#চিরসখা (৩)
মেধাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে আসাদ। নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে মেধা আসাদের বুকের কাছে খাবি খায়। ওর নাক ডুবে যাচ্ছে স্বামীর লোমশ বুকে। সেদিকে অপর জনের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেকটা সময় পর মেধাকে ছেড়ে স্ত্রীর দিকে রুমাল এগিয়ে ধরে আসাদ। রাগে মেধার শরীর কাপছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় না। আসাদের কাছ থেকে দূরে যাওয়া সম্ভব না। লোক ঠেলাঠেলি করা কনসার্ট না। উল্টো টেবিল পেতে চেয়ারে বসে গান উপভোগ করার আয়োজন করেছে হোটেল কতৃপক্ষ। কিন্তু টেবিল গুলো পাশাপাশি। বের হবার রাস্তা খুব সামান্য। লোকজনের গায়ের ওপর দিয়ে যাওয়া যাকে বলে।
–দম আটকে মারতে চাও নাকি।
–এত লোকের সামনে? তোমাকে বিয়ে করে হাজতবাস করতে হবে এমন ইচ্ছে নেই।
–আরেকটু হলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে জিভ উল্টে মরতাম।
–মারতে হলে খালি বিচে গলা চিপে ধরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেব।
আসাদ বাচ্চাদের মতো হাসে। ওর গজদন্তের হাসিটা মিষ্টি। হিরক হাসলে গালে টোল পরতো। মেধা আনমনে মুক্তো খোঁটে। আসাদের আঙুলে ওর ঘাড়ে খেলছে। হাত সরিয়ে দিতে গেলে আরো জেঁকে বসে।
–ছোট বাচ্চা কার্পেট ময়লা করলো বলে ক্লিন করে গেলো।
–তাতে হয়েছে কি। শ্বাস বন্ধ করতে হবে।
–এই দেখো, এটুকু বোঝ না, রাগ দেখাও। তোমার না ডাস্টে সমস্যা হয়।
মেধা নিজের বেখেয়ালি আচরনের জন্য লজ্জিত। আসাদ খুটিনাটি সব বিষয় মনে রাখে। একজন লাভিং কেয়ারিং হাজবেন্ড। নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার পুরুষালী আচরণ মেধার ভালো লাগে না। ঘুমঘুম চোখের এক নারীর উপস্থাপনায় কনসার্ট শুরু হয়েছে। সম্ভাষণ শেষে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হবে। আসাদ সহ অনেকে উঠে দাঁড়ালো। মেধা ব্যাগ থেকে চুইংগাম বের করেছে। আসাদ খপ করে ওর হাত ধরে টেনে তোলে।
–কেমন ধরনের অভব্যতা।
–চুপ করে দাঁড়াও।
–স্ট্যাচু অফ লিবার্টি সাজতে ভালো লাগে না।
–এটাকে দেশপ্রেম বলে। তোমার ক্যাটাগরির কিছু গাধা বসে থাকে। বা দাঁড়িয়ে গল্প করে, ফোন রিসিভ করে।
–বাজে শব্দ উচ্চারণ নিষেধ ছিলো।
আসাদ জাতীয় সঙ্গীত শেষে স্টেজের দিকে আগায়। মেধা ফোন বের করে। এখানে তার শোনার কিছু নেই। নব্বই দশকের কিছু বৃদ্ধ তারকা ধরে আনা হয়েছে। এরা ভাঙা গলায় ভুলে যাওয়া সুরে গান গাইবে। মেধা চারপাশ দেখে নেয়। অশীতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধা থেকে শুরু করে তাদের মতো ইয়ং কাপলের সংখ্যা কম নয়। এরা একে অপরের হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে গান শুনতে বসেছে। সদ্য বিবাহিত জীবন রঙিন ও সুন্দর। বিবাহিত দম্পতির বিছানা ফায়ারপ্লেসের সামনে থেকেও অধিক উত্তপ্ত। মেধার কাছে তা ধূসর, পানসে। যা অল্প দিনের ভেতর বর্ণহীনে পরিনত হবে৷ হেডফোন কানে ঠেকানোর আগে মাইকে নিজের নাম শুনতে পায় মেধা। আসাদের হাতে একুইস্টিক। স্টেজের ওপর পাতা চেয়ারে ওল্ড স্কুল মিউজিশিয়ান স্টাইলে বসে আছে।
‘দিস সং ইজ ডেডিকেটেড টু মাই বিউটিফুল লাভলি চার্মিং ওয়াইফ, মেধা।’ এ্যাল গ্রীনের গাওয়া ‘লেটস স্টে টুগেদার ‘ আসাদ চমৎকার গায়। মেধার চোখ ভারী হয়ে আসে। হিরক চমৎকার বাঁশি বাজাতে পারে। ধানমন্ডি লেকের দিকে নিয়মিত বাঁশি বাজিয়ে আছে। ওদিকে গেলে হিরক তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাঁশি বাজাতো। বাসর রাত হিরকের বাঁশি শুনে কাটাবে ঠিক করে ছিলো মেধা। কোথা থেকে কি হয়ে গেলো। অতীতের কথা যাঁকিয়ে আছে বর্তমানকে ভুলিয়ে।
— রুম সার্ভিসকে ডিনার এখানে সার্ভ করতে বলে দাও। একটা কল রিসিভ করতে হবে। মেধা সালোয়ার স্যুট ছেড়ে হালকা পোষাক পরে। এখনো কনসার্ট চলছে। আসাদের জরুরী কাজের জন্য উঠে আসতে হলো। ও পাশ থেকে “নীল মনিহার” গান ভেসে আসায় মেধা ফেসপ্যাক লাগাতে লাগাতে শোনে। হিরকের জন্য পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা আগলে রাখা ছিলো। সই আসায় মেধার প্রতি হিরকের ভালোবাসা নির্মোক হয়েছে। অভ্যাস এক ভয়ানক অভিযোগ তোলা অভিজ্ঞতা।
–খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।
–ধন্যবাদ। ফর্মালি বলছো?
–অফিসের বস বা কলিগ নও তুমি।
আসাদ এগিয়ে এসে স্ত্রীর গালে চুমু খেয়ে স্তনের পাশে হাত বোলায়। গাঢ় লাল রঙের নাইটিটা কখনো ট্রাই করেনি মেধা। নাক সিঁটকে তুলে রেখেছে। আসাদের মাঝে মাঝে বন্য প্রেম করতে ইচ্ছে হয়। মেধার ভেতর সেই উগ্রতা আছে, প্রকাশ করে না। আসাদ বুঝতে পারে, চাপ দেয় না। প্রত্যেক মানুষের একটা আইস ব্রেকিং টাইম ও পয়েন্ট থাকে। যাকে যার যার নির্দিষ্ট মুহূর্ত আসতে দিতে হয়।
–এখন সে ক্স হচ্ছে না, সরি।
–সে ক্স করার জন্য বউকে সুন্দর বলতে হয় না। তুমি বা আমি কেউ কাউকে ইমপ্রেস করার পর্যায়ে নেই।
–তাহলে গান গাইলে, সেটা দেখানো ছিলো।
আসাদ একটু বিব্রত হয়। অত কিছু ভেবে সে গান করেনি৷ ঐ মুহূর্তে মেধার প্রতি যে অনুভূতি এসেছে, গেয়েছে। এর বেশী কিছু না। সে কারো কাছে জবাবদিহি দেবার লোক নয়। সংকটে আসলে মানুষ যে কোন পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করে।
–গুছিয়ে বলতে পারি। ডিনারের পর বলি।
–অগোছালো করো বলে দাও। যদি সে ক্স করতে চাও, করতে পারো। আমি ফেসপ্যাক খুলতে পারবো না। মাত্র লাগিয়েছি। চোখ বন্ধ থাকবে।
–চাইছি না।
–বাঁচালে।
নতুন বউদের মতো মুখ টিপে হাসলো মেধা। আসাদের চেহারার ভাব ভঙিমা দেখতে ইচ্ছে। চোখ ঢাকা থাকায় পারছে না। ঠোঁটের কাছে স্ট্র পেয়ে টেনে নেয়। ‘মিষ্টি ডাবের পানি’, আসাদ আনিয়েছে। মেধার গোল হয়ে আসা ঠোঁট দেখতে ভালো লাগে। বিয়ে থেকে শুরু করে এখানে আসা অব্দি তার মাথায় চাপ কাজ করছে। হাসপাতালে রক্ত দিতে গিয়ে অচেতন মেধাকে দেখে প্রথম মায়া লাগা। পুরনো প্রেমিকের বিয়ের খবর শুনে যে মেয়ে হাত কেটে বসে তাকে ‘বোকা’ বা গাধা বললে ভুল হয় না। আসাদ তাই মেধাকে গাধা বলেছে। মেধার মা -বোনের কান্না ওকে স্পর্শ করে। রাশাদ মেধার কথা বলে পাত্র খুঁজতে বললে আসাদ রাজী হয়। ওর বোনের বিয়েতে প্রাণোচ্ছল সোজা সাপটা মেধাকে ভালো লেগে যায়। বাহিরে হালকা বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কনসার্ট ভেঙে গেলো। মুখ ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ ঘেষে নামা বৃষ্টি দেখছে আসাদ। ফেসপ্যাক খুলে মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দেয় মেধা। সিলেট থেকে ঘুরে এসে বাড়ি গিয়ে হিরক বউ নিয়ে ফিরলো। আসাদ ওকে কেমন ছোট করে কথা বলে সব সময়। এর কারন কি।
–আমরা কবে ফিরব।
–ভালো লাগছে না?
–তুমি আমাকে চাপ দিচ্ছো।
–দিতে দিচ্ছো কই।
–ঘুমবো। ফটো গুলো কবে পাওয়া যাবে।
–বিশ্রাম করো। আমি ডিভানে বসে কাজ বসছি।
–বিছানা ছাড়তে হবে না। ঘেন্না করছো?
–একদম বাজে কথা বলবে না মেধা।
আসাদ ল্যাপটপ খুলে বিছানায় বসলো। অফিসের কাজ ঘাড়ে এসে পরলো। ছুটি কমিয়ে ফিরে যেতে হবে। মেধা নাইটক্রিম মেখে এসে শোয়। আসাদ বেড সাইড ল্যাম্প নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। ঘুমের সময় মেধা আলো সহ্য করতে পারে না। বৃষ্টি নামায় হালকা শীত লাগে। ঘুমের মাঝে মেধা কুঁকড়ে গেলে আসাদ স্ত্রীর গায়ে কম্ফর্টার টানে। নির্বোধ নারীরা হৃদয়াকাঙ্খায় ব্যকুল হয়ে পুরুষের কাছে মূল্য খোঁজে। পৃথিবী এখন একনায়কতন্ত্র কায়েম করা বোধহীন রাগী প্রভু দ্বারা পরিচালিত। আবেগ সামলে নিলে অভ্যন্তরীণ ক্ষয় কিছু ঠেকানো যায়৷ মেধার চুলে হালকা বিলি কাটে আসাদ । উদাসীনতায় প্রেম জাগে না, ভালোবাসা সেখানে বহুদূরের ভাসমান বাতিঘর। হিরকের সাথে হিরন্ময় সংসার স্বপ্নে বিভোর মেধা ঘুমের ঘোরে মিটিমিটি হাসে। স্বপ্নে ওর হাতে ধরে থাকা বইয়ের নাম ‘বোকা মেয়ের ডায়েরী’। যেখানে হিরকের জন্য লেখা হাজার বেকার কবিতারা উন্মুখ হয়ে কালো অক্ষরে ফুঁটে আছে।
(চলবে)