#চিত্রলেখার_কাব্য
সাঁইত্রিশতম_পর্ব
~মিহি
সময় বহমান। বস্তুত সবচেয়ে দ্রুতগামী জিনিস বোধহয় এটাই। চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করলেই যেন সময় উড়ে চলে যায়। পাঁচ মাসের মতো হলো তার ভাই-ভাবীর ডিভোর্স হয়েছে। বাচ্চাগুলোর কাস্টাডিও ভাবীর কাছে। অর্ণব অবশ্য এতে খুব একটা মন খারাপ করে না। যত যাই হোক, অপর্ণা মায়ের দায়িত্ব ঠিকই পালন করবে সে জানে। হয়তো মাসে একদিন বাচ্চাদের দেখা পায়, তাতেই সে খুশি। চিত্রলেখা এসব নিয়ে কখনো বেশি কথা বলতে যায় না। তার পৃথিবীটাই একরকম বদলে গেছে এ কয়েক মাসে। রঙ্গন ঢাকা ফিরেছে সেদিনই। অনিকেরও ঢাকায় চাকরি হওয়ার পর সাথীও সেখানে। চিত্রলেখাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ জোর করেছিল দুজনে তবে চিত্রলেখা যায়নি। অর্ণবকে একা ফেলে তার যেতে ইচ্ছে হয়নি। তাছাড়া যে এলাকায় সে অপমানিত হয়েছে সেখান থেকে পালানোর মতো মানসিকতা তার তখন হয়নি। উপযুক্ত জবাব দিয়েই সে যেতে চায়।
সন্ধ্যে হতে চললো। অর্ণব ফিরবে বেশ রাত করেই। বাড়িতে ‘সায়রা’ নামের এক বৃদ্ধা আছেন, রান্নাবান্নার কাজসহ সব কাজ মোটামুটি তিনিই দেখেন। চিত্রলেখাও তার কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করে। সায়রা সন্ধ্যে হতেই রান্না শেষ করে বসে থাকেন। এশার নামাযের পর দীর্ঘসময় ধরে কুরআন তেলাওয়াত করেন। এই মানুষটার আশেপাশে থাকলেও চিত্রলেখার মনে প্রশান্তি বজায় থাকে। চিত্রলেখাকে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে। অনেকটা গ্যাপ পড়েছিল পড়াশোনায়, এখন সব গুছিয়ে পড়ছে সে। আচমকা ফোনটা বেজে উঠলো চিত্রলেখার। খানিকটা বিরক্তবোধ করলো সে। নম্বরটা অপর্ণার মায়ের। মহিলা গতকাল থেকে চিত্রলেখাকে ফোন করে যাচ্ছেন। চিত্রলেখা ইচ্ছে করেই রিসিভ করেনি। মুরুব্বি হলেও এ মহিলার মধ্যে নূন্যতম সৌহার্দ্যবোধ নেই, তার সাথে কথা বলা মানে নিজেকে ছোট করা। ফোন ক্রমশ বেজেই চলেছে। চিত্রলেখা না পারতে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম, মা আমার মেয়েটাকে বাঁচাও মা। ও মরে যাবে। নওশাদ লোকটা ওকে বিরক্ত করছে। লোকটার ক্ষমতা তো তুমি জানো মা। ঐ লোকটার হাত থেকে আমার মেয়েকে বাঁচাও।
-ঐ লোকটার সাথে সখ্যতা গড়তে কি আমি গিয়েছিলাম আন্টি? আমার কিছু করার আছে এখানে? যে বিপদ আপনার মেয়ে ঘাড়ে নিয়েছে, সে বিপদের সমাধান আমি কী করে হবো? আমায় দয়া করে বিরক্ত করবেন না।
চিত্রলেখা কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিল। নওশাদ লোকটা ভয়ঙ্কর তা সে জানে কিন্তু অপর্ণা যে গর্ত খুঁড়েছে, তাতে তার পড়া অনিবার্য ছিল। চিত্রলেখা অপর্ণার বিষয়টা মাথা থেকে বের করে পড়ায় মনোযোগ দিল। মনোযোগ একবার বিচ্যুত হলেই রঙ্গনের খেয়ালগুলো মস্তিষ্কে আনাগোনা করতে শুরু করে। চিত্রলেখা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও পারেনা সেসব থামাতে। চিত্রলেখা জানে রঙ্গনকে পাশে রেখেও সে স্বপ্ন পূরণে এগোতে পারতো কিন্তু আদৌ কি সে তার স্বপ্নের জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করতে পারতো তখন? প্রেম এবং পড়াশোনা দুইটা একসাথে কখনো হয়না। চিত্রলেখা রঙ্গনের থেকে দূরে আছে মানে এই না যে তার ভালোবাসা প্রতিমুহূর্তে কমছে, আদতে ভালোবাসার মাত্রা যে চক্রবৃদ্ধির হারে বাড়ছে তা সে সর্বদাই অনুভব করতে পারে।
___________________________________
চিঠি লেখা শেষ করে রঙ্গন নিচে তারিখ দিয়ে ‘৩১৭’ লিখলো। এটা তার লেখা ‘৩১৭’ তম চিঠি। চিত্রলেখার জন্য জমানো কথাগুলো সে চিঠিবদ্ধ করছে সেই কয়েক মাস আগে থেকে। কথা না হোক, অনুভূতিগুলো জমা হোক চিঠির পাতায়। আচমকা ফোন বেজে উঠাতে ধ্যান ভাঙলো রঙ্গনের। মনে পড়লো ব্যস্ততায় গতকাল থেকে মায়ের ফোন রিসিভ করতে মনে নেই তার। চটজলদি কল রিসিভ করলো।
-এত কিসের ব্যস্ততা রঙ্গন? গতকাল থেকে তুমি আমার কল রিসিভ করছো না!
-স্যরি মা, নতুন জব তো। কাজের একটু চাপ থাকেই।
-তোমার চাকরিটা করার কোনো দরকার আছে রঙ্গন? তুমি এখানে এসে তোমার বাবার অফিস জয়েন করলে কী সমস্যা?
-আমার নিজের যোগ্যতায় কিছু তো করা উচিত মা, ভবিষ্যতে কী হবে বলা তো যায় না।
-কী বলতে চাইছো?
-মা তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো, তাই না?
-এটা কি বলতে হয়?
-আমার সাথে একদিন কথা না বলতে পেরে তুমি এতটা উৎকণ্ঠা! ভালোবাসার মানুষের সাথে কথা না হওয়ার যন্ত্রণা কেমন মা? খুব বেশি কষ্ট হয়? আমার কেন যেন অনুভূতি শক্তি হারিয়ে গেছে।
রঙ্গন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। আশফিনা আহমেদ কল কেটে দিয়েছেন। রঙ্গন ফোনের সিক্রেট ফোল্ডারে ঢুকলো। এখানে চিত্রলেখার হাতে গোণা কয়েকটা ছবি আছে। বেশ কয়েকটা ওর কলেজের গ্রুপ ফটো যেটা রঙ্গন কলেজের পেইজ থেকে সংগ্রহ করেছে আর একটা ছবি সে তুলেছিল লুকিয়ে। চিত্রলেখা যখন বিলে পা ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল তখনকার তোলা। রঙ্গনের কাছে এ ছবিগুলো ছাড়া আর কিছু নেই। চিত্রলেখার স্মৃতিগুলো ইদানিং বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে সুযোগ ছিল ভার্সিটিতেই লেকচারার হওয়ার। রঙ্গনের সেদিকে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। শিক্ষকতাটা তার দ্বারা হবে না এটা সে অনেক আগেই বুঝেছে। চিত্রলেখার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে গুণতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ঢাকা শহরে তার শান্তির খোঁজ নেই। প্রচণ্ড ব্যস্ততম একটা দিন শেষ করে সে অনুভব করে সময়গুলো কেবল তার সাথে প্রতারণাই করে চলেছে। চিত্রলেখার স্মৃতিগুলোও তাকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে প্রতিমুহূর্তে। তবুও রঙ্গন নিজেকে সামলায়। মাস তিনেক পরেই এইচ.এস.সি পরীক্ষা। এ সময়টাতে চিত্রলেখার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না সে। চিত্রলেখার থেকে দূরে থেকেও তার স্বপ্ন পূরণের অংশ হয়ে থাকতে চায় সে। রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুনগুন করতে থাকে,”সখী ভাবনা কাহারে কয়, সখী যাতনা কাহারে কয়…”
________________________________
-রূপসার নানিবাড়ি থেকে কল করেছিল।
-কী বলেছে?
-নওশাদ লোকটা নাকি ভাবীকে বিরক্ত করছে।
-ঐ মহিলা আর তোর ভাবী নেই। যাই হোক, বিরক্ত করছে তাতে আমরা কী করতে পারি? নম্বর ব্লক করিসনি কেন তুই এখনো? ব্লক কর এখনি। আর শোন, অনিক কল করেছিল। তোর টেস্ট পরীক্ষা তো শেষ। এইচএসসির আগে একবার ঘুরে আসতে বললো।
-এখন কোথাও গেলে গোছানো পড়াশোনার আবার সমস্যা হবে। পরীক্ষা শেষ হোক, এডমিশন কোচিংয়ের জন্য তো যাবোই ভাইয়া।
-আচ্ছা ঠিক আছে। খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাস। কাল দেখলাম টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিস। পড়াশোনা ভালোমতো করতে হলে আগে শরীরের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যা।
-আচ্ছা ভাইয়া আর তোমার ঐ বন্ধুর খোঁজ পাওয়া গেল?
-না, পুলিশ খুঁজছে। ভাগ্যিস ওর কথা শুনে টাকাগুলো ইনভেস্ট করিনি, আমার টাকাও নিয়ে যেত শয়তানটা!
-বিশ্বাস জিনিসটা আসলেই বুঝে শুনে করতে হয় ভাইয়া। আসি আমি।
চিত্রলেখা চলে গেল। অর্ণব চিত্রলেখার কথার অর্থ ঠিকই বুঝতে পারছে। এক ছাদের নিচে থেকেও যেন ভাইবোনের দূরত্ব কমছে না। অর্ণবের সবসময় মনে হয় তার বোন কখনো তাকে আগের মতো বিশ্বাস কিংবা শ্রদ্ধা করতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবার শেষ করে উঠলো সে। “সায়রা খালা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে, তিনি তো আবার আটটার আগেই খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলেন।” ভাবতে ভাবতে অর্ণব প্লেটটা ধুয়ে রেখে নিজের ঘরে এসে বসে। ফোনের ভাইব্রেশন বুঝতে পেরে ফোন হাতে নিল অর্ণব। অচেনা নম্বর থেকে কল আসছে। অর্ণব বুঝতে পারলো না রিসিভ করবে কি করবে না। ইমার্জেন্সি ভেবে শেষমেশ কল রিসিভ করলো সে।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
-অর্ণব, আমি অপর্ণা বলছি। প্লিজ আমার কথা শোনো।
-তোমার কথা শোনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই অপর্ণা। তুমি আমার সন্তানদের মা, সেই সূত্রে তোমাকে যতটুকু সম্মান এখন দিই সেটুকুও কেড়ে নিতে বাধ্য করিও না!
-অর্ণব, আমি এভাবে থাকতে পারছি না। ঐ নওশাদের লোকজন আমাকে প্রতিমুহূর্তে বিরক্ত করছে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। এই সময়ে তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পারো না!
-আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে অপর্ণা, তোমার প্রতি আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই। ভেবো না ডিভোর্স হয়েছে বলে এমন বলছি, আদতে তোমার মতো একজন জঘন্য মানসিকতার মানুষকে আমি আমার আশেপাশেও দেখতে পারবো না। তাছাড়া এখন আফসোস করে কী লাভ? নিজের পায়ে কুড়ালটা তো তুমি নিজেই মেরেছো।
-অর্ণব প্লিজ…
অর্ণব কলটা কেটে দিল। চিত্রলেখা একটা কথা প্রায়শই বলতো,”আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না!”। অর্ণবের আজ মনে হচ্ছে কথাটা কতটা খাঁটি! অপর্ণার এ দুরবস্থা তার স্বীয় কীর্তিকলাপের ফল।
____________________________________
ঘুমোনোর জন্য মাত্র বিছানায় বসেছে এরই মধ্যে ফোনটা আবার বেজে উঠলো। চিত্রলেখা খানিকটা বিরক্ত হলো। ফোন সে সর্বদা বিছানা থেকে দূরে রাখে ঘুমোনোর আগে। এখন আবার গিয়ে দেখতে হবে কে কল করলো।
আশফিনা আহমেদের নম্বরটা ট্রু কলার চিনিয়ে দিল তাকে। দোনোমনা ভাবেই কলটা রিসিভ করলো সে।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো লেখা?
-আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ যেমন রেখেছেন। আপনি ভালো আছেন?
-হুম আছি। কিন্তু আমার ছেলে ভালো নেই লেখা। একসময় আমিই চাইতাম সে তোমার থেকে দূরে থাকুক কিন্তু এখন ওর কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারছি। তুমি দয়া করে ওর সাথে একটু কথা বলো।
-আমার পক্ষে তা সম্ভব না আন্টি। আমরা দুজন দূরে থেকেও মানিয়ে নিয়েছি। এখন যোগাযোগ করলে দুজনের জীবনই এলোমেলো হয়ে যাবে।
-ওর কষ্টটা তুমি বুঝতে পারছো না একটুও?
-আ’ম স্যরি আন্টি!
চিত্রলেখা কল কাটলেও তার মন আজ বড্ড উতলা হয়ে আছে। খুব স্বাভাবিক জীবনটা কেন যেন সকাল থেকে অন্যদিকে রূপ নিচ্ছে। না পাওয়া সবকিছু যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে,”এসো স্পর্শ করো আমায়!” চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করতেই অনুভব করলো একটা সাদা এপ্রোন গায়ে জড়াতে পারার তৃপ্তিটুকুর উদ্বেগ। কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে স্বপ্নের খাতিরে তবে ক্ষণিক মুহূর্তের কথা কি বড্ড বেশি সাধনাচ্যুত করবে তাকে? একটু কথা বোধহয় রঙ্গনও চায়!
রাত প্রায় এগারোটা। সারা বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। এখন ঘরে বসে কথা বলা অসম্ভব। সাবধানে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে উঠলো চিত্রলেখা। কাঁপা কাঁপা হাতে রঙ্গনের নম্বর ডায়াল করলো। রিসিভ হতে বোধহয় তিন সেকেন্ডও লাগলো না।
-হ্যালো…
-ফোনের কাছেই ছিলেন বুঝি?
-হুম। কেমন আছো?
-ভালো আছি।
-তোমার মুখে অনেকদিন পর আপনি শুনতেও ভালো লাগছে! তোমার জন্য অনেকগুলো চিঠি লিখেছি। দেখা হলে দিবো।
-আপনি ভালো আছেন?
-তোমায় ছাড়া ভালো থাকাটা ঠিক জমছে না আমার। তাড়াতাড়ি ডাক্তার হও আর এই মুমূর্ষু রোগীটার প্রাণ বাঁচাও প্লিজ।
-আহারে!
-তুমি ছাদে তাইনা?
-কী করে বুঝলেন?
-ঘরে থাকলে প্রাণখোলা হাসিটা শুনতে পেতাম না। এভাবে হাসছো মানে ছাদে আছো।
-ভালো এনালাইসিস! তো আমায় মিস করেছেন?
-শাহরুখ খানের মতো ফিল্মেটিক ওয়েতে বলা আমার দ্বারা হবে না। আমি প্রচণ্ড মিস করছি তোমায়, প্রচণ্ড বেশি! দেখা হলে হাতদুটো বেঁধে আমার বুকের সাথে মিশিয়ে রাখবো যেন কোনভাবেই নিজেকে ছাড়াতে না পারো।
-রঙ্গন, আমার আসলে আরো কিছু বলার ছিল।
-বলো।
চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। আশফিনা আহমেদের কল করার কথাটা কেন যেন বলতে মন চাইলো না। রঙ্গনের যদি মন খারাপ হয়ে যায় এই ভেবে যে সে রঙ্গনের মায়ের জোরাজুরিতে কল করেছে? যদি ভুল বোঝে রঙ্গন! চিত্রলেখা এখন বড্ড ভয় পায়, রঙ্গনকে হারানোর ভয়।
-কী হলো? কিছু বলবে বলছিলে!
-আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি রঙ্গন।
-রঙ্গনও তার রঙ্গনাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আরো অনেকটা সময় ধরে কথা বলতে ইচ্ছে করছে রঙ্গনা কিন্তু তুমি ছাদে থেকো না প্লিজ। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। নিচে যাও। আর শোনো আমায় মিস করলে তুমি কল করতেই পারো! একটুখানি কথা সবসময় যে তোমাকে ডিসট্র্যাক্ট করবে তা না, কখনো আমাদের কথা তোমায় মোটিভেটও করবে। বুঝেছো?
-হুম।
-ঢাকা শহর তোমার অপেক্ষায় আছে।
-আর আপনি?
-সে তো জনমভর ধরে তোমার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত!
-পাগল প্রেমিক!
-ডাক্তার হবে তো, চিকিৎসা কোরো।
-আচ্ছা, ভাইয়া উঠেছে বোধহয়। আমি রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।
-আচ্ছা।
-শোনো…
-কী?
-কিছুনা!
-পাশে থাকলে নাহয় বাহুতে জড়িয়ে রেখে সমস্ত মন খারাপ দূর করতে পারতাম কিন্তু বড্ড দূরে আছি প্রেয়সী! পাশে থাকলে যতবার না এ শীতের হাওয়া তোমায় ছুঁতো, তার চেয়ে বেশি আলিঙ্গনে আমি বাঁধতাম তোমায়।
-রা…রাখছি আমি।
চিত্রলেখা কল কাটলো তৎক্ষণাৎ। রঙ্গনের একেকটা কথা তার মস্তিষ্কে ঝংকার তুলছে যেন। ছেলেটা এত কেন বোঝে তাকে? চিত্রলেখার এখন বড্ড আফসোস হয়। না চাইতেও ছেলেটাকে কতটা দূরে সরিয়ে রেখেছে সে! সময়গুলো আরেকটু দ্রুত পেরোলো হতো না?
চলবে…
#চিত্রলেখার_কাব্য
আটত্রিশতম_পর্ব
~মিহি
______________________
-লেখা তুই অযথা চিন্তা করছিস! তোর পরীক্ষা যথেষ্ট ভালো হয়েছে, তুই এডমিশনের প্রিপারেশনে মন দে।
-আমি পারছিনা ভাবী। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। নওশাদ লোকটা আমার পরীক্ষার সময়টুকুতে এত ঝামেলা করবে আমি ভুলেও ভাবিনি। বিশ্বাস করো ভাবী এক্সাম হলে যতবার আমায় হ্যারাস করা হয়েছে তার হিসেব করে আমি শেষ করতে পারবো না। ঐ লোকটার শাস্তি না হওয়া অবধি আমি কিভাবে ভালো থাকবো বলো। মেডিকেল আমার স্বপ্নের চেয়েও দামি কিছু, যেখানে আমি আমার ভালোবাসাকেও উপেক্ষা করেছি সেখানে ঐ লোকটা কেন আমার সাথে এমন করলো?
-দেখ, ক্ষমতা ব্যবহার করে আর কতদূরই বা যাবে! তাছাড়া এইচএসসির খাতা তো আর ঐ লোক দেখতেছে না। তোর না ক্লাস ছিল আজ বিকালে? আমি রেখে আসবো?
-ক্লাস অনলাইনে নিবে আজ, জানানো হয়েছে।
-রঙ্গনের সাথে কথা হয়েছে তোর? দশদিন হলো ঢাকায় এসেছিস, ওকে একবার জানানো উচিত না?
-চার মাস ধরে কথাই হয়নি আমাদের আর তো জানানো। ওর সাথে একদিন কথা বললে পরের এক সপ্তাহ আমার আর পড়ায় মন বসে না ভাবী! তোমার এই ফুপাতো ভাইটা এমন কেন বলো তো।
-উহুম উহুম…প্রেম জমে ক্ষীর?
-ধূর! যাও তো তুমি। খালি কেমন কেমন করো!
-আচ্ছা স্যরি। অর্ণব ভাইয়া তোকে রেখে যাওয়ার পর থেকেই দেখতেছি তোর মন খারাপ। বাদ দে তো আমার চাচার কথা। ঐ লোকটা মানুষের কাতারেই পড়ে না।
-এত সহজে তো ছাড়বো না ভাবী। ওনার শাস্তির ব্যবস্থা না করে আমি এসেছি ভেবেছো? সময় আসলেই বুঝতে পারবে।
-আচ্ছা বুঝেছি। ফালুদা বানাবো ভাবছি। তুই বসে থেকে পড়, আমি বানিয়ে আনছি।
সাথী চলে যেতেই চিত্রলেখার মন আবারো খারাপ হয়ে গেল। ঢাকা শহর তার মোটেও ভালো লাগছে না। কেমন যেন দম বন্ধ করা শহর। সেই পরীক্ষার আগে একবার সুবহার সাথে কথা হয়েছিল, তারপর থেকে তারও খোঁজ নেই। রঙ্গনকে তো কল করারই সাহস পায়নি চিত্রলেখা। আগের কলের লজ্জা কাটিয়ে উঠতেই বোধহয় তার বছর দেড়েক লাগবে আরো।
চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করলেই নওশাদ লোকটার কুৎসিত চেহারা ভেসে উঠে। এমন একটা পরীক্ষা যায়নি যেখানে পরীক্ষার হলে তার পাঠানো লোক এসে চিত্রলেখাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে এক্সপেল করার চেষ্টা করেনি! একমাত্র সে-ই জানে কোন যুদ্ধে সে নেমেছে। নওশাদকে তো সে ছাড়ার পাত্রী মোটেও নয়। নিজের শহর ছাড়ার আগেই সে সব বন্দোবস্ত করে এসেছে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সময় জিনিসটাই ইদানিং চিত্রলেখার সাথে শত্রুতায় মেতে উঠেছে। মেডিকেল পরীক্ষার সময় আর কয়েক মাস মাত্র। আগামী চল্লিশ দিনের মধ্যে বোর্ডের রেজাল্ট আসবে। তার এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে মেডিকেল এক্সাম হবে। সরকারের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েও লাভ নেই। চিত্রলেখা জানে সে এক অভাগা ব্যাচের স্টুডেন্ট। এখন সময়কে দোষারোপ না করে তাকেই যথাসাধ্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
অনলাইন ক্লাস করতে বসে আজ খানিকটা বিরক্ত হলো চিত্রলেখা। আজকে এক নতুন টিচার ক্লাস নিচ্ছে। ফিজিক্সের ক্লাস চলছে, বুয়েটিয়ান টিচার সম্ভবত তবে তার কথাবার্তার মাঝে চিত্রলেখার অদ্ভুত একটা অস্বস্তির রেশ রয়ে যাচ্ছে। চিত্রলেখা ক্লাস না করেই ডিসকানেক্ট করে বেরিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ মনে হলো ভুল করে ফেলেছে। মাঝ ক্লাস থেকে লিভ নিলে ব্যাপারটা আরো বেশি দৃষ্টিগোচর হবে আর কোচিং থেকে এলার্ট আসবে এটার। চিত্রলেখা নিজের কাজের উপরই বিরক্ত হলো। পরিকল্পিত সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফালুদা খেতে খেতে আবার বই হাতে নিল সে।
__________________________
-করতেছে টা কী এখন?
-পড়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ আছে?
-তোমার ননদ পড়তে পড়তে পাগল হয়ে যাবে আপা, আমি বিয়ের আগেই বউহারা হতে চাই না!
-রঙ্গন! তুমি এখনো বাচ্চাই আছো, আচ্ছা শোনো।
-কী?
-সামনের সপ্তাহের রবিবার কী বলো তো।
-রবিবার!
-গাধা! ঐদিন তোমার প্রেমিকার জন্মদিন।
-কী! অবশ্য তোমাদের কৃপায় যতসময় পাইছি প্রেম করার, তাতে জন্মদিন জানবো ভাবলা কেমনে? সব খাটাশ তোমরা!
-বেয়াদব, বড় আপার সাথে এইভাবে কথা বলে?
-আচ্ছা স্যরি। সামনের সপ্তাহে জন্মদিন তো! আচ্ছা ঠিক আছে। আমার সাথে প্রথম জন্মদিনটা সেরা জন্মদিন হবে রঙ্গনার।
-আয়হায়!
-আহা আপা, লজ্জা দিও না। আমি রাখছি, তোমার ননদকে একটু কম পড়তে বলো। ডিএমসির সব সীট কি একাই দখল করতে চায়?
-গুণী-জ্ঞানী বউ পাচ্ছো, শুকরিয়া আদায় করতে শিখো ছেলে।
-আলহামদুলিল্লাহ। এখন তুমি একটু আমার বউয়ের খেয়াল রাখো আপা, আমি পরে কথা বলবো।
-আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ।
সাথী কল কেটে দিয়ে হাসতে থাকলো। অবশেষে চিত্রলেখার জীবনে একটুখানি সুখের আভাস তো পাওয়া যাচ্ছে! রঙ্গন ছেলেটা মারাত্মক ভালোবাসে চিত্রলেখাকে। মানুষ আর কী-ই বা চায় জীবনে? চিত্রলেখা তো সারাজীবন একটুখানি ভালোবাসাই চেয়েছিল, একটুখানি নিখাদ ভালোবাসা। সাথী মুচকি হাসতে হাসতে চিত্রলেখার ঘরের দিকে এগোলো। সারাদিন ধরে পড়ছে মেয়েটা! ঠিকমতো একটু গল্পও তো করা দরকার।
-এই লেখা, ফালুদা শেষ করেছিস?
-হুম ভাবী, অনেক সুন্দর বানিয়েছো।
-তোর তো ক্লাস ছিল এখন, করলি না যে?
-আর বলো না ভাবী, আজ যে স্যারটা ক্লাস নিতে এসেছিল কেমন জানি করে কথা বলে। মানলাম স্যার ইয়াং, হয়তো আমাদের চেয়ে বড়জোর বছর তিনেকের বড় কিন্তু স্যার তো! তার কথাবার্তা যদি অতিরিক্ত ফ্র্যান্ক হয়, সেটা দৃষ্টিকটু না?
-হুম। তোদের সময়টা বড্ড অদ্ভুত রে। এখন শিক্ষক হতে খুব বেশি নীতিবান হতে হয়না। তাই শিক্ষকরাও নিজেদের সম্মানের জায়গাটা ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তোদের জেনারেশনে তাল মিলাতে গিয়ে তারা নিজেদের সম্মান খুইয়ে ফেলছে।
-ভালোই বলেছো ভাবী।
মিনিট বিশেক গল্প করলো চিত্রলেখা। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেকটা ক্লান্তি যেন দূর হলো। এখন একটু ঘুমিয়ে শেষরাতে উঠে আবার পড়তে হবে। ঘুমোনোর জন্য টেবিল থেকে উঠতেই ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। চিত্রলেখা বিরক্তিতে চ’কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করলো। ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ফোন বেজে উঠার মতো কর্কশ কাকের ডাকও নয়! চিত্রলেখার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ফোনটাকে ব্লেন্ডারে ঢুকিয়ে একদম গুড়ো গুড়ো করে ফেলছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। চিত্রলেখা ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া কিছুই রাখেনি। হোয়াটসঅ্যাপেই এসেছে মেসেজটা। মেসেজ ওপেন করলো সে।
“আসসালামু আলাইকুম আপু। তুমি আজকে আমার ক্লাসটা করোনি। কোনো অসুবিধা? আসলে আমি স্টুডেন্টদের সাথে খুব বেশি ফ্রি। কোধো সমস্যা থাকলে দয়া করে আমাকে জানিয়ো।”
মেসেজটা পড়ে চিত্রলেখার মাঝে বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না তবে চিত্রলেখা বুঝতে পারলো সে বোধহয় অযথাই ভুল বুঝেছিল লোকটাকে। চিত্রলেখা নাম মনে করার চেষ্টা করলো স্যারটার। বোধহয় আহাদ নাম। চিত্রলেখা বুঝতে পারলো না রিপ্লাই করবে কি করবে না। আর রিপ্লাই করলেই বা কি রিপ্লাই করবে! বাড়তি ভাবনাচিন্তা এবং ফোন উভয়ই রেখে চিত্রলেখা ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন সকাল নয়টায় ক্লাস আছে কোচিংয়ে।
________________
নয়টার ক্লাসের কথা ভেবে সাড়ে আটটায় বেরিয়েছিল চিত্রলেখা কিন্তু ঢাকার জ্যাম তাকে ঠিকই দশ মিনিট লেইট করালো। প্রথমে আবার সেই আহাদ স্যারের ক্লাস! দশ মিনিট পর ক্লাসে ঢোকার পারমিশন চাইছে সে। কত জোড়া চোখ যে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছে তা অনুভবও করতে চায় না সে। আহাদ বিশেষ কোনো বাক্য উচ্চারণ না করে কেবল নাম জিজ্ঞাসা করে তাকে বৃতরে আপার অনুমতি দিল। চিত্রলেখার নাম বলতেও খানিকটা সংকোচবোধ হচ্ছিল। যে বিষয় থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়াতে চায়, তা-ই যেন বারবার মূর্তির মতো সামনে এসে উপস্থিত হয়। চিত্রলেখা আহাদকে যত বেশি উপেক্ষা করতে চেয়েছিল ঠিক ততটাই তার চক্ষুর সম্মুখে আসতে বাধ্য হচ্ছে চিত্রলেখা।
চলবে..