চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-১২

0
512

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১২

রাত তখন অনেক গভীর। এই ছোট বিছানার উপর কোনভাবে গুটি শুটি মে’রে শুয়ে আছে অর্নিলা। সারফারাজ দরজার সামনে থেকে অনি কে দেখছে। খোলা জানালা থেকে বাতাস আসছে তীব্রতরে। অনি কাঁপছে। ওর বোধহয় শীত লাগছে। সারফারাজ এগিয়ে গিয়ে জানালা বন্ধ করল। এবার সাদা রঙের একটা লাইট জ্বলছে মাথার উপর। ঘরটা বোধহয় কাঁপছে। ঝাকুনি খাচ্ছে সারফারাজ,‌ তার পুরো শরীর নড়ছে অথচ নড়ছে না তার দৃষ্টি। চোখ অন্যদিকে ফিরছে না। একদৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে অনির দিকে। এই মেয়েটার আর্কষন প্রবল অনেক। ফারাজ সেটা এড়িয়ে চলতে পারে না। সে আরো এগিয়ে গেলো। অনেক কাছে সে অর্নিলার অনেক কাছে। মাথা উপর করে অনিকে দেখছে। চুল গুলো সুন্দর করে বেনুনী করা। ছোট ছোট চুল গুলো কপালে জড়ো হয়ে আছে। সারফারাজ হাত দিলাম সেগুলো সরিয়ে দিল। তার হৃৎস্পন্দন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, সে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। ভালোবেসে ফেলছে অনি কে। কিন্তু এই ভালোবাসা থাকবে তো চিরকাল। চিরকাল রইবে তো এই ভালোবাসার মুগ্ধতা।

আচমকা চুমু খেলো অনির কপালে। তার হৃৎস্পন্দন এবার বোধহয় একটু শান্ত হলো। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। এতোক্ষণ ধরে যেমনটা অনুভব করছিলো এখন আর তেমন লাগছে না। মনের উপর থেকে কোন এক ভার যেন সরে যাচ্ছে। তার মন , হৃদয়, আত্মা তাকে বলছে ভালোবাসতে। এই ভালোবাসায় তারা তৃপ্ত!

অনি চোখ মেলে তাকাল। ঘুমটা যেন হঠাৎ ই ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুমের মাঝে সে একটা স্বপ্ন দেখেছিলো। কপালে হাত রাখল। ফারাজ ভাই তার কপালে চুমু খেয়েছে। লজ্জায় বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরল। অসম্ভব এটা কখনো হতে পারে? ভাই তো তার হাতটা আজ অবধি ঠিক করে ধরল না। আলতো করে তার হাত স্পর্শ না করে কপাল কেন করবে। এটা কি কখনো হয়?

চারপাশ চোখ বুলিয়ে দেখল ফারাজ ভাই নেই। কোথায় গেলো ভাই? জানালা টা বন্ধ। ঘুমানোর আগে বেশ মনে ছিল জানালাটা খোলা। বন্ধ করল কে? তাহলে কি ফারাজ ভাই এসেছিল। বিছানা ছেড়ে নামল সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ঝনঝন ট্রেনের শব্দ। ধরে ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে অনি। হঠাৎ সে থেমে গেল। তার চোখ আটকে গেল ফারাজ ভাই কে দেখে। ফারাজ ভাই দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। অনি অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। ফারাজ ভাইয়ের চুল গুলো এলোমেলো হয়ে দোল খাচ্ছে। একহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাত সিগারেটের ধোঁয়া শূন্যে মিলিয়ে দিচ্ছে। দৃষ্টি কোমল হলো। ভাই কে সিগারেট খেতে দেখে অতো অবাক লাগল না। কিন্তু অনির মনে হলো সে ভাইয়ার প্রেমে পড়ে গেল। আশ্চর্য! এটা কোন সময় হলো প্রেমে পড়ার মতো।

এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়াল। ফারাজ তখনো অনির সম্পর্কে অবগত না। তার বিস্ময় দৃষ্টি ফারাজ ভাইকে ঘিরে। দ্রুতবেগে তার হৃদয়ের হৃৎস্পন্দন চলছে। বুকে হাত রাখল অনি। ফারাজের খেয়াল হলো। শুধালো, “অনি? তুমি এখানে? কি করছো?”

“আপনাকে দেখছি ফারাজ ভাই!”

ছোট ছোট চোখ করে চেয়ে রইল ফারাজ। এই মেয়েটা এতো স্পষ্টভাষী! দেখে তো মনে হচ্ছে না মিথ্যে বলছে।‌ অর্ধেক খাওয়া সিগারেট ফেলে দিতে চাইল সে। বাঁধ সাধল অনি। তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, ”ফেলবেন না ফারাজ ভাই?”

”কেন?”

”আপনি দাঁড়িয়ে সিগারেট খান, আমি আপনাকে একটু দেখি।”

কথাগুলো বারি খাচ্ছে। ফারাজ প্রথমে বুঝতে পারল না। একটু পর বলে উঠল, “তুমি কি পাগল হয়ে গেছো অনি?”

“হ্যাঁ, ফারাজ ভাই পাগল হয়ে গেছি। আপনার প্রেমে পড়ে আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি।”

ফারাজ চমকে উঠল। হাতের সিগারেট ফেলে দিল সে। অনির হাস্যউজ্জ্বল মুখটা নিমিয়ে গেল। সে বলে উঠল, ”জানেন আপনাকে কতোটা সুর্দশন লাগছিলো দূর থেকে। আমি দেখেই তো প্রেমে পড়ে গেলাম।”

সারফারাজ জবাব দিল না। তার হাত ধরে ফের নিয়ে এলো ঘরের মধ্যে। হাতটা ছাড়তে যাবে অমনি অনি বলে উঠল, “হাত ছাড়বেন না ফারাজ ভাই, আরেকটু ধরে রাখুন।”

সারফারাজ কথা শুনল না। ধপ করে হাতটা ছেড়ে দিল। ঠোঁট উল্টে ফেলল অনি। ফারাজ তার কপালে টোকা দিয়ে বলল, “আমার প্রেমে পড়ার জন্য আমায় মৃ/ত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছ। বাহ অনি!”

“মানে ফারাজ ভাই?”

“সিগারেট খেলে মর/ণ নিশ্চিত। তবুও ভালো ভাবে কেউ মর/তে পারে না। অথচ তুমি চাইছো আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার সামনে সিগারেট খাই। কি আবদার!”

অনি চোখ নামিয়ে ফেলল। মিনমিন স্বরে বলল, “আমি‌‌ ওভাবে বলি নি ফারাজ ভাই। আপনি দূর থেকে দেখতে পুরো মুভির হিরোর মতো লাগছে।”

”আর নিজেকে কি ভাবছিলে? হিরোয়িন!”

“দোষ কি ভাবলে ফারাজ ভাই। সব মুভিতেই তো হিরোর হিরোয়িন থাকে তার স্ত্রী! আমিও তো আপনার স্ত্রী!”

”এসব কথা তোমাকে কেউ শিখিয়েছে?”

“সে শিখাবে। আমি নিজেই জানি। আপনি দেখেন না ফারাজ ভাই, আমি বড় হয়ে গেছি। আগে টপস পরতাম এখন শাড়ি পরি, এখন আমি রান্নাও করতে পারি, ঘর গোছাতে পারি আর কিছুদিন পর ভার্সিটিতেও ভর্তি হবো। তখন আমি আরো বড় হয়ে যাবো।”

“এতো বড় হয়ে কি হবে অনি?”

“আপনাকে ভালোবাসতে পারব!”

আকস্মিক কথায় ফারাজ চমকে উঠল। কিয়ৎকাল চেয়ে থাকার পর তার বিস্ময় ভাব কাটল। ট্রেনটা তখনি যেন থেমে যেতে লাগল। হয়তো কোন স্টেশনে এসেছে। সবকিছু কেঁপে উঠল। তাল সামলাতে না পারে অনি এসে ঠেকল সারফারাজের কাছে। তার দৃষ্টি পড়ে আছে ফারাজ ভাইয়ের খোলা শার্টের বুকের উপর। আজকের এই একরাতে তারা অনেক কাছাকাছি এসেছে যা গত কয়েকবছরেও যায় নি। ফারাজ ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসার অনুভূতি সেদিন প্রথম এসেছিল যেদিন দেখেছিল তার জন্য ফারাজ ভাই প্রতিবাদ করছে। সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলো, আবার আনন্দ ও হচ্ছিল। তার ফারাজ ভাই তার জন্য লড়ছে। সেদিন প্রথমবারের মতো তার হাত শক্ত করে ধরেছিল ফারাজ ভাই। সেই ছোঁয়া সে আজ অবধি ভুলতে পারেনি। ওমন ভাবে কেউ তাকে কখনো ধরে রাখেনি। ফারাজ ভাই আর শতবার ও তার হাত ছুঁয়ে নিলে ওমন অনুভূতি আর কখনো আসবে না। কখনো না, প্রথম অনুভূতির প্রথম ছোঁয়া সব অন্যরকম। কখনো তা এক হয় না।

ফারাজ মুখ নিচু করে তাকাল। অনি চোখ মেলে তাকাল তার দিকে। অনি তার হাত শক্ত করে ধরে নিল। ফারাজ ভ্রু কুঁচকে নিল। আচমকা তার ওষ্ঠাদ্বোরে আবদ্ধ করে নিল অনি। ফারাজ চমকে উঠল। বিস্ময়ে হতবাক সে। কোন শব্দ করল, কোন কথা বলল না। দু সেকেন্ডের মাঝে কি হলো ভাবতে সময় লাগল। অনির অশ্রুসিক্ত নয়নের দৃষ্টিজোড়া তখনো বহমান।‌ সে দূরেও যাচ্ছে না, কাছেও আসছে না। কেমন এক মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে। ফারাজ মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনি হাত ছাড়েনি তখনো, হন হন করে ফারাজ চলে গেল। হাতের বন্ধন আলাদা হয়ে গেল। অনি কেঁদে উঠল। ফারাজ ভাই আবারো তাকে ফেলে চলে গেছে। সেদিনকার মতো। রাতে ঘুম থেকে উঠে পাগলের মতো খুজেছিলো ফারাজ ভাইকে। কিন্তু পায়নি, আজও কি পাবে না! ফারাজ ভাই কি আজ আবারো চলে যাবে তাকে ফেলে…
.
খানিকক্ষণ বাদে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। অনি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। অশ্রুকণা শুকিয়ে গেছে। ফারাজ ভাই এখনো এলো না। চলে যায় নি তো আবার। ফারাজ ভাইয়ের যা রাগ হয়তো কোন স্টেশনে নেমে চলেও গেলো। কিন্তু তাকে এখানে একা ফেলে ফারাজ ভাই চলে যেতে পারে না। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেলো।‌ কেঁপে উঠলো সে। ফিরে তাকিয়ে দেখল সারফারাজ!

উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কি বলবে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ফারাজ পানির বোতল এগিয়ে দিল তার হাতে। আবারো বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। তার সাথে যেন লুকোচুরি খেলছে ফারাজ ভাই।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে