চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয় পর্ব-১১

0
492

#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১১

অর্নিলা কে সাথে নিয়ে সারফারাজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। বের হবার পথে শাহিনুর বেগমের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি অস্থির। আরিফ হাসান শক্ত মানুষ। তিনি একদৃষ্টিতে সারফারাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ”ওর খেয়াল রাখবে,‌ঠিক যেভাবে আমি রেখেছিলাম। ও আমার মেয়ে! নিজের বউ মনে করে না, আমার মেয়ে মনে করে ওর খেয়াল রাখবে সারফারাজ।”

সারফারাজ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল। ফরহাত দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সব শয়তানি বুদ্ধি ওর। শ্রেয়মী আর রুদমিলা তারাও এসে হাজির। আরাফাত দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে হাসছে। হেসে হেসে বলছে, “যা তোরা। আমিও আসছি। বেশিদিন তো আর বাকি নেই।”

অর্নিলার অশ্রুসিক্ত আঁখি দুটি নামিয়ে রাখল। ব্যাগপত্র সব গাড়িতে তুলছে সিধু। ট্রেন অবধি তাদের এগিয়ে দিয়ে আসবে। সারফারাজ গাড়ির দরজা খুলল। অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফাত এগিয়ে আসতেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, “আমি যাবো না!”

আরাফাত তার হাত আগলে ধরল। ফিসফিসিয়ে বলল, “কেন যাবি না রে বুড়ি। গেলে তো ভালোই হবে। তোর ভালোবাসার মানুষ কে তুই একা পাবি, আলাদা করে পাবি। ভালোবাসতে পারবি। এটাই তো সময়, নিজের ভালোবাসা এবার তাকে বুঝিয়ে দে। আর কতোকাল একপাক্ষিক ভালোবেসে যাবি।”

দৃষ্টি মেলে চাইল অর্নিলা। চোখের পাতা কাঁপছে। কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আরাফাত হাসছে! এই ছেলেটা সম্পর্কে তার দেওর হয়, সে হয় তার ভাবী। বলে ভাবী নাকি দেওর কে আগলে রাখে অথচ তার দেওর তাকে আগলে রাখছে। আরাফাত তার দেওর না, নিজের আপন ভাই, সবচেয়ে কাছের বন্ধু। অর্নিলার মনের সব কথা তার নখদর্পণে। আরাফাত ধমকের সুরে বলল, ”দেখি , চল উঠতো গাড়িতে।”

পেছন থেকে ছোট ফুফু বলে উঠলেন, ”একি? দেওর ভাবী কে ধ/মক দিচ্ছে। অর্নিলা তো সম্পর্কে বড় হয় তোমার আরাফাত!”

শাহিনুর বেগম বলে উঠলেন, “ওসব সম্পর্ক ওদের মাঝে নেই ভাবী। দুজন ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে। এসব সম্পর্কের টানাপোড়েন ওদের মাঝে আনবেন না।”

“তা বললে কি করে হবে? সম্পর্কে বড় মানে বড় ওখানে…

থামিয়ে দিল বড় ফুফু। তিনি গম্ভীর মুখে চেয়ে আছে সারফারাজের দিকে। সে এসেছে শুনে তাড়াহুড়ো করে বিদেশ থেকে এসেছে আজ তিনদিন। এর মধেই সারফারাজ চলে যাচ্ছে। কথা হলো না ঠিক করে। আরিফ হাসান এগিয়ে গেলেন। অর্নিলা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। আরাফাত তাকে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসাল। ফরহাত এগিয়ে এসে বলল, ”আমি যাচ্ছি ওদের ছেড়ে দিয়ে আসতে। আরাফাত তুই যাবি?”

দুই কদম পিছিয়ে গেল আরাফাত। মাথা দুলিয়ে জবাব দিল না। আরিফ হাসান পেছন ঘুরলেন। তিনি আর পারবে না। হয়তো আরো এগিয়ে দিয়ে আসতে গিয়ে অর্নিলা কে বাসায় ফেরত নিয়ে আসবেন তিনি। “নিকুঞ্জ নিবাস” এর দিকে ফিরে চাইলেন। এই বাড়িটা এখন নিশ্চুপ হয়ে গেল। এখন আর কেউ বাড়ির ছাদে ছোটাছুটি করবে না। আর কেউ তাকে ঔষধের কথা মনে করিয়ে দিবে না। রাত জেগে থাকত বলে বকা দেওয়ার মতো কেউ রইল না। তিনি বোধহয় একা হয়ে গেলেন। শাহিনুর বেগম এগিয়ে গিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কান্না থামছে না তার। আরাফাত তাকে ধরে রাখলেন। সবাইকে কাঁদিয়ে দিয়ে অর্নিলা আর সারফারাজ চলে যাচ্ছে। কে জানে? হয়তো এখান থেকে নতুন শুরু তাদের!
.
ফরহাত দুজনকে ট্রেন অবধি পৌঁছে দিল। অর্নিলা মন খারাপ করে কেবিনের মধ্যে বসে আছে। ফারাজ বাইরে দাঁড়িয়ে ফরহাতের সাথে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। ফরহাত মুচকি মুচকি হেসে ফারাজের ঘাড়ে হাত রাখল। বলে উঠল, ”বুঝলি! এরপর টানা দুই তিন বছর পর হাজির হবি। জোড়ায় আসবি না খবরদার। সাথে আরো একজনকে নিয়ে আসবি।

”তোর আজেবাজে কথা রাখ তো ফরহাত।”

“আজেবাজে কথা! সত্যি, তোর মনে হয় তুই সবার মতো আমাকেও বোকা বানাতে পারবি। শোন ফারাজ। আর কেউ পারুক আর না পারুক এই ফরহাত কিন্তু ফারাজের মনের কথা ভালো বুঝতে পারে। আমি জানি তোর মনে কি চলছে। আরে আমরা রক্তে মিশে আছি।”

ফারাজ চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। ফরহাত বলে উঠল, “কিন্তু সাবধান বাদ্রার। বাচ্চা মানুষ তো!”

“বাচ্চা মানুষ! কে বাচ্চা? অনি! ও অনেক বড় হয়ে গেছে এখন তুই হয়তো দেখে বুঝতে পারছিস না নয়তোবা না বোঝার ভান করছিস।

“এজন্যই বোধহয় ফারাজ ভাইয়ের তর সইছে না।

“কি সব কথা বলছিস ফরহাত। আমি এখনো অনি কে পুরোপুরি বিশ্বাস করি না।‌আফটার অল ও শামসের শিকদারের মেয়ে। ওদের বংশের কাউকে বিশ্বাস করতেই আমায় ভয় করে।

ফরহাত হালকা কাশল। খানিকটা সিরিয়াস মুড নিয়ে বলে উঠল, “তুই লিখে রাখ। আমি বলে দিচ্ছি, অনি একদম তেমন নয়। তুই এখনো ওকে চিনতে পারিস না। যেদিন পারবি, সেদিন খুশিতে পাগল হয়ে যাবি। তোর চাইতে কেউ আর বেশি ভালোবাসতে পারবে না ওকে।”

ফারাজ কথা বাড়াল না। ওর সত্যিই ভীষণ ভয় করে। একবার ঠকেছে বার বার ঠ/কতে মন চায় না। তাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছে এতোদিন দমিয়ে রেখেছিল এখন রাখবে কি করে? অনি তো এখন তার সাথেই থাকবে, তারা দুটি মানব এখন একসাথেই এক ছাদের নিচে থাকতে শুরু করবে। সে কি চাইলেও পারবে অনি কে এড়িয়ে চলতে। তার মন মানবে তো!
ফরহাত ট্রেনের মধ্যে ঢুকে বলল, “যাই, অনি কে একবার শেষ বিদায় দিয়ে আসি। ট্রেন ছেড়ে দিবে তো!”
সারফারাজ দাঁড়িয়ে ভাবছে, ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। ভাবনার যেন শেষ হচ্ছে না!
.
ট্রেন ছেড়ে দিল। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস থেকে টেন ছুটছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাতের এই অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য দেখা বেজায় মুশকিল। অর্নিলা চোখের পানি মুছে জানালার দিকে চেয়ে রইল। দূরের বাড়ি গুলোয় আলো জ্বলছে। চিকচিক সেই আলোর একটু ঝলকানির দেখা মিলছে। সারফারাজ নেই অনেকক্ষণ। অর্নিলা বাইরে চেয়ে দেখল। এক জায়গায় এতোক্ষণ বসে থাকার স্বভাব তার নেই। উঠে দাঁড়াল সে। দরজার সামনে এসে বের হতেই কারো পা চোখে পড়ল। মুখ তুলে তাকাল। ফারাজ ভাই! বুকটা ধক করে উঠল তার। শরীর শিউরে উঠল। দরজার জায়গাটুকু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। মুখ উঁচু করে চোখ মেলে চেয়ে আছে। দৃষ্টি নামছে না। ফারাজ ভাইয়ের অনেক কাছে দাঁড়িয়ে সে। কতো দিনের অপেক্ষার পর, কতো রাতের ভাবনার পর এভাবে যে দাঁড়িয়ে হিসেব করেনি। আবছা স্বপ্নে দেখা কল্পনা গুলো যেন বাস্তব হতে বেশি দেরি নেই। কতোদিনের স্বপ্ন তার ললাটে এসে ঠেকবে ফারাজ ভাইয়ের ওষ্ঠাজোড়া। বক্ষে টেনে নিবে ফারাজ ভাই। বাহুদ্বোরে আটকে রেখে দিবে তাকে।‌ কতোই না স্বপ্ন তার!

চোখে চোখ পড়তেই বিদ্যুতের ন্যায় সরে গেল ফারাজ ভাই। চোখ নামিয়ে ফেলল অর্নিলা। ফারাজ ভাই বলে উঠল, “কোথায় যাচ্ছো অনি?”

“কোথাও না ফারাজ ভাই। এই একটু হাঁটতে বের হলাম।”

“হাটা লাগবে না অনি। অনেক রাত, ভিতরেই থাকো।

”আচ্ছা।

উল্টো ফিরল অনি। সারফারাজ কি মনে করে বলে উঠলো, “আচ্ছা চলো হেঁটে আসি।”

অনি চমকে উঠল। ফারাজ ভাইয়ের মনে একসাথে কতো কিছু যে থাকে সে বুঝে উঠতে পারে না। দুজনেই একসাথে একটু বেরুলো। একদম শেষের মাথায় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। চল/ন্ত ট্রেন থেকে বাইরে উঁ/কি মারল অর্নিলা। তৎক্ষণাৎ তার বাহু ধরে টে/নে সরিয়ে আনল সারফারাজ। ধমকে/র স্বরে বলল, ”পাগল হলি নাকি? এভাবে উঁকি দেবার কি আছে? পড়ে গেলে আর শরীরের কিছু খুঁ/জে পাওয়া যাবে নাকি?”

অনি মুখ চেপে হেসে উঠল। ভ্রু কুঁচকে ফেলল ফারাজ। সে হাসির কিছু বলেনি। তবুও এই মেয়েটা হাসছে। আশ্চর্য! ফারাজ ভাই এখনো হাত ছাড়েনি। অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। ধড়ফড় করছে তার হৃদয়/খানি। সারফারাজ এবার হাত ধরে টেনে বলল, ”হয়েছে আর হাঁটা লাগবে না। চল!”

“ফারাজ ভাই; তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আমার কিছু হবো না। আমি তো ম/রতে আসিনি।”

কেবিনে এসেই হাতটা ছেড়ে দিল। অর্নিলা বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে বলল, ”ফারাজ ভাই, আপনি ভ/য় পেয়েছেন। ভ/য় পাবেন না। আপনি তো ডাক্তার মানুষ। কতো মানুষের মৃ/ত্যু দেখবেন। আমার মৃত্যু/তে ভয় পেলে চলবে।”

“ডাক্তাররা সবার মৃ/ত্যু সহ্য করতে পারে অর্নিলা। এগুলো দেখতে দেখতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু কাছের মানুষগুলোর মৃ/ত্যু তারাও স/হ্য করতে পারে না। কারণ দিনশেষে তারাও মানুষ। হৃদয় তাদের ও থাকে।”

অনি একগাল হেসে বলল,
“তাহলে বলুন ফারাজ ভাই, আমিও আপনার অনেক কাছের!”
সারফারাজ চেয়ে দেখল অনি হাসছে। কথাগুলো বলার আগে ভাবে নি এখন ভাবতে হচ্ছে। অনেক গভীর কথাই বলে ফেলেছে সে।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে