চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪৩+৪৪

0
511

#চিত্রলেখার_কাব্য
তেতাল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

রঙ্গন মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছে। একটু পরপর তার হাতে মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে। বরাবরই সে শান্ত স্বভাবের ছেলে কিন্তু একবার রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তা দমানো দায় তার পক্ষে। রঙ্গনের মুখোমুখি বসে আছে আহাদ লোকটা। পাশেই কোচিংয়ের অথোরিটির সবাই। রঙ্গনের কথায় বেশ কিছু মেয়ে দাঁড়িয়ে আহাদের নামে কমপ্লেইন করেছে। কোচিং কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই আহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তবে রঙ্গন যেন বিষয়টা নিয়ে আর ঝামেলা না করে তাই তাকেও বোঝানো হয়েছে। রঙ্গন এসব নিয়ে আর মাথা ঘামালো না। আহাদের উপর তার রাগ তখনো কমেনি। মানুষ কতটা নোংরা হলে নিজের ছাত্রীকে হ্যারাস করার চেষ্টা করে! নিজেকে কোনোরকম শান্ত করে কোচিং ছেড়ে বেরোলো সে। সর্বপ্রথম সাথীর নম্বরে কল করলো সে।

-আপা, লেখার কী অবস্থা? শান্ত হয়েছে?

-হুম। কথা বলছে না সেভাবে তবে পড়ছে এখন।

-ওর কোচিংয়ের ঐ স্যারকে আমি মেরেছি আজ। আরো কয়েকটা মেয়েকে বিরক্ত করতো লোকটা। কোচিং ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। লেখাকে এসব জানানোর দরকার নেই আপা। কোচিং থেকে যদি কোনোরকম কল যায় ও যেন রিসিভ না করে। এখানে যা যা হয়েছে সব যেন ওর আড়ালে থাকে। ও ওর মতো করেই পড়ুক।

-রঙ্গন তুমি মারামারি করেছো? ফুপু জানলে …

-আমিই জানাবো মাকে, তুমি চিন্তা করো না আপা। আমার চিত্রলেখার খেয়াল রেখো। ওর কিছু হলে আমি সত্যিই বাঁচতে পারবো না আপা।

-আমি বুঝি রঙ্গন। তুমি চিন্তা কোরো না।

রঙ্গন কল কাটলো। এখন সন্ধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে কখন ব্রিজের কাছাকাছি চলে এসেছে খেয়াল করেনি রঙ্গন। ব্রিজের সাথে হেলান দিল সে। চিত্রলেখার প্রতি নিজের অনুভূতির প্রখরতা দিব্যি অনুভব করতে পারছে সে। কিছুক্ষণ সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের মায়ের নম্বরে কল করলো সে। আশফিনা আহমেদ যেন ফোনের কাছেই ছিলেন। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলেন তিনি।

-রঙ্গন, ভালো আছো তুমি?

-তুমি কি ফোনের কাছেই ছিলে মা? নাকি জানতে আমার কল আসবে?

-তোমায় কল করবো ভাবছিলাম। ভালো আছো তো তুমি? সকাল থেকে মন কু’ডাক ডাকছিল। তাই ভাবছিলাম এখন বোধহয় অফিস টাইম শেষ, তাই কল করি।

-মা তোমার মনে আছে ছোটবেলায় একবার মারামারি করেছিলাম বলে তুমি সাতদিন আমার সাথে কথা বলোনি?

-হুম মনে আছে।

-কেন মারামারি করেছিলাম মনে আছে?

-হুম। শপিং মলে একটা লোক আমায় ধাক্কা দিয়ে আমাকেই দোষারোপ করছিল বলে।

-আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি বলেই ঐ অল্প বয়সেও নিজের তিনগুণ বয়সী লোকটার গায়ে হাত তুলতেও সংকোচবোধ করিনি। এটা আমার ভালোবাসা ছিল মা। এরপর তোমায় আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম পরিস্থিতি যেমনই হোক আমি মারামারিতে জড়াবো না। আমি সেই প্রতিজ্ঞা দুইবার ভেঙেছি মা। দুইবারই চিত্রলেখার জন্য? মেয়েটাকে কি তবে আমি ভুলতে পারবো মা? তোমায় আমি যতটা ভালোবাসি ততটাই আমি সেই মেয়েটাকেও ভালোবেসে ফেলেছি। আমার দোষ কোথায় মা? মেয়েটা তো নিজের স্বপ্নের জন্য লড়ছে পুরো পৃথিবীর সাথে! আমি যদি ওর পাশে না থাকি ও হয়তো তবুও একা লড়ে যাবে কিন্তু আমি তো তা চাইনি মা। আমি তো সবসময় ওর পাশে থাকতে চেয়েছি।

-রঙ্গন মাথা ঠাণ্ডা করো। চিত্রলেখার পাশে তুমি সবসময় থাকবে। আমি নিজেই তোমাদের বিয়ে দিব। তুমি শান্ত হও।

-তোমার ভাই আমার লেখার দিকে হাত বাড়িয়েছিল মা। ঐ লোকটাকেও আমি মেরেছি। ও ভবিষ্যতেও আমার লেখার ক্ষতি করতে চাইবে। আমি যদি তাকে মেরে ফেলি তুমি আমায় ভুল বুঝবে মা?

আশফিনা আহমেদ চুপ হয়ে গেলেন। রঙ্গনের মাথায় কী পরিমাণ রাগ চড়ে বসেছে তা যেন স্পষ্ট টের পেলেন তিনি। নিজের ছেলের অবস্থাটা অল্প হলেও আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। এখন রঙ্গনকে কিছু বলাই উচিত হবে না তার।

-কিছু বলছো না কেন মা?

-রঙ্গন, চিত্রলেখার তোমাকে প্রয়োজন। তুমি ওর প্রতি নজর রাখো। নওশাদ অন্যায় করেছে, তার শাস্তি আমিই তাকে পাওয়াবো। তুমি এসব বিষয়ে জড়িয়ো না। তুমি লেখার পাশে থাকো।

রঙ্গনের মাথা বোধহয় খানিকটা ঠাণ্ডা হলো। এ প্রসঙ্গ থেকে সরে বাড়ির খোঁজখবর নিলো সে। আরো নানান কথা বলে মিনিট পনেরো পরে কল রাখলো। রঙ্গন কল কেটে দিতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আশফিনা আহমেদ। নওশাদের মুখোমুখি তিনি রঙ্গনকে হতে দিতে পারেন না। রঙ্গন নওশাদের বড়সড় ক্ষতি করতেই পারে তবে নওশাদ রঙ্গনের যে ক্ষতিটা করবে তা হলো রঙ্গনের জন্মপরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা। এই একটা সত্য আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে আশফিনা আহমেদ ক্লান্ত। তবুও এ বিষয়টা তিনি রঙ্গনের সামনে আসতে দিতে চান না। তার জন্য যা করতে হয় তিনি করবেন।

_______________________

-বারান্দায় আসো।

-আপনি এই রাতে এখানে কেন?

-চুপচাপ বারান্দায় এসো। তোমায় দেখবো একবার।

রঙ্গনের আকুতিটা যেন চিত্রলেখার অন্তর ফালা ফালা করে চলে গেল। কেন সে এই ছেলেটাকে এত কষ্ট দিচ্ছে? চিত্রলেখার মন মাঝেমধ্যেই বলে যদি রঙ্গনের সাথে তার আরো দেরিতে দেখা হতো! তবেই বোধহয় ভালো হতো। এত অপেক্ষা তার নিজেরও ভালো লাগছে না। গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। নিচে তাকাতেই দেখতে পেল রঙ্গন তার বারান্দার দিকেই তাকিয়ে আছে। পড়নে ফরমাল শার্ট প্যান্ট কিন্তু শার্টের এক হাতা গোটানো আবার অপরটা ছেড়ে দেওয়া। ইন করা শার্টের একাংশ বেরিয়ে আছে। এমন ছন্নছাড়া রঙ্গনকে কখনো দেখেছিল কিনা মনে করতে পারছে না চিত্রলেখা।

-আপনার কী হয়েছে রঙ্গন? একে তো এই শীতের মধ্যে সোয়েটার ছাড়া এসেছেন, তার উপর এমন অবস্থা কেন? কিছু হয়েছে?

-আমায় একটা প্রমিজ করো।

-কী?

-ছোটখাটো যে রকম সমস্যাই হোক না কেন, তুমি আমাকে জানাবে।

-আচ্ছা জানাবো।

-তোমার কোচিংয়ের স্যারকে আমি আজ মেরেছি। আপাকে নিষেধ করেছিলাম কথাটা তোমাকে জানাতে কিন্তু আমি নিজেই জানালাম কারণ তুমি যেন নিজেকে একা না ভাবো। তোমার উপর একটুও আঁচ আসলে তার পরিণতি আমি ভালো রাখবো না রঙ্গনা! তবে এটা ভেবো না আমি সবসময় আসবো। আমি থাকবো তোমায় যুদ্ধ শেখাতে, তোমার লড়াইটা আমি লড়বো না। এবার যা করেছি রাগের মাথায় তবে পরবর্তীতে যদি এমন পরিস্থিতি আসে, চুপচাপ চলে না এসে মেরে রেখে আসবে। বুঝেছো?

-হুম। এখন আপনি উপরে আসেন। আমি ভাবীর হাত দিয়ে চাদর পাঠাচ্ছি।

-তুমি নিজের দিকে তাকাও তো! তোমার শীতের কাপড় কোথায়? সোয়েটার সব বেঁচে দিছো? যাও নিজে আগে সোয়েটার পড়ো! আর চাদর দিতে চাইলে নিজে আসবা। আমি অপেক্ষা করছি।

চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সারাদিনের উদাসীনতা যেন এক মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল। একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিজের চাদরটা হাতে নিল সে। খুব সাবধানে ড্রয়িং রুমে খেয়াল করলো। অনিক এখনো আসেনি আর সাথী রান্নাঘরে ব্যস্ত। গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো চিত্রলেখা। বাড়ির পেছনের অংশটা গাছগাছালিতে ভরা, অনেকটা বাগানের মতো জায়গা। রঙ্গন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা সতর্ক পায়ে রঙ্গনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। রঙ্গনের চোখে এখনো রাগের ঝাঁঝ যেন বহাল! তবে চিত্রলেখাকে ক্ষণিক সময় দেখার পর তার চাহনি স্বাভাবিক হয়ে এলো। আগের চঞ্চল রঙ্গন যেন ফিরলো।

-চাদর নেন। বাচ্চা এখনো আপনি? এভাবে এসেছেন! ঠাণ্ডা লাগলে?

-ঠাণ্ডা লাগলে তুমি সেবা করতে! এই বাহানায় তোমায় পাশে পাওয়া যেতো।

-বাচ্চামি রেখে বাসায় যান।

-সারাদিন এত মন খারাপ ছিল, আমায় একবার কল দেওয়া যেত না? তোমার মাথায় একটা বিষয় ঢুকে গেছে যে প্রেম করলে কোনদিন ভালো করা যায় না! লেখা আমরা বাচ্চা না, তোমার ভাই ভাবী যেমন তোমার স্বপ্নপূরণে পাশে আছে আমিও তেমন। আমার সাথে দিনরাত তোমায় কথা বলতে হবে না। একটু মন খারাপ হলে আমায় তুমি কল করতেই পারো। আমি তোমার বন্ধু এটা ভুলে যেও না। তাছাড়া প্রাইভেটে পড়ি বলে এতটাও খারাপ স্টুডেন্ট না যে সমস্যা সমাধান করে নেওয়ার বাহানায় একটু কলও করা যাবে না!

-আচ্ছা? ঠিক আছে এরপর সব সমস্যা আপনার থেকেই সলভ করে নিব।

-আমরা বিশেষ মানুষের জন্য সবসময় নিয়ম ভাঙি রঙ্গনা। তুমিও নিয়ম ভাঙার দলে নিজেকে ক্ষণিকের জন্য রাখতে পারো।

-অনেক হয়েছে। ঠাণ্ডা লাগবে, বাসায় যান এখনি।

-চলে যাবো? বিদায় করার এত তাড়া? আচ্ছা বুঝলাম। যাচ্ছি।

রঙ্গনের মেকি অভিমান বুঝে খানিকটা হাসলো চিত্রলেখা। তবে বিদায় শব্দটা যেন তাকে উদাসীই করে তুললো। চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো তার। চিত্রলেখা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রঙ্গন পিছু ফিরে চিত্রলেখার চোখে হাত রেখে কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল।
“আমার স্পর্শ তোমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর দুঃসাহস না করুক তবে তোমার মনে উদাসীনতার আগমনের পথে দেয়াল হয়ে থাকুক।” কথাটুকু বলে কয়েক ন্যানোসেকেন্ডের মাঝেই যেন রঙ্গন চলে গেল। চিত্রলেখা বুঝতেও পারলো না কী থেকে কী হলো। সে বিস্মিত হয়ে তখনো সেখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রঙ্গনের প্রস্থানের পানে চেয়ে রইলো।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চুয়াল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

আজ রঙ্গনের জন্মদিন। সপ্তাহ তিনেক হলো রঙ্গনের চিত্রলেখার সাথে কথা হয় না। রঙ্গন প্রতিমুহূর্তেই মনে করে চিত্রলেখার কথা কিন্তু আজকের দিনে মনটা যেন একটু বেশিই খারাপ হয়ে আছে। চিত্রলেখার জন্মদিনের জন্য অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল কিন্তু চিত্রলেখা আচমকা সাথীকে নিষেধ করলো তার জন্মদিনে কোনোরকম অনুষ্ঠান না করতে। এতে অবশ্য সাথী বিশেষ অবাক হয়নি। জন্মদিন শব্দটাই চিত্রলেখার পছন্দ না তবুও সে চেয়েছিল একটু কিছু করতে কিন্তু চিত্রলেখার নিষেধাজ্ঞার পর আর সাহস পায়নি। জন্মদিন নিয়ে মেয়েটার স্মৃতি মোটেও সুখকর নয়। চিত্রলেখার পাঁচ কি ছয় বছর বয়সের সময় জন্মদিনে মেয়েটা তার বাবার হাতে বেধড়ক মার খেয়েছিল। এরপর থেকেই এ দিনটা তার জন্য অভিশপ্ত। ঘটনাটা সাথী রঙ্গনকে বুঝিয়ে বলেছিল তবুও রঙ্গন মানতে পারেনি। একটা ঘটনাকে এভাবে বয়ে বেড়াবে এটার কোনো মানে নেই। তবে সাথীও রঙ্গনকে নিষেধ করে। চিত্রলেখার জন্মদিন পালন করতে না পারার খারাপ লাগাটা যেন আজ কয়েকগুণ বিষিয়ে তুলছে রঙ্গনের মনটাকে। চাইলেও আজ কোনোকিছুতে মন বসছে না তার। অফিস থেকে ছুটি নিতে চেয়েছিল তবে ফ্রি থাকলে মন আরো খারাপ হবে। অফিসে এসে মন ভালো হওয়া তো দূর উল্টো আরো খারাপ হয়ে আসলো। একেকজন এসে উইশ করছে, রঙ্গনের মনের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। জন্মদিন শব্দটার উপর যেন এখন তারও রাগ উঠে গেছে। কাজের উপরও ঠিকঠাক মনোযোগ আসছে না। অফিস টাইম শেষ ছয়টায়। পাঁচটার পর রঙ্গনের মন কোনভাবেই টিকলো না। মন অদ্ভুত রকমভাবে আনচান করছে। রঙ্গনের ফোনটা অনেকটা আচমকাই বেজে উঠলো। চিত্রলেখার নম্বর ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। রঙ্গন চোখ কচলালো। সত্যিই চিত্রলেখা কল করেছে! তড়িঘড়ি করে চল রিসিভ করলো সে।

-লেখা, কিছু হয়েছে? তুমি এই অসময়ে কল? ঠিক আছে সব?

-শশশশ! এত বেশি বোঝেন কেন? আমি কি এমনি কল করতে পারি না? অফিস টাইম শেষ কখন?

-ছয়টা!

-এখন বেরোতে পারবেন একটু?

-কোথায় আসতে হবে?

-আপনার অফিসের নিচে আমি অপেক্ষা করছি!

-তুমি এখানে এসেছো? কখন? কিভাবে?

-এতগুলো প্রশ্ন একসাথে? নিচে আসেন বলতেছি।

রঙ্গন কাজগুলো গুছিয়ে রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে নামলো। চিত্রলেখা পার্কিং সাইটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গনের দৃষ্টি তার উপর পড়তে কয়েক ন্যানোসেকেন্ড লাগলো মাত্র। চিত্রলেখাকে দেখে রঙ্গনের হৃদস্পন্দন যথানিয়মে কম্পন তুললো। মেয়েটাকে যখনই দেখে সে, তার হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি যেন অনিবার্য। রঙ্গন জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

-এখন বলো এখানে তুমি হঠাৎ?

-এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম তাই ভাবলাম দেখা করি একটু। তোমার বাসাটা কোথায়? দেখাও তো।

-তুমি বাসায় যাবে? পরে নিয়ে যাবো কখনো, এখন তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি চলো।

-বাসায় নিয়ে যাবেনা সরাসরি বললেও চলতো।

-কেন নিয়ে যেতে চাচ্ছিনা তা বুঝতেছো না? অন্য কোথাও নিয়ে যাই?

-হুম চলো। তোমার চেনা জায়গায় অনেক ঘুরেছি, এখন আমার পছন্দের একটা জায়গায় চলো।

-কোথায়?

-আসো।

চিত্রলেখার পিছু পিছু চলতে শুরু করলো রঙ্গন। চিত্রলেখা রিকশা ধরলো। রঙ্গন আদেশমতো চিত্রলেখার পাশাপাশি বসলো। চিত্রলেখার পড়নে সাদা নীলের সংমিশ্রণে একটি গোল জামা। রঙ্গনের মনে হচ্ছে আজ পৃথিবীর সমস্ত শুভ্রতা এসে চিত্রলেখাকে ছুঁয়েছে। রঙ্গন এ শুভ্রতায় কোনো কলঙ্কের দাগ লাগাতে পারে না। রিকশা বেশ ধীরগতিতে চলছে। রঙ্গনের অবশ্য বেশ ভালো লাগছে। চিত্রলেখার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সে। মেয়েটার চুল হালকা বাতাসে উড়ছে। বারংবার লেখা কানের পিছে তা গুঁজে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। রঙ্গন দৃশ্যটা উপভোগ করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকার বাহানায় কখন যে রিকশা থেমেছে সেদিকেও ধ্যান নেই তার। চিত্রলেখা নামাতে রঙ্গনের ঘোর কাটলো। নিজের খামখেয়ালিপনার জন্য নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো।

-কী জনাব? ধ্যানজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন? আসুন নৌকায় উঠবো।

-নৌকা? এখন? সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তো। নৌকা কোথায় পাবে?

-আসবেন চুপচাপ?

রঙ্গন কথা না বাড়িয়ে পিছু পিছু গেল। চিত্রলেখার এক নাবিকের সাথে কী যেন কথা বললো। অতঃপর রঙ্গনকে ডেকে নিল সে। রঙ্গন খানিকটা বিস্মিত হয়ে নৌকার দিকে এগোলো। চিত্রলেখার হাবভাব আজ বড্ড অন্যরকম লাগছে রঙ্গনের। নৌকায় একপাশ হয়ে বসলো দুজন। রঙ্গন খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলেও চিত্রলেখা রঙ্গনের এক হাত নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিলো।

-দেখেছেন রঙ্গন তারারা আমাদের জন্য মিটিমিটি করছে?

-চাঁদ ছেড়ে তারার দিকে তাকানোর বোকামি কিভাবে করি বলো তো রঙ্গনা! যেখানে চাঁদ আভায় স্পর্শ করে আছে, আমি কি এমন যে চাঁদকে উপেক্ষা করে তারার দিকে দৃষ্টিপাত করবো?

-কাব্যচর্চা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

-মোটেও না! আজ হঠাৎ একসাথে তারাবিলাস করতে ইচ্ছে হলো যে? বই বেচারা প্রত্যাখ্যান করেছে আমার প্রেয়সীকে?

-উহু। শুভ জন্মদিন রঙ্গন। এই তারাগুলোর চেয়েও আপনার জীবন উজ্জ্বল হোক।

-তুমি তো জন্মদিন পছন্দ করো না!

-আমার বেলায় সেটা। আপনার বেলায় না! তাছাড়া আজ বইগুলো আসলেই আমাকে তিরস্কার করেছে। আমার কেবলমাত্র সাদা এপ্রোন দরকার। ঢাকা মেডিকেলে টপ করতে চাইনা আমি। পাগলের মতো সেদিকে আর ছুটতেও চাইনা। আমার রঙ্গনকে চাই, আমার পাশে সবসময় আমার রঙ্গনকে চাই।

-স্বপ্ন সবসময় বড়ই দেখতে হয় রঙ্গনা। স্বপ্ন না দেখলে তা পূরণ হবে কী করে? তুমি না চাইলেও আমি চাই তুমি মেডিকেলে টপ করো! এতে তোমার উপর আনীত সব মিথ্যে অভিযোগ মুছে যাবে। আমি সবসময় আছিই, স্বপ্নের পেছনে ছোটো তুমি।

-সিরিয়াস আলাপ থাকুক এখন?

-যথা আজ্ঞা রানীসাহেবা। বলেন কী হুকুম।

-জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে একটা গান শোনাতে হবে এখনি।

-উমম..যা আদেশ করবেন শিরোধার্য!

রঙ্গন একবার আকাশের দিকে তাকালো। অতঃপর চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করলো,

“এই মায়াবী চাঁদের রাতে, রেখে হাত তোমার হাতে
মনের এক গোপন কথা তোমায় বলতে চাই…”

চিত্রলেখা আনমনেই রঙ্গনের কাঁধে হেলান দিল। মুহূর্তগুলো থেমে যাক! এভাবেই রঙ্গনের পাশে বসে আজীবন অতিবাহিত করুক সে। চিত্রলেখার ভাবনায় কেবল এটাই ঘুরপাক খেতে থাকে। রঙ্গন বোধহয় বুঝতে পারলো চিত্রলেখার মনের অবস্থাটা কিন্তু চাইলেই সবসময় সব সম্ভব হয় না। এই মুহূর্তটুকুও শেষ হওয়ার ছিল।

-তোমায় রেখে আসি চলো।

-আমি যেতে পারবো।

-তুমি যেতে পারলেও আমি যেতে দিব না। তোমার সাথে আরো কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত করার সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইনা।

-আপনি আন্টিকে কল করেছেন আজ?

-উহুম। মা-ই কল করবে তবে সবার শেষে। মা বলে প্রথমে জন্মদিনে উইশ করার চেয়ে শেষে উইশ করাটা বেশি মনে থাকে। এতে মায়া বেশি থাকে।

চিত্রলেখা মুচকি হাসলো। রঙ্গন ছেলেটা বড্ড ভাগ্যবান। আশফিনা আহমেদের মতো একজন মা সে পেয়েছে। চিত্রলেখার মাঝে মাঝে বড্ড আফসোস হয়। আশফিনা আহমেদ হয়তো কখনোই তাকে মেনে নিবেন না। তখন রঙ্গনের সাথে তার সম্পর্কে যদি ভাটা পড়ে? চিত্রলেখা তা কোনোক্রমেই চায় না। রঙ্গন না জানুক, চিত্রলেখা তো ডানে আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে ঠিক কতটা ভালোবেসে আগলে রেখেছেন। এ ভালোবাসার কাছে চিত্রলেখার ভালোবাসার মূল্য কতটুকূ? যদিও ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না তবুও চিত্রলেখা আন্দাজ করতে পারে আশফিনা আহমেদের ভালোবাসা এক সুবিশাল সমুদ্রের ন্যায়। রঙ্গন সে সমুদ্রে আজীবন ভেসে বেড়াতে পারবে আর চিত্রলেখার ভালোবাসা বোধহয় ছোট্ট একটা নদী। এ নদীর স্রোতে ভেসে কতদূরই বা যেতে পারবে রঙ্গন? অবান্তর সব প্রশ্নে চিত্রলেখার মস্তিষ্কে জ্যাম বাঁধে। চিত্রলেখার আনমনা রূপটা রঙ্গনেরও নজর এড়ায় না। রঙ্গনের ইচ্ছে করে আলতো করে চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে স্পর্শ করে মেয়েটাকে ভড়কে দিতে।

চলবে …

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে