#চিত্রলেখার_কাব্য
পঁয়ত্রিশতম_পর্ব
~মিহি
“চাচা…” সাথীর যেন মাথা ঘুরে উঠলো। তার ছোট চাচা চিত্রলেখাকে দেখতে এসেছে? আসলেই? অপর্ণার কি নূন্যতম জ্ঞানবুদ্ধি নেই? সাথী চিত্রলেখাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। কাচের টুকরোগুলো মেঝেতেই পড়ে রইলো। নওশাদ কেবল অগ্নিদৃষ্টিতে সাথীর প্রস্থান দেখলো। অর্ণবও খানিকটা বিব্রতবোধ করছে। নওশাদ দেখতে বয়স্ক মনে না হলেও বয়সটা তো তার বেশিই। তাও আবার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। অপর্ণা এমন প্রস্তাব কী করে আনলো ভেবে পেল না সে।
“ভাইয়া, আমার কথা আছে তোমার সাথে।” কথাটুকু বলে চিত্রলেখা আবারো ঘরের ভেতরে চলে গেল। অর্ণব মাত্র উঠেছে ঘরে যাওয়ার জন্য, নওশাদ তাকে আটকালো।
-আপনার সাথে কিছু কথা বলে রাখি। যদিও সম্পর্কটা বেমানান ঠেকবে তাও ভাই-ই ডাকলাম। চিত্রলেখা আপনাকে কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছে। সে কী বলবে আমি জানি। চিত্রলেখা একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ছেলেটা কে জানেন? রঙ্গন আহমেদ, আমার ভাগ্নে। চিত্রলেখাকে পছন্দ করার কথা বলেছিলাম বলে সে আমায় মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। ছেলেটার আচরণের কথা আমি না বলি, শুধু এটা জেনে রাখুন সে আমাদের আপন কেউ না। এখন একজন জন্মপরিচয়হীন ছেলের আচরণ কেমন হবে তা আপনার অজানা নয়। এ বিয়ে আটকাতে চিত্রলেখা হয়তো আমার নামে অনেক নোংরা কথাই বলতে পারে তবে আমি রাজনীতিতে থাকলেও নিতান্তই সহজ সরল মানুষ। শত্রুর অভাব নেই তা তো জানেন, কয়েকদিন আগেও আমাকে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। চিত্রলেখাও সেরকম কোনো মিথ্যেরই আশ্রয় নিবে। আমি তাকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম বিধায় প্রস্তাব এনেছি। আপনি চাইলেই আমাকে না করে দিতে পারেন, আমার আপত্তি নেই।
-আপনি বসুন, আমি লেখার সাথে কথা বলে আসছি। যেহেতু আপনি একা এসেছেন, আজকে বোধহয় কথা না বাড়ানোই ভালো। আপনি খাবার খান। আমি আসছি একটু পর।
_______________________
অর্ণব ঘরে প্রবেশ করতেই সাথী বেরিয়ে গেল। অর্ণব চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ালো। চিত্রলেখার ভয় ক্রমশ বাড়ছে। লোকটার চেহারা দেখলেও তার গা গুলিয়ে আসে। তার ঐ নোংরা চাহনি আবারো মনে ভেসে উঠে চিত্রলেখার।
-বল কী বলবি।
-ভাইয়া, তুমি ঐ লোকটার সাথে আমার বিয়ের কথা ভাবছো?
-দেখতে এসেছে, বিয়ে হয়ে যায়নি। তাছাড়া বয়স একটু বেশি ছাড়া আর কীই বা দোষ আছে ওনার? তোকে পছন্দ করে বলেই প্রস্তাব দিতে এসেছে।
-ভাইয়া …ঐ লো..লোকটা..
চিত্রলেখার শ্বাসকষ্ট অনুভব হচ্ছে। চেয়েও যেন কথাগুলি বলতে পারছে না সে। অর্ণবের সাথে দূরত্বটা যেন কদিনেই কয়েকগুণ বেড়েছে।
-তুই বলবি কিছু? এভাবে চলে আসাটা মোটেও ভালো দেখায় না।
-ভাইয়া, ঐ লোকটা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার দিকে নোংরা…
-তুই রঙ্গনের কথায় এসব অপবাদ দিচ্ছিস ওনার নামে? তোর লজ্জা করেনা? লোকটা তো বয়সে বড় তোর! এত নোংরা চিন্তা কী করে করতে পারিস তুই? রঙ্গনের উপর খুব টান? ঐ ছেলেটা যে জন্মপরিচয়হীন তা নিশ্চয়ই বলেছে সে তোকে? বলেনি?
চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। নওশাদ লোকটা নিম্নমানের তা সে জানতো কিন্তু এতটা নিচু তা সে বুঝতে পারেনি। নিজের স্বার্থে নিজের বোন কিংবা ভাগ্নে কাউকেই পরোয়া করলো না সে!
-চুপ করে আছিস কেন লেখা? তুই ভাবলিই বা কী করে ঐরকম ছেলেকে আমি মানবো? টাকা থাকলেই সব হয়না লেখা। তোর জন্য ভালো হবে ঐ ছেলের কথা ভাবা বাদ দে। আশফিনা আহমেদকে তুই ভালোমতোই চিনিস। ঐ মহিলা তোকে কোনোদিন সুখে থাকতে দিবে? নওশাদের সাথেই তোর বিয়েটা করতে হবে এমন কথা নেই তবে রঙ্গনের চিন্তা বাদ দে।
অর্ণব চিত্রলেখার কথার অপেক্ষা করলো না। ঘর ছেড়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। চিত্রলেখা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। আসলে হচ্ছেটা কী তার সাথে? তার জীবন নিয়ে কি সিনেমা চলছে? যে যা পারছে করেই যাচ্ছে তার সাথে! এবার সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে তার। ভালো থাকার অভিনয় অনেক করেছে, এবার ভালো থাকার সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।
_________________________________
-লেখা, তোর কি উচিত না রঙ্গনকে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া?
-রঙ্গন যখন সব জানতে পারবে, তখন সে এটাও জানবে যে সে আশফিনা আন্টির আসল ছেলে নয়। এ সত্যটা আন্টি লুকিয়ে রেখেছে এত বছর ধরে। আমার কারণে রঙ্গন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সঙ্কটে পড়ুক তা আমি চাইনা ভাবী।
-তো এখন কী করবি? অনিকের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছি না, ফোনটা যে কী করেছে! কোন বন্ধুর ওখানে উঠেছে তাও বলেনি। অর্ণব ভাইয়ের কথাবার্তাও কেমন জানি ঠেকছে। লেখা, তুই আদৌ ভেবেছিস কী করবি?
-হুম। ঘুমাবো।
চিত্রলেখা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সাথী কথা বাড়ালো না। দুপুরের পর থেকেই চিত্রলেখা এমন করছে। অপর্ণা বেশ খুশি, অর্ণবের হাবভাব বোঝা যাচ্ছে না। সাথী কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ফোন হাতে নিয়ে রঙ্গনকে কল করবে কি করবে না ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো। চিত্রলেখা মেয়েটার জীবনে দুঃখ এত বেশি কেন ভেবে পায়না সাথী। বাবা থাকা সত্ত্বেও বাবার আদর পায়নি, এক ভাইয়ের স্নেহ যখন পেয়েছে তখন অন্যজন মুখ ফিরিয়েছে। একসাথে সুখ কখনো ধরা দেয়নি মেয়েটাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাথী। সেও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
সকাল সকাল অর্ণব তৈরি হচ্ছে। বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে সে, ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। চিত্রলেখা ঘর থেকে বেরোয়নি। অর্ণবও কথা বাড়ায়নি। নওশাদের সাথে চিত্রলেখার বয়সের গ্যাপটা সেও বুঝতে পেরেছে। জেনেবুঝে এমন ছেলের হাতে তো আর মেয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া সম্পর্কটাও গোলমেলে হয়ে যায়। ভাবীর চাচা হবে কিনা দুলাভাই! বলতেও অন্যরকম শোনায়। এসব নিয়ে আপাতত ভাবতেই চাইছে না অর্ণব। চিত্রলেখাকে খানিকটা ভয় দেখাতে চেয়েছিল সে যেন মেয়েটা ভালোবাসার মায়াজাল থেকে সরে আসে। জীবনের অন্যতম দুইটা বছরের মূল্য যেন বুঝতে শিখে। চিত্রলেখার বিয়ের আলাপ করে রঙ্গনের কথাটা জানতে পেরেছে সে। এতে অবশ্য সুবিধেই হলো। রঙ্গনের থেকে চিত্রলেখাকে যতটা পারা যায় দূরে রাখতে হবে। এসব ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। আশেপাশে কাউকে না দেখে অর্ণব নিজেই গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই অপর পাশে রঙ্গনকে দেখে খানিকটা চমকালো সে। এত সকালে রঙ্গনকে নিজের বাড়ির সামনে মোটেও আশা করেনি সে। ভালোবাসা তবে এতটাও ঠুনকো নয় দুজনের, খানিকটা জটিলই বিষয়টা!
-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, ভেতরে আসতে পারি?
-কী দরকার তোমার? এখানে কেন এসেছো?
-ভাইয়া, বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে আলাপ করলে বিষয়টা ভালো দেখাবে না।
-ভেতরে এসো।
রঙ্গন আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকেই চোখজোড়া যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লো চিত্রলেখাকে খুঁজতে। বিষয়টা অর্ণবেরও নজর এড়ালো না।
-বোসো, কী দরকার বলো।
-ভাইয়া, আমি চিত্রলেখার সাথে একটু দেখা করতে চাই।
-ওর সাথে কী দরকার তোমার?
-ভাইয়া, আমি ওকে ভালোবাসি।
-তো?
-আমি বিয়ে করতে চাই ওকে। আপনার অনুমতি থাকলে..
-আমার অনুমতি নেই, তুমি আসতে পারো।
-কারণ জানতে পারি? এতটা অযোগ্য বোধহয় আমি নয়।
‘রঙ্গন!’ অর্ণব কিছু বলার আগেই চিত্রলেখা খানিকটা জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো। রঙ্গন চাতক পাখির মতো সেদিকে তাকালো। চিত্রলেখার চোখ লাল। রঙ্গনের বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। সে ভাবতো এসব যন্ত্রণা বোধহয় কাল্পনিক তবে এ প্রথম সে অনুভব করলো অন্য কারো চোখের পানি তার বুকে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে।
চিত্রলেখার অর্ণবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রঙ্গনকে কিছু বলার সাহস না হলেও সে বাধ্য আজ। অর্ণবকে না আটকালে সে অবশ্যই রঙ্গনের জন্মপরিচয়ের কথা তুলবে যা রঙ্গনকে কোনোভাবেই জানতে দেওয়া যাবে না।
-ভাইয়া, আমি রঙ্গনের সাথে একটু কথা বলতে চাই শেষবারের মতো।
‘শেষবারের মতো’ বাক্যাংশটা রঙ্গনের কর্ণকুহরে কুৎসিত কোনো ঘণ্টার আওয়াজের ন্যায় বিশ্রি শব্দের ঝংকার তুললো। চিত্রলেখা শেষবারের মতো বলতে কী বোঝাতে চাইলো? চিত্রলেখা কি বিয়েতে রাজি? রঙ্গনের ব্যাকুলতা যেন ক্ষণিকেই বেড়ে গেল আকাশসম।
চলবে…
#চিত্রলেখার_কাব্য
ছত্রিশতম_পর্ব
~মিহি
আশফিনা আহমেদ বিরক্ত বোধ করছেন তা তার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে। চিত্রলেখার কথায় তিনি এখানে আসার পাত্রী মোটেও নন তবে রঙ্গনের খাতিরে তাকে আসতে হয়েছে।
-চিত্রলেখা, যা বলার বলো। এভাবে ঘটা করে সবাইকে এক জায়গায় এনে বসিয়ে রেখেছো কেন?
-হিসাব মিলাচ্ছিলাম আন্টি। যাই হোক, কিছু কথা বলার ছিল আপনাদের উদ্দেশ্যে। আপনার সাথেই প্রথমে আলাপ সেরে নেই তবে।
চিত্রলেখার কণ্ঠস্বরে খানিকটা বিব্রতবোধ করলেন আশফিনা আহমেদ। অদ্ভুত এক তেজী স্বর! এটা কি চিত্রলেখার কণ্ঠস্বর? নাকি অন্য কেউ ভর করেছে তার মাঝে?
অপর্ণা এবার বেশ খানিকটা রেগে গেল। অর্ণব না থাকলে সে নির্ঘাত কষে একটা থাপ্পড় লাগাতো চিত্রলেখার গালে। আশফিনা আহমেদ আশেপাশের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিচক্ষণতা ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
-কী বলতে চাও সাফ সাফ বলো।
-আপনার ছেলেকে আমি ভালোবাসি এ কথা আপনি জানেন আন্টি। আমায় আপনি পছন্দ করেন না সেটাও আমি জানি। আপনার ইচ্ছেটা আংশিক পূরণ হবে কারণ আগামী তিন বছরের জন্য আমি আপনার ছেলের থেকে একেবারে দূরে সরে যাচ্ছি। তিন বছর পর আমার সাথে সাক্ষাৎ করে যদি আপনার আপত্তি থাকে তবে আমি রঙ্গনকে বিয়ে করবো না।
-এটা কি তুমি ভেবে বলছো?
-জ্বী। আপনি রাজি?
-হ্যাঁ!
-বেশ তাহলে আপনার সাথে আমার কথা শেষ। আপনি এখন এই জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে ফিরতে পারেন।
আশফিনা আহমেদ চিত্রলেখার স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথায় অনেকটাই ঘাবড়ে গেছেন। মেয়েটা যে এতটা কাট কাট কথা বলবে তা তিনি ভেবে আসেননি।
“এসো রঙ্গন” আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে তার সাথে যেতে বললেন। রঙ্গন তখনো চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে আছে। তার নিজেকে পুতুল মনে হচ্ছে এখন।
-রঙ্গনের সাথে আমার কথা হয়নি আন্টি, ও একটু পরে আসুক? শেষদিন তো!
-বেশ।
আশফিনা আহমেদ কথা বাড়াতে চাইলেন না। এ বাড়ির পরিস্থিতি তার দম বন্ধ লাগছে। রঙ্গনকেও নিয়ে আসতেন তবে চিত্রলেখার কথায় অদ্ভুত একটা মায়া অনুভব করে আর বাড়তি কথা বললেন না। রঙ্গন মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। সাথী সবকিছু দেখছে কেবল। সে বোঝার চেষ্টা করছে রঙ্গনকে সব জানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা কতটুকু সঠিক ছিল। চিত্রলেখা এবার অপর্ণার মুখোমুখি দাঁড়ালো।
-ভাবী, যে লোকটার বিয়ের প্রস্তাব আপনি এনেছেন তাকে আপনি কিভাবে চেনেন?
-না চেনার কী আছে? উনি তো সাথীর চাচা হন। সেই সূত্রে…
-তাহলে ভাবীর চাচা মানে আমারও চাচা? তার সম্বন্ধ আপনি কেন আনলেন?
-আজব তো, উনি তোকে পছন্দ করে তাই..
-উনি আমাকে পছন্দ করে এ কথা আপনি জানলেন কী করে?
-কোর্টে যখন দেখা হয়েছিল তখন বলেছিলেন।
-কোর্টে যখন সবাই ছোট ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত ছিল তখন আপনি ওনার সাথে কথা বলেছেন? তাও আবার এ বিষয়ে? এতক্ষণ সময় ধরে তো কথা বলতে দেখিনি আপনাকে।
-তুই বলতে কী চাইছিস? আমি পরে ওনার সাথে কথা বলেছি। তখন উনি প্রস্তাব দিয়েছেন।
-এটা আপনি ভাইয়াকে জানিয়েছিলেন?
-ওকে জানাতে হবে কেন?
-সেটাই তো। ভালো কথা বলেছেন। আমিই কথা বলছি ভাইয়ার সাথে।
চিত্রলেখা অপর্ণার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। অপর্ণা আসলে চাইছে টা কী?
-ভাইয়া, আমি ভাবতাম তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করো। পরিস্থিতি যেমনই হোক তুমি আমার পাশে থাকবে। হোস্টেলের ঘটনার সত্যতা একবারো আমার কাছে তুমি জানতে চাওনি। সে রাতে আদৌ আমার কাছে কেউ এসেছিল নাকি ঘটনা অন্যকিছু একবারো জানতে চেয়েছো? তোমার দোষ আমি দিচ্ছি না। সে রাতে আমার রুমমেটের বন্ধু এসেছিল এবং খুব সুনিপুণভাবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে যার প্রমাণ আমার কাছে নেই। এখন সবটা তোমাদের বিশ্বাসের উপর। রঙ্গন, আপনারও মনে হয় আমি কোনো ছেলেকে এনেছিলাম রুমে?
-আমি তোমাকে বিশ্বাস করি চিত্রলেখা তবে ভাইয়া শুধুমাত্র পরিস্থিতির কারণে…
-ব্যাখ্যা চাইনি রঙ্গন। আমার ব্যাখ্যা কেউ জানতে চায়নি একবারও, আমিও চাইনা। ভাইয়া, আমি কেন হোস্টেলে গিয়েছি জানো? তোমার বউয়ের মা আমাকে কল করে যা নয় তা বলেছে। আমি লজ্জায় এ বাড়িতে আর থাকতে পারিনি। এ কথা আমি বলতাম না কিন্তু আমার ধৈর্য শেষ। আমার সহ্যক্ষমতাও অবশিষ্ট নাই আর।
-মানে? এসব আগে বলিসনি কেন তুই?
-আগে বললে কী করতে? বিশ্বাস তো হারিয়েই ফেলেছি! ঐ নোংরা লোকটা আমায় রেপ করার চেষ্টা করেছিল এটা বিশ্বাস করেছো? করোনি! রঙ্গন বিশ্বাস করেছে ভাইয়া। আমার এক কথায় সে বিশ্বাস করে নিজের মামাকে আঘাত করেছে। ওর মাঝে আমি তোমার প্রতিচ্ছবি দেখি যে আমাকে আগলে রাখতে জানে। আমার ভালোবাসা কী ভুল ভাইয়া?
-লেখা, তুই ভুল বুঝিস না আমাকে। আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী যা সঠিক মনে হয়েছে তাই ভেবেছি। আমি এখনো তোকে বিশ্বাস করি বলেই তোর সাথে হোস্টেলের ঘটনা নিয়ে কোনো কথা বলিনি।
-তোমার বউ বাকি কাজ করে দিয়েছে, তাইনা ভাবী? এলকায় খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি তো? কষ্ট হয়েছে ভাবী? তুমিও তো একটা মেয়ে! আমার ভাবী হও তুমি? একটুও খারাপ লাগলো না?
অপর্ণা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সাপের ন্যায় ফোঁস করে উঠলো। নিজের উপর আনীত অভিযোগ কাঁটার ন্যায় চুবছে তার শরীরে।
-একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবি না! নিজে কুকর্ম করে আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো? লজ্জা করেনা?
-ভাইয়া, ভাবী যে একটা নতুন নেকলেস কিনেছে তা কি তোমায় দেখিয়েছে? দাঁড়াও আমি দেখাই।
চিত্রলেখা রূপসাকে ডাকলো। রূপসা ভেতরের ঘরে খেলছিল। চিত্রলেখার ডাকে দৌড়ে বাইরে আসলো।
-রূপ, আমাকে যে সুন্দর মালাটা দেখিয়েছিলে না ঐটা আনো তো পাখি।
-ঐ তো সুন্দরটা?
-হ্যাঁ।
-দাঁড়াও।
রূপসা দৌড়ে অপর্ণার ব্যাগ থেকে নেকলেসটা বের করে এনে চিত্রলেখার হাতে দিয়ে দৌড় দিল। অপর্ণার মুখ চুপসে যেতে সময় লাগলো না। অর্ণবের চোখ লাল হয়ে এসেছে। এসব যদি সত্যি হয় তবে আজ অপর্ণার সাথে সে কী করবে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে না।
-অপর্ণা, এটা তুমি কিনেছো?
-না, মা…মা দিয়েছে আমাকে। বাড়িতে গিয়েছিলাম না তখন মা…
-মিথ্যে বললে তোমাকে এই মুহুর্তে তালাক দিব আমি। কল দিব তোমার বাড়িতে? তোমার মাকে না, তোমার বাবাকে কল করবো। তিনিই বলবেন সত্যিটা!
-না…এ…এটা ন…নওশাদ চাচা দি..দিয়ে…
অপর্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে থাপ্পড় পড়লো অর্ণবের। একটা থাপ্পড়ে অর্ণবের রাগ ক্ষান্ত না হলেও সে নিজেকে স্থির করলো। আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি এখনো।
চিত্রলেখার এই প্রথম কাউকে কষ্ট পেতে দেখে আনন্দ হচ্ছে। অপর্ণা নামক মানুষটার প্রতি সে এতদিন ছোটখাটো ক্রোধগুলো জমিয়ে রাখতো যা আজ আগ্নেয়গিরিতে রূপ নিয়েছে। অপর্ণা আসলে ভুলে গিয়েছিল আগ্নেয়গিরি সুপ্ত থাকে ঠিকই তবে চিরকাল নয়। অর্ণব অপর্ণার দিকে পুনরায় হাত তোলার আগেই থামালো চিত্রলেখা।
-দাঁড়াও ভাইয়া, কথা তো শেষ হতে দাও। তারপর তোমার বউকে যা ইচ্ছে কোরো। আমার বলার তেমন কিছু নেই। আগামী তিন বছর সময় দরকার আমার। তোমার কাছে দুইটা রাস্তা খোলা। প্রথমত আমার মায়ের সমস্ত গয়না এবং আমার নামে লিখে দেওয়া মায়ের জমি আমাকে দেওয়া অথবা তিন বছরে আমার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ দেওয়া। আমি জানি তুমি এমনিতেও আমার পড়াশোনার খরচ দিতে অস্বীকার করতে না কিন্তু তোমার বউয়ের সমস্যা থাকতেই পারে আর কী!
-লেখা, তুই শান্ত হ। তারপর আমরা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবো।
-আমার শান্ত থাকার সময় আমি পার করে এসেছি ভাইয়া। তুমি কোনটা চাও বলো। আমার জমিজমা ফেরত দিতে নাকি পড়াশোনার খরচ?
-খরচ আমি দিব এবং জমিও তোর থাকবে। তুই নিজেকে শান্ত…
অর্ণবের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলো না চিত্রলেখা। রঙ্গন এতক্ষণ নোনা চোখে সবটা দেখছিল। চিত্রলেখা তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই সে খানিকটা ভীত হলো। অন্য সকলের মতো তার জন্যও কি অভিযোগ বাক্স ভরেছে চিত্রলেখা?
“আমার জন্য অপেক্ষা করবেন রঙ্গন? আগামী তিনটা বছর? আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি আপনাকে অপেক্ষা করাচ্ছি। আমার উপর ভরসা থাকবে তো আপনার? তিন বছর পর আপনার সামনে দাঁড়ালেও আপনার রঙ্গনা হয়েই থাকবো তো?” চিত্রলেখার আকুতি যেন রঙ্গনের বুকে এসে ধাক্কা দিল। রঙ্গনের ইচ্ছে করলো চিত্রলেখাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,”আমি জনমভর অপেক্ষা করবো, তুমি শুধু আমারই থেকো।”
চলবে…