চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৪১+৪২

0
520

#চিত্রলেখার_কাব্য
একচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখার ঘরের দরজা বন্ধ সকাল দশটার পর থেকে। সাথী বার কয়েক দরজায় ঠকঠক করেও কোনো লাভ হয়নি। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। সাথী খানিকটা হলেও ভয় পাচ্ছে। অনিককে ইতোমধ্যে কল করেছে সে। এইচএসসির রেজাল্ট নিয়ে চিত্রলেখা মন খারাপ করেছে তা সাথীও বুঝতে পারছে। জিপিএ ফাইভ পাওয়াটা চিত্রলেখার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, সেখান থেকে ৪.৮০ পাওয়াটা সে কোনোভাবেই আশা করেনি। একরকম মন ভেঙেছে তার। চিত্রলেখা ঠিকই উপলব্ধি করছে এখানে নওশাদের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কি কেউ ভালো ফলাফল করেনি? করেছে! এখানে ব্যর্থতা তার। ইন্টার লাইফের শুরুর সময়টা নষ্ট না করলে বোধহয় এখন আফসোস করতে হতো না। চিত্রলেখার চোখ ভিজে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মনে অদ্ভুত রকমের সব কুচিন্তা খেলা করছে। তার সাথেই এমন কেন হলো? সব স্বপ্ন যেন চোখের সামনে ধূলিসাৎ হতে দেখছে সে!

সাথী প্রায় আধঘণ্টার দরজা ধাক্কা দিয়েও চিত্রলেখার সাড়াশব্দ পেল না। এদিকে অনিকের নম্বর বন্ধ। কোনো উপায় না পেয়ে সে রঙ্গনের নম্বরে কল করলো। রঙ্গন অফিসে ছিল, ফোনের দিকে খেয়াল করেনি সে। একটু পর সাথীর নম্বর থেকে মিসড কল দেখে তৎক্ষণাৎ সাথীর নম্বর ডায়াল করলো সে। রিসিভ হতে সময় লাগলো না।

-আপা বলো, কী হয়েছে? আজ তো রেজাল্ট দিয়েছে, লেখা…

-লেখা দরজা খুলছে না রঙ্গন, প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে ওকে ডাকছি কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

-আপা তুমি নক করতে থাকো। আমি আসছি। আর ভাইয়াকেও কল করো। দরকার পড়লে দরজা ভাঙাও আপা প্লিজ। আ..আমি আসছি।

রঙ্গন আর কিছু বলতে পারলো না, কল কেটে দিল। সাথী দরজায় শব্দ করেও লাভ হচ্ছে না। অনিকের অফিস কাছেই কিন্তু সাথী চিত্রলেখাকে রেখে সেখানে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। যদি মেয়েটা কিছু একটা করে বসে? সাথী কেবল আল্লাহ আল্লাহ করে চলেছে। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

_________________________

রঙ্গনের আসতে কাঁটায় কাঁটায় সাত মিনিট লাগলো। ঠিক কোন স্পিডে বাইক চালিয়ে সে এসেছে তা সে নিজেও মনে করতে চাইলো না। অনিকও ততক্ষণে সাথীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরে আসার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। রঙ্গন কোনো কথা না বলেই জোরে জোরে দরজায় শব্দ করতে লাগলো। চিত্রলেখার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রঙ্গন দেরি করলো না। বেশ জোরেই দরজায় ধাক্কা দিতে থাকলো। অনেকটা জোরে ধাক্কা দেওয়াতে ভেতরের ছিটকিনি ভেঙে যেতে সময় লাগলো না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রঙ্গনের চোখ পড়লো চিত্রলেখার উপর। দেয়ালের সাথে মিশে মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে মেয়েটা। আশেপাশের কোনো শব্দই যেন তার কানে যাচ্ছে না। রঙ্গন কিংবা সাথীর ভেতরে প্রবেশেও যেন সে মোটেও অবাক হয়নি। রঙ্গনের কেন যেন মনে হচ্ছে চিত্রলেখা এখনো রেজাল্টের বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সে নিঃশব্দে চিত্রলেখার পাশে বসলো। তাতেও চিত্রলেখার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। রঙ্গন চিত্রলেখার গালে হাত রাখলো। নোনা জল চিত্রলেখার চোখ বেয়ে গড়াতে সময় নিলো না। রঙ্গনের তখন পরিস্থিতি বিবেচনার সময় নেই। সে তড়িঘড়ি করে চিত্রলেখাকে বক্ষপিঞ্জরে আগলে ধরলো শক্ত করেই। চিত্রলেখার কান্না তখন বাঁধ ভাঙলো। আর্তনাদের করুণ স্বরে সাথীরও করুণা হতে লাগলো। জিপিএ ফাইভ জিনিসটাকে এ সমাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে ফেলেছে তা যেন সাথীর চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানো হলো। চিত্রলেখা কবে থেকে এ প্রচলিত সমাজের বাধাধরা মানতে লাগলো? সে তো বরাবরই নিয়ম ভঙ্গকারী হতে চাচ্ছে তবে কেন এখন এ সামান্য শিকলে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার অভিপ্রায়?

রঙ্গন ধীরে ধীরে চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চিত্রলেখাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সে।

-লেখা শান্ত হও, কিচ্ছু হয়নি। এভাবে কান্না করার মতো কিচ্ছু হয়নি!

-আমি পারবো না রঙ্গন। আমি যেখানে এইচএসসিতেই পারলাম না সেখানে এডমিশনে কিভাবে পারবো? আমার দ্বারা হবে না! আমি ব্যর্থ।

-লেখা! তুমি পাগল হয়েছো? এইচএসসি আর এডমিশন এক হলো? তুমি ভালোমতো প্রস্তুতি নিয়েছো, তুমি পারবে। তুমি এইটার চিন্তা বাদ দাও। কত মার্ক কাটা যাবে? ৫ বা ৬? এটা বাদেও তুমি পারবে। আমি বিশ্বাস করি তুমি পারবেই।

-আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না রঙ্গন। আমি পারবো না।

-আমি এইচএসসিতে ৪.৪৮ পেয়েছিলাম। সেই দুঃখে পাবলিক পরীক্ষায় দিইনি। দিলে কি আমি পেতাম না চান্স? আমি ভয় পেয়েছিলাম আর এই ভয়টাই আমাকে দুর্বল করেছে। ভয়কে নিজের উপর ভারি হতে দিও না লেখা। আমি, আপা, ভাইয়া সবাই আছে তোমার পাশে। তুমি পারবেই। তোমাকে জবাব দিতে হবে সবাইকে। তোমার স্বপ্ন তোমায় পূরণ করতেই হবে!

চিত্রলেখা শান্ত হলো খানিকটা। চোখের পানি মুছতেই খেয়াল হলো সে এখনো রঙ্গনের বুকের মাঝে আবদ্ধ। সাথীও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা তৎক্ষণাৎ রঙ্গনের বুক থেকে সরে গেল। রঙ্গন মাথা চুলকাতে চুলকাতে উঠে দাঁড়ালো।

-রঙ্গনা, তোমার রেজাল্টের চিন্তা একদম বাদ এখন। তুমি শুধু এডমিশনে মন দিবা আর এখন থেকেই। রাগ আর মন খারাপের সময় পড়াশোনা সবসময় ভালো হয়। সুতরাং এখন থেকেই পড়তে বসো আর আমি এই সময়টাতে দূরে থেকেই প্রতিমুহূর্তে পাশে থাকবো। তুমি শুধু লড়ে যাও, রঙ্গন আছে আর তোমারই থাকবে।

চিত্রলেখার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। তার চোখের দ্যুতি বলে দিল সে নিজেকে প্রস্তুত করছে ভবিষ্যতের যুদ্ধটার জন্য। রঙ্গন বেস্ট অফ লাক জানালো কেবল। চিত্রলেখার চাহনি আর কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে পাগল করতে উদ্যত হবে, আপাতত সে উন্মাদের কোঠায় নাম লেখাতে চায় না।

অনিকের আসার আগেই রঙ্গন বেরিয়ে গেল। অনিক এখনো জানেনা রঙ্গন চিত্রলেখার সাথে এখনো যোগাযোগ রেখেছে। বিষয়টা এমন হুট করে না জানাটাই ভালো। অনিক এসে দেখল বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সে যারপরনাই অবাক হলো। সাথী যেভাবে ভয় দেখিয়ে তাকে বাড়িতে এনেছে তাতে সে অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে সে আর সেসব কথা তুললো না।

_______________________

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। চিত্রলেখা তখনো পড়ছে। রঙ্গন ঠিকই বলেছিল। রাগ আর মন খারাপ এ দুইটা জিনিস মানুষের পড়াশোনায় মনোযোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘসময় ধরে পড়ার ফলে চিত্রলেখার ঘাড়ে খানিকটা ব্যথা শুরু হলো। বিশ্রামের জন্য বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। অনেকদিন সুবহার সাথে কথা হয়না ভেবে সুবহার নম্বর ডায়াল করলো সে। বারকয়েক রিং হওয়ার পর সুবহা কল রিসিভ করলো।

-কেমন আছিস লেখা?

-আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোর খবর বল।

-আমিও ভালো। বাবা আগের থেকে একটু সুস্থ। এখানে নিয়ে এসেছি। বলা যায় নতুন সংসার এটা। রেজাল্ট কেমন আসছে তোর?

-৪.৮০। তোর কী অবস্থা?

-৪.১৭! তুই তো ভালোই করেছিস। সামনে তো মেডিকেল এক্সাম তোর, ভালোমতো প্রস্তুতি নে।

-তুই তো ঢাবিতে পরীক্ষা দিবি?

-আমার রাবিতে পড়ার শখ রে এখন। এত সুন্দর জায়গা রাজশাহী। এটা ছেড়ে ঐ ঢাকার কোলাহলে যেতে ইচ্ছে করবে বল।

-তাও তো কথা। তুমি তো এখন সংসারী নারী। তোমার কি আর ইচ্ছে করে সংসার ফেলে কোথাও যেতে?

-জুতো চিনিস?

-হ্যাঁ চিনি তো। কেন তুই চিনিস না?

-ধূর! এত রাতে জেগে আছিস? পড়ছিস তাইনা?

-হুহ। তুইও পড়তেছিস?

-হ্যাঁ।

-আচ্ছা পড়, পরে কথা হবে।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখা কল কেটে ফোন রাখবে ঠিক সে সময় লক্ষ করলো হোয়াটসঅ্যাপে আবার একটা মেসেজ এসেছে। তবে এবার আননোন নম্বর থেকে। মেসেজ ওপেন করলো চিত্রলেখা। টাইপিংটা বডি চেনা চেনা লাগছে। লেখাটা পড়তে শুরু করলো সে,

“এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ মিস করেছো? ব্যাপার না সোনা, ভাব যা বেশি তোমার এইটুকু নিচে নামা দরকার ছিল। বেশি উড়ো না বাবু, আচ্ছা? মেডিকেলে তোমার চান্স পাওয়া আমি নিশ্চিত করবো শুধু আমার হও একবারে। তুমি মেডিকেলে সীট পাবে আর আমি তোমাকে। ডিল খারাপ না। ভেবে দেখো বেবি ডল!”

চিত্রলেখার গা গুলিয়ে উঠলো মেসেজটা দেখে। সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে এই নোংরা মেসেজটা তাকে কে করতে পারে।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
বিয়াল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“দেখো তোমার কাছে কোনো সলিড প্রমাণ নেই। কেবলমাত্র তোমার একটা কথার উপর ভিত্তি করে আমরা একজন রেসপেক্টিভ টিচারকে কেন কোচিং থেকে বের করবো?” এ প্রশ্নের সম্মুখে চিত্রলেখা সত্যিই বলার মতো কিছু পেল না। সে একজন সাধারণ শিক্ষার্থী, তার কাছে পাকাপোক্ত কোনো প্রমাণ নেই। আগের নম্বরের মেসেজগুলোও সে ডিলিট করে ফেলেছে। বাস্তবিক অর্থে সে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ দায়ের করছে। আর কিছু বললো না চিত্রলেখা। বোকামিটা সে করেই ফেলেছে। এখন তা শোধরানোর সময় নয়। আহাদ লোকটাকে পরাস্ত করার সময় সামনে সে আরো পাবে তবে এই দুই মাস তাকে ভর্তিযুদ্ধ জয় করতে হবে। সাদা এপ্রোন আর তার মাঝে এখন যত বাধা আছে সব অতিক্রম করতে হবে তাকে। চিত্রলেখা টিচার্স কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো চিত্রলেখা। আহাদও সেখানে উপস্থিত ছিল। এবার তার কর্কশ রূপটা খানিকটা ফুটে উঠলো কথাবার্তায়।

-স্যার, এই মেয়েটা আমার উপর মিথ্যা দোষারোপ করেছে। অবশ্যই আমার উপর তার কোনো রাগ রয়েছে। আপনার অনুমতি থাকলে আমি তার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।

চিত্রলেখা ভ্রু কুঁচকালো। সিনিয়র লোকটা মাথা নেড়ে চলে গেল। চিত্ কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোকটা সব বুঝেও কিছু বলছে না অসম্মান হবে এই ভয়ে। আহাদের অগ্নিদৃষ্টি চিত্রলেখার বড্ড বিরক্ত লাগলো। কথা বলার রুচিটুকুও অবশিষ্ট নেই তার। এমনিতেই রেজাল্টের পর থেকে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে মারাত্মকভাবে। এখন এসব বিষয়গুলোতে জড়ানোর ইচ্ছেও নেই তার। চিত্রলেখা চলে যেতে উদ্যত হলো আহাদ শক্ত করে তার হাতটা ধরলো এবং অপর হাতটা দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। চিত্রলেখা বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকালো সেদিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহাদের নোংরা হাত তাকে বিশ্রিভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। চিত্রলেখা ছিটকে সরে গিয়ে পরক্ষণেই সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল আহাদের গালে। শব্দটা এতটাই তীব্র শোনালো যে কেবিনের বাইরে থেকে সিনিয়র শিক্ষকটির আসতে সময় লাগলো না। কেবিনের পরিস্থিতি দেখে তিনি যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন।

-আহাদ কী হয়েছে তোমার?

-স্যার, এই মেয়ে পাগল! আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করাতে আমায় থাপ্পড় মেরেছে। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মতো বেয়াদবি যে করতে পারে সেই মেয়ের কথা আপনি বিশ্বাস করবেন স্যার?

-আমি তো প্রথমেই বুঝেছি এই মেয়ের সমস্যা আছে। এই মেয়ে! পড়াশোনা না করে এডমিশনে ভালো করতে চাও? বাপরে শখ! এসবের জন্য শিক্ষকদের নোংরা অপবাদ দিয়ে তাদেরই দোষ দাও, তোমার মতো মেয়ের কোথাও চান্স হবেনা।

চিত্রলেখার হাত পা যেন জমে গেছে। তোকে কেবিনে বেশ ভীড় জমেছে। চিত্রলেখা তখন আড্ডার বিষয়বস্তুতে রূপ নিয়েছে। অন্তর্মুখী চিত্রলেখার কাছে এত ভীড় স্বাভাবিক নয়। বরাবরই তার চিরায়ত দুর্বল রূপটা এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। চিত্রলেখা কোনো উত্তর দিল না। আহাদের মুখের বিশ্রি হাসি বলে দিচ্ছে লোকটা কতটা নোংরা একটা চাল চেলেছে। চিত্রলেখা কেবল নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

-লেখা তুই কেন কিছু বললি না? তোর কি একটাবার সব ক্লিয়ার করা উচিত ছিল না?

-বাদ দাও ভাবী। ঐ রকম নোংরা লোকের নাম নিতেও আমার নিজের উপর ঘৃণা লাগছে। ওরা নাকি শিক্ষক! ছিঃ!

সাথী কথা বাড়ালো না। চিত্রলেখার মনের অবস্থা অল্প হলেও বুঝতে পারছে সে। রঙ্গনকে এসব ঘটনা জানাবে কি? জানানো উচিত হবে। ভাবতে ভাবতেই সে ফোনের দিকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ চোখ কপালে উঠলো তার। রঙ্গন কল করেছিল। ফোন ইয়ারফোনের সাথে কানেক্টেড থাকায় অটোম্যাটিক রিসিভ হয়েছে। সাথী ভয়ে ঢোক গিলল। ইয়ারফোনটা খুলে ফোন কানে ধরলো সে। কিছু বলার পূর্বেই কলটা কেটে গেল। সাথী বুঝতেই পারলো না কী হলো একটু আগে। রঙ্গন কতটুকু কথা শুনেছে তা আন্দাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।

_________________________

চিত্রলেখার বিষয়টা কোচিংয়ে ভালোই ছড়িয়েছে। স্টুডেন্টরাও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছে। অবশ্য আলোচনার মুখ্য কালপ্রিট চিত্রলেখাই। আহাদ নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করছে। কাউকে ফাঁদে ফেলা বোধহয় তার থেকে ভালো কেউ পারবেনা। মনে মনে নিজেই নিজের কাঁধ চাপড়ালো। ক্লাস নিতে নিতে এসবই ভাবছিল সে। স্টুডেন্টদের মধ্যে কিছুক্ষণ ফিসফাস চললেও আহাদ এবার তাদের চুপ করিয়ে দিল। ক্লাসে মনোযোগ দিতে বললো সবাইকে। মুহূর্তেই সারা কক্ষে পিনপতন নীরবতা সৃষ্টি হলো। আহাদ হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকাতেই অনুভব করলো কেউ একজন তার কলার ধরে তাকে পেছনে টানছে। বিব্রত হয়ে পেছনে ফিরলো সে। লম্বা-চওড়া এক ছেলে তার কলারে হাত দিয়েছে। ক্লাসে আবারো শোরগোল পড়ে গেল। “সাইলেন্স” বলে চেঁচিয়ে উঠলো আহাদ কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তিটি তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই আহাদের মুখ বরাবর ঘুষি হাঁকালো। তীব্র রাগের আঁচটা যেন স্পষ্ট টের পেল আহাদ। ছেলেটার পরিচয় জানেনা সে। অপরিচিত একজন ছেলে তারই ক্লাসে ঢুকে তাকেই মারছে এ যেন দুঃসাহসিক ব্যাপার। কতিপয় স্টুডেন্ট ইতোমধ্যে ভিডিও করতে শুরু করেছে। আহাদ কিছু বলার সুযোগই পেল না। যতগুলো চড় থাপ্পড় সে খেয়েছে তাতে তার দাঁত অবধি নড়ে উঠেছে। ক্লাসে শোরগোল শুনে শেষমেশ সকলে আহাদের ক্লাসে ঢুকলো। অপরিচিতের ছেলেটাকে আহাদের থেকে সরানোর চেষ্টা চালাতে লাগলো। টানাটানিতে আহাদের কলার ছিঁড়ে ছেলেটার হাতেই রয়ে গেল। তবুও যেন তার রাগ কমলো না। আহার এবার যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

-কে তুই? তোর সাহস তো কম না! আমার ক্লাসে ঢুকে আমার গায়েই হাত দিস!

-তোর মতো নোংরা কীটের গায়ে হাত দিছি এইটা আমার জন্য লজ্জাজনক। তোর মতো কীট শিক্ষক হওয়ার যোগ্যই না। তোদের জন্য শিক্ষকতার মতো একটা মহান প্রফেশনের অপমান হচ্ছে এখন।

-তুই কে এসব বলার? কী প্রমাণ আছে তোর কাছে?

রঙ্গন এবার খানিকটা শান্ত হলো। নিজের পরিচয় জানালো না আগেই বরং উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কিছু কথা যে সে বলবে তা স্পষ্ট বোঝা গেল।

-তোমরা সবাই একটু আগের ঘটনা দেখেছো। আমায় ভুলও বুঝতে পারো তবে কাজটা আমি কেন করেছি তা তোমাদের জানা প্রয়োজন। একটা মেয়ের উপর অপবাদ দেওয়া খুব সোজা। মেয়েদের দোষ দেওয়াটাও খুব সোজা। তোমরা যেমন আজ দুপুরের ঘটনার জন্য নিশ্চয়ই মেয়েটাকে দায়ী করেছো! একবারো ভেবেছো মেয়েটা আদতে সত্যি বলতেও তো পারে! তোমাদের বোনের উপর এমন এলিগেশন আসলেও মেনে নিতা? আর এই নোংরা লোকের তো চেহারা দেখলেও বোঝা যায় শালা লুচ্চা! তোমাদের মনে হয়তো একে নিয়ে অনেক রেস্পেক্ট আছে কিন্তু বি অনেস্ট, এই লোকটা তোমাদের মধ্যে কোনো মেয়েকে বিরক্ত করেছে? এখনই সময়, নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করো!

ক্লাসের কেউই দাঁড়ালো না। রঙ্গন জানতো এত সাহস কেউ দেখাবে না। তবে রঙ্গনের এ আশাহত হওয়াটা যেন ভালো লাগলো আহাদের। ঠোঁট বেয়ে তার রক্ত গড়াচ্ছে তবুও কুৎসিত হাসিটা ঠোঁটের কোণে বহাল তবিয়তে রয়েছে। রঙ্গনের রাগ যেন আরো কয়েক গুণ বাড়লো। ইচ্ছে করলো হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। চিত্রলেখার কথাগুলো শোনার পর থেকে তার ঠিক কী পরিমাণ রাগ হয়েছে তা সে কাউকেই বোঝাতে পারবে না। আহাদকে খুন করলেও হয়তো এখন তার মন শান্ত হবে না কোনভাবেই।

“দেখো আজ যদি তোমরা চুপ থাকো, লোকটা কয়েক মাস পর তোমাদের জুনিয়রদের সাথেও সেইম কাজ করবে। হতে পারে ভবিষ্যতে তোমার বোনের সাথেও এমন করবে! আজ চুপ থাকার মানে হচ্ছে লোকটাকে প্রশ্রয় দেওয়া!” রঙ্গন শেষবারের মতো চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো। এতে যদি কারো বোধবুদ্ধি ফেরে! এতেও যদি কেউ কিছু না বলে তবে রঙ্গন আর এসবের ধার ধারবে না। সোজা ঐ লোকটার কান ধরে টেনে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে মারবে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে