#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৮
দীর্ঘ টানা ১২ ঘণ্টা পর নিজের বাড়িতে ফিরল সারফারাজ। সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। ক্লান্ত লাগছে বড্ড, মাথাও কেমন ঘুরছে। ট্রেনে রাতের ঘুমটা তেমন হয়নি। এরপর তো অপারেশন রুমের টেনশন। ঘুমের কথা প্রায় একদম ভুলেই গেছিল। শেষমেষ যখন অপারেশন রুম থেকে বের হয় তখন ক্লান্তি অনুভব হচ্ছিল। আশ্চর্য, এতোটা ক্লান্ত সে মোহনগঞ্জ থেকে ফিরে এসেও হয়নি। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ মেলে রাখতে পারছে না। ঘাড়ে ব্যাথা অনুভব করছে। একটু একটু পা ফেলে এগিয়ে গেল সে। সিঁড়ি বেয়ে ফ্ল্যাটে এসে চোখ বুলাল। ব্যাগ থেকে খুঁজে চাবিখানা বের করে দরজার সামনে তাকাতেই বোধ হলো, দরজায় তো তালা নেই। আচমকা ঘোর কাটল তার। হকচকিয়ে উঠল। দরজায় তালা নেই মানে। ঘরে তার মানে কে আছে। চারদিক স্তব্ধ, সারফারাজ আরো নিশ্চুপ হয়ে গেল। মাথায় একসাথে অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবনা চিন্তায় পড়ে গেল। অবশেষে কলিং বেল বাজাল।
দরজায় একটু কাছে এসে কান পাতল। কারো এগিয়ে আসার শব্দ পাচ্ছে। যতোই গাঢ় শব্দ হচ্ছে ততোই তার হৃৎপিণ্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজার ওপারে অনাকাঙ্ক্ষিত মুখখানি দেখে বিস্মিতবিমূঢ় হয়ে গেল সারফারাজ। অনি! প্রাণবন্ত মেয়েটার মুখে হাসি, হাতে খুন্তি, শাড়ির আঁচলটাও কোমরে গুঁজা। সহজ গলায় বলে উঠল, ”আপনি এসে গেছেন!”
হতভম্ব কণ্ঠে বলে উঠল, ”তুমি? অনি তুমি এখানে!” সারফারাজের কণ্ঠে আশ্চর্য মিশ্রিত। মাথা ঝাকালো সে। স্বপ্ন দেখছে না তো। অনি এখানে কিভাবে আসবে। আজ তো রুদমিলার বিয়ে। বিয়ে ফেলে অনি একা একা এখানে চলে আসবে। তা হয় নাকি? মা বাবা ওকে আসতে দিল! মনে হাজারো প্রশ্ন। অনি তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। হাতের ছোঁয়া পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল সারফারাজ। এটা অনিই। সে মিথ্যে দেখছে না। অর্নিলা মৃদু হেসে বলল, “তাড়াতাড়ি গিয়ে গোসল সেরে নিন। রান্না প্রায় হয়ে গেছে আপনাকে গরম গরম খেতে দিবো।”
”তুমি সত্যিই বিয়ে রেখে চলে এলে অনি?”
অর্নিলার পিছন পিছন ঘরে ঢুকল সারফারাজ। ব্যাগটা সোফার উপর রেখে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অনি। বলে উঠল, ”তো আর কি করতাম? আপনাকে একা ফেলে ওখানে বসে বিয়ের দাওয়াত খেতাম। তা সম্ভব হতো? আপনাকে দেখত কে ফারাজ ভাই?”
“তাই বলে তুমি এভাবে চলে আসবে! কই আমি তো এতোদিন একাই থাকতাম। কখনো তো অসুবিধে হয় নি।”
হাতের খুন্তি দিয়ে তরকারি নড়াচড়া করছে। এদিক মুখ ফিরিয়ে বলল, ”যখন থাকতেন তখন থাকতেন। তখন তো আর বউ ছিলো না। এখন তো আছে। যান আপনি গিয়ে গোসল করে আসুন।”
“কাজটা তুই ঠিক করিস নি অনি। রুদমিলা কি ভাববে? মেয়েটার বিয়ে অথচ আমরা কেউ নেই। ওর কি মন খারাপ হবে না!“
“না হবে না। মন খারাপ হবে না। ও বরং আরো খুশিই হবে। আপনি বেশি ভাবছেন ফারাজ ভাই!” কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল অর্নিলা। সারফারাজ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। অর্নিলা ক্লান্তি ভরা মুখস্রী তাকে থামিয়ে দিল। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটুখানির জন্য দম ফেলার সময় পায়নি মেয়েটা। অথচ এখনো কাজ করে যাচ্ছে। সারফারাজ এগিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে গেল। গ্লাসে পানি ঢেলে জিজ্ঞেস করল, ”কিভাবে এলি? কে এসেছে তোর সাথে? আরাফাত!”
“না তো। আমি একাই এসেছি!”
হতবাক হয়ে গেল সারফারাজ। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল, “বাবা তোকে আসতে দিলো?”
“কেন দিবে না? আমি বড় হয়ে গেছি না। সব কাজ আমি একাই করতে পারি!” শব্দ করে হেসে ফেলল সে। সারফারাজ মুগ্ধ হয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে গেল তার কথাবার্তা শুনে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মেয়েটা তাকে নিয়ে বড্ড বেশি ভাবে। বড় ভালোবাসে তাকে। তার মায়াবতী সে। তা না হলে কি এভাবে ছুটে আসতে পারে। না শরীরে আর কুলাচ্ছে না। ঘরে এসে সোজা ঢুকল বাথরুমে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো সে। এখন অনেকটা ফ্রেস লাগছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে চোখ পড়ল বিছানার উপর। আর লোভ সামলাতে পারল না সারফারাজ। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে অর্নিলা ভাত বেড়ে তাকে ডেকে এসে দেখে তিনি ঘুমাচ্ছেন। একবার ডাক দিবে বলে ভেবেও তটস্থ হয়ে যায়। না থাক কি দরকার। সে তো ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক না! এখন জাগাতে মায়া লাগছে বড্ড। কিন্তু কিছু খেলো না যে? খালি পেটে ওভাবে ঘুমাবে!
এগিয়ে এলো সে। বিছানার কাছেই তোয়ালে পড়ে আছে। অর্নিলা নরম হাতে তার মাথায় হাত রাখে। ইশ্! চুল গুলো এখনো ভিজে। পানি চুয়ে চুয়ে ঘাড় বেয়ে পড়ছে। তোয়ালে হাতে নিয়ে মুছে দিতে লাগল যত্ন করে। তার নরম হাতের ছোঁয়া জুড়ে যাচ্ছে সারফারাজের কপাল জুড়ে। গতরাতে সারফারাজ চলে আসার পর পরই কোন কিছুতে মন বসাতে পারছিলো না সে। গায়ে হলুদে সবাই নাচছে, গান বাজনা করছে অথচ অর্নিলার মনটা পড়ে আছে সারফারাজের কাছে। তাকে এমন আনমনে দেখে রুদমিলা নিজেই বলে উঠল, “তুই ও তো সারফারাজের সাথে গেলেই পারতিস অনি। শুধু শুধু থেকে গেলি। ছেলেটা ওখানে সামাল দিবে কি করে? তোর মনটা তো ওখানেই পড়ে আছে!” কথাগুলো যেন মনে ধরল অনির। সেই তো, আগে ভেবে দেখল না কেন? সময় নষ্ট করেনি একদম। ভোরের ট্রেনে কাউকে না জানিয়ে ট্রেনে চড়ে গেল। তাকে না পেয়ে যখন আরিফ হাসান হন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন তখনই ফোন করলেন অর্নিলাকে। বেচারি ততোক্ষণে হাতের নাগালে চলে চলে গেছে। বাসায় ফিরতে সম’স্যা হয়নি একদমই। রাস্তা ঘাট ওতো ভালো না চিনলেও জায়গার নাম ঠিকঠাক বলেছে। সিএনজি এসে সোজা থামল বাসার সামনে। যাক চিন্তা রইল না আর।
ফোন বাজছে। রুদমিলার ফোন হয়তো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বিকেল ৪ টা ৪৫ বাজে। ওর বিয়ে তো এতোক্ষণে হয়ে গেছে। নিশ্চিত সে অনেক খুশি। ইশ, বরকে সামনাসামনি দেখা হলো না। যাক তাতে কি? নিজের বর কে দেখে মন ভরানো যাক। নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। কি করেছিলো সে? রোস্ট নিয়ে ছোটাছোটি করেছিলো? ভাইয়া সবার সামনে তাকে বোকা বানিয়েছিলো? অ্যাহ, এসব মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠলো অর্নিলা। সারফারাজ নড়েচড়ে উঠতেই মুখ হাত দিলো তৎক্ষণাৎ। আরেকটু হলেই বোধহয় ঘুমটা ভেঙে যেত তার!
.
তখন চারদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অর্নিলা তার বারান্দায় দোলনার উপর বসে থেকে আকাশ দেখছে। তার হাতের চিরুনির সাহায্যে একটু একটু করে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে। আচমকা পিছনে কারো উপস্থিতি পেয়ে মাথা তুলল সে। সারফারাজ কে দেখতে পেয়ে খানিকটা ঘাবড়ে গেল।
“কি? ভয় পেলি?”
“ও আপনি!”
“কি করছিস?”
”চুল আচড়াচ্ছি।”
বলেই চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। আচমকা তার হাত থেকে চিরুনি নিয়ে নিল সারফারাজ। আলতো করে তার চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। অনি দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসল। বেনী পাকালো। অনেকটা অগোছালো সেই বেনী! কপালে হাত রেখে শুধায়, ”মাথা ধরেছে?”
“হুঁ!”
“চা খাবি?”
”উহু!”
সারফারাজ হাসল। তার মাথা টিপে দিতে লাগল। অর্নিলা চোখ বন্ধ করে নিল। সারফারাজ মৃদু স্বরে বলে উঠল, “দেখ অনি, আমি পুরোপুরি ভালো মানুষ নই। কিন্তু আমার দিক দিয়ে আমি ঠিক আছি। নিন্ততাই এক ভদ্রলোক আমি। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম তাই মা বাবা খুশি। ডাক্তার হতে পেরে আমি খুশি। আমার বন্ধুদের আমি বিশ্বাস করি, তারা আমায় বিশ্বাস করে আমার বন্ধুত্ব সার্থক। আর তোকে ভালোবেসে আমার জীবন সার্থক!”
অনি অনেকটা অমনোযোগ হয়েই কথাগুলো শুনছিলো। শেষের কথাটা তার কানে বাজল। একটু হকচকিয়ে উঠে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। ফারাজ ভাই অমায়িক হাসি দিলেন। অনির চোখে অশ্রু জমে গেল। চোখ সরিয়ে ফেলল সে। কেউ একজন বলেছিলো, যখন তুমি ভালোবাসতে শিখবে তখন দেখবে তোমার হৃদয় অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার কথা শুনে তোমার চোখে অশ্রু জমতে শুরু করবে। সেই অশ্রু একদম মুছে ফেলবে না। সেটা হচ্ছে আনন্দের অশ্রু, তোমার ভালোবাসার সাক্ষী!
#চলবে….