চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-১৭

0
530

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৭

ইরার কথা শুনে ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেল অর্নিলা। আমতা আমতা করে বলল, “কে বলল এসব? এমন কিছু তো না।”

ইরা ভ্রু কুঁচকালো। নাচ উঁচিয়ে বলল,‌ “সত্যি তো। সারফারাজ তোকে সুখে রেখেছে!”

”অবশ্যই। খারাপ কেন রাখবে।”

“হ্যাঁ, শুনেছি আলাদা নাকি থাকছিস। তা অনেকদিন তো হলো। ছয় মাস ত হতেই চলল। কোনো সুখবর নেই!”

অর্নিলা বুক কেঁপে উঠল। ইরা আপু কথাবার্তা কেমন ধা/রালো ঠেকছে তার কাছে। সে পাশ কাটিয়ে বলল, “হবে। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?”

”কিছু নেই। দু বছরের বেশি হয়ে গেল বিয়ের। এখন নয়তো কখন অনি? আমার ছোট ননদের বিয়ের আজ ৬ মাস যেতে না যেতেই সুখবর পেয়ে গেলাম। তোরটা কবে পাবো?”

অর্নিলা মুখ টিপে হেসে বলল, ”তোমার ননদ তো দেখি আপু অলরাউন্ডার! সবাই কি তার মতো নাকি!”

ঝাঝিয়ে উঠল ইরা। “এসব কি কথা? তুই কি এখনো ছোট কিছু বুঝিস না। এখন নয়তো কবে? যত তাড়াতাড়ি হবে ততোই তো ভালো তাই না!”

”কি হবে গো আপু?”

”মজা করিস না অনি। বাচ্চা হবে। বাচ্চার মা হবি কবে?”

”ওহ এই কথা!”
এদিক ওদিক ফিরে তাকাল সে। খুঁজছে একজনকে। গেলো কোথায়? খানিকক্ষণ বাদে চোখে পড়লে। পাশে ফরহাত ভাই দাঁড়িয়ে তার পাশেই শ্রেয়মী। বিয়ের প্ল্যানিং চলছে। আশপাশ আর কাউকে না দেখে অর্নিলা চেঁচিয়ে উঠল, ”ফারাজ ভাই!” সারফারাজ কথা বলছিলো। থেমে পিছনে তাকাল। সাথে ফরহাত আর শ্রেয়মীও চেয়ে রইল। ইরা আপু এখনো ভ্রু কুঁচকে ভাবছে। অর্নিলা চেঁচিয়ে উঠেই বলল, ”ইরা আপু জিজ্ঞেস করছে বাচ্চার‌‌ বাবা কবে হবেন? আমায় বাচ্চার‌ মা কবে বানাবেন?”

কথাটুকু বুঝতে একটু সময় লাগল। বুঝতে পেরে তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। শ্রেয়মী কোনভাবে মুখের হাসি থামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ফরহাত না পেরে জোরে জোরে হাসতে লাগল। ইরা আপু শরমে মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছেন না। অর্নিলা দাঁত বের করে হাসছে। ইরা আপু রেগে তার পিঠে দু একটা কিল ঘু/ষি মেরে বললেন, “চুপ করে বেয়াদব মেয়ে। এসব কথা কেউ এভাবে জোরে চেঁচিয়ে বলে নাকি?”

”আরে বাবা মারছো কেন? ভুল কি বললাম। তুমিই তো জানতে চাইলে। এখন বাচ্চা কি আমি একা পয়/দা করব,‌ বাপ কে তো লাগবে।”

ইরা আপু জিহ্ব কামড় দিলেন। ”ছিঃ ছিঃ এসব কি কথা অনি। তোর মুখে বাঁধছে না এভাবে বলতে। চুপ কর চুপ কর!”

অনি কি আর চুপ করার লোক। ঠিক জায়গা মতো দিয়েছে। ভালোই লাগে তার ফারাজ ভাইকে চাপে ফেলে। ফিরে চেয়ে দেখল সারফারাজ এদিকেই চেয়ে আছে। ভ্রু নাচালো সে। ইরা আপু ইতস্তত বোধ করে সামনে ফিরল। সারফারাজের চোখাচোখি হতেই তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, ”বাচ্চা মানুষ, ওর কথা ধরো না তুমি সারফারাজ!”

”জানি আপু। তুমি বরং এই বাচ্চাকে বড় করো। বড় হলে তবেই না মা হতে পারবে। বাচ্চা কি পারবে আরেক বাচ্চা সামলাতে।”

শ্রেয়মী এবার হেসে উঠলো। ফরহাত পিঠ চাপড়ে বলল, “সেই ভাবে দিল। একদম ১০০ তে একশ।”

ইরা আপু অর্নিলার কান ধরে বললেন,‌ ”ঠিক বলেছো। ওকেই আগে বড় করতে হবে। আয় তুই আমার সাথে। এদিকে আয়!”

টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল অর্নিলা কে। অনি মুখ ফিরে চেয়ে আছে সারফারাজের দিকে। সারফারাজ ডেকে উঠে বলল, ”ইরা আপু, তোমার বাচ্চা বোনকে বলে দিও। বড় হতে। বড় হয়ে গেলে দুদিন লাগবে না বাচ্চার মা হতে। ওর বড় হতেই বরং সময় লাগবে!”

”আপনি আবারো আমার ঘাড়ে দোষ দিচ্ছেন। দেখি ইরা আপু ছাড়ো। লাগছে আমার।” কান ছাড়িয়ে এসে দাঁড়াল সারফারাজের সামনে। বলে উঠল, ”কি জানি বলছিলেন?”

”বলছিলাম তোমায় বড় হতে। তুমি এখনো বাচ্চাই আছো।”

“কে বলল আপনাকে আমি বাচ্চা আছি।”

সারফারাজ ঝুঁকে গেল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “নাহলে এসব কথা এসে বরের কানের কাছে বলতে। চেঁচিয়ে না! বোকা মেয়ে।”

অর্নিলা হতভম্ব হয়ে গেল। ফারাজ ভাইয়ের এমন কণ্ঠস্বর তাকে থমকে দিল।‌ চেয়ে দেখল সারফারাজ ভাইয়ের মুখটা তার অনেক কাছে। ঢোক গিলল সে। সারফারাজ মুখ তুলে তাকাল। ফরহাত কে বলে উঠল, “ইদের পরেই তো বিয়ে। চল অনেক প্ল্যান বাকি।‌ এই বিয়ের পর আরেক প্ল্যান করব।”

অর্নিলা আচমকা বলে উঠল, ”কিসের প্ল্যান?”
সারফারাজ তার দিকে ফিরে হাসল। জবাব না দিয়ে চলে গেল। অথচ অর্নিলা অস্থির হয়ে উঠল। সেই হাসিতেই একটা জবাব ছিল। কি ছিলো সেই জবাব?
.
মাঝরাতে সারফারাজ ঘরে এলো। কালই তো ইদ।‌ কাল বলেও লাভ নেই, মাঝরাত তো চলেই গেছে। তাদের বাড়ির ছাদে আজ আলোয় ঝলমল করছে। প্রতিবারই করে। চাঁদরাতে বাড়ির সবাই জাগে অনেক রাত অবধি। ছাদের কোণায় বসে মেয়েরা মেহেদী পড়ছে। রুদমিলা মেহেদী পরছে না, সবাইকে পরিয়ে দিচ্ছে। সে মেহেদী পরতে যাচ্ছে অমনি সবাই বলে বেড়াচ্ছে, তুমি তো দু’দিন পর মেহেদী পরবে। বরের নাম লেখাবে। আজ বরং আমাদের মেহেদী পরিয়ে দাও। বেচারী সেই কখন থেকে বসে মেহেদী পরাচ্ছে। সিরিয়াল কমছে না বরং বাড়ছে। নাজিয়া এক কোণায় বসে নিজ হাতে মেহেদি দিয়ে ফরহাতের নাম লিখে মিটিমিটি হাসছে। ফরহাত বসে আছে ওই দূরে কোণায়। এতো আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও তাদের চোখে চোখে কথা দেখে সারফারাজ শেহদাত অবাক হয়ে গেল। ফরহাতের সাহস আছে বলতে হবে। ছাদের চারদিক খুঁজেও যখন অনি কে দেখতে পেলো না তখনি ঘরে এলো। একটু আগেও যেন তাকে ছাদেই দেখেছিলো।

ঘরে ঢুকতেই দেখল অর্নিলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো করছে। সেকেন্ডের জন্য সারফারাজ ঘাবড়ে গেলো। অতঃপর ভালো করে দেখতে লাগল। না তার অনি পাগল হয়ে যায় নি। ওই বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। মুখের সামনের চুলগুলো সরানোর বৃথা চেষ্টা। দু হাত মেহেদী দিয়ে রাঙানো। সে এগিয়ে এলো। আয়নার সামনে তার প্রতিবিম্ব দেখে পিছন ফিরল অনি। ফারাজ ভাই ততোক্ষণে আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। অনি থমকে গেল। এই নিয়ে দু’দুবার তার এমন অনুভূতি তাকে জাগান দিচ্ছে তার ভালোবাসার। ফারাজ ভাইয়ের তার দিকে এগিয়ে আসার ব্যাপারটা,‌‌ তাকে কাছ থেকে দেখার বিষয়টা কিংবা তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিচ্ছে। অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে গেল। সারফারাজ বড় আদুরে স্বরে ডেকে উঠল, ”অনি!”

নিচু গলায় বলে উঠল সে, ”হুম!” হাসল সে। হাত দিয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে কানের লতিতে। এগিয়ে গেল এক পা। পিছিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলে ঠেকল অর্নিলার পিঠটা। একটা রাবার বেন হাতে দিয়ে চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে বেঁধে দিল সারফারাজ। অনি বড় বড় চোখ করে দেখছে। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বরের এতো পরিবর্তন! হুট করেই। বিষয়টা ভাবিয়ে তুলছে তাকে। সারফারাজ পিছিয়ে গেছে সেই কখন অথচ তার কাছে থাকার রেশ এখনো ভুলতে পারেনি অনি। তার মুগ্ধ দৃষ্টির প্রতিটা পলকে যেন তার ভালোবাসার জাগান দিচ্ছে। হঠাৎ তার ঘোর ভাঙে। সে জিজ্ঞেস করছে,

“মেহেদী দেওয়া শেষ?”

অর্নিলা হেসে উঠল। বলল, ”হ্যাঁ, এই তো দেখুন আপনার নাম।”

মেহেদীর মাঝে সারফারাজের নামটা যেন জলজল করছে। সারফারাজ শেহদাত। মৃদু হাসল সে। আবারো পিছিয়ে যাচ্ছে। অমনি অর্নিলা ফট করে বলে উঠলো, “তখন কিসের প্ল্যান করার কথা বললে ফারাজ ভাই?”

”কখন?”

“ওই যে তখন। ফরহাত ভাইয়কে যে বললে।”
বড্ড উৎসুক সেই কণ্ঠ। সারফারাজ ক্ষীণক্ষণ চেয়ে থেকে কাছে এগিয়ে এলো আবারো। অর্নিলার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “ওই, তোমাকে বাচ্চার মা বানানোর প্ল্যান!”

শিউরে উঠল অর্নিলা। হঠাৎ করেই সারফারাজের প্রতিটা কথা, তার কথা বলার স্বর সবকিছু তার শিউরে তুলছে। ভয়ংকর ভাবে সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে সে। সম্মোহিত সেই কণ্ঠ। হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। আরাফাত ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ”বুড়ি আছিস?”
সারফারাজ স্বরে দাঁড়াল তৎক্ষণাৎ। অর্নিলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কোমল কণ্ঠে বলে উঠল, “হ্যাঁ আছি!”
.
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এসেছে। আগামীকালই তো বিয়ে।‌ সবাই মহাব্যস্ত। পুরো পরিবার মিলে হাজির হয়েছে ফরহাতের বাসায়। তার বোনের বিয়ে। দায়িত্ব তার কিছুও কম না। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে বৈকি। গান বাজছে ধীরে ধীরে। মেহমান সবে আসতে শুরু করেছে। অর্নিলা হলুদ রঙের শাড়ি পরে বের হলো সবে। তার হাতে গাজরা। খুব শখ ফারাজ ভাই নিজ হাতে এই গাজরা তার খোঁপায় বাঁধবে। মনে মনে তার কতো আশা। বিয়ে তো গতকালই শেষ হয়ে যাবে। এরপর সে তার কাছে আসবে। সেদিন নিজেই তো বলল, বিয়েটা শেষ হোক। লজ্জায় নাক কান লাল হয়ে উঠল অর্নিলা। ছিঃ এসব কি ভাবছে সে। মুখ টিপে হেসে এদিক ওদিক খুঁজে যাচ্ছে। কোথায় গেলো সে?

এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে ফরহাতের দেখা মিলল। তার কাছে নিশ্চয়ই তার হুদিশ মিলবে। জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল, ”ওই তো ওদিকে দেখলাম!” অর্নিলা হেসে সেদিকেই পা বাড়াল। কার সাথে ফোনে যেন কথা বলছে মনে হলো। একটু দূরে দাঁড়িয়েই ভাবছে। কথা শেষ হলেই এগিয়ে যাবে। খানিকক্ষণ বাদে কথা বলা শেষ হলো। অর্নিলার উৎসুক চাহনি যেন সবটা বলে দিতে চায়। কিন্তু তার অস্থির মুখখানা দেখে চেপে গেল। শান্ত কণ্ঠে বলল, ”কি হয়েছে ফারাজ ভাই?”

সারফারাজ ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। এক নিঃশ্বাসে কতোগুলো কথা বলল। সবগুলোই যেন অর্নিলার মাথার উপর দিয়ে গেল। শুধু দুটো কথা শুনল সে। সে চলে যাবে। আজ রাতের মধ্যেই তাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। ইমার্জেন্সি পেশেন্ট আছে। কাল অপারেশন! ড. শরিফুল ইসলাম তাকে সেখানে থাকতেই বলেছে। যেভাবেই তো তার থাকা চাই। রাতের শেষ ট্রেনেই সারফারাজ চলে যাবে। একবিন্দু সময় নষ্ট করেনি। কখন যে তারা দুজন বাবা কে জানাল, কখন যে “নিকুঞ্জ নিবাস” ফিরল, কখন সারফারাজ চেঞ্জ করে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ল কিছু্ই মনে করতে পারছে না অনি। শুধু এতোটুকু মনে পড়ে রেলস্টেশনে তার হাতে তখনো সেই গাজরা। এতোক্ষণ হাতের মুঠোয় থাকার কারণে এখন ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। তার কান্না পাচ্ছে ভীষণ। ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে আরো অনেক আগে। আরাফাত তার পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, ”মন খারাপ করিস না বুড়ি, ভাইয়ার কাজটাই তো এমন।” অনি বুঝল। সামলে নিল নিজেকে। তাকে অনেক কিছু্ই বুঝে নিতে হয় নিশ্চুপে কারণ সে বড় হচ্ছে। বড়রা সবকিছু মুখ ফুটে বলতে পারে না। কখনো না!

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে