চিরসখা পর্ব-০৭

0
1996

#চিরসখা(৭)

হিরকের কাপড় ধুতে গিয়ে সই নতুন শাড়ি কেনার স্লিপ পেয়েছে। কিন্তু, আলমারি আতিপাতি করে খুঁজে কোন নতুন শাড়ি পায়নি। সামনে সইয়ের জন্মদিন বা ম্যারেজ এনিভার্সরি নেই। হিরকের আম্মার জন্য শাড়ি কিনলে হিরক সইকে নিয়ে যায়। ননদের কথা আলাদা। সই ওর হাতে টাকা দেয়, সে নিজে কেনে। বাবুর জন্য গরম কাপড় কেনার কথা। হিরকের সময় হয় না। সই বাবুকে রেখে একা যেতে পারে না। ছুটির দিনে হিরক বাসা থেকে কেনাকাটা করতে যেতে চায় না। সইয়ের অবশ্য ভালো লাগে। হিরক একটু উড়নচণ্ডী পুরুষ। সইয়ের বাবার মতো সংসারের জন্য অন্তঃপ্রাণ নয়।
সইয়ের হাতে বাজার খরচ দেয়। মাসিক বাজার যা লাগে করে। সই হিসাবী মেয়ে। মেহমান না আসলে তার সদাই এক মাস টেনে অন্য মাস চালাবার ক্ষমতা আছে। হিরক খুব একটা খরচের হিসাব চায় না। সই টাকা জমায়৷ একটা অনলাইন হোম মেড ফ্রোজেন ফুডের ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবে। বাবুকে যদি হিরক সন্ধ্যায় এসে ধরে, সই সহজে খাবার বানাতে পারে। হিরক সইয়ের খাটুনী নেবে, কিন্তু সইয়ের আলাদা উপার্জন উৎস হোক মানতে নারাজ।

বাড়ি এসে হিরক যে খুব সইয়ের সাথে সময় কাটায় তা না। বিয়ের পর কিছুদিন বউ পাগল ছিলো। খুব ঘুরেছে, বেড়িয়েছে, বাইরে বাইরে খেয়েছে। বাবু পেটে আসার পর তৈরী হওয়া দূরত্ব সন্তান জন্মের পর বেড়ে গেলো। সইকে অবহেলা ও করে না হিরক। কিন্তু, মায়া নেই। সাংসারিক কথার পর স্বামী -স্ত্রীর কিছু আলাদা কথা থাকে। হিরক সেখানে নীরব। সই নিজ থেকে কথা বললে হিরক বলে। এমনকি গল্প ও জমে না। বিছানা গোছাতে গিয়ে সই আয়নায় নিজের দিকে তাকায়। বাবুকে নিয়ে রাত জাগার জন্য চোখের নীচে কালি। ছোট বাচ্চা কোলে বড় চুল সামলানো যায় না। বাচ্চা চুল টেনে ছেড়ে। তাই লম্বা ঘণ চুল কেটেছে সই। বাবু জন্মের পর কোমড়ে চামড়া ফেটেছে। একদিন রাতে হিরক ওর শাড়ি খুলে হতাশা ঝাড়লো।
–নিজেকে মেনটেইন করো।
–সময় পাই না।
হিরক সইয়ের পেটের ফাটায় হাত বুলিয়ে সরাসরি সে ক্স শুরু করে। সইকে জাগানোর কোন প্রয়োজন নেই। হিরক নিজের চাহিদা পূরন শেষে ঘুমিয়ে পরলে সই বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে। হিরক এমন ছিলো না। বিয়ের পর শারিরীক কলায় হিরক ওকে পারদর্শী করে তুলেছে। সেখানে এমন একতরফা সে ক্স হতে পারে সইয়ের কাছে অকল্পনীয়। হিরক বিয়ের আগে একাধিক মেয়ের সাথে শু য়ে ছে। সই খুব খুশী হতো স্বামীর স্বীকারোক্তি জেনে। হিরক বলতো, সই ওর জীবনে সব। আগে পরে অন্য কারো অস্তিত্ত নেই। দিন ভর কাজ করতে গিয়ে সইয়ের মনে শাড়ির কথা খচখচ করে।

বিয়ের পর মেধা নামের মেয়েটাকে ও পাত্তা দেয়নি। তখন নতুন মানুষ, নতুন সংসার, নতুন শরীরের মোহ। মেধার কথা বিয়ের রাতে জানিয়ে ছিলো হিরক। গায়ে পরে প্রেম করতে চেয়েছে। হিরক খুব গুছিয়ে মিষ্টি কথায় মাখা প্রেমে মায়া ঢেলে কথা বলতে জানে। মেয়েরা সহজে পটে যায়। সংসারী পুরুষরা হয় কাঠ খোট্টা। সারাদিন বউ -বাচ্চাকে সুখে রাখার চিন্তায় এরা কষ্ট করে। সুনিশ্চিত ভবিষ্যত গড়তে চায়। বউ বাচ্চার প্রতি বেখেয়াল থাকে না। হিরকের ভেতর দুটোই আছে, কম বেশী৷ সইয়ের বিয়ে করতে আপত্তি ছিলো না। বিয়ের পর পর বাচ্চা নিতে সে চায়নি। হিরকের অধিক উত্তেজনায় ঘটনা ঘটে যাবার পর শাশুড়ী খুশী হয়ে তাকে আংটি দিয়েছেন৷ সব সময় বাবুর জন্য এক টুকরো জমি করবেন বলেন। যে বাচ্চা সইয়ের জীবনে এত আনন্দ এনে দিলো, তার জন্যই কি হিরক আস্তে আস্তে উদাসীন হয়ে গেছে।

সইয়ের নিজের কাছে নিজের ভাবনা দূর্বল লাগে। মেধাকে দেখে সই নিজের প্রতি গর্ববোধ করেছে। চাছা ছোলা মুখের ঝগড়াটে মেয়ে। সইয়ের সাথে প্রথম দেখায় কেমন করে হিরককে ছেড়ে দিতে বলে। সিলেটে ঘুরে বেড়ানোর কথা জানিয়ে সইয়ের কান ভারী করতে চেয়েছে। হিরক বাঁশি বাজায়। চটপটে ছেলেদের প্রেমে মেয়েরা দ্রুত পরে। মেধাও পরেছে। জেনে শুনে আগুনে ঝাঁপ দিলে আগুনের কি দায়। একটা ছেলের পেছনে একটা মেয়ে সারাক্ষণ ঘুরলে ছেলেটার পক্ষে কতদিন মানা করা সম্ভব। সই জানে হিরক বন্ধুসুলভ আচরণ করে। মেধা তার ফায়দা লুটে শুয়ে পরলে হিরকের দোষ কোথায়। সই মনের ভাবনাদের কাটাকাটি করে স্বামীকে এগিয়ে রাখে।
অফিস থেকে দেরী করে ফেরে হিরক। সইয়ের হাতে একটা শাড়ির প্যাকেট এগিয়ে দেয়।
–আম্মা আসলে দিও। অফিসে রেখে দিয়ে চলে এস
ছিলাম।
–তুমি একা কিনলে।
–হা, কোন আত্মীয়ার বিয়ে আছে৷ আম্মাকে নিয়ে যেতে বলেছে।
–আম্মা কবে আসবে।
–যবে আসার আসবে। বাবু কই।
–কটে শুয়ে খেলে।
–চা খাবে।
–এখন চা খাবার সময়?
সই বুঝতে পারছে হিরকের মেজাজ খারাপ। অফিসের ঝামেলা হয়তো। সই হিরককে তোয়ালে এনে দেয়।
–গোসল করে নাও।
–গোসলের কাজ করেছি যে গোসল করবো? সকালে একবার গোসল করবো, রাতে আবার গোসল করবো। আমি না মেথরের কাজ করতে যাই।
–আমি কি তাই বলেছি।
–ঢং করো না। ঘুমাবো, টেবিলে খাবার দিয়ে রাখো। উঠে খাবো।
সই টেবিলের চেয়ার চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। আজকে সে ইউটিউব দেখে স্বামীর পছন্দের কলিজার সিঙারা বানিয়েছে। হিরক অন্য সময় ফিরে চা নাস্তা খায়। বাবু কটে আওয়াজ করছে। সই কান্না গিলে বাচ্চা কোলে নিয়ে দুধ খাওয়ায়। বাচ্চার কাজ বাবা ফেলে দিতে পারে। মা পারে না।
তার ভালো স্বামীটাকে কেউ তাবিজ করেছে। মাকে জানিয়ে হুজুরের পানি পড়া আনতে হবে। নয়ত, তাদের সুখে কারো নজর লেগেছে। এ ঐ মেধা **র কাজ হবে। সে ছাড়া হিরকের পিছুপিছু কেউ মেস পর্যন্ত বিয়ের পর আসেনি।

হিরক পাশের রুমে এসে দরজা আটকে দিয়েছে। মেধার জন্য কেনা শাড়ির রিসিটের কথা সে ভুলে গিয়ে ছিলো। তাই, আম্মার জন্য আরেকটা শাড়ি কিনে এনেছে। মেধা নক করার পর হিরকের সব কিছুতে অস্থির লাগে। মেধাকে মেসেজ দেয় হিরক, ‘জেগে আছো? ভালো লাগছে না। ‘ সই দরজা টোকা দিচ্ছে। লাইট বন্ধ করে দেয় হিরক। চব্বিশ ঘন্টা সংসার সংসার যন্ত্রনা লাগে। বেশ ভালো কাটতো দিন। বাড়ি গিয়ে অসুস্থ মায়ের কথা রাখতে বিয়ে করা। তবে সইকে তখন খারাপ লাগেনি। সুন্দরী ঘরোয়া সুশীলা লক্ষী মেয়ে। গৃহকর্মে সুনিপুণা একেবারে। হিরকের ভালোই চলছিলো সব। ইদানিং একটু পানসে লাগে। বিয়ের আগের সেই ফ্লার্টিং খোলামেলা জীবনকে মিস করে। মেধার আগমন তার কাছে মেঘ না চাইতে ও বৃষ্টি। তাছাড়া, মেধা ও হিরক দুজন বিবাহিত। একের কাছে অন্যের কোন এক্সপেকটেশন থাকবে না। প্রেম চললে একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। এখন তাও নেই। স্বেচ্ছায় হেঁটে আসা সুযোগ তাই হিরক হারাতে নারাজ। মেধাকে আবার কল দেয় হিরক। মেধার ফোন সুইচড অফ। ভয়েস মেসেজ পাঠায় এবার, ‘মেধা, আমার মেধা, ক্ষমার অযোগ্য জানি। শুধু একবার দেখা করো। ফাঁসির আসামীকে শেষ ইচ্ছা পূরনের সুযোগ দেয়। তুমি কি আমাকে তাও দিবা না।’ মেসেজ পাঠিয়ে হিরকের একটু হালকা লাগে। পেটে টান পরেছে। দরজা খুলে সইকে খাবার দিতে বলে বাবুর সাথে খেলা শুরু করে। সই সুন্দর করে টেবিল সাজায়। গতমাসের বাজার খরচ জমিয়ে একটা টেবিল ক্লথ কিনেছে। একটু আগে হিরকের মেজাজ খারাপ দেখে ভুড়ি রান্না করেছে সই। খেতে বসে হিরকের মন ভালো হয়ে গেলো।
–সুন্দর তো ক্লথটা।
–কেমন কিনেছি বলো।
–কত পরলো।
— জমানো টাকা দিয়ে হয়ে গেছে।
–টাকা লাগলে বলবে। তোমাদের জন্যই তো সব করি।
হিরকের সামান্য একটা কথায় সইয়ের কষ্ট চলে গেছে। বাবুকে তাড়াতাড়ি ফিডার খাইয়ে ঘুম দিয়ে আসে। হিরক তখনো খাচ্ছে।
–তুমি খেয়েছো।
–না, পরে খাবো।
হিরক প্লেট থেকে মাখা ভাত তুলে সইকে খাওয়ায়। ঘর ঠিক তো দুনিয়া ঠিক। সইকে রাগিয়ে তুললে তার বিপদ। আম্মা আসছে। তাছাড়া, সংসার নষ্ট করা বোকামী। ফোনে অটো মেসেজ আসে, মেধার ফোন এখন খোলা৷ হিরক আয়েশ করে সইয়ের বানানো দুধ চিতই পিঠা খায়। মেধা ফোন খুলে হিরকের দুটো মেসেজ সহ অনেক মিস কল পাবে। এখন হিরক চুপ থেকে মেধার কল ব্যাকের অপেক্ষা করবে। বাবুকে কটে রেখে লাইট অফ করে হিরকের গায়ে হাত দেয় সই। স্বামীর মন ভালো করার জন্য স্ত্রীর কর্তব্য করবে। হিরক ওদিন তাকে ডেকে পায়নি। সইকে আদর করতে করতে হিরক মেধার কথা ভাবে। মেধা সে ক্স লাইফে সুখী তো। নাকি ঐ ফ্রাস্টেশন থেকে হিরককে নক করলো।

আসাদ ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন দেখ ছিলো। ট্রেনিং হেড কালকে একটা কাজ সাবমিট করবে। মেধা আসার পর থেকে গুম হয়ে আছে। মা খেতে ডাকলে বলেছে স্যুপ খাবে। পরে অমলেট খেলো। রুপা কাবাব বানিয়ে ছিলো, দিয়ে গেলো। স্ত্রীর দিক থেকে মনোযোগ সরায় আসাদ। গুরুত্বপূর্ণ কাজ বস তাকে দিয়ে নির্ভার থাকেন। বিশ্বাসটা থাকুক। মেধা শুতে এসে অনেকটা সময় এপাশ ওপাশ করে শেষে আসাদকে ডাকে। কাজ থেকে মুখ না তুলে আসাদ মেধাকে ঘুমিয়ে পরতে বলে।
–ভালো লাগছে না।
–চকলেট আছে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে।
–স্নিকার্স!
–তোমার ভালো লাগে তাই।
মেধা আচমকা আসাদের গা জড়িয়ে ঘাড়ে চুমু খায়। ল্যাপটপ কোলে আসাদ চমকে ওঠে। মেধা নিজ থেকে এগিয়ে আসে না। আজকে যখন চাইছে, সুযোগ হারানোর প্রশ্নই আসে না। মেধাকে শুইয়ে এলোপাতাড়ি চুমু খায় আসাদ। মেধা চোখ বন্ধ করে। একটা শরীর ভুলে যেতে আরেকটা নতুন শরীর যথেষ্ঠ। কথাটা ভুল, সম্পূর্ণ ভুল। যারা ভালোবাসেনি তারাই ভুলতে পারে, ভুলে যায়।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে