#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দশম পর্ব
~মিহি
তূর্যর বাড়িতে গণ্ডগোল চলছে। এ গণ্ডগোলের কারণ অবশ্য এক হিসেবে ধরলে আয়াশ। তূর্য বাড়িতে ঢুকেই তার চাচার কুকীর্তি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার বাবা তায়েফ উদ্দিন অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠে আসেন। এখনো তূর্য চুপ হয়নি। সে রীতিমতো শপথ করেছে হয় তার চাচা বাড়ি ছাড়বে নয়তো সে। তায়েফ উদ্দিন কোনদিকে যাবেন বুঝে উটতে পারছেন না। একদিকে ভাই, অন্যদিকে ছেলে। নিজের ভাইয়ের কুকীর্তি তার কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। সেকারণেই তিনি চুপচাপ এককোণে বসে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তূর্যর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে আজ। একটা মানুষ নিচে নামতে নামতে অর্ধেক হাত গর্তে অবধি পড়ে গেছে অথচ কিনা তওবা করার নাম নেই, সেই ধরনের মানুষকে জুতা দিয়ে মেরে মুখ চুনকালি করিয়ে দিলেও তার নূন্যতম লজ্জাবোধ হবে বলে মনে হয় না। তূর্য জানে তার চাচার জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের কথা। তূর্যর চাচা আনিস বরাবরের মতো চরিত্রহীন স্বভাবের। গ্রামের একটা মেয়েও তার কুনজর থেকে বাঁচেনি। লোকটা সবচেয়ে বেশি অন্যায় করেছিল আয়াশের একমাত্র ফুপু রজনীর প্রতি। রজনীর তখন বিয়ে হয়ে গেছে, কোলে আট মাসের বাচ্চা। তূর্যর বয়স তখন আট-নয়। একদিন হঠাৎ তূর্য লক্ষ করল আনিস উদ্দিন রজনীর হাত চেপে ধরছে বারবার। বিব্রত রজনী এই ফাঁকা রাস্তায় আট মাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে ক্রন্দনরত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য তখন কিছু বোঝেনি, রজনী ফুপুকে আবার সে খুবই পছন্দ করত। গলায়-গলায় সখ্যতা যাকে বলে। সে চাচা আর ফুপুর কাছে এসে সালাম দিতেই তার চাচা তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে যায়। তূর্য সামান্য বাকা দৃষ্টিতে তাকালেও তেমন কিছুই বোঝেনি। রজনী ফুপুও তাকে আর কিছু বলেনি কিন্তু একদিন আচমকা শোনা যায় আয়াশের ফুপুর মৃত্যুসংবাদ। তাকে নাকি ধর্ষণ করে রাস্তার পাশে ফেলা হয়েছে। তার আগের রাতেই আনিস উদ্দিনকে রক্তমাখা পোশাকে ঘরে ঢূকতে দেখেছিল তূর্য, কাউকে বলতে পারেনি ভয়ে। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে অনুতাপ বাড়তে থাকলো। ঐ আট মাসের বাচ্চা মা হারিয়ে এখন সৎ মায়ের সংসারে বড় হচ্ছে। এর জন্য কোন না কোনোভাবে তূর্যও দায়ী। সে যদি প্রথম দিনেই সবাইকে সব বলে দিত, তাহলে এমন পরিস্থিতি কখনো আসতো না।
তায়েফ উদ্দিন আর আনিস উদ্দিনের মধ্যে চেঁচামেচি শুরু হয়েছে আবার। তূর্যর আর ভালো লাগছে না এসব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আয়াশের বাড়ির দিকে গেল সে। ছেলেটা একা আছে, না জানি কী করছে! তূর্য আয়াশ আর নিজের সম্পর্কের দিকে তাকালে বারবার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে তার,”ওহে পৃথিবী! শুনছো? এই শহরের ব্যস্ততার ভীড়ে হারিয়ে যায় না সত্যিকারের বন্ধুত্বগুলো!” কথাটা ভাবতেই লজ্জা লাগে তার। অনেকটা সিনেমার মতো হত ব্যপারটা। হাঁটতে হাঁটতে আয়াশের বাড়ির কাছেই এসেছিল সে, আচমকা দেখল লতা মুখ লুকিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। বেশ তাড়া আছে মনে হচ্ছে। তূর্য এক দৌড়ে আয়াশের কাছে গিয়ে কথাটা বললো। আয়াশও তাড়াহুড়ো করে তূর্যকে সাথে নিয়ে এলো। লতা তখন ওদের থেকে শ’মিটার খানেক সামনে। লতার পিছু নিতে লাগলো দুই বন্ধু যদি কোন প্রমাণ পাওয়া যায় এ আশায়।
___________________________
সিদ্ধির হাত-পা কাঁপছে। ডাক্তার বলেছেন হার্ট অ্যাটাক, আপাতত তার বাবা অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। পাশে বসে থাকা তাহমিদ ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে সিদ্ধিকে স্বান্তনা দিচ্ছে কিন্তু তা সিদ্ধির কর্ণকুহরে বিন্দুমাত্র কম্পনও সৃষ্টি করতে পারছে না। আচমকা একটা কথা সিদ্ধির কানে ঝংকারের ন্যায় বেজে উঠলো। “আঙ্কেল বলেছেন আগামীকালই আমাদের বাগদান করিয়ে রাখবেন।” তাহমিদের বলা এই কথাটাই সিদ্ধির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। তাহমিদের দিকে চোখ তুলে তাকায় সে। অদ্ভুত ধরনের এক হাসি তাহমিদের ঠোঁটে অথচ সিদ্ধি ভাবলেশহীন।
-“সিদ্ধি, আঙ্কেল আপনাকে বলেনি এসব?”
-“না আর আমি আপাতত বাগদানে ইচ্ছুক না।”
-“দেখুন সিদ্ধি, আমি আঙ্কেলকে কথা দিয়েছি যে বাগদান কালই হবে। উনি এখন যে অবস্থায় আছেন, আমি চাইনা একজন অসুস্থ মানুষকে দেওয়া কথার খেলাপ করতে। দরকার হলে বিয়ে দেরিতেই হবে।”
-“আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে একবারও বলেছি আমি? তাছাড়া বাবা অসুস্থ এখন।”
-“সেজন্যই বলছি আমি। প্লিজ বুঝুন, ওনাকে খুশি রাখতে হবে।”
সিদ্ধি চুপ হয়ে যায়। চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,”আয়াশ! তোমায় দরকার আমার, এ মুহূর্তে তোমায় আমার পাশে দরকার আমার।” ইচ্ছে হলেই বা কী? সব ইচ্ছে কী পূরণ হয়? ইচ্ছে পূরণ হয় না বলেই তো মানুষের বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়। সব ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেলে তো জীবন শেষ। ঠিক ঐ গানের লাইনটার মতো,’সব পেলে নষ্ট জীবন।”
_______________________
আয়াশ যা ভেবেছিল ঠিক তাই। এসবের পেছনে ঐ তারেক রহমান নামক লোকটাই আছে। লতা এসেছিল লোকটার সাথে দেখা করতে, একটা বন্ধ গোডাউনে। লতা তারেক রহমানের সাথে কী নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি করছে। লতাকে বেশ ক্ষীপ্ত দেখাচ্ছে, তারেক রহমানও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আয়াশ ধীরস্বরে তূর্যকে বললো পুলিশে কল করতে। তূর্য নম্বরে ডায়াল করলো। “হ্যালো” বলতেই পেছন থেকে কেউ তূর্যর মাথায় আঘাত করে। আয়াশ পিছনে ঘুরতেই তার কপালেও আঘাত করা হয়। সাথে সাথে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে দুজন। তাহমিদ বাঁকা হাসি দিয়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়। লতা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা-ছেলের দিকে। তারেক রহমানের ইশারা পেয়েই বিদায় হলো সে। তাহমিদ হাসছে। সিদ্ধি তাকে বলেছে বাগদানের ব্যবস্থা করতে। এসব এত সহজে হয়নি। সায়ন সাহেবের জ্ঞান ফেরার পর বাগদানের কথা তোলায় সিদ্ধি মানা করে দেয়। সায়ন সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠেন, তখনো ঠিকমতো হুঁশ নেই তার। সিদ্ধি ভাবে সে বাগদানে মানা করায় বাবা কষ্ট পাচ্ছে। তাই সে রাজি হয়ে যায় অথচ ঘটনাটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়। তাহমিদের তো খুশিতে মাটিতে পা পড়ছে না। আয়াশ নামক কাঁটাটাও তার জীবন থেকে সরে গেল। আবার, আজ সিদ্ধিও তার হতে চলেছে। এক ঢিলে দুই পাখি, এর চেয়ে বেশি সুখকর কী হতে পারে?
-“বুঝলে বাবা, খেলাটা কিন্তু ভালোই খেললে।”
-“আরে রাখ তোর খেলা! মাস্টারমাইন্ডের বুদ্ধি সব। আমি তো শুধু স্কুলের জমিটা হাতানোর জন্য এসব করেছি। ঐ জমি এক বিদেশী কোম্পানির কাছে বেঁচে আমি এখন লাখপতি।”
-“কিন্তু ওরা জমিটা কিনলো কেন? এখনো তো কিছুই হয়নি ওখানে। আগের মতোই স্কুল আছে।”
-“ওদের প্রজেক্ট খুবই গোপনীয়, চার বছর ধরে রিসার্চ করে এখন সব ঠিকঠাক করছে। আগামী মাসেই দেশে আসবে।”
-“তাহলে এত আগে কিনে রাখার কারণ কী?”
-“ওসব আমি জানিনা। তুই এই দুটোকে বেঁধে রাখ তো।”
তাহমিদ হাসে। অতঃপর আয়াশ আর তূর্যকে চেয়ারে বসিয়ে হাতে-পায়ে শিকল লাগিয়ে দেয়।
_________________________
-“আমায় মাফ করবিনা শ্রাবণ?”
-“জানিস তানভী, আমাদের পাঁচজনের মধ্যে যে ভয়টা সবচেয়ে বেশি কাজ করে তা হলো বন্ধুত্ব হারানোর ভয়। তোর মধ্যে যখন সে ভয়টা কাজ করেনি, নিশ্চয়ই তোর কাছে বন্ধুত্বটারও নেই।”
-“শ্রাবণ!”
-“থাক তানভী! প্লিজ আমায় আর ছোট করিস না। যা হওয়ার তোর সামনেই হলো।
শ্রাবণ উঠে আসে। নেশা কাটেনি এখনো তার, টলমল করছে নেশার ঘোরে। শ্রুতির চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না শ্রাবণ। তানভীকে পারলে এখনি খুন করে ফেলে শ্রাবণ কিন্তু পারছে না। বন্ধুত্ব সূত্রে এখনো তানভীর উপর মায়া আছেই কিন্তু তানভী যা করেছে তার জন্য শ্রাবণ কোনদিনই ওকে মাফ করতে পারবে না। নেশার ঘোরে সবকিছু বললেও শ্রাবণ মন থেকেই বলছে কথাগুলো। যার জন্য আজ শ্রুতি তাকে ছেড়ে গেল সেই মেয়েটাকে সে কিছুতেই মাফ করবে না, কিছুতেই না।
আসলে বিষয়টা খুব সহজ, একটা সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষ ঢুকলে তার ধ্বংস অবধারিত যেমনটা শ্রাবণ আর শ্রুতির সম্পর্কে তানভীর উপস্থিতিটা।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]