চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৫১ এবং শেষ পর্ব

0
736

#চিত্রলেখার_কাব্য
অন্তিম_পর্ব
~মিহি

বিয়ের বিষয়টা একান্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসলো চিত্রলেখা। একরকম জেদই ধরলো সে অপর্ণার বাবা মাকে বিয়েতে আনার। তাদের কাছে ক্ষমা না চেয়ে সে নিজের দাম্পত্য জীবন শুরু করতে চায় না। পরিস্থিতির কারণে হলেও অপর্ণার মৃত্যুতে খানিকটা দায়ভার তো চিত্রলেখারও। অর্ণব এ যুক্তি খণ্ডাতে পারলো না। বাধ্য হয়েই অপর্ণার বাবা মাকে ডেকে পাঠালো সে। তাদের মেয়ের মৃত্যুর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে তারা এ বাড়িতে আসেননি। অর্ণব দুয়েকবার রূপসা রাদিফকে ও বাড়িতে রেখে এসেছে। এমন অবস্থায় তারা এখানে আসবেন কিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে অর্ণব তবুও সে বোনের খাতিরে তাদের ডেকেছে ঠিকই। অর্ণব বিয়ের যাবতীয় কাজকর্ম দেখছে। খাবার দাবারের ব্যবস্থা বাইরে থেকে করা হয়েছে। সাথীর এখন প্রেগ্ন্যান্সির সাড়ে তিন মাস চলছে। সে এসেছে গত পরশু। অনিকও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে বোনের বিয়ে উপলক্ষে। সাথীকে পুরোপুরি বিশ্রামেই রেখেছে সবাই। তার প্রেগ্ন্যান্সিতে কিছু জটিলতা আছে বিধায় সবসময় তাকে নজরে রাখতে হয়। সায়রা খালা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ, তিনি সর্বদা সাথীর আশেপাশেই থাকেন। রূপসা রাদিফও আজ বেশ খুশি। রঙ্গন বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেই তাদের মন জিতে নিয়েছে। বাচ্চা দুজন এসবের মাঝে নিজের মাকে ভুলে থাকার চেষ্টায় করে চলেছে। তারা জানে তাদের মা কোথাও লুকিয়ে থেকে তাদের দেখছে, বাস্তবতা বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের এখনো হয়নি।

চিত্রলেখা লাল শাড়ি পড়েছে। রঙ্গনের পছন্দ করা শাড়ি আর রঙ্গন তার পছন্দ করা পাঞ্জাবি পড়বে। সাজসজ্জার দিকে বিশেষ নজর দিল না চিত্রলেখা। ঘরোয়াভাবে বিয়ে, সেহেতু বাড়তি সজ্জা সেজে নিজের বিবাহপূর্ব ঔজ্জ্বল্য আড়াল করার মানে হয়না। সাথী পাশে বসে দেখছে। এই মেয়েটাকে খুশিতে দেখার জন্য সে সর্বদা সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চাইতো। সৃষ্টিকর্তা অবশেষে তার দোয়া কবুল করেছেন।

_______

অপর্ণার বাবা-মা যখন চিত্রলেখার ঘরে এলেন তখন চিত্রলেখা মাত্র আয়নার সামনে থেকে উঠতে ধরেছে। ঘরে একা সে, সাথী একটু আগেই বাইরে গিয়েছে। চিত্রলেখা বিব্রতবোধ করলেও নিজেকে সামলে তাদের সালাম দিল। অপর্ণার মা আন্তরিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন।

-ভালো আছো মা? বিয়ের জন্য অনেক শুভকামনা।

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আপনারা এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনাদের দোয়া না পেলে আমি আমার নতুন জীবন শুরু করতে পারবো না। আমি জানি ভাবীর মৃত্যুর শোক আপনারা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, আমায় দেখে খুব রাগও হতে পারে। আমি আপনাদের কাছে কিভাবে ক্ষমা চাইবো তাও জানা নেই আমার। আপনারা আমায় দয়া করে দোষী ভাববেন না।

-লেখা, ক্ষমা আমার চাওয়া উচিত। তোমাকে আমি অনেক বাজে কথা বলেছি, অপর্ণাকে অনেক কুবুদ্ধিও আমি শিখিয়েছি। এসব নিয়ে আমার মৃত মেয়ের উপর রাগ জমিও না। মাফ করে দিও মা।

-ভাবীর প্রতি আমার কোনো রাগ নেই আন্টি। আপনারা আমার জন্য দোয়া রাখবেন এটাই আমার চাওয়া শুধু।

-ফি-আমানিল্লাহ। সুখী, দীর্ঘজীবী হও এবং সংসারে আলো বয়ে নিয়ে আসতে পারো যেন।

অপর্ণার বাবা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখ নিচের দিকে। তিনি কিছু বলতে পারছেন না। অপর্ণার মায়ের চোখ ছলছল করছে। চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলেন তিনি। অতঃপর চিত্রলেখার হাতে একটা ডায়েরী ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”শেষ পৃষ্ঠাটা পড়ো সময় হলে।” চোখের জল আর বাধ মানলো না তার। মুখে আঁচল গুঁজে তিনি তৎক্ষণাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পিছু ডাকতে গিয়েও পারলো না চিত্রলেখা। একজন মায়ের কান্না মানে তার মেয়ের জন্য জমানো শত অনুভূতি, সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তার নেই। চিত্রলেখা ডায়েরীটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে এক সন্তানহারা পিতা মাতার নীরব আর্তনাদ প্রত্যক্ষ করলো। ডায়েরিটা খোলার জন্য তার মন আনচান করতে লাগলো। ধৈর্যধারণ করতে না পেরে সে শেষ পৃষ্ঠাটা বের করলো,

“অনুষ্ঠানগুলোতে আর আমার প্রয়োজন পড়ে না। বাবা-মাও খোঁজ নিলো না। সবার আদরের মেয়ে থেকে বোঝা হয়ে যাওয়ার অনুভূতিটা দারুণ। রক্তের সম্পর্কেও এমন করে পর করে দেওয়া হয়! আমি তাদের আপন হয়েও বোঝা হয়ে রইলাম। প্রতিপদে আমাকে, আমার বাচ্চাদেরকে পরোক্ষভাবে কটাক্ষ করা হয়। কেন যেন আজ চিত্রলেখার কথা বড্ড মনে পড়ছে। কতটা অত্যাচার করেছি তাকে তার ভয়াবহতা মনে পড়ছে। কখনো সুযোগ পেলে ক্ষমা চেয়ে নিব। দুঃখিত চিত্রলে…”

এরপর আর লিখতে পারেনি অপর্ণা। শেষ পৃষ্ঠাটা বেশ কুঁচকানো। চিত্রলেখার চোখের সামনে সেদিনের নারকীয় দৃশ্যের এক ঝলক কল্পনায় ভেসে উঠতেই তার আত্মা চমকে উঠলো। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে কেবল অপর্ণার শান্তি কামনা করে দোয়া করলো। মানুষটা অনুতপ্ত ছিল, ক্ষমাও চাইতে চেয়েছিল তবুও কী নির্মম মৃত্যু! এর চেয়ে কঠিনতম মৃত্যু কামনা করলো চিত্রলেখা নওশাদের জন্য। আশেপাশে তাকালো সে। ডায়েরিটা ফিরিয়ে দিতে হবে। মেয়ের শেষ স্মৃতিটুকু চিত্রলেখা তার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে চায়। অতঃপর সে সব অতীত ভুলে নবজীবনে পা ফেলবে।

____________________

-অন্যায় হিসেবি লোকটার শাস্তি কম হয়ে গেল না মা?

-তুমি যা দেখতে পাও, সেটুকুই কি সবসময় সত্য?

-মানে?

-তোমার মা কখনো কাউকে প্রাপ্যের কম শাস্তি দেয় না রঙ্গন। নওশাদের সাথে এখন কী হচ্ছে তা বাইরের কেউ জানেনা। যে সেলে সে আছে, সেখানে সে প্রতিরাতে কামনা করে এ রাতটাই যেন তার শেষ রাত হয় কিন্তু প্রতিদিন সকাল হয় এবং সে কী অত্যাচার সহ্য করে তা আমি বলবো না। এসব নিয়ে আজকের দিনে ভেবো না। আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিচে অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি এসো।

আশফিনা আহমেদের রহস্যজনক হাসির আড়ালে চাপা পড়ে থাকে কিছু রহস্য যার খোলাসা হয় না। রঙ্গন মুচকি হাসে, মায়ের এ স্বভাবের সাথে সে পরিচিত। রঙ্গন চুপিসারে নিজের বিছানার নিচ থেকে একটা ছবি বের করে। এই ছবিটা তার অ্যালবামের প্রথম ছবি যেটা তার মা সবসময় তার থেকে আড়াল করে এসেছে। রঙ্গন এ সত্য প্রথম জেনেছিল বছর দুইয়েক আগে। বন্ধুত্বের টানাপোড়েন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এটা জেনে আরো অশান্তিতে পড়েছিল। অতঃপর চিত্রলেখার আগমন, মায়ের সাথে স্নায়ুযুদ্ধ। সব মিলিয়ে জীবনটা একটা এডভেঞ্চার বলা চলে। আশফিনা আহমেদ তাকে এতবছরে বুঝতে দেননি সে তার নিজের ছেলে নয়। রঙ্গনও বুঝতে দিবে না সে এ সত্য জানে। ছবিটা আবার অ্যালবামে রেখে নতুন একটা জীবন শুরু করতে চলেছে সে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল রঙ্গন।

_________________________________________

“কবুল বলতে এত সময় নিলে যে? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।” চিত্রলেখার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলল রঙ্গন। চিত্রলেখা দূর আকাশে তাকিয়ে আছে। নিজের মা-বাবার কথা আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার। বিয়ের সময়টাতে মেয়েরা কেন যেন বাবা মাকেও সবচেয়ে বেশি মনে করে। রঙ্গন বোধহয় চিত্রলেখার উদাসীনতা বুঝতে পারলো।

-এই শীতের মধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে জমে যাচ্ছি অথচ আমার রঙ্গনার ঠোঁটে এখনো বসন্ত এলো না, আমারো মনে রঙ লাগলো না।

-বসন্ত আসেনি কে বললো? কবুল বলে বসন্ত বরণ করেছো না?

-বসন্ত এখনো আমাকে বরণ করেনি।

রঙ্গনের দৃষ্টি চিত্রলেখার ঠোঁট বরাবর। চিত্রলেখার মনে হলো কোনো কিছু যেন তাকে জমিয়ে ফেলছে চারদিক থেকে। সারা শরীর শিরশির করে উঠলো তার। রঙ্গন খানিকটা এগিয়ে চিত্রলেখার দু’ গালে হাত রেখে কাছাকাছি আসার কেন করলো। ঠিক সেসময় ছাদের দরজা খোলার শব্দ হলো। ছিটকে সরে গেল চিত্রলেখা। অহম ‘স্যরি স্যরি’ বলতে বলতে চোখ বন্ধ করলো। রঙ্গন চোখ কটমট করে তাকালো সেদিকে। নিষ্পাপ শিশুর মতো মুখ করলো অহম।
“ভাইয়া, তোমার তো লাইন ক্লিয়ার কিন্তু আমারটা এখন আমার সাথে চাঁদ দেখতে চাইতেছে সেটা আমার দোষ? এত সুন্দর করে বাসরঘর সাজাইছি তোমাদের, সেটা ছেড়ে ছাদে কী? যাও নিচে যাও!” অহমের কথায় রঙ্গন তেড়ে যেতে নিল তার দিকে। অহম আর মার খাওয়ার অপেক্ষা না করে নিচে দৌড় দিল। চিত্রলেখা রঙ্গনের হাত শক্ত করে ধরে তার বুকে মাথা রাখলো।

“আমি নিঃশব্দ নীরব প্রেমিকা হয়ে,
উষ্ণ আলিঙ্গনে তোমায় বাঁধবো।
আমি স্বচ্ছ চঞ্চল সরোবর হয়ে,
নীলরঙা জলে তোমায় ভাসাবো।
আমি অমানিশার চাঁদ হবো না,
দিবালোকের সূর্য হয়ে তোমায় রাঙাবো।”

চিত্রলেখার কথায় রঙ্গনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। পূর্ণতার সংজ্ঞা সে উপলব্ধি করেছে। এ পূর্ণতার প্রতীক্ষা সে করেছিল। অবশেষে চিত্রলেখাকে নিয়ে তার এক অশেষ কাব্য রচিত হলো।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে