চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব-০৭

0
967

#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
সপ্তম_পর্ব
~মিহি

মধ্যরাতে জোনাকির আনাগোনা, তারায় তারায় আকাশ আজ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। বাসের জানালার সাথে হেলান দিয়ে রাতের রূপগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। মনের বিস্তর অংশ জুড়ে সিদ্ধির আনাগোনা। ন’বছর, দীর্ঘ একটা সময়। এ ন’বছরে কি সিদ্ধির একবারও মনে হয়নি তার মনের এক অংশ শূন্য পড়ে আছে? প্রকৃতি নাকি শূন্যস্থান পূরণ করতে ভালোবাসে, সিদ্ধির মনে তার জন্য যে শূন্যস্থান ছিল তা কি আদৌ আছে আর? আয়াশ আনমনে হাসে, আবার পরক্ষণেই সিদ্ধির জন্য মন কেঁদে ওঠে। আয়াশ চোখ বন্ধ করে। তারেক রহমানের সম্পর্কে ইতিমধ্যে গুগল থেকে ছোটখাটো একটা তথ্যভাণ্ডার সংগ্রহ করে ফেলেছে। তারেক রহমান বেশ খ্যাত ব্যবসায়ী। শুরুর দিকে তারেক রহমানের কাছে বেশি মূলধন না থাকায় ব্যবসা ডুবতে বসেছিল কিন্তু এই ডুবতে থাকা ব্যবসায় আচমকাই অনেক লাভ হয়। বিষয়টা খটকা লাগে আয়াশের কাছে। ভালোভাবে লক্ষ করলে বুঝতে পারে এই ডুবতে থাকা ব্যবসায় আচমকা উন্নতিটা হয় ঠিক সে সময়টাতে যে সময় তার বাবার খুন হয় এবং সায়ন সাহেব তার পরিবারকে নিয়ে গ্রাম ছাড়েন। এই দুইটা ঘটনা কখনোই কাকতালীয় হতে পারে না, এই দুই ঘটনার কোথাও না কোথাও যোগসূত্র তো আছেই। তারেক রহমান সম্পর্কে আরো রিসার্চ করে দেখল আয়াশ। তারেক রহমানের স্ত্রী মারা গেছেন গত বছর, ছেলে আছে একটা। ফোন অফ করলো আয়াশ। চোখ জ্বালা করছে খুব, চশমাটা বোধহয় চিলেকোঠার ঘরটাতেই ফেলে এসেছে। আয়াশের চোখে সমস্যা আছে। দীর্ঘসময় চশমা ছাড়া ফোন, টিভি স্ক্রিন এসবের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না কিন্তু সিদ্ধির সামনে ভুল করেও চশমা পড়ে না সে। সিদ্ধি যদি জানে আয়াশ চশমা পড়ে, তাহলে আয়াশকে খেপাত যেমন করে আয়াশ সিদ্ধিকে ‘চাশমিশ’ ডাকে। সিদ্ধির চোখে সমস্যাটা অনেক ছোট থেকেই তবে আয়াশের এই মেডিকেলে পড়তে এসে। আয়াশের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিদ্ধির ছোটবেলার মুখটা। চিকন ফ্রেমের চশমা পড়া মেয়েটা আজ কত্ত বড় হয়ে গেছে ভাবতেই আয়াশ মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে।

_________________________

সিদ্ধি চিলেকোঠার ঘরটাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শেষরাতের দিকে ঘুম ভাঙতেই সিদ্ধির খেয়াল হলো সে এখানে ঘুমিয়েছে। ঘরজুড়ে অদ্ভুত মিষ্টি একটা ঘ্রাণ যা এখনো আয়াশের উপস্থিতি জানান দেয়। বিছানায় থাকা বালিশটাতে মুখ গুঁজে থাকে সিদ্ধি। একটু পরেই উঠে বালিশটা ছুঁড়ে মারে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? কেন এমন হচ্ছে? আয়াশ থাকতে তো কখনো ওর প্রতি অনুভূতি কাজ করতো না। তাহলে এখন কেন? সিদ্ধির মনও যেন কটাক্ষ করে চলেছে তাকে। ধীরে ধীরে ওঠে বসতেই সিদ্ধির চোখ গেল মেঝেতে পড়ে থাকা চশমায়। এগিয়ে গিয়ে চশমাটা হাতে নিয়ে ভালোভাবে দেখল। এই রকম চশমা তার কোনোকালেই ছিল না। মোটা ফ্রেমের চশমা তার বরাবরই অসহ্য লাগে বলে সে কখনো কিনেনি। তাহলে এই চশমাটা কার? আয়াশের? আয়াশকে তো কখনো চশমা পড়তে দেখেনি সিদ্ধি। চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে আছে সিদ্ধির, বারবার কান্না আসছে তার। লাইট অন করে আশেপাশে লক্ষ করলো। বিছানার এককোণে আয়াশের বইগুলো চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা। আয়াশ বইগুলো রেখে গেছে? কেন? কিছুই মাথায় আসছে না তার। কেবলই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, যে কান্নার শব্দ কারো কানে পৌঁছাবে না। ভোরের মৃদু আলো ঘরের জানালা ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে। ভোরের এ মৃদু আলোটুকুও যেন অসহ্য লাগছে সিদ্ধির। মাথার ভেতর কামরাচ্ছে তার। শব্দহীন কান্নার ঘোরেই আবারো মেঝেতে বসে পড়ে সিদ্ধি।

_______________________

ক্যাম্পাসে আসার পর থেকেই শ্রাবণ শ্রুতিকে খুঁজছে। সারা ক্যাম্পাস খুঁজেও শ্রুতিকে পায় না সে। ঠিক তখনই লক্ষ করলো শ্রুতি আর অয়ন লাইব্রেরিতে বসে আছে। শ্রাবণের হাসিমুখ মুহূর্তের মাঝেই বিবর্ণ হয়ে যায়। অয়ন আর শ্রুতির মাঝে কী এমন গভীর সম্পর্ক যে দুজন যেখানেই থাকে, একসাথে। কোনমতে রাগটাকে দমন করে ইশারায় অয়ন আর শ্রুতিকে বাইরে ডাকলো শ্রাবণ। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বের হলো দুজনে। শ্রুতি চুপ। অয়নই প্রথম মুখ খুলল।

-“কীরে শ্রাবণ বাইরে ডাকলি যে?”

-“আসলে তোদের ইনভাইট করতে আসছিলাম।”

-“বলিস কী! ভাবীর নাম কী!”

-“আরে ধূর শালা! বিয়ের ইনভাইটেশন না, শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি পরশু তাই কাল একটা ছোটখাটো পার্টি দিতে চাই তোদের। তানভীকে আগেই বলেছি, তোদের জানায়ে সিদ্ধিকে জানাবো। ঐ তো ক্যাম্পাসেও আসলো না।”

-“আচ্ছা যাবনি।”

-“কীরে শ্রুতি, তুই কিছু বলছিস না যে।”

শ্রাবণের কথায় মুখ তুলে তাকালো শ্রুতি। পড়ুয়া একটা আভা সারাক্ষণই ফুটে ওঠে মেয়েটার মুখে। নির্জীব চোখজোড়ার মাঝের নির্মলতা শ্রাবণের মনে বর্ষণ সৃষ্টি করে। খুব করে চায় সে এই মেয়েটাকে। মেয়েটা কি আদৌ বুঝবে কখনো নাকি আজীবন কেবল বইপোকা হয়ে অবুঝও থেকে যাবে?

-“আ..আমি বলতে পারছি না শ্রাবণ। কাল আমার এক ফ্যামিলি ফাংশন আছে। সো তোরা এনজয় কর, পরে কখনো গেট টুগেদার হলে আমি থাকবো।”

-“আমি চলে যাচ্ছি শ্রুতি। শেষবারের মতো এই আবদারটা অন্তত রাখ।”

-“এমনভাবে বলছিস যেন একেবারেই ছেড়ে যাচ্ছিস। কলেজ ছাড়ছিস, আমাদের তো না।”

-“দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসা কমে যায় রে, শ্রুতি।”

শ্রুতি চুপ হয়ে যায়। শ্রাবণের সাথে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই তার। “আচ্ছা আমি আসবো” বলেই শ্রুতি মেইন গেটের দিকে এগোয়। বরাবরের মতোই পিছন ফিরে দেখেনা সে। দেখলে হয়তো বুঝতো কতটা আকুল চোখে কেউ একজন তাকিয়ে আছে তার পানে।

________________________

হেল্পারের ডাকে ঘুম ভাঙতেই আয়াশ খেয়াল করে বাসের সবাই নেমে গেছে। পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা খুঁজতে থাকে। নাহ, নেই! পকেটে না ফোন আছে, না টাকা। ঘুমের ঘোরে যে সব চুরি হয়ে গেছে তা বুঝতে সময় লাগলো না আয়াশের। টাকাগুলো নাহয় আবার আসবে কিন্তু ফোনটা দরকার ছিল আয়াশের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়াশ। যা চলে গেছে, তা নিয়ে ভাবার কিছু নেই। সামনে অগ্রসর হতেই হবে। বাস থেকে নেমে গ্রামের রাস্তার দিকে হাঁটা ধরে সে। এ অঞ্চলে রাস্তা প্রচণ্ড খারাপ ছিল, এখন কিছুটা উন্নত হয়েছে দেখে বেজায় খুশি হয় আয়াশ। গ্রামের অভিমুখে পৌঁছাতেই দেখা হয় তূর্যর সাথে। সেই আগের মতোই মুখাবয়ব, ছোট চুল, ভদ্র বেশ। তূর্যকে দেখেই হাসিমুখে ডাক দেয় আয়াশ।

-“তূর্য! কেমন আছিস?”

-“আরে ভবিষ্যৎ ডাক্তার সাহেব যে! এইতো ভালো। তোর কী অবস্থা?”

-“ভালোই আছি। আচ্ছা শোন, খুবই জরুরি কাজে এসেছি। তিন থেকে সাতদিনের মতো থাকবো গ্রামে, এই পুরো সময়টা তোর আমার সাথে থাকতে হবে, তোর কোনো সমস্যা হবে না তো?”

-“অনুমতি চাচ্ছিস? হুকুম করবি তুই, তোর জন্য তো জানও হাজির।”

-“গ্রামের অবস্থা তো প্রায় বদলেই ফেলেছিস রে।”

-“হ্যাঁ রে। একটাই স্বপ্ন, এই গ্রামটাকে যতটা উন্নত করা সম্ভব, করবো। এতদিন বাবা করে গেছেন, এখন চেয়ারম্যানের ছেলে হিসেবে কিছু দায়িত্ব তো আছে আমার।”

-“ডাক্তারি পড়া শেষ হলে গ্রামে একটা ক্লিনিক খুলবো, বাবার ইচ্ছেটা পূরণ করতে হবে তো।”

-“নাফছী আর খালা কেমন আছে?”

-“তারা ভালোই।”

-“আচ্ছা, এখন বল কী কাজ তোর।”

-“আমি এক লোকের ডিটেইলস চাই।”

-“কার?”

-“বাবার মৃত্যুর পর যে লোকটার লাশ জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল, ঐ লোকটার।”

-“রমিজ আলী? ঐ তো এই গ্রামেরই না।”

-“এখানকার না?”

-“নাহ! ওর বাড়ি পাশের গ্রামে। ওকে না চিনলেও দু-চারটে কথা শুনেছি ওর সম্পর্কে। লোকটা আগে এক ডাকাত দলের সাথে কাজ করতো। পরবর্তীতে পুলিশ কেইসে ফেঁসে দু’বছর জেলও খেটেছে। বের হওয়ার পর খুন-খারাবি শুরু করেছিল আবার।”

-“ডাকাত থেকে খুনী! পুলিশ আগে ধরেনি কেন লোকটাকে?”

-“যদিও বলা উচিত না, আমার বড় চাচাকে তো চিনিসই। লোকটা মোটেও সুবিধের না। বড় চাচা নিজের ব্যবসা ক্ষেত্রের শত্রুদের ভয় দেখানোর জন্য রমিজ আলীকে প্রায়ই ভাড়া করতো যার কারণে রমিজ আলীর বিরুদ্ধে কোন কেইস পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই চাচা অফিসারগুলোর ট্রান্সফার করিয়ে দিয়েছেন।”

-“তোর বাবা কিছু বলেনি তোর চাচাকে?”

-“বাবা জানেনা রে এসব। তিনি ছোট থেকেই ভাই বলতে পাগল, কেবল আমিই জানি চাচার কুকীর্তি। দু-চারজন গ্রামবাসীও জানে। বাবার হার্টে সমস্যা ধরে পড়েছে। এ সময় আমি আর বাবাকে কষ্ট দিতে চাইনা।”

-“আচ্ছা বুঝলাম। রমিজ আলীর পরিবারে কে কে আছেন?”

-“এক বউ আর দুটো মেয়ে ছিল। রমিজ আলী মারা যাওয়ার পর ওর বউ বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।”

-“আচ্ছা। ওর বউয়ের সাথেই আগে কথা বলতে হবে।”

-“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ঐ রাতে তোর বাবাকে মারাটাই ঐ লোকের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।”

তূর্যর কথায় আয়াশ ভ্রু কুঁচকায়। এভাবে অবশ্য সে ভাবেনি। তার ধারণা ছিল এসবের পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য সায়ন সাহেবকে গ্রামছাড়া করা কিন্তু তার বাবার সাথে তো কারো কোন শত্রুতা ছিল না। তাহলে তাকে কেউ কেন মারতে চাইবে?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে