#চিরসখা (৬)
হিরকের ফোন কেটে অফিসের ওয়েটিং এ বসে আছে মেধা। এসব আবদার এখন কেনো। বিয়ে করে বাচ্চা ফুটিয়ে হিরকের মেধাকে চাইছে। মেধার সব সময় মনে হয়। এমনকি পুইশাকের তরকারী দেখলে ও মেধার মনে হয় এটা হিরকের প্রিয় ছিলো। আসাদ যখন মেধার কোমড়ে হাত রাখে,মেধার শরীর হিরকের স্পর্শকাতরতায় ভোগে। বড় ভাই কোন শিউরিটি দিতে পারলেন না। ওরা মেধার সিভি উল্টে পাল্টে রেখে আগের জবের স্যালারী আর এক্সপেক্টেড স্যালারী শুনে ‘পরে যোগাযোগ করা হবে’ বলে দিলো। মেধার আসাদের বাসায় এখনি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আসাদের মা চতুরতার সাথে ওকে হ্যারাস করেন মনে হয়। মেধার ভুল ও হতে পারে। আসাদ ফোন করেছে। অনিচ্ছা স্বত্তে মেধা ফোন ধরলো।
–চাকরী পেলে?
–নাহ।
–আজকে অন্য কোথাও ইন্টারভিউ আছে?
মেধা সময় নিয়ে ‘না’ বললো। আসাদের এসব কথায় কিছু যায় আসে না। মেধার চাকরী হলে মেধার জন্য ভালো। আসাদ যে বউ এর টাকা খাওয়া লোক নয় তা মেধা বোঝে।
–বাইরে লাঞ্চ করবে?
–না
— তাহলে,বাইক ডাকবো? বাসায় যাও।
–আমি ডেকে নেবো।
— না, আমি ডাকছি৷ ফেয়ার বিকাশ করে দিব। তুমি চলে যাও।
মেধাকে কথা বলার সুযোগ দিলো না আসাদ। ফোন কেটে গেছে। মেধা উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক ঘুরলো। আরজু নামের ফুলের দোকান থেকে গোলাপ কিনে গন্ধ নিলো। এ দোকানের এক পাশে প্লাস্টিকের ফুল, অন্যপাশে তাজা ফুল সাজানো। মেধা প্লাস্টিকের ফুল নেড়েচেড়ে রেখে দেয়। আসাদের সাথে ওর সম্পর্ক এই ফুলগুলোর মতো। দেখতে চমৎকার, মনোরম সুন্দর৷ আদতে প্রাণহীন, নকল। আসাদ ফোন করে গাড়ির নম্বর জানায়। বাইকার আমুদে লোক। মেধা গাড়িতে ওঠা মাত্র গল্প শুরু করে। হা হু উত্তর দেয় মেধা। হিরক ওকে একটানা মেসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছে। মেধার সাথে হিরকের আগের ছবি, হিরকের তোলা মেধার একার ছবি আছে। এর মধ্যে একটা ছবি হিরকের বাচ্চার চলে এসেছে। মেধা ঠাস করে ফোন উল্টে ফেলে। বজ্জাত ড্রাইভার ওকে গাড়ি থেকে নামতে বললে মেধা খেয়াল করে এটা ওর ডেস্টিনেশন না। প্রশ্ন করার আগে গাড়ি হাওয়া। মেধা দেখে আসাদ দাঁড়িয়ে আছে।
–সারপ্রাইজ কেমন লাগলো।
–ভালো।
–যাক, কিছু একটা করে তোমাকে সারপ্রাইজ করা গেলো।
–এখানে হঠাৎ।
–সকাল থেকে তেহারী খেতে ইচ্ছা করছে।
–চলো।
আসাদ বউ’র হাত ধরে রাস্তা পার করে। মেধার হাতের গোলাপ গুলো ও বারবার খেয়াল করছে। মেধা বুঝতে পেরে একটু বিব্রত হয়। আসাদের দিকে গোলাপ এগিয়ে দেয়।
–নাও।
–সিরিয়াসলি?
–এখানে সিরিয়াসের কি হলো।
–তুমি জেনে বুঝে গোলাপ কিনে দিলে আমাকে।
–ভালো না লাগলে ফেলে দাও।
আসাদ হেসে গোলাপ গুলো ধরে রাখে। মেধার লিপস্টিক ছড়ে গেছে। রাস্তায় সবার সামনে স্ত্রীর লিপস্টিক ঠিক করে দেয়। টিস্যু দিয়ে মেধার ঠোঁটের চারপাশ চেপে মুছে। তারপর ওকে ‘থ্যাংকস ‘ বলে জড়িয়ে ধরে। মেধা খুব বিব্রত। আসাদের কাজ গুলো দেখানো মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা রয়েল তেহারী ঘরে ঢোকে। ছোট ঘর, কাঠের চেয়ার টেবিল পাতা, গাছপালায় সাজানো ছিমছাম পরিবেশ৷ মেধার ভালো লাগে। হিরকের সাথে এমন দোকানে খেতো।
আসাদ বসার আগে মেধার চেয়ার টেনে ওকে বসায়। আসাদের ছোটখাটো এটিকেট গুলো যে কোন মেয়েকে মুগ্ধ করার মতো। শার্টের হাত গুটিয়ে হাত মুখ ধুতে ধুতে আসাদ আয়নায় মেধাকে লক্ষ্য করে। হাসিখুশি দেখা যাচ্ছে। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে টেবিলে আসে।
–কি খাবে।
–সাদা ভাত, আলু ভর্তা, ডাল, ডিম ভাজি।
–বাস!
–ইলিশ মাছের ডিম।
–এখানে এসব পাওয়া যাবে না।
–তাহলে তুমি খাও।
–বাতাস খাবে তুমি?
–বাসায় গিয়ে খাবো।
আসাদ দুইটা হাফ তেহারীর অর্ডার দিয়ে ‘আসছি ‘ বলে বের হয়। মেধা কোক নেয়। পেট প্রায় খালি। তেহারী দিয়ে গেলে প্লেট থেকে সেদ্ধ ডিম তুলে খাওয়া শুরু করে। আসাদ ফিরে আসে অল্প সময়ের মধ্যে। ওর হাতে দুটো পোটলায়, সাদা ভাত -ছোট প্যাকেটে ডাল উঁকি দিচ্ছে। দ্রুত হাতে আসাদ মেধার থালা সাজায়। ভাত- ডিম ভাজি, আলু ভর্তা, টমেটো ভর্তা। মেধা অবাক হয়ে দেখে। আসাদ কোথা থেকে এসব জোগাড় করলো। খাওয়া শেষে দু’জন হেঁটে সামনে আগায়।
–সামনে নবরূপা আছে।
–আমার কিছু কেনার নেই।
–আমি কিনব, চলো।
মেধা না করতে পারে না। আসাদ তার হাজবেন্ড। তাছাড়া, সব বিষয়ে অনিহা দেখানো যায় না। মেধা জেনে শুনে বুঝে কবুল বলেছে। কেউ জোর করেনি৷ আসাদ কিছু শার্ট কেনে। মেধাকে নিয়ে সালোয়ার-কামিজের সেকশনে গিয়ে পছন্দ করতে বলে। মেধা কথা না শোনার ভান করে শাড়ির কাছে গিয়ে নেড়েচেড়ে শাড়ি দেখছে।
–আমি জানি তুমি শাড়ি পরতে পছন্দ করো।
–আপা বলেছে?
–তোমার এলবামে সত্তর ভাগ ছবি শাড়ি পরে তোলা।
–আচ্ছা। এই জন্য?
–না, তোমাকে শাড়িতে সুন্দর লাগে, সে জন্য।
মেধা একটু লজ্জা পায়৷ আসাদ ভনিতা ছাড়া কথা বলে। আজ এভাবে বললো। যে কোন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে এমন আচরণ করবে। মেধার আসাদকে ভালো লাগে না। সেটা আলাদা বিষয়। আসাদ পছন্দ করে মেধাকে শাড়ি কিনে দেয়। মেধা হিসাব করে। হিরকের কখনো এত টাকার উপহার দেবার সামর্থ্য ছিলো না। কিন্তু, ভালোবাসতে জানতো। আসাদ টাকার গরম দেখিয়ে তুলনা করছে। শাড়ি কেনা হলে আসাদ রিকসা নেয়। মেধার সাথে রিকশা চড়তে ভালো লাগছে। মেধার মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শাড়ির ব্যাগ হাতে নেয়নি। আসাদ রিকশার হুড তুলে মেধার কোমড়ে হাত রাখে। মেধা উল্টো দিকে তাকিয়ে থাকে। হিরক হলে স্থান কাল ভুলে চুমু খেয়ে বসতো। আড়ংয়ের সামনে রিক্সা থামলে মেধার বুক ধরাস করে ওঠে। আসাদ আজকে পদে পদে হিরককে মনে করিয়ে ছাড়বে। স্ত্রীকে নিয়ে সোজা গহনার কালেকশনে আসে আসাদ। মেধার জন্য শাড়ির সাথে মিলিয়ে পাতলা সোনার দুল পছন্দ করে। বিল করতে গিয়ে আরেকপ্রস্ত বিব্রত হয় মেধা। হিরক যেদিন প্রপোজ করে ছিলো, এই মেয়েটা কাউন্টারে ছিলো।
–আরে আপু, কেমন আছেন?
–এই তো। ইয়ে, বিলটা তাড়াতাড়ি দেয়া যাবে।
–যাবে, কাগজ শেষ। আনতে গেছে।
–ও, হাতে করে দেয়া যায় না?
–একটু আপু হয়ে যাবে৷ ভাইয়া কই। কি লাকি আপনি। আমি বাসায় গিয়ে হাজবেন্ডকে আপনাদের কথা বলে ছিলাম। ভাইয়া কত পাগল আপনার জন্য। ইশ, কি সুইট কাপল আপনরা।
মেধা তাগা সেকশনের দিকে হাঁটা শুরু করে। তার গহনা নেয়া লাগবে না। আসাদ পাশ থেকে সব শোনে। কাগজ এসে গেলে কার্ড বাড়িয়ে দেয়।
–এটা ঐ আপুর গহনা, ভাইয়া। আপনার কোনটি।
–এটাই, আমি ঐ আপুর হাজবেন্ড। কাউন্টারের মেয়েটা চোখ বড় করে আসাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বিল কাটে। শাড়ি ও গয়না বাবদ অনেক গুলো টাকা খরচ হয়েছে। আসাদ ভাবনা উড়িয়ে দেয়। আসাদ মেধাকে নিয়ে বিকেলে রিকশায় ঘুরে ফুচকা খাওয়ার প্লান মাথা থেকে বাদ দেয়। যদি সমস্ত অনুভূতি ও স্মৃতিদের আগলে রেখে আকড়ে ধরে মেধা বেঁচে থাকতে চায়, তাহলে বিয়েতে রাজি হলো কেনো। অহেতুক, এই প্রহসনের মানে কি। বাড়ি ফেরার পথে সারা পথ মেধা কানে হেডফোন গুঁজে রাখে। আসাদ একটু পরপর মেধাকে পরখ করে নেয়। পড়াশোনা জানা, চাকরী করা মেয়ে, একটা অতীত ছিলো। প্রায় সবার থাকে। বিয়ে করা মানে সব ভুলে সামনে ‘মুভ অন’। ও মেধার সাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরী করতে চেয়েছে। উল্টো, মেধা এসব স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত। তাহলে, বিয়ে নামের প্রহসনের পিড়িতে বসার দরকার ছিলো না। মেধা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। হিরক আগামীকাল ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থাকবে বলে মেসেজ পাঠিয়েছে। মেধা যেন যায়, জরুরী।
(চলবে)