২২

0
495

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২২

অর্নিলা রান্নায় ব্যস্ত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। ইদানিং তাদের বাসায় খুব গ্যাসের সমস্যা করছে। দুপুর হতেই গ্যাস প্রায় চলেই যাচ্ছে। এই নিভো নিভো গ্যাসে কিছু রান্না করা সম্ভব নয়। তবুও অর্নিলা সব গুছিয়ে রেখে দেয়। মানুষটা আসলে তাকে খেতে দিতে হবে। সে আজ অবধি খাবার নিয়ে কোন অভিযোগ করেনি। দেরি করে খেতে দিলে খেয়ে নিয়েছে। জিজ্ঞেস ও করেনি দেরি হলো কেন। বরং তাড়াহুড়ো দেখলে এসে হাত বাটায়। অনির ভালো লাগে। আবার দুঃখ পায়। ইশ! বাইরে থেকে করে এসেও লোকটা এখন ঘরেও কাজ করবে। ভালো লাগে না তার।

গ্যাস এসেছে সব মাত্র। তোড়জোড় করে রান্না করছে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। অর্নিলার চোখ মুখ চকচক করে উঠল। ফারাজ ভাই এসেছে! হ্যাঁ, কখনো কখনো এই সময়ও আসে। তরকারির চুলো কমিয়ে দিয়ে ছুট দিলো সে। সদর দরজা খুলে নিয়াজ কে কোনভাবেই আশা করেনি। কাজের চোটে শাড়িটাও এলোমেলো হয়ে ছিল‌। ঠিক করে নিল। নিয়াজের চোখ কোন দিক থেকে কোন দিক যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। চোখে কালো সানগ্লাস। অনি অবাক হয়েছে বটে। থমথমে স্বরে বলল, “ভাইয়া আপনি!”

নিয়াজ আমতা আমতা করছিলো। বলল, “ওহ হ্যাঁ, ওই এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দেখা করে যাই।”

অর্নিলা দু সেকেন্ড চুপ থাকল। বাসায় সে একা, কেউ নেই। নিয়াজ কে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। সবাই বলছে নিয়াজ ভাই বদলে গেছে। সত্যিই কি তাই। বছর পেরিয়েছে। সময় বদলেছে। মানুষের আচরণের কি পরিবর্তন হয় না। ঘড়ির দিকে ফিরে চাইল। ফারাজ ভাইয়ের আসার সময় হয়ে গেছে। ভয় খানিকটা কমছে। অর্নিলা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল। বলল, “আসেন ভাইয়া ভেতরে আসেন।”

নিয়াজ পায়ের জুতো খুলে ঘরে প্রবেশ করল। অর্নিলা দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাকে সোফায় বসতে বলল। একটু পর পর ঘড়ির দিকে চাইছে। সারফারাজ একটু বাদেই এসে পড়বে। তখন আর ভয় থাকবে না। একদম না। নিয়াজ চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ বলে উঠল, “সারফারাজ বাসায় নেই?”
অর্নিলা যেন হকচকিয়ে গেল। বিস্মিত চাহনিতে ফিরে তাকাল। অস্ফুট স্বরে বলল, “এই তো আসবে। একটু আগেই কল করেছে।” কথাটা বলে মন যেন শান্ত হলো। নিয়াজ চোখের চশমা খুলে সামনে রাখল। অর্নিলার স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে। শুধায়, “চাচা কোথায়?”

“বাসাতেই আছে। বের হবার সময় দেখলাম শুয়ে আছে।”

“ওহ, তো তুমি এখানে কেন ভাইয়া? কি দরকার ছিলো?”
নিয়াজ মুখের দিকে চেয়ে থাকল। নিরুত্তর সে। অর্নিলা হাসার চেষ্টা করল। পরিস্তিতি বদলে যাচ্ছে কেমন করে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তার কপাল জুড়ে। বিচলিত হয়ে রান্না ঘরে ছুটে এলো। এখন মনে হচ্ছে নিয়াজকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে একদম ঠিক কাজ করেনি সে। ভুল করেছে। বিরাট ভুল। গ্লাসে পানি ঢেলে তরতর করে খেয়ে ফেলল। চুলোয় তরকারি টগবগিয়ে রান্না হচ্ছে। ধনেপাতা কুচি পড়ে আছে। এগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। আচমকা পিছনে কারো আভাস। অর্নিলা চমকে পিছন তাকাল। নিয়াজের মুখখানি ভয়ং/কর হিং/স্র ঠেকল তার কাছে। গলা শুকিয়ে গেল। থমকে গিয়ে বলল, “তুমি এখানে?”

সে শান্ত কণ্ঠে বলল, ”অনি আমার কথাটা শোন..
বলেই হাত বাড়াল। অনি চোখ রাঙিয়ে উঠল। ঝাঁঝা/লো কণ্ঠে বলে উঠল, “একদম না। ছিঃ, ভাইয়া। তুমি একটুও বদলাও নি। সবার সামনে ভালো সাজার নাটক করছিলে।”

আচমকা হাত ধরে টানতে লাগলো নিয়াজ। তার কণ্ঠ এখনো শান্ত। বলল, “আমার কথাটা শোন অনি।”

অর্নিলা মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠলো, ”না না, তোমাকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে আমি ভুল করেছি। একদম উচিত হয় নি তোমাকে বিশ্বাস করে। তুমি বদলাও নি। একফোঁটা বদলাও নি। ছাড়ো…. কথা বলতে পারল না। নিয়াজ বেশ ঠান্ডা মাথার লোক। পরিকল্পনা যেন করাই ছিল। মুখ চিপে ধরে রান্নাঘর ছেড়ে বের করিয়ে আনছে। অনি হাঁস/ফাঁস করছে তার হাত থেকে ছুটতে। বসার ঘরে এসে যেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল। নিয়াজের হাত ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল। শেষবারের নিয়াজের আ/ক্রমণ এসে ঠেকল তার পিঠেতে। ব্লাউ/জের খানিকটা অংশ যেন ছিঁ/ড়ে পিঠে আঁচ/ড় বসে গেল। সামনের ফুলদানি হাতে নিয়ে ঘুরে তাকাল অনি। দুজনেই নিস্তব্ধ।‌ বদ্ধ ঘরে দুজনের শ্বাস প্রশ্বাস ছাড়া আর কিছুর শব্দ ঠেকছে না। চুলোয় তরকারীর তেজ বাড়ছে। অনি শাসি/য়ে উঠল, “আর এক পা না, আমি কিন্তু আগের মতো আর ছোট নেই। আমার হাত থামবে না।”

নিয়াজ চমকিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে। ঢোক গিলে বলল, ”অনি!”

অর্নিলা ফুলদানি আঁচ/ড়ে মেঝেতে ফেলল। মেঝের চারদিকে ফুলদানির ভা/ঙা টুকরো ছড়িয়ে। সে দ্রুত ভা/ঙা টুকরো হাতে তুলে নিল। নিয়াজ দু পা পিছিয়ে গেল। তার চোখে মুখে এখন খানিকটা ভয়ের আভাস। অনি বড় ঠান্ডা গলায় কড়াভাবে বলল,‌”বের হও, এখুনি! আর কখনো আসবেনা এখানে!”

নিয়াজ কিৎকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। না, এই অনি আর আগের মতো নেই। বুঝল, এখানে তার জোর ঠেকবে না। নিঃশব্দে সে পালিয়ে গেল। অনি ছুটে এসে দরজা বন্ধ করল। ক্লান্তিতে মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। দরজায় ঠেসে মেঝেতে বসে পড়ল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। এই মানুষ গুলো কেন এতো নোং/রা, এতো কেন কুৎ/সিত! এতো কিছুর পরেও তাদের শিক্ষা হয় না। কেন বার বার তার সাথেই! কাঁদতে কাঁদতে শ্বাস উঠে গেল। শ্বাস নিতেও এবার কষ্ট হচ্ছে। কতোক্ষণ এভাবে ছিলো জানে না। যখন বোধ হলো, সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল। তরকারির চুলো বন্ধ করে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। পুরো বাসা এবার নিস্তব্ধ, নিঝুম। তবুও এখানে মন খুলে শ্বাস নিতে পারছে না অনি। মেঝে পরিষ্কার করল, পরনের শাড়িখানা বদলে নিল চট করে। ফারাজ ভাইয়ের মাথা গ/রম এমনিতেই। আজকের ঘটনা জানতে পারলে নিয়াজকে প্রাণে মে/রে ফেলবে কোন সন্দেহ নেই। এসব ঝামেলা কিছু চায় না সে। আজকের এই বিষণ্ণ বিকেলের জঘন্য ঘটনাগুলো স্বপ্নের মতো ভুলে যেতে চায়। কোন ঝামেলা চায় না, কোনোরকম না!

তবুও যেন সে আঁসফাঁস করছে। বিকেলে দেখা লোকটাও এখন বেডে শুয়ে। দুটো পা নেই, পঙ্গু হয়ে গেল সারাজীবনের জন্য। বিধাতা এতো তাড়াতাড়ি তার বিচার করে ফেলল? এসব লোকের প্রাপ্ত শাস্তি কি এটাই! ইয়াতিম শিকদার দরজার বাইরে কঠোর মুখে বসে আছে। তিনি যে কতোটা চিন্তিত বুঝানো যাবে না। তার বংশের ছোট ছেলে। বংশ নিয়ে আবার চাচা একটু বেশিই সিরিয়াস থাকে। শুনল, ভাইয়া ভাবী রওনা দিয়েছে। বোধহয় সকালের মধ্যেই চলে আসবে। ফারাজ ভাই আশেপাশে নেই। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছেন। সত্যি বলতে নিয়াজের জন্য অনির একটুও খারাপ লাগছে না। কিন্তু মায়া হচ্ছে তার চাচার জন্য। এই চাচা তার কাছে তার বাপের সমান। চাচার কাছে এগিয়ে এলো। আলতো স্বরে বলল, ”চাচা, মন খারাপ করবেন না। আল্লাহ যা করার করেছে, এখানে তো আপনার হাতে কিছু নেই।”

কথাটুকু কানে যাওয়া মাত্র ইয়াতিম শিকদার ছ্যা/ত করে উঠল। চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল, “ছা ড়মু না, আমার পোলার যে এই হাল করছে তারে ছা ড়মু না। অনি তুই এখানে থাক, আমি থানায় যামু।”

অনি বাঁধা দিতে চাইল। চাচা কথা শোনার পাত্র নন। পেছনে এসে দাঁড়াল সারফারাজ। বলে উঠল, “যাবেন, কিন্তু এই ভোররাতে গিয়ে কাউকে পাবেন বলে মনে হয় না। একটু অপেক্ষা করেন, সকাল হোক।”

ফিরে চাইল সারফারাজের দিকে। এরপর সামনে হেঁটে পাইচারি করতে লাগল। বিরবির স্বরে বলছে, “ছাড় তাম না, কাউরে ছাড় তাম না। আমার পোলার সারাজীবন নষ্ট কইরা দিছে। ওরে আমি ছাড়তাম না!”

অনি ছুটে আসল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। তাকে বিচলিত দেখে সারফারাজ তার মাথায় হাত রাখল। চোখ বুলিয়ে বলল, ”কি হয়েছে?”

”চাচা খুব রেগে আছে।”

”থাকুক রেগে।

“কিছু কি করা যাবে না।”

“একদম না। পা দুটো হারিয়েছে, জীবন হারা য়নি এইই বেশি।

“কি করে হলো বলুন তো।”

“এটা ঢাকা শহর অনি। রাস্তায় অগনিত গাড়ি চলাফেরা করে। তখনি হয়তো..

“বিয়েটা বোধহয় হবে না।

“এই প ঙ্গু ছেলেকে কে বিয়ে করবে অনি? মানুষকে ভালোবাসা যায়। অমানুষ কে না।”
অনি ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থেকে ফারাজ ভাইয়ের কথা শুনছে। সে মৃদু হেসে বলল, “তোর কি খারাপ লাগছে অনি?”

অনি মাথা দুলিয়ে না বলল। ক্ষীণস্বরে জবাব দিলো, “চাচার জন্য খারাপ লাগছে। ছেলের এমন অবস্থায় চাচা ভেঙে পড়েছে একদম।”

সারফারাজ ইয়াতিম শিকদারের দিকে ফিরে তাকাল। ভ্রু কুঁচকালো। তার জন্য বিন্দুমাত্র মায়া তার হচ্ছে না। কারণ এই লোক নিজেও একটা অমা নুষ। ছোট ফুফু যখন ভাইয়ের কৃতকর্মের কথা তাকে জানিয়ে সাহায্য চেয়েছিল তখন সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বলেছিলো “বড় বংশের ছেলেরা এমন একটু করবেই।” এখন দেখুক সেই বংশের ছেলের হাল। অর্নিলা এসব কিছু্ই জানে না বলে তারা মায়া বেশি। বেশ, না জানুক। এই পৃথিবীর অন্ধকারের ছায়ার সাথে যার পরিচয় যতো কম ততোই ভালো। সে ততোই পবিত্র মনের অধিকারী। এমন শুদ্ধ রমনীই তো দরকার ছিলো তার অশুদ্ধ জীবনে। সারফারাজ অনির হাত আগলে ধরল। ভোর হয়ে আলো ফুটছে। কোন প্রমাণ নেই, মেইন রাস্তায় রক্তে র দাগ সব ধুয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে। বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে কিছু্ই দেখা যাচ্ছিল না। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলো অবধি নিভে ছিলো। কোন প্রমাণ নেই, কিছু নেই। তবুও তার কাজে সে সফল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে