চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪৫+৪৬

0
485

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঁয়তাল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“চিত্রলেখাকে এখন এসব জানিয়ো না অর্ণব। মেয়েটার কাল পরীক্ষা। এসব নিয়ে ভাবলে ওর পরীক্ষা খারাপ হবে।” আশফিনা আহমেদের কথায় মুখ তুলে তাকালো অর্ণব। পরিস্থিতি এতটা দ্রুত এমন বদল দেখাবে কল্পনাও করেনি সে। অপর্ণাকে বোধহয় খানিকটা ঘৃণা করতে শুরু করেছিল সে কিন্তু এমন পরিণতি কখনো চায়নি। অপর্ণাকে তুলে নিয়ে যেতে নওশাদ লোক পাঠিয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন অপর্ণার এক আত্মীয়ের বিয়েতে সবাই গিয়েছিল। অপর্ণা বাসায় একা ছিল, সাথে এক কাজের মহিলা। নওশাদের ভাড়া করা লোকগুলো এসেছিল অপর্ণাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু অপর্ণাকে দেখে তাদের মনে যে কুমতলব ভর করে তার পরিণাম হয়ে উঠে ভয়াবহ। অতর্কিত আক্রমণ চলে অপর্ণার উপর। কাজের মেয়েটাকে বেঁধে রেখে অত্যাচার করা হয়েছে দিন দুপুরে! অত্যাচারের এক পর্যায়ে অপর্ণার নিঃশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসলে ছেলেগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তাদেরকে পালাতে দেখে নিকটস্থ প্রতিবেশী। তিনি চটজলদি অপর্ণাদের বাড়িতে ঢুকে দেখেন এই অবস্থা। এম্বুলেন্সে কল করে অপর্ণাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন অল্প সময়ের মধ্যেই। পাশাপাশি অপর্ণার বাড়ির লোক এবং অর্ণবকেও তিনিই খবর দেন। অর্ণব বুঝতেই পারছে এসবে নওশাদ ছাড়া কারো হাত নেই। আশফিনা আহমেদ কিভাবে এসব খবর পেলেন এখনো জানে না সে তবে অপর্ণার জন্য করুণা হচ্ছে তার। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে আছে। বাচ্চা দুটো অর্ণবের পাশে ঝিম ধরে বসে আছে। তারা বুঝতে পারছে না তাদের মায়ের কী হয়েছে। কাজের মেয়েটার শরীরেও বেশ কিছু ক্ষত। অপর্ণার জ্ঞান না ফিরলে বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। অর্ণব ভেবেছিল অপর্ণার মা এসব নিয়ে একটা কাণ্ড নিশ্চিত বাধাবেন কিন্তু তা হলো না। ভদ্রমহিলা চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সবকিছুর জন্য যেন নিজেকেই আংশিক দায়ী করছেন এখন তিনি। কোনো একসময় চিত্রলেখার সাথেও এমন করার মতলব তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন। আজ সে যন্ত্রণা হারে হারে টের পাচ্ছেন। নিজের কলিজার টুকরো সন্তানের উপর আঁচ আসলে মা সহ্য করতে পারে কখনো? সেখানে চিত্রলেখা মা হারা প্রাণ ছিল, তার মাথা রাখার জন্য তো মায়ের আঁচলটুকুও ছিল না। আজ বড্ড অসহায় লাগছে তার নিজেকে। মেয়ের এ অবস্থার কিয়দংশ দায়ভার নিজ কাঁধে নিয়ে প্রাণত্যাগ করার তীব্র বাসনা যেন জেঁকে বসেছে তাকে।

আশফিনা আহমেদ হাসপাতালে এসেছেন তাও এক ঘণ্টা হতে চললো। তিনি মূলত অর্ণবের সাথে কথা বলার জন্যই এসেছিলেন কিন্তু কথা শেষ হয়নি এখনো। কথা হওয়ার সুযোগও নেই। এমন একটা পরিস্থিতি এখানে, তিনি হুট করে বলতেও পারছেন না এসবের জন্য তিনি তার ভাইকে শাস্তি দিতে চান। অনেকটা গরু মেরে জুতো দানের মতো শোনাবে বিষয়টা তবে আশফিনা আহমেদ এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নওশাদের এ ভুলের ক্ষমা তিনি করবেন না। ক্ষমতা কেবল নওশাদের একার নেই, তারও রয়েছে। নওশাদের চেয়ে বরং কয়েকগুণ বেশি ক্ষমতা এখন তার হাতে। অর্ণবকে এককোণে দাঁড়াতে দেখে আবারো কথা বলার চেষ্টা করলেন আশফিনা আহমেদ।

-অর্ণব?

-দুঃখিত আন্টি, আমি আপনাকে এড়িয়ে যেতে চাইছি না কিন্তু পরিস্থিতিটাই এমন যে ঠিকমতো কথা বলার অবস্থা নেই।

-সমস্যা নেই। আমার শুধু একটা কথাই বলার ছিল। নওশাদের উপর তুমি যাকে নজর রাখতে বলেছো, তার সংগ্রহ করা প্রমাণসহ তাকে আমার সাথে দেখা করতে পাঠিয়ো। আমি চাই নওশাদ তার ভুলের শাস্তি পাক।

-আচ্ছা আন্টি, আমি তৌহিদকে জানাবো।

-এদিকে সামলে নিও। আমি আসছি।

-জ্বী আচ্ছা।

আশফিনা আহমেদ বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না আর। অর্ণব এখনো অপর্ণার কেবিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোথাও একটু হলেও মায়া যেন রয়েই গেছে। অপর্ণার এই অবস্থাটা অর্ণবের মনকে ঠিকই পোড়াচ্ছে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে অর্ণব বোধহয় কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। পরোক্ষভাবে সেও কিছুটা দায়ী এসবের জন্য।

_________________________________

-ভাবী আমার প্রচণ্ড ভয় করছে। মনে হচ্ছে কাল কিছুই পূরণ করতে পারবো না আমি।

-লেখা! ঘুমা তুই এখন। আজকে রাত জাগিস না অন্তত। এতদিন যা পড়েছিস তা যথেষ্ট। আজকে শান্তিতে একটু ঘুমা তাহলেই কাল ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দিতে পারবি।

-আচ্ছা তুমি যাও। আমি ঘুমাচ্ছি।

-আমার সামনেও রঙ্গনকে কল করতেই পারিস!

কথাটা বলে মুখ টিপে হাসলো সাথী। চিত্রলেখার লজ্জারাঙা মুখটা প্রত্যক্ষ না করেই কক্ষ ত্যাগ করলো সে। সাথীর কথাতে চিত্রলেখার যেন আরো মন চাইলো রঙ্গনকে একটু কল করতে। পরক্ষণেই মনে হলো কথা বলার পর যদি আরো অস্থির হয়ে পড়ে সে? তখন তো আরো ঝামেলা বাঁধবে! এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে বেশিক্ষণ থাকতে হলো না চিত্রলেখার। রঙ্গন নিজেই কল করলো। তড়িৎ গতিতে রিসিভ করলো চিত্রলেখা।

-আসসালামু আলাইকুম। ঠিক আছেন ম্যাডাম? নাকি চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন?

-ঠিক আছি।

-তুমি জীবনেও ঠিক নাই! এত ওভারথিংক করলে হয় সোনা? তুমি যা প্রিপারেশন নিয়েছো, সেটা শুধু কাল এপ্লাই করবে। এখনো জেগে আছো কেন? এখনি ঘুমাবা!

-আমার ঘুম আসতেছে না। প্রচণ্ড চিন্তা হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু পারবো না।

-চিত্রলেখা, আমরা হারানোর ভয় তখন পাই যখন আমাদের চাওয়াটা অনেক বেশি হয় আর এ চাওয়াটা খাঁটিও হয়। খাঁটি চাওয়ার ফলাফল আল্লাহ ঠিকই দিবেন। তুমি কেবল নিজের উপর ভরসা রাখো। আমি জানি তুমি ভালোমতোই পরীক্ষা দিবে।

-আমার যদি মেডিকেলে না হয়?

-জীবন শেষ হয়ে যাবে তাতে? মেডিকেল কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সীট শুধু সমাজের সামনে তোমায় একটা যোগ্যতার আসন দেয়। দিনশেষে ঠিকই ডাক্তাররা বেতন না পেয়ে আন্দোলনে নামে। তখন সমাজের মানুষ কোথায় থাকে? জীবনে একটা কিছু এচিভ করতে পারাটা সফলতা বটে তবে তার উপর জীবন মরণ নির্ভর করানো নিছক বোকামি। তোমাকে আমিই বলেছিলাম বড় স্বপ্ন দেখতে কিন্তু এতটাও বড় স্বপ্ন না যেটা ভাঙলে তুমি আর দাঁড়াতেই পারবে না!

-এত কথা কোথায় পান আপনি?

-পরিস্থিতি বা অন্য কোনভাবে হয়তো শিখে গেছি। রঙ্গন শুধু তোমার সামনেই বড্ড বেশি চঞ্চল, অন্যদের কাছে সে বড্ড ম্যাচিউর। বুঝেছো রঙ্গনা?

-বুঝেছি।

-ঘুমাও এখন। সবরকম দুশ্চিন্তা বাইরে ছুঁড়ে পেলে নিদ্রার জগতে পাড়ি জমাও।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখা ফোন রাখলো। কালকের দিনটা বিশেষ। সকালে তাড়াতাড়ি উঠবে সে। একবার অর্ণব ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত। এখানে আসার পর থেকে হাতেগোনা কয়েকবার কথা হয়েছে। কাল একটা বিশেষ দিন। বড় ভাইয়ের দোয়া নেওয়াই উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। অর্ণবের নম্বর ডায়াল করলো চিত্রলেখা। প্রথমবারে রিসিভ করলো না অর্ণব। কিছুক্ষণ পর নিজেই কল ব্যাক করলো সে।

-ভাইয়া, কল ধরলে না যে? ব্যস্ত ছিলে?

-একটু। তুই ঘুমাসনি? কাল না পরীক্ষা তোর?

-তোমার মনে আছে? একবার তো কলও করোনি আমায়! আমি ভাবলাম ভুলেই গেছো।

-তোকে বিরক্ত করতে চাইনি পিচ্চি।

অর্ণব কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়ার্ড বয় পাশে থেকে কিছু একটা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। অর্ণব কোনোরকম পাশ কাটিয়ে এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো। চিত্রলেখা জানতে পারলে বিষয়টা আরো জটিল হবে। তাই অর্ণব যতটা পারছে সবকিছু আড়াল করার চেষ্টা করছে।

-ভাইয়া কোথায় তুমি? কে যেন কিছু একটা বলে উঠলো, ওষুধ না কী যেন একটা। হাসপাতালে তুমি?

-আরে নাহ পিচ্চি। একটূ জ্বর এসেছে তাই ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে এসেছি। তুই অযথা চিন্তা করা বাদ দিয়ে ঘুমা তো।

-আচ্ছা ভাইয়া দোয়া রেখো আমার জন্য।

-ফি-আমানিল্লাহ।

চিত্রলেখা কল কেটে দিলেও তার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। অর্ণব ফার্মেসিতে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। চিত্রলেখার কেন যেন মনে হচ্ছে অর্ণব তার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে কিন্তু কী লুকোচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিছানায় হেলান দিয়ে ভাফতে শুরু করলো সে। ঘুমের আগমন ঘটতে বেশি সময় লাগলো না। কাল এক নতুন যুদ্ধ চিত্রলেখার জীবনের, হতেই পারে এটাই শেষ যুদ্ধ হবে।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
ছেচল্লিশ_পর্ব
~মিহি

“স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ! লেখা তুই খুশি না?” সাথীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা চিত্রলেখা। সে অনেক বেশি খুশি কিন্তু কোথাও একটা সংকোচ-দ্বিধা তাকে আটকে ফেলেছে ভেতরে ভেতরে। ঢাকা মেডিকেলের জন্য চিত্রলেখার গভীরতম স্বপ্ন হয়তো ছিল না কিন্তু রঙ্গনের ইচ্ছে ছিল। রঙ্গন কি মন খারাপ করবে? চিত্রলেখা চাইলেও খুশি হতে পারে না। সাথী ইতোমধ্যে অনিককে মিষ্টি আনতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে চিত্রলেখার মুখে হাসির রেশমাত্র নেই। রঙ্গনকে কল করার সাহসটুকুও যেন পাচ্ছে না সে। চিত্রলেখার উদাসীনতা অনুভব করতে পারলো সাথী।

-লেখা? কী হয়েছে তোর? এত ভালো রেজাল্টের পরও তোর মন খারাপ কেন?

-জানিনা ভাবী। মনে হচ্ছে কিছু একটা কমতি রয়ে গেছে।

-রঙ্গনের সাথে কথা বলেছিস?

-না ভাবী। ও চেয়েছিল আমি যেন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাই। ওর ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকে গেল ভাবী।

-পাগল মেয়ে, আগে কথা বলে তো দেখো।

সাথী মুচকি হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এই দুইজনের প্রেম তাকে নিজের অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনিকের সাথে প্রেমের স্মৃতিগুলি এখনো অম্লান তবুও সংসারের চাপে কোথাও একটা হারিয়ে গেছে সেই পুরনো টান। প্রেমিকের ভালোবাসার সংজ্ঞা আর স্বামীর ভালোবাসার সংজ্ঞা বরাবরই আলাদা। প্রেমিকের বেলায় শুধু প্রেমটাই থাকে, স্বামীর বেলায় থাকে দায়িত্ব। সমুদ্রের নীরব ঢেউ যেমন আচমকা তীরে আছড়ে পরে, তেমন করে সাথীর মনের রদবদলটা ক্ষণিকের মাঝেই ঘটে। অনিকের সেই প্রেমিক রূপটা আজ বড্ড অনুভব করছে সে।

রঙ্গন দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। চিত্রলেখা এখনো কল করলো না কেন এই ভেবে সে অস্থির। রেজাল্ট কী এমন এসেছে! রঙ্গনের চিন্তা কোনভাবেই কমছে না। সামনে থেকে কল করারও সাহস পাচ্ছে না। ইদানিং চিত্রলেখাকে নিয়ে বড্ড ভয় পায় রঙ্গন। মেয়েটার মনের অবস্থা শতভাগ বোঝার চেষ্টা করে সে। রঙ্গনের বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হলো না। চিত্রলেখার কল আসলো। রঙ্গন যেন এই মুহুর্তের অপেক্ষাতেই ছিল। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো সে।

-হ্যালো!

-কী হয়েছে? তোমার কণ্ঠ এরকম কেন? ঠিক আছো তুমি?

-ঢাকা মেডিকেলে আসেনি, স্যার সলিমুল্লাহ’তে এসেছে।

-আলহামদুলিল্লাহ। এত খুশির খবর কেউ এভাবে বলে? এই মেয়ে তুমি পাগল? আমি..আমি কী করবো বুঝতেছি না। এই তুমি বাইরে অনেক করো, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।

-কিন্তু আমার তো ঢাকা মেডিকেলে হয়নি রঙ্গন!

-ঢাকা মেডিকেলের এপ্রোনের রঙ আলাদা? তুমি চেষ্টা করেছো রঙ্গনা, শত চেষ্টার পরও অনেকেই হেরে যায়। তুমি তো তবুও নিজের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়েছো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আমি তোমার বাসার সামনে গিয়ে কল করছি।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখার মন খারাপ ভাব খানিকটা কমে আসলো। সে ভেবেছিল রঙ্গন বোধহয় মন খারাপ করবে কিন্তু ছেলেটা যেভাবে বোঝালো তাতে চিত্রলেখার মন খারাপ টেকার কথাই ছিল না। চিত্রলেখা চটজলদি অর্ণবের নম্বরে কল করলো। রঙ্গনকে কল করার আগেও দুইবাদ সে অর্ণবের নম্বর ডায়াল করেছে। নম্বর বন্ধ বলছে। বাড়িতে ফোন বলতে ঐ এক অর্ণবেরটাই। চিত্রলেখা নিজের ভাইকে খুশির খবর জানাতে উৎসুক অথচ সে কলই রিসিভ করছে না! খানিকটা রাগ হয় তার। তার বড় ভাই তার রেজাল্টের কথা যেন ভুলেই গেছে! চিত্রলেখা ঠিক করলো সেও আর কল করবে না, ভাইয়ের উপর সেও রাগ করবে এবার! কথাটা ভেবে ফোন সাইলেন্ট করে বিছানার পাশে রেখে দিল সে। এখনো সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে তার। সত্যিই কি সাদা এপ্রোনের যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে সে? পরীক্ষার একটা ঘণ্টা চিত্রলেখার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সর্বপ্রথম ইংরেজী আর জিকে অংশটুকু শেষ করেছিল সে। এদিকে বাঁচানো সময়টুকু ফিজিক্সে কাজে লাগিয়েছে বলেই কোনরকম তাড়াহুড়ো হয়নি। শিওর না হয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর সে করেনি তবুও পরীক্ষার হল ছেড়ে বেরোতেই কতরকম আজগুবি চিন্তা যে দানা বাঁধে মাথায়! একবার মনে হয় খাতায় রোল ঠিকমতো পূরণ করিনি, আবার কখনো মনে হয় প্রশ্নের সিরিয়াল অনুযায়ীই উত্তর করেছি তো? এ ভয়টা চিত্রলেখা রেজাল্টের আগ অবধি আটষট্টি ঘণ্টা দিব্যি উপলব্ধি করেছে। খেতে, বসতে, উঠতে সব জায়গায় সে কেবল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে গেছে যেন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। আল্লাহও তার দোয়া কবুল করেছেন। মেয়েটার অসংখ্য স্বপ্নভঙ্গের পর অবশেষে স্বপ্ন পূরণের দরজাগুলো খুলতে শুরু করেছে।

___________________________________

অপর্ণার অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ। একে তো শারীরিক অসুস্থতা, পাশপাশি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছে সে। ডাক্তারদের মতে মেয়েটার বাঁচার কোনো ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই যার কারণে সে কোনভাবেই নিজেকে সুস্থ হতে দিতে চাচ্ছে না। অর্ণব কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। একদিকে তার দুই বাচ্চা, তাদের তো কোনো দোষ নেই! অপর্ণার দিকে তাকিয়ে আজ কেবলই করুণা হচ্ছে অর্ণবের। পাপের শাস্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা স্বীয় চোখে প্রত্যক্ষ করলো সে। অপর্ণা যদি সময় থাকতে একবার বুঝতো! রূপসা কান্না করতে করতে অর্ণবের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ণব উঠতেও পারছে না। ফোনটা পকেটে আছে, সেটা বের করারও সুযোগ হচ্ছে না। কিছু সময় বাদে অপর্ণার মা এসে বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। রূপসা রাদিফকে কোনভাবেই বাড়িমুখো করা যাচ্ছে না। তাই অর্ণবও হাসপাতালেই রয়ে গেছে। তার বাচ্চাদের এখন তাকে প্রয়োজন। প্রয়োজন অপর্ণারও ছিল তাকে তবে এখন অনুভূতিগুলো কেবল রূপসা রাদিফের মা হিসেবে আসবে, স্ত্রী হিসেবে যে মায়া তা আর কখনো জন্মাবে না রঙ্গনের মনে।

________

তৌহিদ খানিকটা ভীত সন্ত্রস্ত অনুভব করছে। প্রথমত আশফিনা আহমেদের বাড়ির আয়তনটাই তাকে অবাক করেছে। দ্বিতীয়ত নওশাদের সাথে আশফিনা আহমেদের সম্পর্কে তাকে একদম সাত তলা থেকে যেন নিচে ফেলেছে। তৌহিদের এখন নিজেরই জানের মায়া হচ্ছে। আশফিনা আহমেদ আবার ভাইকে বাঁচাতে তাকে মেরে টেরে ফেলবে না তো? সোফায় বসে জিকির করতঃ লাগলো তৌহিদ।

আশফিনা আহমেদ সময়ের পাকা হলেও গুণে গুণে সাড়ে চার মিনিট লেইট করলেন তিনি। তৌহিদের মুখোমুখি বসতেই অনুভব করলেন ছেলেটা ভীত হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলার চেষ্টা করলেন আশফিনা আহমেদ।

-তুমি তৌহিদ?

-জ্বী ম্যাম।

-তো উকিলগিরি ছেড়ে গোয়েন্দাগিরিতে কেন?

-প্যাশন ম্যাম!

-আচ্ছা ভালো। নওশাদের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ তোমার কাছে আছে?

-প্রমাণ বেশ অনেকগুলোই আছে। কিছু প্রমাণ শুরুর সময়ের যেগুলো শক্তপোক্ত না তবে এখন যেগুলো প্রমাণ পেয়েছি তাতে কাজ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কমসে কম বছর দশেকের শাস্তি তো কনফার্ম।

-প্রমাণটা কী? কথা না ঘুরিয়ে সরাসরি প্রমাণগুলোর কথা বলো।

তৌহিদ এবার সিরিয়াস হলো। স্পাইডারম্যান কালারের ব্যাগটা থেকে বেশ কিছু পেন ড্রাইভ এবং ফাইল বের করলো সে। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বল রেখা। আশফিনা আহমেদ স্পষ্ট লক্ষ করলেন এ ছেলের সবকিছু নিয়েই আত্মবিশ্বাস অধিক। চোখের চাহনিই বলে দিচ্ছে বিষয়টা।

তৌহিদ একে একে বোঝালো কোন ফাইল, কোন পেন ড্রাইভে কী আছৈ। কয়েকটাতে নওশাদের রাজনৈতিক কারচুপির প্রমাণ আছে তো কিছু পেন ড্রাইভে তার নোংরা চরিত্রের। নিষিদ্ধ পল্লী থেকে শুরু করে গ্রামের সহজ সরল মেয়েরাও তার অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। এসব প্রমাণ তৌহিদের জোগাড় করতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা কেবল সে-ই জানে। বিশেষ করে কোনো মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া অত্যাচার সম্পর্কে জানতে চাইতেও তৌহিদের লজ্জায় মাথা নিচু হয়েছে। তবে নওশাদ সম্পর্কে যত জেনেছে তত আগ্রহ বেড়েছে তৌহিদের। একটা লোক এত কুকর্ম করেও কী ক্লিন ইমেজ নিয়ে চলে! ভাবতেও অবাক লাগে তার।

“এখন বাড়িতে কাজের লোকরা ঘুমিয়ে, কোনো জাগ্রত মানব নেই ভেতরে। তোমায় যদি খুন করে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দিয়ে আসি এ প্রমাণগুলোর কী হবে ভেবে দেখেছো?” তৌহিদ যেন অনুভব করলো আশফিনা আহমেদের কণ্ঠস্বরের এক আকস্মিক পরিবর্তন!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে