চৈত্রের প্রেম পর্ব-০৪

0
178

#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
(৪)

❝শ্রাবণ শারিয়ারকে দুই হাতে আগলে নেয় সাঁঝি। তার মধ্যে প্রচন্ড রকমের ভালো লাগা কাজ করছে। সে শ্রাবণকে ভালোবাসে এটাই সত্যি তার কাছে। দুনিয়ার মানুষের কাছে হতে পারে বয়সের পাগলামি কিন্তু সাঁঝির কাছে এটা ভালোবাসা৷ শ্রাবণ শারিয়ারের বই পড়ে ভালো লাগার জন্ম এরপর কখন যে শ্রাবণ শারিয়ারকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলো সাঁঝি সেটা নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। আসলে এইটা আবেগ,হয়তো তাই। হোক না কিছু ভালোবাসা আবেগে আবদ্ধ। আবেগ আছে বলেই না দুনিয়ায় ভালোবাসার মতো পাগলামি চলে।

আপনার খাবার এনেছি খেয়ে নিবেন চলুন। সাঁঝি খুবই ক্ষীণ স্বরে বলে কথাটা। আর শ্রাবণ! সে একই ভাবে সাঁঝিকে আলিঙ্গন করে রেখেছে।

কি হয়েছে আপনার ভাই.. সাঁঝি ভাইজান বলতে গিয়ে আজ নিজেকে সংবরণ করে নেয়। শ্রাবণের মসৃণ চুলের ফাঁকে আঙুল তুলে বলে কেনো এতো ভেঙে পড়ছেন আপনি? এই পরিস্থিতিটা শক্তভাবে কাটিয়ে উঠতে হবে আপনাকে। এইভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। আমি যতদুর আপনাকে জানি,চিনি তাতে এটা বুঝেছি আপনি খুবই শক্তভীতের একজন মানুষ। আপনাকে সহজে টলানো যায় না। তাহলে আজ কেনো এমন দুর্বল ভাবছেন নিজেকে।

আমি যেনো বাধ হারিয়ে ফেলেছি সাঁঝি। এতগুলো মানুষের খুনের দায় আমার উপর। যেখানে আমি কিছু জানিনা, যে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই আজ তারই দোষারোপ করা হচ্ছে আমাকে। একটু একটু করে যে সম্মান,আত্মমর্যাদা আমি গড়ে তুলেছি সেটা এক নিমিষে শেষ করে দিতে চাই ওরা। কে করছে এমন? কেনো বা করছে এমন আমার সাথে। শ্রাবণ হতাশ হয়ে বলে।

সত্য খুব শীগ্রই সামনে আসবে আপনি দেখে নিয়েন। দয়া করে আপনি নিজেকে সামলান। খেয়ে নিবেন আসুন। এই কয়দিনে চেহারার কি হাল করেছেন খেয়াল করে দেখেছেন আপনি। এখন তো যে কেউ আপনাকে দেখে বলবে আপনি সত্য বুড়ো হয়ে গেছেন। সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে ওই দেখ বুড়ো বেটার কচি বউ যাচ্ছে। সাঁঝি রসিকতা করে বলে কথাটা যাতে শ্রাবণের মনটা একটু ভালো হয়।

সাঁঝি আজ আমাকে একটু ভালোবাসবে? আপন করে নিবে আমাকে? হঠাৎ শ্রাবণের এমন অদ্ভুত আবদারে দমে যায় সাঁঝি। শরীরে কাটা দিয়ে উঠে শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যায়। অন্ধকারের মাঝেও সাঁঝির অবাক চাহনি চোখ এড়ায়নি শ্রাবণের। তার উৎসুক চাহনি,সাঁঝির জবাবের অপেক্ষা। সাঁঝি চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকায়, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রোদ্দুর। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ দাঁড়িয়ে গেছে সাঁঝির কাছে। ভারী ভারী নিশ্বাস, ছুটে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে।

খেয়ে নিবেন আসুন, সাঁঝি কথা ঘুরিয়ে চলে আসতে গেলে শ্রাবণ আবারও সাঁঝির হাত চেপে ধরে। দ্বিতীয়ভাবের মতো একই অনুভূতির শিকার হয় সাঁঝি।

আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি! শ্রাবণ শারিয়ারের নির্লিপ্ত আওয়াজ।

❝উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাইনি, তাই প্রশ্নরা আহত হয়ে ফিরছে উত্তরের তরে। তবে সব প্রশ্নের উত্তর কি জরুরি। থাকনা একটা প্রশ্নবোধক হয়ে। ভালোবাসি এতটুকু বুঝতে পারলে হবে।❞ সাঁঝির কথায় শ্রাবণ মুচকি হেসে একটা হেঁচকা টান দেয় সাঁঝির হাত ধরে। সাঁঝি এসে পড়ে শ্রাবণের কোলে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সাঁঝির ঘাড়ে মুখ ডোবায় শ্রাবণ। আবারও নতুন এক ভালো লাগার সাক্ষি, নতুন অনুভূতি, হয়তো একটা অজানা সুখের সন্ধানে।

পরের দিন শ্রাবণ শারিয়ার প্রকাশনীতে ফোন দিয়ে জানায় যে, সে আগামী তিনদিনের মধ্যে তার বইয়ের কাজ শেষ করে জমা দেবে। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে তাকে বেরুতে হবে। একটা বিষয় নিয়ে জীবন কখনো আটকে থাকে না। তাই তারও উচিত সব কিছু উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে চলা। জীবনে চলার পথে বাঁধা আসবে এবং সেই বাঁধা অতিক্রম করে তবে জীবনের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা যায় । কিছু সময়ের জন্য শ্রাবণ এটা ভুলে গিয়েছিলো। যে ঘটনা কেন্দ্র করে তার জীবন ত্বরান্বিত হচ্ছে সেটার দায় তার নেই। কারণ সে জানে,কোনো দোষ সে করেনি। তাই সত্যের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

হারুন রশীদ সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন তিনি। হঠাৎ করে দুদিন ধরে শরীরটা যেনো সায় দিচ্ছে না তাকে। তার উপর এই জটিল কেস। পুরো ডিপার্টমেন্টকে যেনো নাজেহাল করে ছাড়ছে। কোনো রকম কুলকিনারা পাচ্ছেন না কেসের। উপর মহল থেকে বরাবরই চাপ পড়ছে হারুন রশীদের উপর, কারণ তিনি এই কেসের প্রধান দায়িত্বে আছেন।

এতো তাড়াতাড়ি ফিরবে আশা করিনি। হঠাৎ কারো কথায় থমকে দাঁড়ায় হারুন রশীদ। তিনি সবে মাত্র ড্রয়িংরুমে পা রেখেছিলেন। তবে কন্ঠস্বরটা চিনতে তার অসুবিধা হয়নি সাথে মানুষটাকেও।

তুমি এখানে? কখন এসেছো? হারুন রশীদ গম্ভীর স্বরে বলেন।

তুমি কি আমার উপর রেগে আছো? সামনে থাকা ব্যক্তির কথায় হারুন রশীদ ক্ষোভ নিয়ে বলেন তার কি কোনো মূল্য আছে তোমার কাছে। তুমি তো সর্বদা তোমার নিয়মে চলো, তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করো৷ এখানে আমার রাগ হওয়া বা না হওয়াতে তোমার কিছু এসে যায় বলে তো আমার মনে হয়না।

সত্যি আমার কিছু এসে যায় না আব্বু। কারণটা তুমি খুব ভালো করে জানো। মেয়ের কথায় হারুন রশীদ এবার দমে যায় একটু। নিভে যাওয়া পোড়া কয়লার ন্যায় নুয়ে পড়েন।

এইভাবে আর কতদিন আমাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় রাখবে ছুটকি মামনী। মুমূর্ষু কন্ঠে বলেন হারুন রশীদ।

ওইসব কথা আজ থাক! যে কাজে এসেছিলাম সেটা শেষ করি এবার। মেয়ের কথায় হারুন রশীদ বলেন আমি কি চেঞ্জ করে আসতে পারি।
হারুন রশীদকে এবার একটু ভালো করে পরখ নেয় তার মেয়ে।
তোমার কি শরীর খারাপ? মেয়ের কথায় হারুন রশীদ স্মীত হেসে বলেন বয়স হচ্ছে আর কত সহ্য করবে এই দেহ। তার উপর এতো চিন্তা,নতুন নতুন কেসের সাথে যুক্ত থাকা। বেশিদিন মনে হয় আর ডিপার্ট্মেন্টের সাথে থাকতে পারবো না। হতাশা নিয়ে বলেন তিনি।

আমার হাতে সময় কম, যা করার একটু তাড়াতাড়ি করবে প্লিজ। মেয়ের অনুমতি পেতেই হারুন রশীদ নিজের ঘরের দিকে ছুটে যায়।

হারুন রশীদ ফ্রেস হয়ে এসে সোফায় বসে। আদা দেওয়া এক কাপ চা তার সামনে।
অনেকদিন পর তোমার হাতের চা খাচ্ছি। হারুন রশীদ চায়ের কাপ হাতে তুলে বলেন।

তোমার কেসের তদন্ত কতদূর?

চলছে, তবে এখনো কোনো সঠিক ক্লু পাইনি ওইগুলো ছাড়া। তবে আমরা সাবধান আছি, পরবর্তী খুনের শিকার আর কাউকে হতে দেবো না আমরা। শহরের প্রতিটি জায়গায় আমরা পাহারা বসিয়েছি।

তোমার কি মনে হয় এইভাবে খুনিকে আটকাতে পারবে? অলরেডি ৯ টা খুন সে করে ফেলেছে এমনি এমনি না। যে ৯টা খুন এতো নিখুঁত ভাবে করতে পেরেছে সে পরবর্তী খুনগুলো করার জন্য নিশ্চিয় ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলবে না৷ তোমাদের চিন্তাভাবনার থেকে তার চিন্তাভাবনা অনেকদূর এগিয়ে এটা মাথায় রাখতে হবে। মেয়ের কথায় হারুন রশীদ ভ্রু কুচকে বলে তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো? তুমি কি এমন কাউকে সন্দেহ করছো যে এই খুনের সাথে জড়িত থাকতে পারে।

এখনো পর্যন্ত কোনো ক্লু পাইনি। একটা ইনফরমেশন যদি পাই তাহলে খুনি পর্যন্ত পৌছাতে কেউ আটকাতে পারবে না আমায়৷ বেশ নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে সবাইকে। তাই আমাদেরও সতর্ক ভাবে এগিয়ে যেতে হবে৷ খুনির চিন্তাভাবনার সাথে আমাদের চিন্তাভাবনার একটা সংগতি রাখতে হবে।

তবে তোমরা মিস্টার শ্রাবণ শারিয়ারের বাড়ি গিয়ে ঠিক কাজ করোনি। অলমোস্ট আমাকে ইনফর্ম করে তো যেতে পারতে। যদি আমাকে ছাড়াই তোমরা সব কিছু করার চিন্তাভাবনা করো তাহলে আমাকে এই কেসে ইনভলভ করেছো কেনো? রেগে যান উনার মেয়ে।

তুমি শুধু শুধু আমার উপর রাগ করছো ছুটকি, আমি তোমাকে ইনফর্ম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এতোটাই ব্যস্ত ছিলে যে আমার ফোন ওঠানোর প্রয়োজন মনে করোনি। তাই কোনো উপায় না পেয়ে আমরা সেখানে যায়। উপর থেকে কি পরিমাণ চাপ আসছে এটা তোমাকে নতুন করে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি একবার মর্গে যাবে লাশ গুলো পর্যবেক্ষণ করতে। হারুন রশীদের কথায় ছুটকি বলে যদি সময় পাই তাহলে ভেবে দেখবো আজ আমি উঠি আর হ্যাঁ! আমাকে না জানিয়ে শ্রাবণ শারিয়ারকে আর ঘাটাবে। তোমাদের এই কেসের সমাধান চাই, আমি দেবো এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কথাটা বলে ছুটকি চলে আসতে গেলে হারুন রশীদ বলেন যদি খুনি সত্যি সত্যি শ্রাবণ শারিয়ারই হয়।

ছুটকির পা টলে যায়। স্বাভাবিক দৃষ্টি রেখে কোমল স্বরে বলে, সত্যির উপর থেকে যদি শব্দটা উঠে যাক তারপর নাহয় ভেবে দেখবো৷ আপাতত উদ্ভট ভাবনায় জড়াতে চাইনা। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়না সে।

আজ এতো দেরি হলো যে বাড়ি ফিরতে? সাঁঝি ঘরে ঢুকতেই শ্রাবণ প্রশ্ন করে। সে তার পড়ার টেবিলে কিছু কাগজপাতি ঘাটছিলো।
শ্রাবণকে দেখে সাঁঝি যেনো চমকে উঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওহ আপনি। এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। সাঁঝি কাধে থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেস হতে। শ্রাবণ শারিয়ার অপেক্ষা করে সাঁঝির জন্য।

সাঁঝি আসতেই শ্রাবণ শারিয়ার বলেন আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি।

কোচিং-এ আজ এক্সাম ছিলো৷ তাই দেরি হয়ে গেছে । তাছাড়া কোচিং থেকে বেরিয়ে আজ একটা রিকসাও পাইনি। হেঁটে আসছি বুঝতে পারছেন।

তোমার ফোন অফ কেনো? শ্রাবণের কথায় সাঁঝি ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে বলে ওহ অফ নাকি৷ তাহলে বোধহয় চার্য আউট হয়ে গেছে। আপনি আমাকে এইভাবে জেরা করছেন কেনো?

সাঁঝির কথায় শ্রাবণ বলে সচারাচর তোমার এতো দেরি হয়না তার উপর ফোনও অফ বুঝতে পারছো কতটা চিন্তা হচ্ছিলো। অলরেডি ৮ টা বেজে গেছে সাঁঝি, সেখানে আমার প্রশ্ন করাটা কি স্বাভাবিক নয়?

সাঁঝি বুঝতে পারে শ্রাবণ রেগে আছে। সাঁঝি এগিয়ে এসে শ্রাবণের কোলের উপর বসে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলে খুব মিস করছিলেন বুঝি আমাকে।সাঁঝি আর শ্রাবণের সম্পর্ক টা এখন স্বাভাবিক। ঠিক আর পাঁচটা স্বাভাবিক দম্পতির ন্যায়।

তুমি কি কোচিং থেকে অন্য কোথাও গিয়েছিলে? হঠাৎ শ্রাবণ শারিয়ারের এহেন কথায় হকচকিয়ে উঠে সাঁঝি। কৌতুহলমিশ্রিত কন্ঠে বলে অন্য কোথাও আবার কোথায় যাবো?

না এমনি মনে হলো তাই শ্রাবণ শারিয়ার আর কিছু বলে না এই বিষয়ে। সে যে সাঁঝির কোচিং এ গিয়েছিলো এটা আর প্রকাশ করলো না।

এইভাবে কাটে এক সপ্তাহ!

শ্রাবণ আজ সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। সাঁঝির কলেজ বন্ধ আজ। তাই সে বাড়িতেই আছে। সকালের নাস্তা শেষে রুমে আসতেই সাঁঝির ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে পরিচিত নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ইমিডিয়েটলি একবার ধানমন্ডি আসতে পারবে৷ আমি তোমাকে লোকেশন সেন্ড করছি কথাটা বলে ফোন রেখে দেয়। সাঁঝি বুঝতে পারে তাকে কেনো ডাকা হচ্ছে এবং কি কাজ তার সেখানে…

চলবে…

ভুলক্রুটি মাফ করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে