চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪৯

0
555

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনপঞ্চাশতম_পর্ব
~মিহি

লম্বা সফর শেষে চিত্রলেখার মাথা ঝিমঝিম করছে। ঠিক করলো সোজা বাসায় ফিরে অর্ণবের সাথে কথা বলবে কিন্তু রঙ্গন তাকে একা ছাড়তে চাইছে না। চিত্রলেখার রঙ্গনকে বাড়িতে নিয়ে যেতে খানিকটা ভয় কাজ করছিল মনে। নিজের ভাইকে তো সে চেনে, আচমকা রঙ্গনের উপস্থিতি বোধহয় তার জন্য হজমযোগ্য হবে না। অর্ণবের রাগ কিঞ্চিত এখনো সঞ্চিত রঙ্গনের প্রতি। অনেকক্ষণ বুঝিয়ে রঙ্গনকে বোঝাতে সক্ষম হলো চিত্রলেখা। রঙ্গন চিত্রলেখাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

চিত্রলেখা বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে মুখোমুখি হলো সায়রা খালার। আচমকা চিত্রলেখার উপস্থিতি যেন তাকে মারাত্মক ঘাবড়ে দিয়েছে। চোর ধরা পড়লে যেমন একটা হাবভাব হয় মুখের, তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন সায়রা খালা। চিত্রলেখা এ প্রতিক্রিয়ার মানে বুঝতে পারলো না। এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া তো সে প্রত্যাশা করেনি।

-খালা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? যেন ভূত দেখেছেন! ভাইয়া কোথায় বলুন তো। আমার ফোন-টোন ধরছে না কেন? ভাইয়া এসেছে তো এতক্ষণে? কোথায় সে?

-অ..অর্ণব? সে…সে তো হা..হাস..

-খালা, কী বলতে চাচ্ছেন একটু তাড়াতাড়ি বলেন। এভাবে তোতলাচ্ছেন কেন? ভাইয়া কোথায়? এতক্ষণ তো দোকান থেকে চলে আসার কথা।

-তুমি আসবে তা বলোনি কেন? জানায়ে আসবা না?

-জানানোর উপায় কই? ভাইয়ার ফোন কতসময় ধরে বন্ধ সে হিসাব আছে? ভাইয়া কোথায় বলেন তো আগে। ভাইয়ার বিচার করি আগে।

-সে বাড়িতে নেই, লেখা। ও হাসপাতালে গেছে।

-হাসপাতালে কেন? কেউ অসুস্থ?

-অ..অপর্ণা অসুস্থ। সেই থেকে অর্ণব বাড়িতে কমই আসে, বাচ্চা দুটার কাছেই থাকে।

-ভাবীর কী হয়েছে?

-ও..ওনারে কয়েকটা লোক মিলে ধর্ষণ করছিল। শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ, বাঁচবে কিনা বলা যাইতেছে না। বাচ্চা দুইটা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। আমি গেছিলাম গতকাল দেখতে।

-এই কথাটা আমাকে আগে কেন বলেননি খালা? কোন হাসপাতালে আছে ভাবী?

-অপেক্ষা করো একটু, অর্ণব এখন আসবে হয়তো বাচ্চাদের রাতে রেখে যেতে। রাতে বাচ্চারা এখানে থাকে, সকালে আবার মায়ের কাছে যাওয়ার জেদ ধরলে অর্ণব নিয়ে যায়।

চিত্রলেখা চৌকাঠেই বসে পড়লো। পৃথিবী যেন থমকে গেছে তার। সবকিছু এলোমেলো লাগছে এখন। এতকিছু হয়ে গেছে এত অল্প সময়ে অথচ তাকে কেউ জানায়নি অবধি! নিজেকে এ মুহূর্তে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হচ্ছে চিত্রলেখার। তার জন্যই এ সবকিছু হয়েছে। নওশাদ লোকটাকে নিজ হাতে খুন না করা অবধি চিত্রলেখার যেন স্বস্তি হবে না। একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে নওশাদকে না দেখলে ডানতেও পারতো না চিত্রলেখা। সায়রা খালা চিত্রলেখাকে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করলেন। চিত্রলেখার হাত পা অসাড় হয়ে আসছে, দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও যেন সে পাচ্ছে না। চোখের সামনে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে সে।

ঘণ্টাখানেক পেরিয়েছে। অর্ণব বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে চিত্রলেখার বিছানার পাশে এসে বসলো। এখনো জ্ঞান ফেরেনি মেয়েটার। বড়সড় একটা ধাক্কাই খেয়েছে বলা যায়। নিজের ভাবীর এ পরিণতি সেও কখনো কল্পনাতে আনেনি। স্বভাবতই ভয়ের মাত্রাটা বেশি হবে। খানিক বাদেই চিত্রলেখা চোখ মেললো। চোখ মেলে অর্ণবকে সামনে দেখে চিত্রলেখার মনের ভয় যেন আরো বেড়ে গেল। নিজের ভাইয়ের চোখে চোখ মিলানোর সাহসটুকুও কি সে পাবে এখন?

-তুই আসবি বলিসনি কেন লেখা?

-তোমায় ফোনে পাচ্ছিলাম না, রেজাল্টের কথাও জানাতে পারছিলাম না। তাই ভেবেছিলাম সামনাসামনি এসেই সবটা বলবো কিন্তু বুঝতে পারিনি এসে এসব দেখবো।

-লেখা, এসব একরকম এক্সিডেন্ট। তুই রিল্যাক্স হ।

-আমার জন্য এসব হয়েছে ভাইয়া! ঐ নওশাদ লোকটাকে আমার মেরে এখান থেকে যাওয়া উচিত ছিল।

-নওশাদ ওর ভুলের শাস্তি পাচ্ছে সে। ওকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। ওর প্রাপ্য শাস্তি ও পাবেই।

-ভাইয়া, আমি ভাবীর সাথে একটু দেখা করতে চাই।

-কাল সকালে নিয়ে যাবো। এখন ঘুমা তুই।

চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অর্ণব। নিজের বোনকে অপর্ণার বাড়ির লোকদের সামনে উপস্থাপন করতে সামান্য ভীতবোধ করছে সে। ঐ বাড়ির সব লোকই যে চিত্রলেখার পরিস্থিতি বুঝবে তা আশাও করা যায় না। অর্ণব দ্বিধার মধ্যে পড়লো।

___________________________

রঙ্গন বাড়িতে ফেরার পর থেকে চিত্রলেখার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। একবার ভাবলো মেয়েটা বোধহয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, পরক্ষণেই নানা দুশ্চিন্তা ভর করেছে তার মাথায়। কিছুতেই মন শান্ত হচ্ছে না তার। অহমের ঘরে গিয়ে একটু আগে দেখে এসেছে অহম পড়ছে। ওর সমস্যা হবে ভেবে আর থাকেনি সেখানে। ঘরে আসার পর থেকে দুশ্চিন্তাগুলো আরো জেঁকে ধরছে তাকে। না পারছে সেগুলি ছুঁড়ে ফেলতে আর না পারছে মেনে নিতে। ভাবনার মাঝেই আশফিনা আহমেদ এলেন রঙ্গনের ঘরে। মাকে দেখে রঙ্গন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।

-ফেরার পর থেকে একবারও আমার ঘরে আসোনি কেন রঙ্গন?

-গিয়েছিলাম, তুমি কাজ করছিলে তাই চলে এসেছি।

-ডাকা যেত না? তা বাদ দাও, মন খারাপ কেন তোমার?

-কিছু না মা, এমনি। এদিকের খবর কী?

-খবর একটা দিতে পারি। ভালো খবরই বলা চলে। বলবো?

-অবশ্যই।

-নওশাদের জেল হয়েছে। এখনো যোগাযোগ মাধ্যমে খবর আসেনি, অতি শীঘ্রই ভাইরাল হবে।

-মজা করছো মা? ঐ লোকটার ক্ষমতা আমরা জানি। তোমার ভাই তো কৈ মাছের প্রাণ। আমার এত মার খেয়েও বেঁচেছে আর তো জেলে একদিন।

-না এবারের প্রমাণ শক্তপোক্ত। নিজের মুখে দোষ স্বীকার করেছে।

-কার কাছে স্বীকার করলো?

-আমার কাছে?

-তুমি ধরিয়ে দিয়েছো ওকে?

-হুম।

আশফিনা আহমেদ হাসলেন। রঙ্গনের মুখে বিস্ময়। মায়ের এ রহস্যময় রূপের সাথে সে খুব একটা অবগত নয়। সে সবসময় তার মাকে দেখেছে কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে। আজ যেন সে ব্যক্তিত্ব রহস্যের চাদরে আবৃত।

-রঙ্গন!

-জ্বী মা।

-বিয়ে কবে করবে তুমি? তোমার প্রেয়সী তো ডাক্তার হবে। তার কি সময় হবে বিয়ে করার? নাকি আগে থেকেই এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখবো? কী বলো রঙ্গন? কবে আমাদের ডাক্তার বউকে নিয়ে আসতে চলেছো এ গৃহে?

এ পর্যায়ে রঙ্গন কয়েকবার হৃদস্পন্দন মিস করলো। আজ আশফিনা আহমেদ তাকে প্রতি পদে পদেই অবাক করছে। অবশ্য মায়ের কথায় রঙ্গনের চোখে যে ঝলকানি দেখা গেল, তাতে রঙ্গন নিজের অনুভূতি আড়াল করতে পারলো না। তার চোখের চাহনি বলে দিচ্ছে সে চিত্রলেখাকে একান্ত নিজের করে পেতে কতখানি উৎসুক।

________________________________

অপর্ণা নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ছটফট করছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে গলা দিয়ে আওয়াজটুকুও ঠিকঠাক বের করতে পারছে না। নার্স তার অবস্থা দেখে অনেকাংশ ভীত হলো। চটজলদি ডাক্তার ডেকে পাঠালো সে। রাতের প্রায় আড়াইটা। দায়িত্বে থাকা একজন ডাক্তার ছুটে এলেন। অপর্ণাকে চেক করতে লাগলেন। পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারলেন তিনি। পরিবারের লোকদের কিভাবে বিষয়টা জানাবেন ভাবতে শুরু করলেন তিনি। ভাবার সময়টুকু অপর্ণা আর দিল না। জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা এবং বেঁচে থাকার তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে রাত দুইটা চৌত্রিশ মিনিটে পৃথিবীর মায়াত্যাগ করলো সে। ঘুমিয়ে থাকা তার সন্তানগুলো জানলো না তাদের মা এ পৃথিবীতে আর নেই। ডাক্তার অপর্ণার মৃত্যু সংবাদটা বাইরে থাকা অপর্ণার বাবা এবং মাকে জানালেন। বয়স্ক মানুষ দুজন নিজেরাই ভেঙে পড়লেন। কী করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। মেয়েকে হঠাৎ হারিয়ে তারা যে ধাক্কাটা খেয়েছেন তা সামলে উঠে কাউকে জানানোর বিবেক তাদের কাজ করছে না। অপর্ণার মা বহু কষ্টে অর্ণবের নম্বর ডায়াল করলেন। অর্ণব ফোন বিছানার পাশেই চার্জে দিয়ে ঘুমিয়েছিল। ফোনের ভাইব্রেশনে তৎক্ষণাৎ ঘুম ভাঙলো তার। অপর্ণার মায়ের নম্বর দেখে তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো সে। অপর পাশ থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় কেবল একটি বাক্য ভেসে এলো,” আমার মেয়েটা আর নেই…”।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে