#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
অষ্টম_পর্ব
~মিহি
-“দেখুন আপনারা ঘর থেকে বের হবেন নাকি আমি চিৎকার করে পাড়া-পড়শী ডাকবো?”
-“দেখুন আমার আপনার সাথে কথা বলাটা খুব দরকার, প্লিজ!”
আয়াশের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলেন মহিলাটি। আয়াশ হতাশ চোখে তূর্যর দিকে তাকালো। তূর্যও হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে একটু একটু ধারণা করেছিল রমিজ আলীর স্ত্রী এত সহজে কথা বলতে চাইবে না। মহিলার টাকার লোভ আছে সেজন্যই স্বামীকে খারাপ কাজ করতে আটকায়নি। এখন গ্রামবাসী খোঁটা দেয় বলে কারো সাথে কথা বলে না। বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর হলো, বাবার পেনশনের টাকায় এখন তার, তার মায়ের এবং সন্তানদের জীবন চলছে। তূর্যকে আনমনে ভাবতে দেখে তাকে আলতো করে ধাক্কা দেয় আয়াশ।
-“কীরে কী ভাবছিস?”
-“মহিলাটার লোভ আছে। টাকা অফার করে দেখি?”
-“আমার কাছে যা ছিল, বাসেই চুরি হয়ে গেছে। নাফছীকে বলে আমার একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করাই থাম।”
-“আমি থাকতে তোর টাকা দেওয়া লাগবে? চুপ করে দাঁড়া।”
-“আমার জন্য এমনিতেই তুই যা করছিস সেটা অনেক, এখন আবার তোর থেকে টাকা দিতে পারবো না আমি।”
-“দিলি তো পর করে! বন্ধু যদি ভেবে থাকিস, চুপ থাকবি।”
তূর্য আবারো দরজায় টোকা দিল। অপর পাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কেবলই অন্তত ধীর গলায় একটা বাচ্চার কণ্ঠ শোনা গেল,”মা, কে যেন ডাকছে দরজায়!” পরক্ষণেই আর কোন শব্দ শোনা গেল না। বোধহয় চোখ রাঙানি কিংবা ইশারায় চুপ করিয়ে দেওয়া হলো বাচ্চাটাকে।
_______________________
সায়ন সাহেবের সকাল থেকেই শরীরটা ঠিক লাগছে না, অস্থির লাগছে। অফিসে গিয়েছিলেন, তারেক রহমানের সাথে নাস্তাও করলেন। তখন অবধি ভালোই ছিলেন কিন্তু হঠাৎ করেই বেশ অস্থির লাগছে। তারেক রহমান তাহমিদকে বলেন সায়ন সাহেবকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে। তাহমিদের এ বাড়িতে আসা মানেই সিদ্ধিকে এক নজর দেখতে পাওয়া। সুতরাং তার মানা করার কোন কারণই নেই। বেশ খুশিমনেই সে সায়ন সাহেবকে বাসায় পৌঁছে দিতে আসে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সিদ্ধির দেখা পায় না। সিদ্ধি তখন ক্যাম্পাসে। একরকম জোর করেই বাড়িতে বসে অপেক্ষা করার চিন্তা করে সে। এখন সে আর সায়ন সাহেব বসে চা খাচ্ছেন, চা-টাও তাহমিদেরই বানানো। তাহমিদ কথাপ্রসঙ্গে বারবার সিদ্ধির নাম নিচ্ছে যা সায়ন সাহেবের বেশ বিরক্ত লাগলেও তিনি কিছু বলতে পারছেন না।
-“আঙ্কেল, সিদ্ধির বিয়ে নিয়ে কী ভাবলেন তাহলে?”
-“পড়াশোনা শেষ হোক তখন দেখবো।”
-“ততদিন তো আর ভালো পাত্র বসে থাকবে না।”
-“মেয়ে আমার, চিন্তা তোমার কেন?”
-“আঙ্কেল, আপনি ভালোভাবেই জানেন আমি এসব কেন বলছি।”
-“আর ঠিক কতবার কত ভাষায় মানা করলে তুমি বুঝবে বলো তো।”
-“আমি বুঝবোনা আঙ্কেল, কোনভাবেই না। সিদ্ধিকে আমার চাই মানে চাই-ই। বাই হুক অর বাই ক্রুক।”
-“ভুল ধারণা এটা তোমার। সিদ্ধিকে তুমি কখনোই পাবে না। দেখো, আমি তোমার বাবার বন্ধু, তোমায় কিন্তু আমি নিজের ছেলের মতোই দেখি। বাবা হিসেবে তোমায় আমি একটা উপদেশ দিচ্ছি শুনো। হয় নিজের ক্যারিয়ারে মন দাও, নাহলে ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে সংসার করো অবশ্যই সেই মেয়েকে যে তোমায় ভালোবাসবে।”
-“মেয়েটা সিদ্ধিই হবে আঙ্কেল। আপনি জীবিত অবস্থায় যদি না হয়, তবে আপনি মরলেই হবে।”
-“ক…কী ব…ব..বলছো তুমি?”
সায়ন সাহেব হাঁপাতে থাকেন,শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার, গলাটা জ্বালা করছে ভীষণ। আচমকা এমনটা হওয়ার কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। এইমুহূর্তে এসব নিয়ে ভাবার অবস্থায়ও নেই তিনি। কোনমতে পকেট থেকে ফোনটা বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু সামনে থাকা মানুষটার পাশবিক রূপটা আজ তাকে বাঁচতে দিতে চায় না তা পুরোপুরি বুঝে গেছেন তিনি।
_______________________
-“সিদ্ধি প্লিজ!”
-“দেখ শ্রাবণ, আমি আসতে পারবো না প্লিজ। আমার শরীর ঠিক নেই।”
-“তুই এই গ্রুপের জান। আমি চলে যাচ্ছি আর তার আগে একটা পার্টি দিচ্ছি, সেখানে নাকি তুই-ই থাকবি না! এইটা কিছু হলো?”
-“দেখ শ্রাবণ, বাবা বাড়িতে একা। লেইট নাইট পার্টি তিনি একদম পছন্দ করেন না।”
-“তোর ভাড়াটিয়া আছে তো!”
শ্রাবণের মুখে কথাটা শোনার পর সিদ্ধির মনে জমে থাকা কষ্টগুলো আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। আয়াশ নামটা ভুলতে চায় সে কিন্তু পারছে না তো। শুষ্ক চোখদুটো থেকে অশ্রু নিঃসৃত হওয়ার আগেই নিজেকে সংবরণ করলো সে। শুষ্ক হাসি হেসে বললো,”ভাড়াটিয়াটা আর নেই রে! থাক তোরা, আমি আসি আর শ্রাবণ, আমি কাল তোকে সি-অফ করতে আসবো।” আর দাঁড়ায় না সিদ্ধি। শ্রাবণ পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকলেও তা কানে নিল না আর। শ্রাবণ মনমরা দৃষ্টিতে সিদ্ধির চলে যাওয়া দেখল। আশেপাশে তাকাতেই তার মনে হতে লাগলো এই স্বার্থপর পৃথিবীতে সে একা, পাশে কেউ নেই তার। শ্রাবণের দৃষ্টি আশেপাশে শ্রুতিকে খুঁজলো কিন্তু পেল না বরং চোখে পড়ল উশৃঙ্খলতার প্রতীক তানভী কিনা চুপচাপ এককোণে বসে সিগারেট ফুঁকছে। অতিমাত্রায় রাগ হলে তানভী দু-একটা সিগারেট খায়। এই অভ্যেসটা ছাড়ানোর হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ সবাই। শ্রাবণ এসে ধপ করে বসে পড়লো তানভীর পাশে। আচমকা কেউ পাশে বসায় নাক-মুখ কুঁচকায় তানভী। পরক্ষণেই শ্রাবণকে দেখে আবারো স্বাভাবিকভাবে সিগারেটের ধোঁয়ায় সুখ খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
-“তোর কী হইছে রে তানভী?”
-“বাবা আমার বিয়ে দিবে।”
-“আরেহ বাহ! তোর তো বহুদিনের স্বপ্ন বিয়ে করা, ট্রিট দে।”
-“যে ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে, তার আগে এক স্ত্রী ছিল। বাচ্চা রেখে পালিয়ে গেছে। আমি বিয়ে করে বরকে নিয়ে কোয়ালিটি টাইম কাটাতে চাই আর তা না করে আমি কিনা এই বয়সে বাচ্চা সামলাবো?”
-“আঙ্কেলকে মানা করে দিতে বল।”
-“বাবা করবে না! ছেলের টাকা আছে। টাকা মানেই তো সব। আমি ছেলেটাকে মেনেও নিতাম কিন্তু ছেলের পরিবারের আচরণ মোটেও ভালো না।”
-“কেন রে?”
-“এমনভাবে দেখে গেছে মনে হয় আমি কোন জিনিস। ওর মা তো পারলে আমারে আর্মিদের মেডিকেল টেস্টের মতো করে টেস্ট করায়ে তারপর বিয়ে দিত। আর শ্বশুরের একটাই কথা, মেয়ে বিয়ের পর বাড়ির বাইরে যাবে না। মানে কী! ননদের তো ঢঙের শেষ নাই। আমার ঘরে ঢুকে সব দেখে বলে, ‘ভাবী তোমার ড্রেসগুলো তো সুন্দর, অবশ্য বিয়ের পর তো আমারই হবে।’ মানে সিরিয়াসলি? এত ন্যারো মাইন্ডের লোক হয়?”
-“বিয়েটা ভাঙ। বল তোর বয়ফ্রেন্ড আছে।”
-“বলছিলাম। ছেলে তাও বিয়ে করবেই, শালা ক্যারাক্টারলেস! এক বউ পালাইছে, এবার আমি বিয়ের আসর থেকে পালাবো।”
-“আঙ্কেলের কী হবে?”
-“ঐটাই ঝামেলা!”
তানভী চুপ হয়ে যায়। কথা বলতে বিরক্ত লাগছে তার। এমনিই এক ঝামেলা ঘাড়ে বসে আছে। শ্রাবণ অনেকক্ষণ ভাবলো। তানভী তখনো সমানে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে।
-“এই তানভী শোন!”
-“কীহহহ!”
-“তুই এক কাজ কর, একটা ছেলেকে পটায়ে বিয়ে করে ফেল। অন্তত ঐ এক বাচ্চার বাপের হাত থেকে তো রেহাই পাবি।”
-“তুই ফাজলামো করতেছিস? ছেলে কই পাবো আমি এখন বিয়ের জন্য?”
-“পটায়ে ফেল। ছেলে পটানো তো ব্যপার নাহ তোর জন্য।”
বলেই শ্রাবণ তানভীর দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করে কথাটা বলা তার উচিত হয় নি। অনিচ্ছাকৃতভাবে তানভীর চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছে শ্রাবণ। তানভীর চোখ ছলছল করছে। শ্রাবণ মলিনভাবে হাসলো। অতঃপর আলতো করে তানভীকে জড়িয়ে ধরলো। তানভী কান্না শুরু করে দিলো। শ্রাবণ থামানোর চেষ্টা করলো কিন্তু থামছে না তানভী। একমনে শ্রাবণের কাঁধে মাথা রেখে কেঁদেই চলেছে। এই অশ্রু নিঃসরণ কিন্তু আরেকজনের হৃদয়ে ক্ষরণ বাঁধিয়ে দিয়েছে। সে আর কেউ নয়, শ্রাবণ আর তানভীর থেকে চার হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রুতি। শ্রাবণের কাঁধে আহ্লাদে তানভীর মাথা রেখে আদুরে মুহূর্ত কাটানোটা মুহূর্তেই শ্রুতির হৃদয়ে কাঁটার ন্যায় খচখচ করতে থাকে। না পারে সে কাঁটাটা উপড়ে ফেলতে আর না পারে কাঁটাটার যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে।
চলবে…