#চিরসখা(১)
মেধার শরীর ছুঁয়ে নেমে আসা নোনা জলধারায় মুখ ডোবায় আসাদ। চোখ বন্ধ করে মেধা। তুমুল ব্যক্তিগত মুহূর্তে প্রাক্তনকে ভাবতে নেই। তবু আসাদ বা হিরক কেউ ব্যতিক্রম নয়। পুরুষ মাত্রই এক। নারী শরীরের খুঁটিনাটি জানতে আগ্রহী। এরপর নিয়মাবলি মেনে একঘন্টা ঘুম। সন্ধ্যায় হোটেল বিচের সামনে নামকরা ব্যান্ডদল গাইতে আসবে। সেখানে মিউজিশয়ানদের সাথে আসাদের চেনাশোনা রয়েছে। কলেজে থাকতে ও একটা ব্যান্ডে গিটার বাজাত শুনেছে মেধা। লিড ভোকাল অসুস্থ হওয়ায় গেয়েছে ও কিছুদিন। কয়েকটা হিট শো, বিদেশ ট্রিপ তারপর পড়াশোনায় ফিরে গেছে আসাদ। নামী কোম্পানির এইচ আরে উঁচু পদে রয়েছে। মেধার সাথে আসাদের দেখাশোনার বিয়ে হলেও আসাদের ভাই মেধার বোনের কলিগ। বোনের বিয়েতে গিয়ে পরে নিজের বিয়ের পাত্রী হয়ে গেছে মেধা। উম, হিরক ঠিক এভাবেই কপালে চুমু খেতো।
–এখন ঘুমিয়ে নাও। বিকেলে ছবি তুলবো।
–বিকেলে আবার ছবি তুলতে হবে।
–তুমি কি সব বিষয়ে উদাসীন নাকি শুধু আমার ক্ষেত্রে?
মেধা কথা বলা থামায়। আসাদ কখনো ঝগড়া করতে চায় না। যুক্তির পর পাল্টা যুক্তি দিয়ে নিজের কোর্টে বল নিয়ে আসে। আসাদ বাথরমে গেলে মেধা ফেসবুক খোলে। হিরকের প্রোফাইল ঘুরে আসে। বউ বাচ্চা নিয়ে দারুণ পরিবার। হিরকের পেটে সুখী পুরুষের মেদ জমেছে। মেধা কেবল ভুলতে না পেরে সময় নষ্ট করলো। আসাদের সাথে বিয়ের আগের দিন বিকেলে গার্ডেনে কাটানো সময়ের কথা মনে হয়। আসাদকে প্রথম দেখায় খারাপ লাগেনি মেধার। শাদা স্ট্রাইপ্ড ফর্মাল শার্টের সাথে মিশকালো প্যান্টে আসাদ ছিলো বেশ পরিপাটি। সোনালীর বদলে গাঢ় নীল রঙের কাফলিং মেধার চোখ কেড়ে ছিলো। গলার টাই খুলে হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে আসাদ প্রথমে কথা শুরু করে
–আমার ব্রেকাপ হয়েছে অল্প সময হলো। আপনি নিশ্চয়ই এই বিয়ে করে আমাকে বিচ্ছেদ জ্বালা ভোলাতে চান না মিস মেধা?
— মহৎপ্রাণ মানুষ সাজার অভিপ্রায় নেই। আপনার ও জানা দরকার। আমার একটা সম্পর্ক ছিলো, ডিপ লিভিং ইন রিলেশনশিপ বলতে যা বোঝায়।
–মানে আপনি ভার্জিন নন, তাই তো।
— ভার্জিন বিয়ে করতে চাইলে সদ্য ঋতুমতী স্কুল পড়ুয়া কোন কচি খুকী বিয়ে করে নিন। এখানে বুড়ো মেয়ের বর সাজতে আসবার প্রয়োজন হলো কেনো।
–সোজা সাপটা কথা বলা আপনাকে দেখে বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়েছে। শুনেছি, সিলেট পর্যন্ত বেড়িয়ে এসেছেন প্রেমিকের সাথে।
মেধা এ পর্যায়ে হাল ছেড়ে চেয়ার ঘুরিয়ে বসে। আপা তাকে অপমান করতে এই লোককে ডেকেছে। তার প্রেমের বিয়ে হোক আপা চাননি। এবারো, সম্বন্ধ আনার নাম করে ভাড়াটে লোক দিয়ে গায়ের ঝাল তুলছে।
–আমাদের অগনিতবার শারিরীক সম্পর্ক হয়েছে। আমি ভার্জিন নই। একবার পিরিয়ড মিস করে পিল খেয়ে এবর্ট করেছি। এরপরেও যদি আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান, করতে পারেন।
আসাদ সিগারেটের ধূয়া উড়িয়ে হেসে ভেতরে চলে গিয়েছিলো। মেধাকে তার পছন্দ হয়েছে জানাতেই সেদিন রাতে কাবিন করিয়ে দিলো দুই পক্ষ। পরদিন ছোট করে অনুষ্ঠান। আপার দৌড়াদৌড়ি দেখে মেধা অবাক হলেও পরে বুঝেছে, তার রুম খালি হলে আপা মেয়েকে নিয়ে এখানে এসে গড়িয়ে যেতে পারে। আম্মার কাছে মেয়েকে রেখে ঘুরতে যাওয়া যায়। মেধা বোনের মেয়েকে আদর করে৷ কিন্তু দায়িত্ব নেয় না বলে আপার খুব রাগ। তাই পাকাপোক্ত করে আপদ বিদেয় করেছে।
বিয়ের পর মেধা আসাদের জন্য রাঁধতে চেয়েছে। আসাদ হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে মেধাকে নিয়ে লংড্রাইভে গেছে। বিশেষ দিনে কিনে আনা ফুল একবার ধরে ফেলে রাখা লোক আসাদ। প্রিয় কবিতার চরণ এসএমএস করলে আসাদ তার রিপ্লাইয়ে একটা হার্ট সাইন পাঠিয়ে খালাস। ডার্ক চকলেট মেধা একদম সহ্য করতে পারে না। আসাদ প্রতি বেলায় খাবার পর ডার্ক চকলেট খাবে। বিয়ের রাতে মেধাকে সরাসরি কাছে টেনেছে আসাদ৷ প্রেম বা ভালোবাসার কথা বলবার বালাই ছাড়া কোন পুরুষ এমন সরাসরি সম্পর্ক শুরু করতে পারে তা ধারনায় ছিলো না মেধার। আসাদকে পরদিন প্রশ্ন করতে আবার সিগারের ধোয়া শূন্যে ছুঁড়ে জবাব দেয় আসাদ, ‘তুমি বা আমি কেউ আমাদের প্রথম নই মেধা। শুধুশুধু নিজেদের ডিজায়ারের ওপর জুলুম করে লাভ নেই। তাছাড়া, তোমার শরীর এমন স্পর্শে অভ্যস্ত। নতুন করে আর কি জাগিয়ে তুলব।
মেধা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছিলো। হিরক প্রেমিক হিসেবে খুব রোমন্টিক ছিলো। জন্মদিনে রাত বারোটায় বাড়ির সামনে এসে ফুল রেখে উইশ করা। হুটহাট শহর ছেড়ে দূরে বেড়াতে যাওয়া, বাক্স ভরে চকলেট দিয়ে মেধার রাগ ভাঙানো। ঝগড়ার পর রাস্তায় কান ধরে উঠবস করে সরি বলা ছেলেটা কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললো। এমনকি মেধাকেও বললো না । ওর বউ এর নাম সই। দেখতে সুন্দর আলাভোলা মেয়ে। সারাক্ষণই হাসতে থাকে। মেধা বিয়ের খবর পেয়ে হিরকের মেসে গিয়ে উঠলে অতটুকুর ভেতর সিঙারা, সমুচা, মিষ্টির ব্যবস্থা করে ফেললো। মেধা তখন পাল্টে যাওয়া বিছানার চাদরে কমলা রঙের আধিক্য দেখছে। হিরকের প্রিয় রঙ আকাশী, মেধার সাদা। তাই বিছানায় হালকা নীল রঙের চাদর বেছাতো মেধা। ওপাশের স্টোভ উঠে গিয়ে ইনডাকশন বসেছে। মিটসেফে সাজানো হাঁড়িকুঁড়ি, বাসন কোসন। হাতের ডালগোনা কফি ঘুটতে ঘুটতে সই হিরকের কথা বলছিলো। মেধার মনে হলো নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢালার গল্পটা।
–আমি কে চিনতে পেরেছেন?
–হিরকের প্রাক্তন প্রেমিকা।
–সব জেনে ও সংসার করছেন কেনো। ছেড়ে দিন না ওকে।
–হিরক ওর মায়ের সাথে আমাকে দেখতে এসে আংটি পরায়। পছন্দ না হলে পুরুষ মানুষ থুতু ফেলে না। আমি মফস্বলের মেয়ে। ছেলে মানুষ ভালো করে চিনি। আপনার থেকে আমি দেখতে সুন্দর। বয়স কম, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকবো না। এমন মেয়ে সংসারের লক্ষী, এটা পুরুষ মানুষ বোঝে। আমার স্বামীকে কাড়তে আসবেন না। সইয়ের আঁচল ছেড়ে হিরক কোন কালীর প্রেমে মজবে না, এটা আমার মা বলেছে৷
দুঃখে রাগে মেধা ও মুখিয়ে ছিলো। সইকে গালাগাল দিয়ে লোক জমিয়ে শুনিয়েছে , হিরক ওর আগেও কত মেয়ের গলায় মালা দিয়ে আকাশ বাতাস সাক্ষী রেখে প্রেম করে শুয়েছে। এসব ছেলেই এমন পল্টি মেরে বিয়ে করতে পারে। মুখে বলে আসলে কি হবে, ফিরে এসে কেঁদে বিছানা বালিশ ভিজিয়েছে মেধা। মা -বোন তার পর একপ্রকারে জোর করে ওকে বিয়ে দিয়ে বেঁচেছে। আসাদকে তাই শর্তগুলো শুনিয়ে ছিলো মেধা। কেউ কারো অতীত ঘেঁটে কালিমা লেপবে না। আসাদ সেসব গায়ে মাখা বা মানার পাবলিক নয়। হিরকের ছবি দেখে ওর মন্তব্য, এটা ভাগার মাছ। আস্ত কারো বাজারের ব্যাগে জায়গা হয় না। এ এক ভাগা তো সে দুই ভাগা করে ভাগে পায়। তুমি কয় ভাগা পেয়েছো তুমি জানো। এসব থার্ডক্লাশ লোকের সাথে আমার তুলনা ধরবে না।
এমন পাল্টাপাল্টি নিয়ম কানুন দিয়ে বিয়েটা সেরে ওরা নিজনিজ পরিবারকে সুখী করেছে। মেধা হিরকের ছবি ডাউনলোড করে ‘চিরসখা’ পাসোয়ার্ড দিয়ে সেভ করে।
(চলবে)