#চিরেকুটের শব্দ (পর্ব ৬)
#মেহেদী হাসান রিয়াদ
অর্থি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। স্বামীর অধিকার ফলাতে তার যোগ্যতার প্রয়োজন হয়না আর সে স্ত্রী হয়েও একটু ভালোবাসা চাইলে তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। অর্ণবের এই কয়েকদিনের আাচার ব্যাবহারে মনে হয়েছিলো প্রথম দিনের তুলনায় অনেকটা বদলে গেছে অর্ণব।
বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে একটা দির্ঘশ্বাস নিলো অর্থি। তার চোখ বেয়ে আবারও নোনা জল বেড়িয়ে আসে।
রাতের খাবার আর খাওয়া হয়নি। চুপচাপ শুয়ে আছে। তার ভাগ্য আর দুর্ভাগ্যর মাজে পার্থক্য খুজে বেড়াচ্ছে। ঘুরে ফিরে উত্তরটা একই জায়গায় এসে থামে। সে কথা বলতে পারেনা এটাই তার অপরাধ। কিন্তু সবাই এটা কেন বুঝতে চায় না যে, এর পেছনে তো তার কোনো হাত নেই। পুরোটাই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে।
এই একটা কারনেই সারা জীবন মানুষের মুখে এটা ওটা শুনে এখন বিয়ের পরও স্বামীর কাছে অপমানিত হচ্ছে।
মেসেন্জারে একটা মেসেজের শব্দ আসতেই চোখ মুছে। ফোন টা হাতে তুলে নিলো সে। দেখে একটা এক্সিডেন্টের পিক। ছেলেটার সারা শরির রক্তে ভিজে একাকার। আর একটু দুড়েই তার বাইকটা পরে আছে।
হুট করে ইসরাত এটা কার পিক পাঠালো বুঝতে পারছে না অর্থি। কারণ ছেলেটা উপর হয়ে পড়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
অর্থি একটা মেসেজ দিলো,
– ছেলেটা কে?
ওপাশ থেকে রিপ্লে,
– প্রান্ত ভাই,,,
মুহুর্তেই একটা অজানা কারণে বুকের ভেতরটা ছেৎ করে উঠে। প্রান্তর জন্য তো তার এমন অনুভুতি হওয়ার কথা না। তবুও কেন এমন লাগছে সেটা তারও অজানা।
এইতো কয়েক মাস আগের কথা,
অর্থি যখন স্কুল লাইফ শেষ করে কলেজে ভর্তি হবে তখন ফ্যামিলির ঘোর বিরোধিতা। এমন মেয়েকে বেশি পড়িয়ে লাভ কি? কিন্তু অর্থি চায় সে পড়বে। সব শেষে অর্থির ভাইয়া তাকে নিয়ে ভর্তি করায় কলেজে। সেদিন টা অর্থির কাছে খুব আনন্দের একটা দিন ছিলো। এর পর শুরু হয় তার কলেজ লাইফ। বাড়ি থেকে বেশি দুড়ে ছিলো না কলেজ। তাই পায়ে হেটেই যেত। গাড়ি করে গিয়ে বাড়তি খরচ বাড়াতে চাইতোনা সে। কারণ তাকে এমনিতেই ফ্যামিলি বোঝা মনে করে।
কয়েকমাস কাটতেই খেয়াল করে প্রতিদিন কে যেন তার জন্য রাস্তায় একটা চিরেকুট আর একটা গোলাপ রেখে যায়। কিন্তু আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেতো না সে।
ধিরে ধিরে ব্যাপারটা অর্থির কাছেও ভালো লাগতে শুরু করে। ১৭ বছর বয়সি আবেগি মন। এভাবে প্রায় অনেক মাস প্রতিদিন তার জন্য এভাবে চিরেকুট আর ফুল রেখে যেত। চিরেকুটের শব্দে প্রকাশ পেত তাকে নিয়ে লেখা হাজারও অনুভুতি। কিন্তু অর্থি কিছু বলতো না। কারণ সে জানে তার সমস্যার কথা ছেলেটা জানলে কখনোই তাকে এতো ভালোবাসবে না।
অনেক মাস পর চিটির উত্তর দেয় অর্থি।
– আপনি কে তা আমি জানিনা। তবে আপনাকে আমার কিছু বলার আছে। আপনি হয়তো জানেন না যে, আমার মাঝে একটা বড় সমস্যা আছে। আর তা হলো, আমি কথা বলতে পারি না। এখন আপনিই বলুন আমার মতো একটা মেয়েকে ভালোবেসে আপনার লাভ কি হবে। যার মুখ থেকে আপনি কখনোই ভালোবাসি শব্দটা শুনতে পাবেন না।
সেদিন কাগজটা রেখে সেখান থেকে চলে গেলো অর্থি। ভেবেছিলো আজ থেকে আর কোনো চিরেকুট আর ফুল রাস্তায় কেউ তার জন্য রেখে যাবে না।
কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমান করে পরদিন আবারও একই ভাবে চিরেকুট আর ফুল পেলো সে।
– যাকে আমি ভালোবাসি, তার ব্যাপারে সব জেনেই আমি ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা টা এতোটা সস্তা নয় যে দিক দেখে কমে যাবে। আর মুখ ফুটে কখনো ভালোবাসি বলতে হবে না। চিরেকুটের শব্দে বললেই আমি অমৃতের স্বাধ গ্রহন করে নিব।
কিন্তু তবুও কোনো উত্তর দিতে পারেনি অর্থি। ফ্যামিলির ভয়ে। এর পর আর উত্তরটা কখনো দেওয়া হয়নি। অর্থির বিয়ে ঠিক হয়ে যায় অর্ণবের সাথে। অর্থি ছোট্ট করে একটা শব্দ লিখে রাস্তায় রেখে আসে, ‘সরি’।
বিয়ের দুই দিন আগে সরাসরি তার সামনে এসে দাড়ায় প্রান্ত। একটা চুরেকুট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে চলে গেলো সেখান থেকে।
চিরেকুট টা খুলে দেখলো অর্থি।
‘দোয়া করি সারা জীবন সুখে থাকো। আর যদিও কখনো তোমার সুখের জীবনে দুখের দিন নেমে আসে। ওইদিন স্বরণ করো আমায়। সব সময় আমাকে তোমার পাশে পাবে।’
কিন্তু আজ প্রান্তর এক্সিডেন্টে তার এতো খারাপ লাগছে কেন? প্রান্ত তো তার কেউ না।
অর্ণব তখনই বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো এখনো ফিরে আসার খবর নেই। না জানে কোথায় গেছে। যতই খারাপ হোক স্বামীর জন্য মায়া তো হবেই।
,
,
আজ ভাইয়ার সাথে অনেক দিন পর নিজের বারিতে এলো অর্থি। বাবা-মা কে দেখে আজ যেন মনটা আনন্দে ভরে গেল।
ভাবিকে দেখলো রান্না ঘরে রান্না করতে ব্যস্ত। অর্থির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সব কাজ একা একা করতে হয়। অর্ণি তো রান্না ঘরের কাছেও আসেনা। অথচ বিয়ের আগে অর্থিকে দিয়েই সব করাতো।
বাবার বাড়িতে তিন দিন থাকার অনুমতি আছে। অর্ণিকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো অর্থি। প্রান্তকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার। এখনো নাকি জ্ঞান ফিরেনি। ইসরাতের কাছ থেকে ঠিকানা নিলো রাতে।
এখন অর্ণিকে নিয়ে রওনা দিলো সে। দুর থেকে একটু দেখেই চলে আসবে।
গরমে শরির ঘেমে একাকার। একটা রিক্সা নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো অর্থি। রাস্তায় জেম থাকায় গরম টা একটু বেশিই লাগছে আজ।
হসপিটালে পৌছে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে গেলো তারা।
প্রান্তর হাত পা বেন্ডেজ করা। অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে বেডে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। গ্লাসে এক হাত রেখে প্রান্তর দিকে চেয়ে আছে অর্থি। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ওখান থেকে বের হয়ে গেলো সে।
অর্ণি বললো,
– প্রান্ত ভাইকে চিনো আপু?
অর্ণির কথায় চুপচাপ মাথা নাড়ালো অর্থি। যার অর্থ সে চিনে।
অর্থি চাপচাপ একটা রিক্সায় অর্ণিকে নিয়ে উঠে গেল।
কেন জানি আজ পূর্বের স্মৃতি খুব মনে পরছে। প্রান্তর চিঠি গুলো বারংবার চোখের সামনে ভেষে উঠছে। তার দেওয়া শেষ চিরেকুট টা আজ তার দুই কান জুড়ে বাজছে।
‘দোয়া করি সারা জীবন সুখে থাকো। আর যদিও কখনো তোমার সুখের জীবনে দুখের দিন নেমে আসে। ওইদিন স্বরণ করো আমায়। সব সময় আমাকে তোমার পাশে পাবে।’
কিন্তু অর্থির সব কষ্ট একটা দির্ঘশ্বাসের মাঝে উড়িয়ে দিলো। প্রান্ত এখন মাত্রই পর পুরুষ। তাকে নিয়ে ভাবলেও এখন পাপ হবে।
বাড়িতে এসে শাওয়ার নিয়ে বের হলো সে। মাথার উপরে ফ্যান টা ছেরে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সে। মা এসে খাওয়ার জন্য ডাকলো। তবে অর্থির বিয়ের আগে মায়ের কন্ঠস্বর আর এখন কন্ঠস্বরে বেশ পার্থক্য বোঝা যায়। এখন আর আগের মতো ঝাঝালো কন্ঠে কথা বলে না তার সাথে।
ফোনে মেসেজের শব্দে ফোন টা হাতে তুলে নেয় অর্থি। অর্ণবের মেসেজ দেখতেই, লাফ দিয়ে উঠে বসে। অর্ণব তাকে নিজে মেসেজ করেছে?
সিন করে মেসেজটা পড়লো সে,
‘নিজেকে সব সময় ভালো প্রমান করতে চাইলেও আমি আগে থেকেই জানতাম তোমার ক্যারেক্টারে প্রব্লেম আছে। না হলে বিয়ের পরেও বাবার বাড়ির নাম করে প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যেতে না।’
অর্থি নিরাশ হলো মেসেজ পড়ে। অর্ণবের চিন্তা ধারা কতোই উন্নত।
To be continue…..