চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩৯+৪০

0
484

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা ইদানিং ঘর থেকে মোটেও বের হয়না তবে আজ রাদিফের পরীক্ষার খাতা দেখাবে, গার্ডিয়ান ছাড়া যাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়েই অপর্ণা গায়ে কালো বোরকা জড়িয়ে রাদিফের স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। মিনিট পনেরো লাগবে যেতে। রিকশা নিল অপর্ণা। কিছুসময় সব ঠিকঠাক থাকলেও একটু পর অপর্ণা লক্ষ করলো দুইটা বাইক তাকে দুইপাশ থেকে ফলো করছে। অচিরেই তার মনে ভয় ধরলো। না জানি কোন বিপদ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য! অপর্ণা রিকশাওয়ালাকে বললো দ্রুত যেতে। তাতে অবশ্য লাভ হলো না। বাইকে থাকা লোকগুলো রিকশার সামনে বাইক থামালো। রিকশাওয়ালা না পারতে রিকশা থামালো একপাশে। লোকগুলো এসে সোজা অপর্ণার দিকে ছুরি তাক করলো।

-চুপচাপ নেমে আমাদের সাথে চল!

-কারা আপনারা? আমার রাস্তা কেন আটকেছেন?

-বেশি কথা বললে কথা বলার মতো অবস্থাতেই থাকবি না, কোনো কথা না বলে আমাদের সাথে আয়।

-দেখুন আমার বাচ্চা স্কুলে অপেক্ষা করছে, আপনারা টাকা নিয়ে যান। আমায় ছেড়ে দিন প্লিজ।

-তোর আসলেই প্রাণের মায়া নাই!

লোকগুলোর একজন অপর্ণার বোরকা ধরে টানাটানি শুরু করলো। সরু রাস্তা হওয়ায় এদিকে গাড়ি খুব কম। অপর্ণা চিৎকার করারও সাহস পাচ্ছে না। আচমকা পুলিশের হুইসিল শোনা গেল। লোকগুলো ছুরি ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালালো। অপর্ণা যেন জমে গেছে। সে কোনভাবেই নড়তে পারছে না। কোনোরকম রিকশাওয়ালাকে বললো রিকশা ঘুরিয়ে আগের জায়গায় নামিয়ে দিতে। রিকশাওয়ালাও যথেষ্ট ভয় পেয়েছে। সেও সময় না নিয়ে রিকশায় টান দিল।

________________________

অর্ণব অপর্ণার বাড়ির সোফাটাতে বসেও খানিকটা সংকোচবোধ করছে। আগেরবার এখানে এসেছিল ডিভোর্স লেটারে সই করতে, এখন তাকে কেন এত জরুরি তলব দেওয়া হয়েছে জানা নেই তার। অবশ্য অতীব দরকারি কোনো কথা না থাকলে তার শাশুড়ির মতো মানুষ কখনো তাকে অনুনয় করে এখানে ডাকতো না তা সে জানে। অর্ণবের ডিভোর্সের পেছনে অন্যতম কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তিটিও তার শাশুড়ি মা। বিষয়গুলো অল্পবিস্তর বুঝতে পারে অর্ণব কিন্তু এসব প্রকাশ করতে চায় না। অপর্ণার বাবা-মা, পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে। বাচ্চারা বোধহয় অপর্ণার সাথে ঘরে রয়েছে। অর্ণব বোঝার চেষ্টা করছে তাকে কেন ডাকা হয়েছে।

-অর্ণব বাবা, তোমায় খুব গুলো কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি।

-তা বুঝতে পেরেছি। বলুন।

-নওশাদ লোকটা যে অপর্ণাকে বিরক্ত করছে তা আমি আগেও লেখাকে জানিয়েছি। আমার মেয়েটা ঘর থেকে বের অবধি হয়না। আজ বের হয়েছে, কিছু লোক এসে তার গলায় ছুরি ধরেছে। তুমি বুঝতে পারছো ব্যাপারটা কত সিরিয়াস?

-জ্বী বুঝতে পারছি।

-দেখো বাবা, অপর্ণাকে তো তুমি চেনোই। মেয়েটার অযথা জেদ, ওকে তুমি মাফ করে দাও বাবা। আর দেখো নওশাদের ক্ষমতা আছে, লোকটা তো এমনি এমনি চুপ করবে না। চিত্রলেখাকে ওর সাথে বিয়ে দিলে কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না। যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে, বিয়েতে অমত করার কী আছে? বিয়েটা হয়ে গেলে সব সমস্যা মিটে যাবে।

-আপনার লজ্জা করেনা? আপনি তো একজন মেয়ে, আপনি দেখতেই পারছেন নওশাদ লোকটা কতটা ভয়ঙ্কর তারপরেও আপনি এই কথা বলার সাহস পেলেন কী করে?

অর্ণব চলে যাওয়ার জন্য উঠলো। অপর্ণার বাবা আটকালেন তাকে।

-বাবা অর্ণব, আমাদের কথায় রাগ কোরো না। আমাদের মেয়েকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমাদের বোধবুদ্ধি কাজ করছে না অর্ণব।

-আপনার মেয়ের বোধবুদ্ধি সময়মতো কাজ করলে এখন এ পরিস্থিতিতে পড়তেন না। যাই হোক, আমি আমার বাচ্চাদের সাথে একটু দেখা করতে চাই।

-অপর্ণার সাথে একবার…

-আমার বাচ্চাদের একটু বাইরে ডেকে নিবেন? আমি দেখেই চলে যাবো।

উপস্থিত সবাই থ মেরে গেল। অর্ণবের কথার কাঠিন্য সকলে উপলব্ধ করতে পারলো। মানুষ কতটা কষ্ট পেয়ে এতটা কঠোর হতে পারে তা বোধহয় তারা অনুভব করার চেষ্টা করলো।

রূপসা-রাদিফের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে এলো অর্ণব। বাচ্চা দুটো এখনো বাবার থেকে দূরত্ব মেনে নিতে পারেনি। পরিস্থিতি বোঝানো তো এতটা সহজ নয়! অপর্ণার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্ণব তৌহিদের সাথে দেখা করার জন্য গেল। তৌহিদের সাথে তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

-অর্ণব ভাই? এখনি আসলেন যে? অবশ্য আমিই আপনার ওখানে যেতাম আজ।

-লেখার সাথে কথা হয়েছে তোমার? কাজ কতদূর? সময় তো বেশি নাই।

-কাজ বেশি বাকি নাই ভাইয়া তবে অপর্ণা ম্যামের উপর নজর রাখছিলাম আজকে। ঠিকঠাক টাইমে পুলিশের সাইরনটা বাজিয়েছিলাম বলে বেঁচে গেছে! যতদূর বুঝলাম গুণ্ডাগুলো প্রফেশনাল না, নওশাদ বোধবুদ্ধি ভাড়া করেছে। নিজের ইমেজ ক্লিন রাখতে চায় আর কী!

-এসব জেনে কাজ নাই তৌহিদ আমার, অপর্ণার যা হয় হোক। ও মরে গেলেও আমার যায় আসে না।

-এটা আপনার মুখের কথা ভাই, আপনি যে কষ্ট পাচ্ছেন তা আপনার চোখ বলে দিচ্ছে। মাফ করে দিয়ে নতুন করে সব শুরু করলেই পারেন!

-তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তবে অবশ্যই তাকে আমৃত্যু ভালোবাসবে কিন্তু তার সমস্ত অন্যায় ক্ষমা করার মতো বড় অন্যায় কখনো করো না। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিণাম জানো? না পাবে ভালোবাসা আর না পাবে শান্তি!

-অপর্ণা ভাবীকে কখনো ক্ষমা করবেন না ভাইয়া?

-না।

-ভাবী অনুতপ্ত হলেও না?

-না। একটা ভুল করার পর অনুতপ্ত হলেই কি সেই ভুলের মাশুল দেওয়া হয়ে যায়? ভুল ভুলই থাকে। তাছাড়া ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত অপর্ণারই ছিল। এখন তার অনুতপ্ত হওয়ার কারণ নেই। সেসব তোমার ভাবতে হবে না, তুমি তোমার কাজ করো।

-আচ্ছা ভাইয়া। আমার আরো কিছুদিন দেখা লাগবে। তাছাড়া এবার ভোটে হেরে লোকটা ক্ষ্যাপা শেয়াল হয়ে আছে। একটু সামলে কাজ করতে হবে।

-করো। সময়মতো যেন সব হয়।

__________________________

চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারছে না এই আহাদ লোকটার সমস্যা কী। হোয়াটসঅ্যাপে আবারো মেসেজ করেছে লোকটা। বিরক্তির ভঙ্গিতে ফোনটা দূরে ছুঁড়লো লেখা। সে অপেক্ষায় আছে তৌহিদের কলের। কল আসছে না মানে এখনো কাজ হয়নি। এতে অবশ্য বিরক্ত হয়ে লাভ নেই। যে দায়িত্ব সে তৌহিদকে দিয়েছে তাতে সময় লাগা স্বাভাবিক। তৌহিদের অযথা এ উকিলগিরিতে সময় ব্যয় না করে পার্মানেন্টলি গোয়েন্দাগিরিতে জয়েন করা দরকার।

চিত্রলেখা ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো। রঙ্গনের একটাই ছবি আছে তার কাছে। প্রোফাইলে যে ছবিটা দেওয়া ছিল আগে, সেটাই সেভ করে রেখেছিল সে। ঢাকায় আসার পর থেকেই রঙ্গনের স্মৃতি মারাত্মক পোড়াচ্ছে তাকে। মন চাচ্ছে একটু দেখা করতে কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক ঘোষণা করছে যে রঙ্গনের সাথে দেখা হলেই সে মনোযোগ হারিয়ে ফেলবে। অবশ্য কথাটা মিথ্যে নয়। রঙ্গনের বলা একটা বাক্যও চিত্রলেখার মনে উত্তাল ঢেউ আনতে সক্ষম।

সাথী চিত্রলেখার ঘরে উঁকি দিয়ে ভালোমতো দেখলো মেয়েটা কী করছে। চিত্রলেখার বিরক্ত হয়ে বসে থাকা দেখে সাথীরও বিরক্ত লাগলো। কানে ধরে রাখা ফোনটা হাত দিয়ে আড়াল করলো।

-আপা, কী হয়েছে? কিছু বলছো না যে?

-তোমার বউয়ের মন খারাপ রঙ্গন।

-লে কেন!

-আমি কিভাবে বুঝবো? তুমি কল রাখো। আমি দেখি কেন এমন বাংলার পাঁচের মতো করে বসে আছে।

-আপা শোনো না, আমি তোমার বাড়িতে আসি আচ্ছা? ভাই হিসেবে প্রথমদিন বোনের বাড়িতে যেতে চাইছি, মানা করো না প্লিজ।

-আমি কিছু বলবো না কিন্তু তোমার বউ যদি আরো রাগ করে তবে আমার দোষ নেই।

-আচ্ছা আপা। চিত্রলেখাকে এখন কিছু বলতে যেয়ো না। ওকে একটু একা থাকতে দাও।

-দুপুর থেকে খায়নি। এখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে। অনিকটারও আজ মিটিং আছে, আসতে আসতে দশটা বাজাবে। আমি দেখি ওকে কিভাবে খাওয়ানো যায়।

-আপা প্লিজ তুমি কিছু করো না। আমাকে দেখতে দাও।

-কী করবে তুমি?

-কিছু একটা।

রঙ্গন কল কেটে দিল। মাঝেমধ্যে নিয়ম ভাঙাই যায়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন বিশেষ একজন থাকে যার জন্য আমরা সকল নিয়ম একবার করে হলেও ভাঙি।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
চল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“মনে পড়লে অকারণ, কাউকে বলা বারণ
রিমঝিমঝিম বরষায় তুই আজ ভেজার কারণ
মেঘেদের ডাকবাক্সে তোর চিঠি পৌঁছে দিলাম…” চিত্রলেখা বিভ্রান্ত চোখে চারিদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে শব্দটা কোথা থেকে আসছে। রেকর্ডেড ভয়েস তবে তার মন জানান দিচ্ছে রঙ্গনের উপস্থিতি। উদভ্রান্তের মতো এলোমেলোভাবে সব ঘর খুঁজলো সে। এখনো গানটা বাজছে কোথাও একটা। রঙ্গনের স্বর যেন চিত্রলেখার মনকে আরো এলোমেলো করে তুলছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ঘর ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়ালো চিত্রলেখা। ঠিক তখনি চোখে পড়লো নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। এখন রাতের দশটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় কুয়াশাও বেশি পড়েছে। সবে শীত আসি আসি ভাব হলেও ঠাণ্ডার প্রকোপ মারাত্মক এবার অথচ ছেলেটা কিনা শুধু একটা হুডি গায়ে জড়িয়ে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো তার ঘরের বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখার প্রচণ্ড রাগ উঠলো। আশেপাশেও কোনোকিছু আর ভাবলো না সে। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে নিচে নামলো।

চিত্রলেখার উদ্বেগ লুকিয়ে রাখতে পারলো না সে। রঙ্গনকে দেখামাত্র তার সমস্ত রাগ যেন জল হয়ে গেল। ইচ্ছে করলো রঙ্গনকে কষে একটা চড় দিতে। বেয়াদব ছেলেটা ফাজলামি শুরু করেছে। শরীর খারাপ হলে কে দেখবে?

-এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কী?

-তোমার উপরের ফ্ল্যাটের মেয়েটার জন্য এসেছি। মেয়েটা খুব কিউট তো!

-ওহ আচ্ছা।

চিত্রলেখার শান্তস্বরে বলা ‘ওহ আচ্ছা’র ভয়াবহতা বুঝতে সময় লাগলো না রঙ্গনের। চিত্রলেখা ফিরে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরেছিল, রঙ্গন পেছন থেকে তার হাতটা ধরলো বেশ শক্ত করেই।

-এ জীবন ফুরিয়ে যাবে তুমি চলে গেলে, ভবলীলা সাঙ্গ হবে তোমায় না পেলে।

-আজ বড্ড গান শোনাচ্ছেন যে গায়ক সাহেব। কাহিনী কী?

-কাহিনী হচ্ছে আমার রঙ্গনা আজ বড্ড উদাসী বিকেলের মতো নিষ্প্রভ হয়ে আছে। তার একটু রঙ্গনের প্রয়োজন।

-আচ্ছা?

-হুম অনেকগুলো আচ্ছা। আমি জানি তোমার পড়াশোনার অনেক চাপ এখন, আমি বেশি সময় নিব না। আমাকে শুধু পাঁচ মিনিট সময় দিতে আপত্তি আছে?

-আপত্তি করলে কি আপনি শুনবেন?

-না।

-তবে?

-আমি চাই তুমি আমাকে অনুমতি দাও তোমার মন ভালো করার।

-অনুমতি দেওয়া হলো।

রঙ্গন পকেট থেকে বেলিফুলের গাজরা বের করলো। চিত্রলেখার বেলিফুল পছন্দ কথাটা সে সাথীর থেকে জেনেছে। রঙ্গনের অবশ্য এ ফুল খুঁজতে অনেকটা সময় লেগেছে। সব জায়গায় লাল গোলাপ সহজলভ্য হলেও শুধু বেলির গাজরাটা খুঁজে পাওয়া ভারি দুঃসাধ্য হয়েছে তার জন্য। রঙ্গন ফুলটা নিয়ে নিজের ডানহাতের সাথে চিত্রলেখার বামহাতটা আলতো করে বাঁধলো।

-কী হলো এটা?

-ফুলেল বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।

-তুমি আসলেই পাগল!

-উফ! কতদিন পর তুমি করে ডেকেছো। শেষ আমি, বুকে ব্যথা করছে।

-নাটকবাজ কোথাকার!

-তুমি নাটক হও প্রিয়, আমি নাটকবাজ হতে দ্বিধা করবো না।

-আপনাকে কে বললো আমার মন খারাপ?

-ভালো কথা মনে করিয়েছো। তোমার কেন মন খারাপ সেটাই শুনিনি এখনো। কী হয়েছে বলো তো।

-ওহ, ঐটা তেমন কিছু না।

-কেমন কিছু সেটাই জিজ্ঞাসা করছি।

-কোচিংয়ের একটা স্যারের পড়ানো ভালো লাগছে না আর কী! ঐটা নিয়েই একটু মন খারাপ।

-হে আল্লাহ, আমার মতো ব্যাকবেঞ্চারের কপালে তুমি এ কেমন আঁতেল রাখলা!

-এই আমি আঁতেল?

চিত্রলেখার ডানহাত দিয়ে সমানে রঙ্গনের ডানহাতে আঘাত করতে লাগলো। রঙ্গন হাসতে হাসতে চিত্রলেখার ডানহাতটাও বাহুবন্দি করে ফেললো।

ফাঁকা রাস্তায় হেডলাইটের অল্প আলোতে রঙ্গনের চোখে দুরন্তপনা দেখলো চিত্রলেখা। এ দুরন্তপনা যে কতদিন তাকে পড়তে বসতে দিবে না তাও উপলব্ধি করতে চাইছে না চিত্রলেখা। এ চাঞ্চল্য উপভোগের করতে ইচ্ছে করছে তার। রাস্তার অপর পাশে পেরিয়ে অল্প দূরত্বে একটা পার্কের লেকের ধারে বসলো দুজন। চিত্রলেখার এক হাত এখনো রঙ্গনের হাতে বন্দি।

-আমার যাওয়া উচিত। ভাবী চিন্তা করবে।

-আপা জানে তুমি এখানে এসেছো।

-ভাইয়া তো জানে না। ভাইয়া রাগারাগি করবে।

-অপেক্ষা জিনিসটা এতটা কষ্ট দেয় কেন বলো তো। আমি চাইলেও কেন তোমায় হুটহাট দেখতে পারবো না? খুব কাছে থেকেও কেন কাছে আসতে পারবো না? অন্তত এক প্রহর কেন কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারবো না? আমি তোমার বিরহে পুড়ছি রঙ্গনা। তুমি জল হয়ে এসে শীতল করো এ দহন যন্ত্রণা।

-বিরহ কাব্য শিখিয়ে দিয়েছে?

-হুম। আচ্ছা পাঁচ মিনিট তো শেষ। চলো তোমাকে রেখে আসি।

রঙ্গন চটজলদি উঠে পড়লেও চিত্রলেখা আলতো করে রঙ্গনের টি-শার্টের কোণা আঁকড়ে ধরলো। চিত্রলেখার চোখজুড়ানো যেন বলছে,”না গেলে হয় না?” রঙ্গনের বুকে তৎক্ষণাৎ ঝড় বয়ে গেল। মেয়েটা আর কতভাবে ঘায়েল করবে তাকে?

-রঙ্গনা, তোমার চাহনি আমায় যেভাবে মাতাল করছে তাতে যদি আমি কোনো ভুল করে বসি তবে তুমি আগামী কতদিন যে পড়াশোনায় মন দিতে পারবে না তা আমিও জানি না।

-আপনি এতটা নির্লজ্জ কবে হলেন?

-তোমার প্রেমে পড়ার পর থেকেই।

রঙ্গন হাসতে লাগলো যেন সে বড়সড় কোনো ডিবেট জিতে গেছে। চিত্রলেখা মুগ্ধ হয়ে সে হাসির দিকে চেয়ে রইলো। এ হাসির স্নিগ্ধতা পরিমাপযোগ্য? মোটেও না! এ হাসি চিত্রলেখার কত রাতের ঘুম কাড়তে চলেছে তা সে নিজেও অনুধাবন করতে পারছে না।

________________________________

-ভাইয়া এখনো আসেনি ভাবী?

-নাহ। রঙ্গন ভেতরে এলো না?

-তুমি ডেকেছিলে ওকে?

-না, ঐ আসতে চেয়েছিল।

-কেন?

-তার রঙ্গনার মন খারাপ ছিল তাই।

চিত্রলেখা আর কিছু বলার উপায় পেল না। রঙ্গনের বাচ্চামির কারণে এখন ভাবীও তার দিকে অদ্ভুত রকমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। চিত্রলেখা মাঝেমধ্যে ভুলে যায় আসলে ছোট কে। সে নাকি রঙ্গন!

ঘরে ঢুকতেই চিত্রলেখার ফোনটা বেজে উঠলো। তৌহিদের কল দেখে খানিকটা ব্যতিব্যস্ত হয়েই রিসিভ করলো চিত্রলেখা।

-তৌহিদ ভাইয়া, কোনো প্রমাণ পেয়েছেন?

-প্রমাণ আছে লেখা তবে জোরদার নয়। আমাদের আরো সময় নিতে হবে। অপর্ণা ভাবীর উপর হামলা লোক্যালদের দিয়ে করানো, ওদের ধরলেও নওশাদের কিছু করা যাবে না।

-ভাবীর উপর হামলা হয়েছে?

-হ্যাঁ, অনেক লম্বা কাহিনী। তবে আমার মনে হয় রঙ্গনকে জানানো উচিত। সে বোধহয় আমাদের সহায়তা করতে পারবে।

-না ভাইয়া। রঙ্গন কোনো ঝুঁকির মধ্যে থাকুক আমি চাইনা। তাছাড়া রঙ্গন এসব থেকে যতটা আড়ালে থাকবে ততটাই ভালো। সময় বেশি লাগুক, সমস্যা নেই।

-আচ্ছা আমি আমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি পুরোদমে। আশা করি কোনো না কোনো প্রমাণ তো হাতে আসবেই। এখন রাখছি আমি।

-আচ্ছা ভাইয়া।

চিত্রলেখা কল কেটে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো। রঙ্গনকে এসব জানানোর ভুলও করা যাবে না। চিত্রলেখার সব ভয় এখন রঙ্গনকে ঘিরে। রঙ্গন যদি এসবে জড়িয়ে ভুলেও কখনো জানে সে আশফিনা আহমেদের আসল সন্তান নয় তখন চিত্রলেখা নিজেকে কিম ক্ষমা করবে? আশফিনা আহমেদ এত বছর ধরে যে সত্য রঙ্গনের থেকে আড়াল করেছেন, সে সত্য আড়ালে থাকাই ভালো। চিত্রলেখা নওশাদকে যতদূর চেনে, তাতে নওশাদ নিজের বেলায় রঙ্গনকেও পরোয়া করবে না এটাই স্বাভাবিক। চরম মাত্রার নিকৃষ্ট একটা লোক সে।

হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ টোনে ঘোর কাটলো চিত্রলেখার। আহাদের ক্রমাগত টেক্সট এবার তাকে বিরক্ত করছে। সমস্যা কি এই লোকটার? চিত্রলেখা যে বিরক্ত এটা বুঝতে তার এতক্ষণ সময় লাগছে? মানুষটার সাধারণ জ্ঞান নাই নাকি কাজে লাগাতে পারছে না? চিত্রলেখা এবার আর কিছু ভাবলো না। তৎক্ষণাৎ নম্বরটা ব্লক করে দিল। মানুষকে কোনোকিছুর সুযোগ দেওয়াই উচিত না বরং সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার আগেই প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করে ফেলা উচিত তাকে। একটু ষুযোগ পেলে মানুষ যে মাথায় চড়ে বসে এর প্রমাণ তো চিত্রলেখা আগেও পেয়েছে। এখন আগের সেই চিত্রলেখাটা তার মাঝে আর নেই। আগ্নেয়গিরির সুপ্ত সময় এখন শেষ, এখন কেবল প্রচণ্ড লাভা প্রতিমুহূর্তে প্রস্তুত হচ্ছে তার মাঝে। কখন কোন সময় এ লাভা কোন ব্যক্তির উপর বিস্ফোরিত হবে তার ধারণা চিত্রলেখার নিজেরও নেই।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে