#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি
“মেঘে রাঙা এ শহরে, আজই বুঝি শেষ দেখা তোমার সাথে” আনমনে কথাটা ভাবতে ভাবতে আয়াশ এগোচ্ছে সামনের দিকে। আপাতত সে রাতের রহস্য জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে গ্রামে গিয়ে গুণ্ডাটা সম্পর্কে খোঁজ বের করা। আয়াশ গ্রামে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললো। তবে মনের মধ্যে একটাই সংকোচ, পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো কী আগের মতো আছে সবকিছু? কিছুটা হলেও তো গ্রামের পরিবেশ বদলেছে। সুতরাং গ্রামে গেলে পরিচিত কাউকে সাথে নিয়ে রহস্য উদঘাটনে নামতে হবে। গ্রামে খুবই কাছের সম্পর্কের তো কেউ নেই আয়াশের। পরমুহূর্তেই আয়াশের মনে পড়ে তূর্যর কথা। তূর্য আয়াশের ছোটবেলার বন্ধু, মাঝখানে অনেকটা সময় যোগাযোগ নেই তাদের তবে তূর্য গ্রামেই থাকে এখনো। তূর্যর কথা মায়ের মুখে শুনেছিল আয়াশ। ছেলেটা নাকি গ্রামের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তূর্য বরাবরই সহজ-সরল একটা ছেলে। এই প্যাঁচের পৃথিবীতে অমন সহজ-সরল মানুষের মূল্য নেই তেমন। তূর্যকে নিয়ে আগে বড্ড ভয় পেত আয়াশ অথচ এখন ছেলেটা ঠিকই নিজের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে, মানবমঙ্গলের উদ্দেশ্য কাজ করে যাচ্ছে। আয়াশ ঠিক করলো গ্রামে গিয়ে সবার আগে তূর্যর খোঁজ করবে তারপর গুণ্ডাটার। আয়াশের একবার ইচ্ছে হলো সিদ্ধিকে দেখে তারপর যাবে কিন্তু মন কেন যেন সায় দিচ্ছে না। মন বলছে সিদ্ধির সামনে গেলেই সে দুর্বল হয়ে পড়বে। সিদ্ধির চোখের দিকে তাকালেই আর যাওয়া হবে না তার। ভালোবাসার মায়াটাই বুঝি সবচেয়ে বড় বেড়াজাল যা মানুষকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। আয়াশ আর কিছু না ভেবে ভেতরে ঢুকলো। সিদ্ধি তখন ঘরে। সায়ন সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। ছুটির দিনে তার কাজই হলো সারাদিন ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়া। আয়াশের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো। সায়ন সাহেবের সামনে বেশ গম্ভীর মুখে দাঁড়ালো সে।
-“আঙ্কেল আমি চলে যাচ্ছি।”
-“চলে যাচ্ছো মানে? কই চলে যাচ্ছো? আর কেনই বা যাচ্ছো? এই সিদ্ধি আবার তোমাকে উল্টো-পাল্টা কিছু বলেছে, তাই না? আমি এক্ষুনি ওর খবর নিচ্ছি।”
-“আরে আরে আঙ্কেল বসেন একটু…।না বসেন না, আমার সাথে বাইরে আসেন একটু। এখানে কথা বলা যাবে না।”
-“কী এমন কথা? তোমার মা আর নাফছী ঠিক আছে তো?”
-“হ্যাঁ আঙ্কেল, সবাই ঠিক আছে। আপনি আসুন আমার সাথে।”
সায়ন সাহেব দুদিন আগের খবরের কাগজটা ফেলে চশমাটা চোখ থেকে খুলে খবরের কাগজের পাশে রেখে আয়াশের সাথে বাইরে এলেন। আয়াশ আশেপাশের ভালোমতো দেখে নিল।
-“কি হয়েছে আয়াশ? কোনো সমস্যা?”
-“না আঙ্কেল, সমস্যা নেই। আমি আসলে কিছুদিনের জন্য গ্রামে যাচ্ছি। এই কথাটা সিদ্ধিকে জানাবেন না। ওকে বলবেন আমি বাসা ছেড়ে দিয়েছি।”
-“কিন্তু কেন?”
-“আঙ্কেল, আমি দেখতে চাচ্ছি ওর মনে আমার প্রতি বিন্দুমাত্রও অনুভূতি আছে কি না।”
-“কোন সমস্যা হলে?”
-“হবে না আঙ্কেল। নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার সাথে আমি শুধু বই এনেছিলাম, তাছাড়া সব জিনিস তো আপনাদের। বইগুলো আপনি একটু লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করুন। তাহলেই সিদ্ধি কিছু বুঝতে পারবে না।”
-“এসব না করলে হয় না, বাবা? তুমি তো জানোই ওর কিছুই মনে নেই।”
-“জানি বলেই এসব করতে চাচ্ছি আঙ্কেল। আমি যা বলছি, ভেবেচিন্তে। আমি আসছি আঙ্কেল, ওর সাথে দেখা হলে তো আর যেতে ইচ্ছে করবে না। সাবধানে থাকবেন আপনারা।”
সায়ন সাহেব হাসিমুখে আয়াশকে বিদায় দিলেন। আয়াশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধির থেকে দূরে যাওয়ার পথে পা বাড়ালো। সে জানেনা কবে এ রহস্য উদঘাটন করে ফিরতে পারবে সে। সে যে নিঃস্বার্থভাবে এসব কাজ করছে তাও না। আয়াশ জানতে চায় তার বাবার খুনের পেছনে আসলে কার হাত ছিল।
____________________
রাত ন’টা পেরিয়েছে। বাড়ির পরিবেশ একেবারে স্তব্ধ। আয়াশের বাড়ি থেকে আসার পর আর ঘর থেকে বেরোয়নি সিদ্ধি। ট্যাক্সিচালক লোকটার কথা শুনে মনটা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ঘর থেকে বের হয়েই সিদ্ধি আশেপাশে আয়াশকে খুঁজতে লাগল। আয়াশকে সে কেন খুঁজছে এ প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছেও নেই। আয়াশকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে উঠলো সিদ্ধি। চিলেকোঠার ঘরটাতে তালা দেখেই বুক কেঁপে ওঠে সিদ্ধির। তার মানে এখনো আয়াশ ঘরে আসেনি? তারা এসেছে ঘণ্টা পাঁচেক তো হচ্ছেই, এতক্ষণ কোথায় থাকতে পারে আয়াশ? ওর তো এ শহরে কোন বন্ধু আছে মনেও হয় না। হঠাৎ সিদ্ধির মনে পড়ে আয়াশের সেই বান্ধবীর কথা যে তাকে ড্রপ করেছিল। “আয়াশ এত রাতে ঐ মেয়েটার বাড়িতে গেছে? ছিঃ!” কথাটা ভাবতেই রাগে গা জ্বলছে সিদ্ধির। “নাহ! এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। যখন ইচ্ছে আসবে, যখন ইচ্ছে যাবে। নিজের বাড়ি পেয়েছে নাকি? বাবাকে বলে একটা ব্যবস্থা করতেই হচ্ছে দেখছি।” বিড়বিড় করতে করতে নিচে নামে সিদ্ধি। সায়ন সাহেবের ঘরের দরজায় এসে দেখে তিনি কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। দরজায় নক করতেই চমকে ওঠে ফোন পকেটে ঢুকান সায়ন সাহেব। সিদ্ধির দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন।
-“কিছু হয়েছে বাবা?”
-“না তো মা, কি আর হবে! তুই কিছু বলবি?”
-“হ্যাঁ বাবা। আসলে জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম আয়াশ কোথায়। আমার সাথেই এসেছিল, তারপর থেকে আর দেখছি না যে।”
-“ও তো চিলেকোঠার ঘরটা ছেড়ে দিয়েছে। ওর কিছু বই ছিল, নিয়ে চলে গেছে।”
-“চলে গেছে মানে?”
-“চলে গেছে মানে চলে গেছে।”
সায়ন সাহেব হেসে উঠলেন। সিদ্ধির মুখে মোটেও হাসি দেখা গেল না বরং তাকে দেখে মনে হলো বিবর্ণ। সিদ্ধির মুখের সমস্ত রঙ যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। বাবাকে আর কোন প্রশ্ন করলো না সিদ্ধি। কানের মধ্যে শুধু একটা কথাই বারবার বাজছে,”আয়াশ চলে গেছে।” চিলেকোঠায় ঘরটা অবশেষে ফাঁকা হলো, শর্তেও জিতে গেল সিদ্ধি। আর কোনদিন আয়াশ ওকে নিজের মুখ দেখাবে না। সিদ্ধির তো খুশি হওয়ার কথা, আসলেই কি সে খুশি হতে পারছে? একটা মানুষ, যার সাথে ঝগড়া না করে তার শান্তি হত না, যাকে অন্য একজনের সাথে দেখলে তার গা জ্বলতো, আজ সেই মানুষটা চলে গেল? “ধূর সিদ্ধি! ঐ গেছে, ভালো হইছে। এবার চিলেকোঠার ঘরটা আবার তোর। ঐ ছেলের কথা মনে করার কোন মানেই হয় না।” মুখে মুখে কথাটা মনের খবর কি রাখতে পেরেছে সিদ্ধি?
_______________________
-“শুনলাম তুই নাকি কলেজ ছেড়ে দিচ্ছিস?”
-“হ্যাঁ রে শ্রুতি।”
-“কারণ কী?”
-“আসলে বাবা খুব প্রেশার দিচ্ছে যেন বাবার কাছে গিয়ে থাকি।”
-“মানে রাজশাহীতে?”
-“হ্যাঁ। ওখানেই একটা কলেজে এডমিশন নিবো।”
-“বছরের মাঝামাঝি সময়ে? অবশ্য তোর বাবার তো আর টাকার অভাব নেই, নিতেই পারিস। যাই হোক, ভালো থাকবি আর যোগাযোগ রাখিস।”
শ্রুতি কথা শেষ করে চলে যায়। শ্রাবণের চোখ নোনা জলে ভরে এসেছে, ভাগ্যিস শ্রুতি পেছন ফিরে তাকায়নি নয়তো শ্রাবণ কী করে লুকোতো নিজের চোখের জল? অবশ্য যাদের পিছুটান থাকেনা, তারা পিছু ফিরে দেখেও না। শ্রাবণ ভেবেছিল শ্রুতি যদি তার দূরে যাওয়ার কথা শোনে তাহলে হয়তো আটকাবে তাকে। তার ভাবনাটা আজীবন ভুল ছিল আর ভুলই থাকবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টি.সি পেপারটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নয় শ্রাবণ। যদি হারাতেই হয়, তবে শ্রুতিকে মনের কথা জানিয়ে তবেই হারাবে।
ভালোবাসার অনুভূতিটাই এমন! যে যন্ত্রণা আমি পাচ্ছি, সে যন্ত্রণা বিপরীতজনকে না দেওয়া অবধি স্বস্তি নেই। সম্পর্ক যতটা গভীর হতে থাকে, এ যন্ত্রণার মাত্রা বাড়তে থাকে। শ্রাবণ যদি ঝুঁকি নিয়ে শ্রুতিকে মনের কথা বলতে পারে, এর প্রেক্ষিতে যা-ই হোক না কেন, তা প্রভাব ফেলবে শ্রাবণ আর শ্রুতির বন্ধুত্বে। ভালোবাসার এই খেলায় হয় শ্রাবণ ভালোবাসা পাবে, নয়তো বন্ধুত্বটাও হারিয়ে ফেলবে।
_________________________
অন্ধকার ঘর। টেবিলের এককোণে বই-খাতার স্তুপ। বিছানা অগোছালো, জানালার পর্দা টেনে দেওয়া। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাঁচতে শিখেছিল নাকি মানুষটা? জানালা খুলে দিল সিদ্ধি। ঐ তো চাঁদের আলো এসে ঘরের কোণে জ্বলজ্বল করছে! এ আলোর মায়ায় পড়তে বুঝি ইচ্ছে করেনি ছেলেটার? নাকি মায়া থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে সে? সিদ্ধি যত চেষ্টা করছে আয়াশের কথা মাথা থেকে বের করার, ততটাই বেশি আয়াশের কথা তার মাথায় আসছে। মানবমনের রঙঢঙ- সে কী আর বোধগম্য হয়? যখন যা ভাবতে চাই না, তা-ই যে বারে বারে মনের আঙিনায় দোলা দেয়। ঠোঁটের হাসি হারিয়েছে সিদ্ধির, হারিয়েছে এক অপরিচিত তবে চিরপরিচিত যুবকের জন্যে।
চলবে…