#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩৩ (শেষ পর্ব )
আরাফাত সকাল বেলা বড্ড ব্যাকুল হয়ে ফিরল সারফারাজের ঘরে। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল অর্নিলা বিছানায় শুয়ে আছে। সারফারাজ তার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে কিছু বলছে। আরাফাত দরজায় কড়া নেড়ে বলল, “আসব!”
“আরাফাত! আয় না।”
“না আসার দরকার নেই। আর তুই শুয়ে থাক। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
“কিন্তু আমি ঠিক আছি ফারাজ ভাই।”
“বললাম না শুয়ে থাকতে। চুপচাপ শুয়ে থাক। মা কে বলে আমি খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিবো। আচ্ছা খাবার আমি নিয়ে আসছি। তুই শুয়ে থাক। কিছু খাবি?”
অর্নিলা মাথা দুলাল। সারফারাজ শুধালো, “কি?”
“মিষ্টি! রসগোল্লা, রসমালাই!”
“হয়েছে হয়েছে। এতো সকালে রসগোল্লা কোথায় পাবো?”
অর্নিলা ধপ করে বসে পড়ল। বলল, “কাল না মেহমানদের জন্য এতো এতো মিষ্টি আনল। তখন সেখানে রসগোল্লা ছিল।”
“বুঝেছি। তুই শুয়ে থাক। একদম লাফালাফি করবি না আমি আসছি।”
“তাড়াতাড়ি আসবেন!”
“হুম!”
সারফারাজ ঘর ছেড়ে বের হলো। আরাফাত শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, “অনির শরীর কি এখনো ঠিক হয়নি?”
“হয়েছে মোটামুটি আছে। তুই কি বলবি বল!”
আরাফাত মাথা চুলকালো। চিন্তায় সে অস্থির। অস্থিরতা তার চোখে মুখে ফুটে উঠছে। সারফারাজ সমস্যায় পড়লে শান্ত ভাবে তা মিটানোর চেষ্টা করে। সেদিক থেকে আরাফাত পুরোপুরি উল্টো। বরঞ্চ সে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল।
“কাল রাত থেকে আনিতা আমার ফোন ধরেনি।”
“ফোন করেছিলি?”
“হ্যাঁ, ফোন বাজছে ধরছে না। ফোন মনে হয় আন্টির কাছে।”
“আব্বু কি বলল কাল।”
আরাফাত মাথা নুইয়ে ফেলল। মিনমিন স্বরে বলল, “আমার আর আনিতার সম্পর্কের কথা আন্টিকে জানিয়েছে আর বলেছে বাকি সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে। সবটা আন্টির কাছে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আন্টি আনিতা কে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে। তখন আমার কি হবে বল তো!”
“এটা কি আগে ভাবা উচিত ছিলো না!”পেছন থেকে ফরহাত বলে উঠল। দুজনেই পিছন ফিরল। ফরহাত মুখ টিপে হেসে বলল, ”গাধা তোকে সাধে বলি। আর কোথায়ও পেলি না, বাপের সামনে প্রেমিকাকে চুমু খেতে হলো।”
আরাফাত ভিমড়ি খেয়ে উঠল। আমতা আমতা করে বলল, “কই, এমন তো কিছু না।”
সারফারাজ বলে উঠল, “তুই জানলি কি করে?”
“আমিও তো গেলাম ছাদে। ভাবলাম মুক্ত আকাশে একটু ধোঁয়া উড়ানো যাক। গিয়ে তো দেখি দূরে দাঁড়িয়ে ছেলে প্রেম, রসিকতা করছে আর বাপে দাঁড়িয়ে দেখছে।”
বলেই হেসে উঠল ফরহাত। আরাফাত ঠোঁট কামড়ে ধরল। চোখ মুখ খিচে বলল, “চুপ করো তো। ভাইয়া, তুই কিছু কর। আমি জানি আন্টি তোর কথা ফেলতে পারবে না। এই অনিকে বল না। অনির কথা তার বড় ফুপু কখনো ফেলবে না।”
সারফারাজ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, “দেখছি।”
“তুই কিছু ভাবছিস, তাই না। ভেবে পেলি কিছু?”
“ভাবছি! ওহ হ্যাঁ, ভাবছিলাম। ঘরে রসগোল্লা আছে!”
“রসগোল্লা! সিরিয়াসলি ভাইয়া। আমি তোকে এখানে এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা কথা বলছি আর তুই রসগোল্লা নিয়ে আছিস।”
ফরহাত শব্দ করে হেসে বলল, “তোর বিয়ের রসগোল্লা আরাফাত!”
“আহা ভাইয়া।”
“আরে অনি রসগোল্লা খেতে চেয়েছিল। বাড়িতে রসগোল্লা আছে।”
আরাফাত দাঁত চেপে বলল, “রান্নাঘরে গিয়ে মা কে জিজ্ঞেস করে দেখ, আমি কিছু জানি না।”
বলেই হন হন করে চলে গেল। ফরহাত হাসতে হাসতে বলল, “ভালো রসিকতা করতে পারিস তুই ফারাজ। ছেলের এভাবেই মরি মরি অবস্থা তুই আবার ঘি ঢালার ব্যবস্থা করছিস!”
.
সারফারাজ ড্রয়িংরুমে এলো। শাহিনুর বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চলে এসেছো। চলো নাস্তা সেরে নাও। অর্নিলা কোথায়? কিছুক্ষণ আগে দেখলাম বাইরে যেতে। এখনো আসেনি।
“ঘরে আছে।
“নাস্তা করবে না?”
“করবে। শরীর টা ভালো নেই। তুমি ওর খাবারটা আমায় দাও। ঘরে নিয়ে যাই।”
“এখনো শরীর ভালো নেই। বলি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে নাকি?”
“হ্যাঁ, কিছুদিন পর যাবো।”
শাহিনুর বেগম খাবার বেড়ে দিলেন। গরম গরম পরোটা আর গরুর গোশত। সারফারাজ প্লেট হাতে নিয়ে বলল, “রসগোল্লা আছে মা?“
“কে খাবে? তুমি।”
“না। অনি।”
“অনি? কিন্তু অনি তো মিষ্টি খায় না।“
“এখন বলল খাবে। থাকলে দাও।”
শাহিনুর বেগম ভাবনায় পড়ে গেলেন। বাটিতে দু পিছ রসগোল্লা রেখে ভাবল, “মেয়েটা ঠিক নেই। শরীরটা ভালো নেই।”
সারফারাজ বসে বসে দেখছে। অর্নিলা টপ টপ দুটো রসগোল্লা মুখে পুড়ল। অথচ এই মেয়ে মিষ্টি জিনিসটাই দেখতে পারে না। কি আশ্চর্য! কতো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অর্নিলা ভ্রু নাচিয়ে বলল, “কি দেখছেন ফারাজ ভাই?”
“কিছু না। এগুলো জলদি খেয়ে নে। আমি বাইরে যাবো।”
“আচ্ছা। ফারাজ ভাই, আপনি খুশি হননি।”
ফারাজ চমকে তাকাল। তার গলা কেমন যেন ধরে আসছিলো। আচমকা ফিরে তাকাল। অর্নিলা নরম দুটো হাত তার গালে রেখে বলল, “আপনি খুব খুশি হয়েছেন তাই না বলুন।”
সারফারাজের চোখে দুটো চকচক করে উঠলো। আলতো করে তার পেটে হাত রাখল। থমথমে কণ্ঠে বলল, “আমার শুধু বিশ্বাস হচ্ছে না অনি। সবকিছু অকল্পনীয় লাগছে।” অতঃপর ফিরে চাইল তার দিকে। কপালে চুমু খেয়ে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। মৃদু স্বরে বলল, “ধন্যবাদ অনি। তোর কারণে আমি বাবা হতে পারব। কিন্তু তোর এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।”
“পারবেন।
“কিভাবে?”
“আমাকে এতো ভালোবেসে!”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল অর্নিলা। সারফারাজ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল। মনে মনে আওড়ালো, “আমি তোকে অনেক ভালোবাসি। তোকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। এখন আরো একজন ও আসছে। কথা দিচ্ছি আমি তাকেও দেখে রাখব।”
.
“হ্যালো বড় ফুপু!”
“কে? বাবা সারফারাজ।”
“কেমন আছেন?”
“রসিকতা করো না। অর্নিলা কেমন আছে এখন?”
“ভালো আছে। এসে দেখে যান।”
”না আমি আর আসব না। সামনের সপ্তাহেই চলে যাবো।”
“কেন? আসবেন না কেন?”
“না জানার ভান করো না সারফারাজ। তুমি তোমার ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করলেও এই বিয়েতে আমি রাজি হবো না।”
সারফারাজ হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল। ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে বলল, “মামা ফুচকা দিন তো। প্যাকেট করে দিবেন।” ফোন কানে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ফুপু বলুন।”
“বাইরে আছো।“
“হ্যাঁ, অর্নিলার জন্য ফুচকা কিনছি। শুনুন ফুপু। ছোট ফুপুর বাড়িতে নাকি আম গাছ আছে। আম গাছে শুনলাম ভালোই আম ধরেছে। অর্নিলা সেই আম খাওয়ার বায়না করছে। আপনি ছোট ফুপু কে বলে সেই আম নিয়ে আসুন।”
“কি বলছো এসব? হঠাৎ আমের কথা বলছো কেন?”
“বলছি। নানু হতে চলেছেন। আম, মিষ্টি যা পারে নিয়ে আসুন।”
“কি বললে?”
“ঠিক শুনেছেন। কি এখনো না এসে থাকবেন।“
“সারফারাজ! তুমি আসলেই একটা আহাম্মক। শুভ কথা কেউ এভাবে বলে। আসছি আমি!“
বলেই ফোন কেটে দিল। সারফারাজ হাসছে। বড় ফুপু সবার উপর রাগ করে থাকলেও অর্নিলার উপরে কখনো রাগ করে থাকতে পারেন না। তিনি এখন ছুটে আসবেন। আসবেন বৈকি! দেখা যাক , এই সুবাদে আরাফাতের ব্যাপারটা সামলানো গেলে হয়।
.
নিকুঞ্জ বাড়িতে যেন আবারো খুশির আনন্দে ছেয়ে উঠল। অর্নিলার মা হবার কথা শুনে সকলে আনন্দে মেতে উঠেছে। অর্নিলার কারণেই আরাফাত আর আনিতার বিয়ে ঠিক হলো। বড় ফুপু অর্নিলার কথা ফেলতে পারেননি। নিকুঞ্জ বাড়িতে জোড়া বিয়ের আমেজে মেতে উঠল। ফরহাত, নাজিয়া আর আরাফাত আর আনিতা। জোড়া বিয়ে হবে একসাথে। বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। তার কারণ ও আছে। হাতে এক মাস। মাসখানেক পরেই অর্নিলা আর সারফারাজ দেশের বাইরে চলে যাবে। হ্যাঁ, ভিসাও চলে এসেছে। অর্নিলা দূরে চলে যাবে তাও এমন সময়ে। শাহিনুর বেগম এসব ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। মেয়েটা একা একা থাকবে। আরিফ হাসানকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অর্নিলা বরঞ্চ এখানেই থাক। তাদের কাছে থাক, তারা দেখে রাখবে। কিন্তু আরিফ হাসানের এক কথা। “তোমার চেয়ে বেশি অর্নিলার সারফারাজ কে প্রয়োজন। সারফারাজকে তার পাশে চাই। তুমি নিশ্চিতে থাকো, সারফারাজ থাকতে অনির কখনো অযত্ন হবে না।“
.
অনির এখন ৬ মাস চলে। সে আর সারফারাজ এখনো লন্ডনে অবস্থানরত। দিন ভালোই যাচ্ছে অর্নিলার। এখানে সারফারাজের পাশপাশি তার পড়াশোনাও চলছে। তবে আজকে শরির টা ভালো নেই। উঁহু এটা শুধু একটা ছুতো। আজ সারফারাজ বাসায় তাই সেও বাসায় থাকবে। রান্না ঘর থেকে টুকিটাকি শব্দ কানে আসছে। তবুও ঘুমের ভান করে চাদর মুড়িয়ে রইল। খানিকক্ষণ বাদে কারো উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করতে লাগল। সারফারাজ তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। উঠানোর চেষ্টা করছে। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসল। অগোছালো চুলগুলো সারফারাজ ঠিক করে দিয়ে বলল, “উঠে নাস্তা সেরে নে অনি।
“আরেকটু ঘুমাই না ফারাজ ভাই না থুরি ফারাজ!”
বলেই দাঁত বের করে হেসে দিল। চোখ মেলে তাকাল সবে। গতরাতে ফারাজ তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো, “আর কতোকাল ফারাজ ভাই বলে ডাকবি অনি?” অনি চুপসে ছিল। তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, “আপনাকে আমি সারাজীবন ফারাজ ভাই বলেই ডাকতে চাই। এই ফারাজ ভাই ডাকে যে আবেগ,গভীরত্ব, প্রেম প্রেম ভাব আছে সেটা কি ভুলতে পারি।” কিন্তু এই কথাগুলো সে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। উল্টো হেসে বলেছিলো, ”কাল থেকে আর ডাকব না ফারাজ ভাই!” তার কথা সে মনে রেখেছে। কিন্তু ফারাজ বলে ডাকতেই তার শরীরে যেন তরঙ্গ ছুটে গেল। এমন কেন হলো?
“উহু না, এখনি!”
“আপনি আমার কোন কথা শুনতে চান না কেন?”
“বললাম তো উঠতে। এখনি অনি।”
জোরাজুরিতে অনি উঠল। সারফারাজ তাকে হাত ধরিয়ে উঠাল। ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে পৌঁছাল। হুঁ, বিরাট আয়োজন! অনি ধীরে ধীরে খেতে লাগল। সারফারাজ গরম দুধ মগে ঢেলে বলল, “পুরোটা শেষ করবি!”
“গন্ধ আসে তো!”
“হুঁ, কোন অজুহাত না।”
অর্নিলা নিজের পেটের দিকে ফিরে বলল, “দেখলে তোমার বাবা কিভাবে আমায় জ্বালায়। মনে রাখবে সব, বড় হয়ে তুমিও এভাবে জ্বালাবে!”
“হ্যাঁ, তুই না বললেও জ্বালাবে। তুই মা কি না!“
“শুনলে আবারো। তোমার নামে বদনাম করছে। মনে রাখবে হ্যাঁ!” বলতে বলতে কেশে উঠল। সারফারাজ ছুটে এসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাওয়া শেষ করে কথা বল অনি। তাড়ার কি আছে?”
“আচ্ছা আচ্ছা!”
“কোন কথা না, চুপচাপ খাওয়া শেষ করবি এবার। বুঝলি!”
মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা!”
খাওয়া শেষ করে একটু উঠে দাঁড়াল হাঁটাহাঁটির জন্য। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছাল বারান্দায়। এখান থেকে চারদিক কেবল বরফে ঢাকা। ভালোই তুষারপাত হয়েছে। শীত শীত লাগছে। পেছন থেকে ফারাজ এসে গায়ে একটা চাদর টেনে দিল। বলল, ”এতো ঠান্ডার মধ্যে এখানে কি করছিস? ভেতরে চল।”
“একটু দাঁড়াই না। ভালো লাগছে।”
“শীত করবে না।”
“এক কাজ করুন। আপনি আমায় জড়িয়ে ধরে রাখুন তো। তাহলে আর শীত করবে না। কি হলো? ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছেন কি? ধরুন একটু জড়িয়ে!”
সারফারাজ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। অর্নিলা মুখ খুলে শ্বাস নিল। সারফারাজ তার ঘাড়ে মাথা রেখে বলল, “শরীর ঠিক আছে।”
“খুব আছে।“
“সামনে সোমবার কিন্তু চেকআপের জন্য যেতে হবে। মনে আছে?”
“খুব আছে ফারাজ ভাই!” বলেই জিহ্বা কেটে বলল, “না না হবে না আমার দ্বারা।”
“কি হবে না।”
“এই আপনাকে ফারাজ বলে ডাকা। আচ্ছা একটু শুনুন, আমাদের মেয়ে হলে নাম রাখব ফারিয়া শেহদাত। আমি আপনাকে ডাকব ফারিয়ার আব্বু! সুন্দর না বলুন।“
“আর ছেলে হলে?”
“না না, এবার ছেলে হবে না। মেয়েই হবে। আপনার মতো দেখতে সুন্দর নাদুসনুদুস একটা মিষ্টি মেয়ে। দেখেন না ইদানিং আমি কতো মিষ্টি খাই। দেখবেন মেয়েটাও মিষ্টি হবে। বুঝলেন ফারিয়ার আব্বু!” হেসে উঠল অর্নিলা। সারফারাজ ঠোঁট কামড়ে ধরল। এতো ঠান্ডার মধ্যে তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে লজ্জায়। কেন এতো লজ্জা পাচ্ছে সে। কি জানি? শক্ত করে আঁকড়ে ধরল তাকে।
.
বিকেল বেলা বেরুলো দুজন। বেশি দূর না, এই তো সামনের স্টোরে। কিছু কেনাকাটা করার আছে। দুজন মিলে শপিং করতে ভালোই লাগে। সারফারাজ তার হাতে হাত রেখে সামনে স্টোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা পিছন থেকে খুব জোরে একটা গাড়ি পাশ দিয়ে গেল। কিছু বখাটে ছেলের কারবার। ভাগ্যিস অর্নিলার কিছু হয়নি তবে বেচারি খুব ভয় পেয়েছে। সারফারাজের হাত শক্ত করে ধরে রেখে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। সারফারাজ ব্যাপারটা সামলে নিল কোনভাবে। সামনের এক বেঞ্চেতে তাকে বসিয়ে পানি খাওয়ালো। সামনে ফিরে দেখল ছেলে গুলো আবারো গাড়ি নিয়ে এদিক আসছে। তার হাতে বিয়ারের ক্যান। অর্নিলা কে দেখে ইশারা করে হাসতে লাগল। ব্যঙ্গ করে আবার সরিও বলতে লাগল। সারফারাজ চোয়াল শক্ত করল। অর্নিলা আলতো করে হাতটা ধরে বলল, “বাদ দিন। চলুন ভেতরে যাই। আমাকে আজ একটা আইসক্রিম কিনে দিবেন ঠিক আছে। আসুন না!” সারফারাজ শব্দ করল না। অর্নিলার হাত ধরে স্টোরে ঢুকে গেল।
ঘটনাটি সপ্তাহ খানেক পরের। একটা কফি শপের বাথরুমে কিছু লোকদের আ/হত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অবস্থা খুবই ভয়াবহ। প্রায় ৪ ৫ জন ছিলো তারা। আশেপাশের লোকদের বক্তব্য ছিলো তারা এই কয়েকজন নেশা করে শপে এসেছিলো। হয়তো নেশার মধ্যেই একে অপরকে মে/রেছে। তবে তারা জোর গলায় বলছে, তাদের মে/রেছে একটি মাত্র লোক। একটা লোক তাদের এই অবস্থা করেছে! কেউই তাদের কথা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হচ্ছে না। পুলিশরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করে।
সারফারাজ বাড়িতে পৌঁছেই প্রথমে বাথরুমে ঢুকে গেল। কোটের ভেতরে শার্টে র/ক্ত লেগে আছে। এই র/ক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে সে। বার বার পিছন ফিরে চাইছে। অর্নিলার ডাক শোনা যাচ্ছে। সারফারাজ আরো দ্রুত ঘসতে লাগল। অর্নিলার প্রায় এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। সারফারাজ হতভম্ব হয়ে পেছন ফিরল।
“কি হয়েছে ফারাজ ভাই? আপনি ঠিক আছেন তো।”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি। রেডি তুই। আমাদের বের হতে হবে তো।”
“হ্যাঁ, আমি তৈরি। ওই রিপোর্ট গুলো পাচ্ছি না। কোথায় যে রাখলাম।”
সারফারাজ ঘাম মুছল। না অর্নিলা কিছু টের পায়নি। গায়ের শার্ট খুলে ফেলে দিল। গলায় তোয়ালে জড়িয়ে বের হয়ে বলল, “আমি খুঁজে দিচ্ছি। একটু বস!”
“উহুম উহুম! এতো শীতের মধ্যে আপনি দেখি উষ্ণতা ছড়াচ্ছেন। ব্যাপার কি ফারিয়ার আব্বু!”
সারফারাজ জবাব দিলো না। তড়িখড়ি করে আলমারির দিকে পৌঁছাল। হুট করে সামনে এসে অর্নিলা দাঁড়িয়ে বলল, ”উফ,আপনি তো দেখি আমার মুড বদলে দিচ্ছেন।”
“আমাদের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে অনি। ঘণ্টা খানেক পর তোর এপোয়েটমেন্ট আছে।”
“হু, গাড়ি দিয়ে যেতে ২৫ মিনিট লাগবে। আমি জানি সেটা। ৫ মিনিট আমায় দিলে কি এতো ক্ষতি হবে বলুন তো!”
সারফারাজ কথা বাড়ালো না। পাশ কেটে এগিয়ে গেলো। কালো রঙের একটা শার্ট গায়ে জড়ালো। দুটো বোতাম লাগিয়ে পেছনে ফিরে দেখল অর্নিলার বিছানার উপর মুখ গুমরে বসে আছে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ”আপনি আমায় একটুও ভালোবাসেন না। সবাই ঠিকই বলে, প্রেগন্যান্সির সময় বর দ্বিমুখী হয়ে যায়। তখন আর ঘরের বউকে ভালো লাগে না। আপনি নতুন কাউকে পেয়েছেন না। বিদেশি ম্যামসাহেব তাই না!”
সারফারাজ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার বিয়ে যখন হয়েছিল তখন অনি বাচ্চা ছিলো,বিয়ের এতোগুলো বছর পরেও এ যেন বাচ্চাই যেন। কথা বলতে বলতে তার গাল বেয়ে অশ্রুও ঝরে পড়ল। অশ্রু মুছে ফেলে ফিরে তাকাল। সারফারাজ এদিকেই এগিয়ে আসছে। দৃষ্টি অস্পষ্ট। চোখ বন্ধ করে নিল সে। সে এগিয়ে এসে তার গালে হাত রেখে ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল। দীর্ঘ অনেক দিনের এমন গভীর চুমুর স্বাদ পেলো অর্নিলা। এতোক্ষণ ধরে সারফারাজের যেই অস্থিরতা তাও যেন ধীরে ধীরে শেষ হলো। কিন্তু অর্নিলার ঠোঁট ছাড়ার নাম নেই। কারোরই বুঝি তাড়া নেই। অর্ধ খোলা শার্টটা আঁকড়ে ধরল অর্নিলা। কিছুক্ষণ বাদে যখন ছাড়া পেল তখন দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমার মনে হলো, আপনি আজ আমায় মেরে ফেলবেন। আরেকটুর জন্য দম বন্ধ হয়নি মারা পড়েনি। কি হলো? হঠাৎ এতো প্রেম!”
সারফারাজের মুগ্ধ দৃষ্টি তখন অর্নিলার ঠোঁটের উপর। না তার স্বাদ এখনো মিটেনি। হাত দিয়ে ঠোঁট দুটো স্পর্শ করছে। মৃদু কণ্ঠে বলল, “আমি সবাইকে মে/রে ফেলতে পারব কিন্তু তোকে কখনো মার/তে পারব না অনি!” অনি শব্দ করে হাসল। হাতের মুঠোয় শার্টটা এখনো। সারফারাজ আবারো এগিয়ে এলো, তাকে থামিয়ে দিল। বলল, ”সময় চলে যাচ্ছে, আমাদের না যেতে হবে!”
সম্মোহিত কণ্ঠে বলে উঠল, ”আরেকটু দেরি হলে এমন কি হবে?” তার ওষ্ঠজোড়ার স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। অর্নিলা যেন বারণ করল না। আজ অনেকদিন পর সারফারাজ তার এতো কাছে। সে ফিরিয়ে দেয় নি। তার আদর মাখা ছোঁয়ায় যেন বার বার কেঁপে উঠছিলো সে!
ডাক্তারের এপোয়েটমেন্ট নিয়ে ঝামেলা হয়নি। পরিচিতি ছিল। বেবী সুস্থ আছে, ভালো আছে। মেয়ে কি না ছেলে সেটা অনি জানতে চায় নি। কারণ তার মন বলছে, তাদের মেয়েই হবে। ফারিয়া নামের দুষ্টু একটা মেয়ে। রাত গভীর হয়ে উঠল। দুজন গাড়ি করে বাড়ি ফিরছে। অর্নিলা সারফারাজের হাত শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। সারফারাজ ধীর গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করছে। চারদিক নিস্তেজ, নিরব। আবারো তুষারপাত হচ্ছে। অর্নিলা দেখলে খুব খুশি হতো। তবে এখন ঘুম ভাঙানোর কোন দরকার নেই। সামনে তাদের সন্তান আসছে। সারফারাজের ভীষণ চিন্তা তাকে নিয়ে। তারা এবার দুজন থেকে তিনজন হবে। তাকে এবার দু’জনকে সামলাতে হবে। ফারিয়ার আব্বু! নামটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে। অনি ভালো নাম রাখতে পারে। মুচকি হাসল। সামনে তাকাল। আকাশ দেখছে। আজ চারদিকে গভীর কালো মেঘে চাঁদ ঢেকে গেছে। ল্যাম্পপোস্ট গুলো আলো দিচ্ছে ধীরে ধীরে। এই গল্পের সমাপ্তির সময় চলে এসেছে। সারফারাজ এমনই থাকবে অনির কাছে। তার দুটো চরিত্রের কথা অনি জানতে পারবে না। কোন এক চৈত্রের শেষ বেলায় যেই প্রেমের সূত্রপাত হয়েছিল আজ সেই প্রেমের সমাপ্তি। এই প্রণয় সহজ ছিলো না। চৈত্রের দুপুরের প্রচণ্ড রোদের তীব্র তাপদাহে শুরু হওয়া এই প্রণয়ের সমাপ্তি এই ঠান্ডা রাতের চাদরে ঢেকে যাবে।
~ সমাপ্তি