#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
তৃতীয়_পর্ব
~মিহি
-“আমাকে ঐখান থেকে ডেকে আনার মানে কী? আপনি কি বুঝতে পারছেন যে ওরা আমাদের গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড ভাবছে?”
-“ভাবলে ক্ষতি কি মিস.চাশমিশ?”
-“আপনার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আপনার সাহস কী করে হয় আমার সাথে পাবলিক প্লেসে ফাজলামি করার।”
-“এখানে বিশ মিটার দূরত্বেও কেউ নেই, পাবলিক প্লেস তো দূরের কথা। আসলে বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ভাবলাম আপনার সাথে একটু ঘুরে আসি কোথাও থেকে।”
সিদ্ধির ইচ্ছে করছিল রাগের মাথায় আয়াশকে দু-চারটে কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু সিদ্ধি তা করলো না। সে চেষ্টা করছে আয়াশকে ঠাণ্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে। সিদ্ধি মুচকি হেসে বললো,”আগামী এক ঘণ্টা এই রোদের মধ্যে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন, বসবেনও না। থাকতে পারলে আপনার সাথে ঘুরতে যাবো।” আয়াশ মাথা নেড়ে সায় দিল।
আয়াশকে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে সিদ্ধি নিজের বন্ধুদের কাছে ফেরত এলো। ততক্ষণে রোদের তাপে সবাই ক্যান্টিনে এসে বসেছে। সিদ্ধিকে আসতে দেখেই সবাই চা অর্ডার করে হাত-পা ছেড়ে বসলো। তানভী কিছুটা গোয়েন্দা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্ধির দিকে। সিদ্ধি বসতেই সে ঝটপট প্রশ্ন করে ফেলে,
-“কীরে! ছেলেটা কে? মনে হইতেছে বহুত ভাব তোর লগে। তলে তলে টেম্পু চালাচ্ছো মামা আর আমরা বললেই হরতাল?”
-“জুতা চিনিস তুই? বাটার জুতা দিয়ে পিটাবো তোকে।”
-“আগে বল ঐ ছেলে তোর বয়ফ্রেন্ড কিনা!”
-“ধুর! ঐ আমার বয়ফ্রেন্ড হতে যাবে কেন? আর তাছাড়া ঐ আমাদের বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া।”
-“বলিস কী! ছেলে কী করে রে?”
-“তোর অতো ওকালতি কিসের? চা আসছে, খা চুপচাপ।”
সবাই চুপচাপ চা খেতে থাকলেও সিদ্ধির মনে চলছে অন্যকিছু। সে বুঝতে চাইছে আদৌ কি আয়াশ একঘণ্টা এই ভরদুপুরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। আর যদি থাকেই তাহলে সিদ্ধিকে আয়াশের সাথে ঘুরতে যেতে হবে। ঘুরতে যাওয়াটা ব্যপার নাহ। ঘোরার বাহানায় আয়াশকে আরেকবার ঝামেলায় ফেলতে পারলে সে খুশিই হবে। চা শেষ করে সবাই নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আচমকা ক্যান্টিনে মোটামুটি হৈচৈ পড়ে গেল একটা ছেলে বাইরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কার যেন স্কেচ করছে। প্রথমত ছেলেটা সুদর্শন হওয়ায় মেয়েদের মাঝে কথাটা ছড়াতে সময় লাগেনি। সিদ্ধির কেন যেন মনে হচ্ছিল ছেলেটা আয়াশই। ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে বাইরে আসতেই বুঝতে পারলো সে যা ভেবেছিল তাই। সিদ্ধিদের এক ক্লাসমেট ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে আছে বোধহয় সে-ই এনেছিল এটা। আয়াশ একমনে স্কেচ করে যাচ্ছে। স্কেচের কাজ যত এগোচ্ছে, সিদ্ধির মনের ভয় তত বাড়ছে। কোন এক অজানা কারণে বারবার হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ছে। আয়াশের থেকে ধ্যান সরাতে তানভী আর শ্রুতির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো সিদ্ধি কিন্তু দুইজনই গভীর মনোযোগ দিয়ে আয়াশের করা স্কেচটা দেখছে। মন-মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল সিদ্ধির। তানভীকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো,”এই তোরা আমার বান্ধবী নাকি ওর? কখন থেকে ডাকছি তোদের, জবাব দিসনা ক্যান? চল তো কলেজের ছাদে উঠবো একটু।” তানভী কোনোরকম ইশারায় বললো,”তুই যা।” ব্যস ঐটুকুই! তানভীর মনোযোগ আয়াশের স্কেচটার দিকে। হওয়াটাই স্বাভাবিক কেননা আয়াশ যে স্কেচটা করছে তা যে সিদ্ধির তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই সিদ্ধির বন্ধুদের। ওরা শুধু স্কেচটা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে যেন সিদ্ধিকে জেরা করতে পারে যে ছেলেটা ওর স্কেচ কেন করলো?
______________________
-“দেখো তাহমিদ, জোর করো না আমায়। আমার নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে। তোমায় আমি আর কতবার বোঝাবো যে সিদ্ধির সাথে তোমার বিয়েটা হওয়া সম্ভব নয়?”
-“আমি বুঝবো না আঙ্কেল, আপনি যতই বুঝান না কেন। আমি আপনার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডের ছেলে। বিপদে আমার বাবা আপনাকে এত সাহায্য করেছেন, তার এই সামান্য প্রতিদান আপনি দিতে পারছেন না?”
-“তুমি টাকার বদলে আমার মেয়েকে চাচ্ছো? সাহস তো কম না তোমার।”
-“না আঙ্কেল, ভুল বুঝছেন আপনি। আমি সিদ্ধিকে ভালোবাসি।”
-“ও বাসে না।”
-“আমি ওর সাথে কিছুটা সময় কাটালেই ও আমায় ভালোবেসে ফেলবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
-“দেখো তাহমিদ, বোঝার চেষ্টা করো। সিদ্ধির বিয়ে ছোটবেলাতেই হয়ে গেছে।”
-“ঐটা কোন বিয়ে ছিল না আঙ্কেল, ঐটা একটা পুতুলখেলা ছিল যা আপনারা সিদ্ধির সাথে খেলেছেন।”
-“আমি আসছি।”
সায়ন সাহেব আর দাঁড়ালেন না। ভেবেছিলেন বন্ধুর অফিসে চাকরি করলে বন্ধুর সাথে সময়ও কাটানো যাবে, ব্যস্ততার খাতিরে মৃত স্ত্রীর স্মৃতিগুলিও আর তাড়া করে বেড়াবে না কিন্তু বোধহয় সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। বন্ধুর চাকরি করতে গিয়ে তিনি নিজের মেয়ের জীবনটা নষ্টের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাহমিদ ছেলে হিসেবে খারাপ না কিন্তু আয়াশের চেয়ে যোগ্য কেউ নয় সিদ্ধির জন্যে কিন্তু তাহমিদকে আয়াশের কথা বললে সে আরো উগ্র হয়ে উঠবে, আয়াশের ক্ষতি করে হলেও সিদ্ধিকে পাওয়ার জন্য মাতোয়ারা হয়ে উঠবে।
_____________________
-“স্কেচ কেমন লাগলো বললেন না তো মিস.চাশমিশ।”
-“ফালতু! আপনার এই কীর্তিকলাপের জন্য এখন সারা কলেজে রটে যাবে আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড আর আমি কিনা এখন আপনার সাথে বসে চা খাচ্ছি। বাহ!”
-“আমার কি দোষ? আপনি বেট হারছেন, ঘুরতে তো হবেই এখন। পরের বেটটাও হারবেন, তারপর কফিও খাবেন আমার সাথে।”
-“জীবনেও না! কফি খাওয়ার জিনিস হলো? আপনিই খান আপনার কফি।”
রাগে গা জ্বলছে সিদ্ধির। কেন যে এই ছেলেকে শর্ত দিতে গেছিল! এখন এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে হচ্ছে তাও এই ছেলের সাথে। চায়ে সমস্যা নেই কিন্তু খেতে হচ্ছে আয়াশের সাথে, এটাই সমস্যা।
দুপুরবেলা আকাশ রোদে ঝকমক করছিল অথচ এখন মেঘে ঢেকে আসছে। ভ্যাপসা গরমের পর বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস এই ঘন কালো মেঘ। সিদ্ধির অবশ্য ভালোই লাগছে ঘুরে বেড়াতে। অনেকদিন হলো ঠিকমতো বাড়ি থেকে বেরই হয়নি সে। আয়াশের সঙ্গ এখন আর মোটেও বিরক্ত লাগছেনা তার বরং ভালোই লাগছে। অদ্ভুত রকমের সে ভালোলাগা, চিরতরে ঠায় নেয়না মনে আবার চিরতরে দূরেও ঠেলে দিতে পারেনা।
আয়াশ সামনে হাঁটছে, সিদ্ধি পিছনে। রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। কিছুটা শুনশানও বলা চলে। আচমকা ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। আয়াশ চটজলদি একটা ছাউনির নিচে দাঁড়ালো। সিদ্ধিকে ডাকলো কিন্তু সে এলো না। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা স্পর্শে ব্যস্ত সিদ্ধি। আয়াশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো সেই বাচ্চা মেয়েটাকে। তার পিচ্চিটা এখনো যে আগের মতোই রয়ে গেছে। অন্যমনস্ক হয়ে সিদ্ধিকে দেখতে দেখতে আচমকা আয়াশের মনে পড়ে এই তীব্র বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হওয়া শতভাগ নিশ্চিত। অনেকটা টেনে-হিঁচড়েই ছাউনির নিচে নিয়ে আসলো সিদ্ধিকে।
-“আজব! গরুর মতো টানছেন কেন আমায়?”
-“গরুর মতো কাজ করলে টানবো না কী করবো? ভিজছেন তো শ্রদ্ধা কাপুরের মতো, জ্বর এলে কোন টাইগার শ্রফ বা অর্জুন কাপুর আসে দেখবোনি।”
-“আপনি একটা….”
-“ভালো মানুষ।”
-“নাহ! আপনি একটা বলদ।”
সিদ্ধির কথা শুনে বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে তাকালো আয়াশ। আয়াশের তাকানো দেখে হো হো করে হাসতে লাগলো সিদ্ধি। এত বছর পর এই প্রথম আয়াশ সিদ্ধিকে মন খুলে হাসতে দেখলো। মেয়েটার সাথে সচরাচর যখনই কথা হয়, মেয়েটা হয় রেগে থাকে নয়তো রাগ করার পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকে অথচ আজ মেয়েটার মাঝে বিন্দুমাত্র রাগ নেই। সমস্ত রাগ-বিষাদ যেন বৃষ্টির ফোঁটায় বিলীন করে নবরূপের আচ্ছাদনে আবৃত এক সিদ্ধিকে দেখছে সে। সিদ্ধির হাসির মুগ্ধতায় ঘোরলাগা দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে আছে সে। আচমকা সিদ্ধি আয়াশের চোখের সামনে তুড়ি বাজায়।
-“কী মি.? বৃষ্টি তো থামলো, যেতে হবে না?”
-“আপনার জামার যে অবস্থা, ডোন্ট মাইন্ড কিন্তু রাস্তায় এভাবে না ভিজলে হতো না?”
আয়াশের কথা শুনে সিদ্ধি ভ্রু কুঁচকায়। অতঃপর ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে গায়ে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে নেয়। সিদ্ধির কাণ্ডে হা করে তাকিয়ে আছে আয়াশ।
-“আমার কাছে সবসময় ব্যাকআপ প্ল্যান থাকেই।”
-“এই গরমে চাদর কে রাখে ব্যাগে?”
-“আমি রাখি। কোন সমস্যা?”
আয়াশ মাথা নাড়িয়ে না ইঙ্গিত করে। পরক্ষণেই মনে মনে গালি দেয় সিদ্ধিকে,”তারছিড়া মেয়ে! চাদর রাখছে ব্যাগে! ক্যান ভাই, আমি শার্ট দিতাম, সেটা গায়ে জড়াতি। আহা! কি সুন্দর রোমান্টিক সিন হইত, তা না উনি চাদর গায়ে দিলেন। কেন রাখা লাগবে চাদর? ওহ না! রাখা লাগবে, আমি না থাকতে যদি বৃষ্টিতে ভেজে কিন্তু আমি থাকতে ক্যান?” নিজের কথার জালে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খায় আয়াশ। সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল দুজনের কিন্তু তাদের জীবনে আসতে চলেছে এক অনাকাঙিক্ষত ঝড় যার পূর্বাভাস অবধি নেই তাদের।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]