#চিরসখা (১১)
প্রেমিকার দেয়া শর্ত অনুযায়ী স্ত্রীকে ডিভোর্সের বিষয়টা ভুলতে পারছে না হিরক। মেধা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে চলে গেছে। কফিশপের বিল মিটিয়ে বাইরে বসে অনেকটা সময় ধরে সিগার টানে। সইকে তালাক দেবার কথা একবারো মাথায় আসেনি। দুটো সম্পর্ক প্যারালালি চললে ক্ষতি কি। মেধা ওর সংসারে থাকবে। হিরক সইয়ের সাথে। দু’জনের দেখা হওয়া, কথা বলা, কাছাকাছি আসায় সংসার নষ্ট করার প্রয়োজন পরে না। ব্যালেন্সের নীতিতে দুনিয়া চলে। মেধা এতদূর ভাবছে, হিরকের আন্দাজে ছিলো না। শারিরীক প্রয়োজন মিটিয়ে নিতে গেলে এখন নিরাপদ জায়গা লাগে। যে মেয়েটার সাথে শুয়ে বসে থাকবে, তাকে পালতে হয়। মেধা সেদিক থেকে নিরাপদ। মেধার পেছনে হিরকের খুব বেশী খরচ আগে ও ছিলো না। এখন মেধা বিবাহিত। বড়লোক স্বামীর পয়সা মেধা খরচ করে৷ হিরকের ওপর চাপ আসবে না। মেধা ও চাকুরীজীবি মেয়ে। সব ঘোট পাকিয়ে যাচ্ছে। হিরক বাহির থেকে খেয়ে বাড়ি ফেরে। সই বেশ গোছানো মা। বাবুকে খাইয়ে দাইয়ে শুয়ে পরেছে। হিরক সইকে জাগালো না। ফ্রিজ থেকে পুডিং বের করে খেতে বসলো। সই দরজায় দাঁড়িয়ে হিরকের খাওয়া দেখছে। তার আজকে প্রথম হোম ডেলিভারির খাবার ছয় জায়গায় গেলো। পেমেন্ট পেয়েছে পনরো হাজার টাকা। এত গুলো টাকা সই কি করবে, কোথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। কাজটা হিরককে লুকিয়ে শুরু করেছে৷ বাঁধা কাস্টমার পেলে জানাবে। আগামীকাল কিছু অর্ডার ওকে পৌছাতে হবে। ডেলিভারী কম্পানী লোক পাঠাতে পারবে না।
–ঘুমাওনি।
–তোমার জন্য জেগে আছি।
–আমি পরে ঘুমাবো। আম্মা কবে যাবে।
–জানি না। উনি থাকুক। আমার ভালো সময় কাটে।
–আম্মাকে দেখতে আসার নাম করে কত লোকের আনাগোনা হয়, হিসাব রেখো। সবাইকে চা-নাস্তা দিলে ও খরচ হয়। আমি একা মানুষ রোজগার করি। তাছাড়া, অল্প টাকায় সংসার চালাতে শেখো। নয়ত, সমস্যায় পরবে।
–তুমি এমন ভাবে কথা বলো, মনে হয় আমি আর তুমি আলাদা৷
–সই, আমি বাসায় অনিয়মিত ভাবে ফিরলে তোমার কষ্ট হবে?
সই কি বলবে বুঝতে পারে না। হিরক কেমন সুরে কথা বলছে৷
–কষ্ট হবে না কেনো।
–একা থাকতে পারবে? তুমি খুব সংসারী মেয়ে সই।
–বিয়ে হলে সব মেয়ে সংসারী।
–সবাই না।
–তুমি কত জন মেয়ে দেখেছো বলো তো।
হিরক অন্যমনস্ক হয়ে টেবিলে খুটছে। সই খেয়াল করে, স্বামীর হাত কাঁপছে। হিরকের ঘাড়ে হাত রাখে সই।
–চলো শুবে।
–তুমি যাও। শোন, বাবু আমাকে খুঁজে ছিলো?
–তোমার জন্য কেঁদে ঘুমিয়েছে। হিরক কিছু বলতে চেয়ে পারলো না। ওর মনে অন্য হিসেব চলছে। সইকে আলাদা বাসায় রেখে মেধাকে এখানে আনা যায়। বলবে সই বাড়ি গেছে। তাই বাসা ফাঁকা। আম্মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে ঝামেলা শেষ।
–হঠাৎ একা থাকার কথা বললে।
হিরক অস্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়ে। –না, এমনি৷ এই বাসার খরচ অনেক৷ একটা ছোট বাসা নিলে কেমন হয়।
সই হিসাব করে, তিন রুমের বাসা। এক রুমে ওরা, অন্য রুমে হিরকের মা। খাবার ঘর বসার ঘর মিলে একটা রুম, সাথে রান্নাঘর, বারান্দা। এরচে’ ছোট বাসা হয় নাকি। হিরক কি ওকে নিয়ে সুখী হতে পারছে না। সইয়ের ভালোবাসায় কোথায় ঘাটতি হলো। হিরক হাঁপিয়ে ওঠে। সইয়ের সাথে কথা কাটাকাটি করতে চাচ্ছে না। আম্মা জেগে উঠলে ঝামেলা পাকাবে। তবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ শরীরের চাহিদা উপেক্ষা করলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। মেধার মোহ সে কাটাতে পারবে না।
সকালে হিরককে বিদায় দিয়ে সই রান্নার জোগাড় করে। হিরকের আম্মা রান্নাঘরে আসা যাওয়া করছেন। গতকাল সই তাকে খাবার ব্যবসার কথা বলেছে। ছেলের সংসারে বউ বাড়তি দু’পয়সা রোজগারের ব্যবস্থা করলে ছেলের লাভ৷ হিরকের আম্মা সইকে কাজে সাহায্য করেন। তার ঝুঁকে কাটাবাছা করতে অসুবিধা। বাবুকে কাছে রেখে দেখভাল করে শান্ত রাখেন। সই বাক্সে খাবার ভরতে ভরতে চিন্তা করে, কোথাও ঘুরতে গেলে হিরকের ভালো লাগবে। একটানা অফিস, বাবুর অসুখে ওর উপর চাপ পরেছে। পুরুষ মানুষ ঝাড়া হাত পা থাকতে পছন্দ করে। বাবুর অসুখের সময় অনেক খরচ হলো। হিরকের জমানো টাকায় হাত পরেছে। সে কারনে, মেজাজ খারাপ থাকতে পারে। সই ডেলিভারির জন্য বেরোয়। যেতে যেতে সই শুধু হিরকের কথা ভাবে। সকালে হিরক কাছে টেনেছে। শরীরের ব্যাথা নিয়ে সই সাড়া দিলো। হিরক প্রটেকশন ব্যবহার করেনি। হিরকের অফিসের জন্য আলাদা করে খাবার দিলো। হিরক কিছু গুছায় না। সই সব কাপড় চোপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করে আলাদা ড্রয়ারে ভাঁজ করে রাখে। কাজের হুড়োহুড়িতে নাস্তা খাওয়া হয়নি সইয়ের। রাস্তার পাশে দোকান থেকে কলা -বিস্কিট খায়। ফার্মাসী থেকে পিউলি কিনে খায়। এখন কোন ভুল করা যাবে না। যতটা সম্ভব কৃচ্ছতা সাধন করে সই হিরককের মুখে হাসি ফোঁটাবে। মেসের এক রুমের সংসার থেকে এখানে এনে স্বামী ভালো রেখেছে। রিকশার পা -দানীতে খাবারের বক্স গুলো চেপে রেখে আগায় সই।আজকাল সিনজির ভাড়া বেড়েছে, নিলে অযথা খরচ বাড়ে।
লাঞ্চ আওয়ারে হিরকের খাবার কলিগরা টেনে নিয়ে খায়। রহমান ভাই সইয়ের রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। হিরক সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করে,
–আপনার ভাইয়ের ডিভোর্স হলো কয় মাস ভাই।
–আর কইয়েন না, সাত মাস।
–আবার বিয়ে দিবেন।
–পোলার টাকা পয়সা জমুক।
–ও ভালো চাকরী করে। সমস্যা কই।
–আগের বউ -বাচ্চার ভরনপোষণ দিতে হয় মিয়া।
–মানে?
–তুমি হালায় শুইলা, সংসার করলা, বাচ্চা পয়দা করলা, সেই বাচ্চার খোরপোষ দিবা না! আবার, বউরে ছয় মাস টাকা দিতে হবে।
–কি বলেন।
— কোর্টে উকিল যদি বউয়ের দোষ পাইতো, ওর কিছু কম লাগতো। মিয়া, কালপ্রিট হইলো আমার ভাই। হের ঘরের বউ ভালো লাগে না। আমরা ওরে একঘর করবো। আহারে, বাচ্চাটা যে কি কাঁদে বাপের জন্য। এমন হা**জা* বাপ, বাচ্চার মুখের দিকে তাকাইলো না একবার।
হিরকের হেঁচকি ওঠে। সই ডিভোর্স ফাইল করলে টাকা পয়সার জোগান দেবার সামর্থ্য হিরকের নেই। সই নরম স্বভাবের মেয়ে। হিরক সাবধানে সব দিক ম্যানেজ করে নিলে কেউ টের পাবে না। বাসায় ফিরে হিরক বাবুর সাথে খেলে। সই গরম তোয়ালে এনে হিরকের ঘাড়ে স্যাঁক দেয়।
–আমরা একদিন ঘুরতে গেলে কেমন হয়।
— আচ্ছা, নিব।
–আম্মা সহ যাবো।
–শিশুপার্কে গিয়ে আম্মার কাজ নাই। তুমি আমি বাবু গেলে বাইকে যাবো। আম্মাকে নিলে গাড়ি লাগবে।
–ওনাকে একা রেখে যাবো?
–আমার থেকে তোমার আম্মার জন্য দরদ বেশী।
–বয়স্ক মানুষ, মন খারাপ হবে৷
–গাড়ি ভাড়া পাঁচশর নিচে হবে না । জিনিষপত্রের দাম জানো? ঘরে বসে খাও তো, জানবা কিভাবে।
সই হিরকের কাছ থেকে সরে আসে। সই ঘরে থাকে ঠিক। বাজারের খবর তার অজানা নয়।
–তোমাকে বলা হয়নি, আম্মা আমাকে টাকা পাঠিয়েছে। ঐ টাকা দিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসি৷
হিরক টিভির ভলিউম কমায়। শাশুড়ী মেয়েকে আলাদা করে টাকা পাঠানো শুরু করলো কবে। তার বিকাশে টাকা আসলে, সইকে কিছু হাতে দিতো।
–কত পাঠিয়েছে।
–হাজার দশেক। বাবুর জন্মদিনে সবাই বড় হোটেলে খেতে যাবো। তোমার বোনকে বলবো।
সইয়ের উচ্ছাস হিরককে স্পর্শ করে না। মেধা ‘কি করছো’ মেসেজ পাঠিয়েছে। হিরক ড্রয়িংরুমে চলে আসে। মেধা একটু পরপর হালকা পাতলা বিষয়ে জানতে চাইছে। হিরক বেশ থ্রিল অনুভব করে। সেই পুরনো মেধা। হিরকের প্রতি দরদ, অভিমান ফিরে আসছে তাহলে। সই ঘরের ভেতর থেকে মোবাইল হাতে হিরকের বদলে যাওয়া ভাব ভঙ্গি খেয়াল করে। আম্মা তাকে ‘দুনিয়ায় চোখ -কান খোলা’ রাখা মেয়ে মানুষ হতে বলেন। হিরকের ওপর নজর রাখতে বোঝান। নিজের স্বামীকে অবিশ্বাস করা যায় না। সই নিজে নিজে হেসে ফেলে বাবুকে নিয়ে শুয়ে পরে। একটু পরেই হিরক এসে বুকে টানবে। এমন স্বামীর ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
আসাদ চা খাচ্ছিলো। উত্তরের বাতাসে শীত বাড়ছে। ব্লেজার খুলে রেখে শার্টের হাতা নামিয়ে নেয়। ফুলকপির পাকোড়া খেতে খেতে ফেসবুকের ছবি দেখে আসাদ। মেধা ওর প্রোফাইল পিকচার বদলেছে। এই ছবিটা হানিমুনে গিয়ে ও তুলে দিয়ে ছিলো। শাশুড়ীকে আসতে দেখে আসাদ উঠে দাঁড়ায়।
–বসো বাবা।
–আপনি কেমন আছেন৷
–মেয়েটা ভালো থাকতে দিলো কই।
–চিন্তা করবেন না।
–বয়স হয়েছে, এখনো অবিবেচক সে।
–আমার উপর ছেড়ে দিন। সময় যাক, ঠিক হয়ে যাবে।
মেধার মা আসাদের দিকে তাকিয়ে চোখে আঁচল তুলে কেঁদে দিলেন। মেধার যে এত ভালো বিয়ে হবে, স্বামী জুটবে তার কল্পনার বাইরে ছিলো। হিরক না কাকে যেন ভালোবাসত। সে ছেলে ধোঁকা দিলে মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে যায়। বিয়ে দিয়ে যা হোক শান্তিতে ছিলেন। এখন আবার মেয়ে বাড়িতে এসে জুটেছে। বড় বোনের সাথে উঠতে বসতে ঝগড়া করে৷ ছোট্ট বাচ্চাটাকে দেখতে পারে না। বোনকে স্বামীর বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলে। বড় মেয়ের জামাইয়ের কাছে থাকতে হলে স্থায়ী চাকরী ছাড়তে হবে। মেধার অত্যাচার তার সহ্য হয় না। পর্দা ঠেলে মেধা ঘরে ঢুকে। একটু আগে অফিস থেকে এসেছে। চোখের কোনে কাজল লেপ্টে আছে। পরনে সাধারণ সুতি শাড়ি। ঠোঁটে হালকা কমলা লিপস্টিক। আসাদ হৃদয়ে মুগ্ধতা মেখে মেধাকে দেখে৷ ওর নাম এই মুহূর্তে দেয়া যায় ‘বিষাদ সুন্দর।’
–আম্মা তোমাকে নিয়ে যেতে বললো।
–তাই আসলে?
–না।
–তাহলে।
–যত বার আসতে চাই তুমি মানা করো। জোর করে তোমাকে নিয়ে মানসিক চাপ দিব না।
–মানসিক চাপ দেবে না। কারন, আমি পাগল।
আসাদ মেধার কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটা শীতে কাঁপছে। ঠোঁটের কাছে কান্না আটকে প্রাণপণে ঢোক গিলছে মেধা। আসাদ কোন উত্তর করে না। মেধাকে জড়িয়ে ধরে। পৃথিবীর যে যেখান থেকে যেভাবে খুশী সেভাবে তাদের দেখে যা ইচ্ছে তাই ভাবুক। এই মেয়েটির এখন উষ্ণতা প্রয়োজন। আজ স্ত্রীকে একাকী ফেলে কোথাও যাবে না আসাদ।
(চলবে)