#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
(৬)
সাঁঝি একজন উকিলকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। হারুন রশীদ আর মামুনুর সাহেব সেখানে আসলে উকিল সাহেব বলেন আমরা মিস্টার শ্রাবণ শারিয়ারের জামিন করাতে এসেছি বলে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় তার দিকে।
এইসবের কোনো প্রয়োজন ছিলো না আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিতাম উনাকে। হারুন রশীদ গম্ভীর স্বরে বলেন।
এরপর একজন কনস্টেবলকে ইশারা করলে শ্রাবণকে নিয়ে আসা হয়।
মিস্টার শারিয়ার আমাদের নজর সব সময় থাকবে আপনার উপর এটা মাথায় রাখবেন৷ এবার শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এনেছিলাম এরপর যদি আপনাকে থানায় আসতে হয় তবে গ্রেফতার হয়ে আসতে হবে মাথায় রাখবেন। কথাটা যেনো সাঁঝির উদ্দেশ্যে বললেন হারুন রশীদ।
খুন করছে একজন আর আপনারা খুনি বানাচ্ছেন আরেকজনকে, এটা আপনাদের ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই না। কথাটা বলে সাঁঝি, শ্রাবণকে নিয়ে চলে আসে।
দুই তিনদিন ধরে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় হারুন রশীদকে। উপর মহলের চাপ দিনকে দিন বেড়ে চলেছে৷ এখন মিডিয়া গুলো রসকষ মিশিয়ে নিউজ করা শুরু করেছে। সাধারণ জনগণ আতঙ্কিত সাথে প্রশাসনের উপর চড়াও হচ্ছেন। কিন্তু এই কেসের কোনো কিনারা যেনো পাচ্ছেন না তারা। শ্রাবণ শারিয়ারের বিরুদ্ধে শুধু ওই একটা প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই পুলিশের হাতে নেই। আর যে প্রমাণ আছে সেটাও ভিত্তিহীন। তাই শ্রাবণকে পুরোপুরি দোষী বলা যায় না।
থানা থেকে আসার পর থেকে শ্রাবণের মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। এতগুলো খুন হয়েছে সেখানে বারবার শুধু তারই নাম আসছে৷ কে করছে এমন তার সাথে আর কেনো করছে এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।
আমাকে আজ একটু ঘুরতে নিয়ে যাবেন কোথাও? শ্রাবণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো আকাশ পাণে স্নিগ্ধ চাহনিতে। সন্ধ্যার আজান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। চারিদিকে আঁধার নামতে শুরু করেছে। কয়েকটা তারা জ্বলজ্বল করছে তার থেকে খানিক দূরে সুন্দর একটা চাঁদ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।
শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝির দিকে ফিরে। সাঁঝির উৎসুক চাহনি, উত্তরের প্রতিক্ষা।
কোথায় যাবে? ধীর শান্ত কন্ঠ শ্রাবণের।
যেখানে আপনার খুশি? আসলে সাঁঝি চাইছে শ্রাবণের মনটা ভালো করতে। সাঁঝি ভাবছে বাইরে গিয়ে একটু ঘুরাঘুরি করে আসলে হয়তো শ্রাবণের মুড ঠিক হবে।
তাহলে আজ রাতের খাবার টা আমরা বাইরে খেয়ে আসি? শ্রাবণের কথায় সাঁঝি বলে তাও হবে, আমি রেডি হয়ে আসি। সাঁঝি চলে আসতে নিলে শ্রাবণ সাঁঝির হাত ধরে থামায়। সাঁঝি কৌতুহলী দৃষ্টি রাখলে শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝিকে কাছে টেনে নিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রাখে। সাঁঝির শরীরে ছোটখাটো একটা কম্পন খেলে যায়। সাঁঝির এই ফিলটা প্রায় হয় যখন শ্রাবণ তাকে ভালোবেসে কাছে টানে।
ওদের মতো কি তোমারও সত্যি মনে হয় আমি দোষী? হঠাৎ শ্রাবণ বলে উঠে এমন কথা। সাঁঝি ভাবান্তর হয়না একটুও। কারণ সে জানে শ্রাবণ এমন কিছু প্রশ্নই তাকে করবে যেটা তার হৃদয় স্পর্শ করতে বাধ্য। তাই সে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলো।
সাঁঝি একটু সময় নেয়, এরপর নির্লিপ্ত ভাবে বলে যদি তাই মনে হতো তাহলে আপনাকে ছাড়ানোর জন্য থানায় যেতাম না। এতোটা ভরসা করতাম না।
তাহলে কেনো এতো লুকোচুরি সাঁঝি? কিসের জন্য এই আঁধার আলোর খেলা? শ্রাবণের রহস্যময় কথায় সাঁঝির ভ্রু কুচকে আসে। শ্রাবণকে ছাড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকায়।
আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন? আমি আপনার কথার মানে বুঝলাম না জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সাঁঝির।
তোমার আসল পরিচয় কি সেটা আমি জানি সাঁঝি, ভণিতা ছাড়াই বলে শ্রাবণ। শ্রাবণ শারিয়ারের কথায় যেনো চমকে উঠে সাঁঝি৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে কি জানেন?
এখনো কি আমাকে এর উত্তর দিতে হবে সাঁঝি? আমি কি জানি সত্যি তুমি বুঝতে পারছো না। শ্রাবণ শারিয়ারের কথায় সাঁঝি দু কদম পিছিয়ে যায়। শ্রাবণের দিক হতে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
কেনো এমন লুকোচুরি আমার সাথে, কেনো তুমি ভুয়া পরিচয় দিয়ে এ বাড়ি এসেছিলে। কেনো তুমি রাশেদা আন্টিকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছো এইসব প্রশ্ন ধুসর হয়ে আছে এখনো।
আপনি যখন সব টা জেনে গেছেন তাহলে আজ আপনাকে সত্য বলতে কোনো বাধা নেই। তবে বিশ্বাস করুন আমি যে মনোভাব নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিলাম সেটার এখন বদল হয়েছে। আমি সত্যটা খুঁজে পেয়েছি।
এরপর সাঁঝি বলতে শুরু করে, হারুন রশীদ আমার বাবা। তবে তার সাথে আমার পার্সোনাল একটা মনোমালিন্য রয়ে গেছে, কেনো কি কারণ সেটা আমি প্রকাশ করতে চাইনা। দয়া করে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না এ ব্যাপারে, মাফ করবেন আমাকে এই বিষয়টা স্ক্রিপ করছি। আমি বাবার সাথে থাকি না। রাশেদা খালা ছোট থেকে বড় করেছে আমাকে তার আদর সোহাগ ভালোবাসা দিয়ে। মায়ের পর এই মানুষটা আমাকে মায়ের স্থান দিয়েছে মায়ের মমতায় বড় করেছেন।
আমি রাশেদা খালাকে নিয়ে একটা বাসায় ভাড়া থাকি। সেখানে থেকে পড়াশোনা করি। তবে আমার সব খরচ বাবাই বহন করেন৷ মানুষটাকে আমি অনেক ভালোবাসি কিন্তু মন থেকে মাফ করতে পারিনা তাই…
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাঁঝি। শ্রাবণ বিস্ময় নিয়ে সব কিছু শুনছে।
ছোট থেকে আমার গোয়েন্দার প্রতি ঝোঁক বেশি। থ্রিলার কাহিনি, রহস্যময় সব বই, গোয়েন্দা রিলেটেড যত বই বাজারে আসতো আমি সব আগে নিয়ে পড়তাম৷ এইসব থেকে আমার মধ্যে একটা প্রবৃত্তি আসে এবং মনস্থির করি আমি বড় হয়ে ডিটেক্টিভ হবো। তখন থেকে আমি এইসব নিয়ে ভাবা শুরু করি, কোনো কেস যদি বাবা সলভ করতে হিমশিম খেতেন তাহলে আমি সেটা সমাধান করার চেষ্টা করতাম এবং সারপ্রাইজলি আমি সেটা সমাধান করে দিতাম৷ বাবা খুশি হতেন এবং অবাকও হতেন আমার প্রতিভা দেখে৷ এইভাবে আমি বাবার কাজে সাহায্য করা শুরু করি এবং একটা সময় বাবার সিক্রেট ডিটেক্টিভ এজেন্সির মেম্বার হয়ে যায়৷ তবে এই টিমের কেউ কারো পরিচয় জানে না বা কখনো জানার আগ্রহও করবে না। আর সেইভাবে কাজ চলে।
আপনার লেখা প্রতিটি বই আমার খুব ভালো লাগতো৷ আপনি খুব সুন্দর ভাবে সব কাহিনি ফুটিয়ে তুলতেন এবং খুবই রহস্য থাকতো আপনার লেখায়৷ এইভাবে আমি আপনার ফ্যানে পরিণত হয় এবং অজান্তে ভালো….
সাঁঝি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। সাঁঝি আবারও ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে এরপর একদিন আপনার কেসটা সামনে আসে৷ বাবা আমাকে সবটা খুলে বলে যদিও আমি আগে জানতাম আপনার বই সম্পর্কে। এই কেসটা নিয়ে খুবই হিমসিম খাচ্ছে সবাই৷ এবং উপর মহল সহ এই কেস নিয়ে নাজেহাল। তখন বাবা আমাকে দায়িত্ব দেন এই কেসের সমাধান করার জন্য। এরপর একদিন আপনার বিজ্ঞাপন দেখি একটা নিউজে যেখানে আপনি উল্লেখ করেন আপনার বাসার জন্য একজন পরিচারিকা দরকার যে আপনার মায়ের দেখাশোনা করবে৷ তখনই আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে আর রাশেদা খালাকে এখানে পাঠায় সাথে আমিও আসি কিছুদিন পর৷
ডিপার্টমেন্টের সবাই মনে করে এইসব আপনি করছেন। সত্যি বলতে আমিও প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতাম এইসবের মধ্যে আপনি জড়িত আছেন৷ তবে এখানে আসার পর এবং আপনাকে দেখার পর আমার সে বিশ্বাস ভেঙেছে। এখন আমি বিশ্বাস করি আপনি কোনো খুন করেননি। আপনাকে কেউ ফাসানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কে এমন করছে এটাই বুঝতে পারছি না। এই কেসটা আমাকেও নাজেহাল করে তুলেছে৷ একবার যদি তাকে হাতে পাই তাহলে বোঝাবো… কথাটা বলে সাঁঝি হাত গোটায়। শ্রাবণ ভ্রু কুচকে তাকায়।
তুমি না ঘুরতে যাবে, যাও রেডি হও। শ্রাবণ প্রসঙ্গ বদলে নেয়। শ্রাবণের কথায় সাঁঝি বলে এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না৷ রাশেদা খালাকে বলি রান্না বসাতে। সাঁঝি আসবে এমন সময় শ্রাবণ আবারও সাঁঝির হাত ধরে আটকায়। কাছে টেনে নিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে সাঁঝির কপাল স্পর্শ করে শ্রাবণের ঠোঁটদ্বয়। সাঁঝির মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে সাঁঝির দুটো গাল। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো সব সময়ই অন্য রকম হয়।
আচ্ছা সাঁঝি, যদি কখনো সত্যি জানতে পারো যে এই খুন গুলো আমি করেছি তাহলে তুমি কি করবে? মেনে নিতে পারবে মন থেকে?
শ্রাবণের কথায় সাঁঝি চুপ থাকে। শ্রাবণের দিকে না তাকিয়ে বলে ভালোবাসা হয় বিশ্বাস আর ভরসা থেকে। আর আমার, আপনার প্রতি সে বিশ্বাস এবং ভরসা দুটোই আছে। এখন আপনি বলুন আমার কি মেনে নেওয়া উচিত নাকি উচিত নয়?
শ্রাবণ মুচকি হাসে। সে জানে সাঁঝি খুবই বুদ্ধিমতী। তার প্রশ্নের উত্তর কৌশলে দেবে।
দুই তিনদিন পর। শ্রাবণ কাজের জন্য বাইরে গেছে। সাঁঝি তার রুমে বসে আনমনে কিছু একটা নিয়ে ভাবছে৷ বিশেষ করে এই কেসটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। সাঁঝি প্রথম থেকে সব পয়েন্ট গুলো একে এক সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। কোথায় ফাঁকফোকর রয়ে গেছে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। খুনি যতই চালাক চতুর হোক না কেনো৷ কোনো না কোনো ভুল তো সে করবেই। এতো নিখুঁত ভাবে আজ পর্যন্ত কেউ খুন করতে পারেনি। সাঁঝির বিশ্বাস এই খুনিও পারবে না৷ তার দ্বারা ভুল হবে৷ আর সেই ভুলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই। এমন সময় সাঁঝির ফোন কেঁপে উঠে। ফোন স্ক্রিনে বাবার নাম দেখে কৌতুহলী হয়ে ফোন তুলে।
সাঁঝি ফোন কানে ধরতেই ওইপাশ থেকে হারুন রশীদ উত্তেজিত কন্ঠে বলে, আমার হাত থেকে কেসটা বেরিয়ে যাচ্ছে সাঁঝি। উপর থেকে নির্দেশ এসেছে। আগামী দুদিনের মধ্যে যদি আমি এই কেসের সমাধান করতে না পারি তবে কেসটা তারা CID -এর কাছে ট্রান্সফার করবে। আর CID কেসটা হ্যান্ডেল করলে কি হবে বুঝতে পারছো। শ্রাবণকে তারা সন্দেহ করবে এবং বারবার তাকেই হয়রানি করা হবে। আমার তো মনে হচ্ছে শ্রাবণই দোষী কিন্তু তুমি মানতে নারাজ। আমরা শ্রাবণ ছাড়া আর কাউকে সন্দেহ করতে পারিনা।
কিন্তু আমি পারি আব্বু! আর আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আগামী দুদিন শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে খুনি পর্যন্ত নিয়ে যাবো Its my promise. খুনি যতই চতুর হোক না কেনো এবার তার নিস্তার নেই। শ্রাবণ শারিয়ার যে নির্দোষ আমি প্রমাণ করে ছাড়বো। কথাটা বলে সাঁঝি ফোন টা কেটে দেয়। আবারও ভাবনার দরিয়ায় ডুব দেয়৷ বলে তো দিলো সে খুনি পর্যন্ত যাবে কিন্তু কিভাবে? খুনির চিন্তাভাবনার তৎপর্য কীভাবে করবে সাঁঝি। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে আজ৷ সাঁঝির কাছে অনেক কেস এসেছে অনেক জটিল কেস সে সমাধান করতে পেরেছে৷ কিন্তু আজ যখন তার ঘর বাঁচানোর প্রশ্ন, প্রিয় মানুষকে রক্ষা করার হিসাব তখন সে নিরুপায়। সে অপারগ হয়ে বসে আছে।
না না না এইভাবে ভাবলে হবেনা৷ আমাকে খুনির চিন্তা ধারার সাথে সঙ্গতি রেখে ভাবতে হবে। প্রথম খুন থেকে আমাকে শুরু করতে হবে৷ আমি নিশ্চিত একটা না একটা ক্লু আমি ঠিক পেয়ে যাবো এর মধ্যে । সাথে সমস্ত খুনের ফাইল নিয়ে বসে। হারুন রশীদ কপি করে পাঠায় সব কেসের তথ্য যেখানে থেকে সাঁঝি সহজে কেস সমাধান করার প্রয়াস পেয়ে থাকে।
চলবে…