চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-৩২

0
530

#চিত্রলেখার_কাব্য
বত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

“কোনো এক সময় আমি তোমায় ভালোবেসেছিলাম চিত্রলেখা তবে তা একতরফা। একতরফা ভালোবাসাটা আমি আড়ালেই রেখেছি সবসময় কিন্তু মনের গহীনে তোমায় আর স্থান দিব না আমি। আজ এই একটা সইয়ের সাথে সাথে তোমার প্রতি আমার যে অনুভূতি ছিল, তাও আমি দাফন করলাম।” কথাগুলি মনে মনে আওড়ে কাবিননামায় সাক্ষর করলো সিয়াম। এখন থেকে সুবহাই তার জন্য হালাল, অন্য সকল অনুভূতিকে সে আর স্থান দিতে চায় না মনে। অন্তত চিত্রলেখার প্রতি নিজের অনুভূতিগুলোকে তো নয়ই, সে অনুভূতির কথা না সুবহা জানবে আর না চিত্রলেখা।

বিয়ে সম্পন্ন হতে হতে সাড়ে চারটা বাজলো। চিত্রলেখা প্রতিটা মুহূর্তে সুবহার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সুবহার চাহনিতে বুঝেছে সে, সিয়ামকে সুবহা একটু হলেও পছন্দ করে। বিয়ের সমস্ত দৃশ্য সুবহার বাবা ভিডিও কলে দেখলেন। তার চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়ালো। মেয়েটাকে তিনি অনেক শিক্ষিত করে তবেই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তবে সিয়ামের উপর তার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।

বিয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন হলেও চিত্রলেখার জন্য ভালোই বিপদ হলো। হোস্টেলে টাইমের আগে না ঢুকতে পারলে তো আর ঢুকতেই দিবে না। এখন রিকশায় গেলেও অনেক সময় লেগে যাবে। চিত্রলেখা গেল সুবহার কাছে বিদায় নিতে।

-সুবহা শোন, রাগ করিস না। আমার ফিরতে হবে। তোরা কাল চলে যাওয়ার আগে আমি এসে দেখা করে যাবো।

-কাল তো আমরা ভোরে চলে যাবো রে। তুই আজ থাক আমার সাথে।

-হোস্টেল থেকে বাড়িতে কল করবে তাহলে, ঝামেলা হবে রে। তাছাড়া আবার আসলে দেখা তো হবেই। নিজের খেয়াল রাখিস।

-তুই একা এখন রিকশায় গেলে সময়মতো পৌঁছাতে পারবি? তার চেয়ে ভাইয়া তোকে বাইকে রেখে আসুক।

-গাধার বাচ্চা, বর হয় তোর! ভাইয়া ডাকতেছিস তাকে! তাছাড়া আজ তোদের বিয়ে হয়েছে, আজকে তোরা সময় কাটা। আমি যেতে পারবো।

-তোকে রেখে আসতে ওনার বাইকে দশ মিনিট লাগবে। তুই চুপচাপ ওনার সাথে যা।

চিত্রলেখার কোনো কথাই শুনলো না সুবহা। সিয়াম তখন মাত্র বসেছিল। সুবহা তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-লেখাকে একটু রেখে আসো তো। বাইকে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবে।

-তাও ভালো ভাইয়া ডাকোনি! আচ্ছা সমস্যা নেই, রেখে আসছি। তুমি অপেক্ষা করো, আমি রেখেই আসবো। ভয় করবে না তো?

-আজব! বাচ্চা নাকি আমি?

-বাচ্চাই!

সিয়াম হাসতে হাসতে উঠে চলে গেল। চিত্রলেখার মুখোমুখি না হতে চেয়েও বারবার মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারটা বিব্রতকর হলেও কিছুই করার নেই তার, মানবিকতার খাতিরে হলেও সে চিত্রলেখাকে একা ছাড়তে পারে না।

সিয়াম বাইক স্টার্ট করলো। চিত্রলেখা খানিকটা দূরত্ব রেখেই বসলো। চিত্রলেখার হোস্টেলের সামনে এসে বাইক থামালো সিয়াম। অনেক কথা জমা থাকলেও তা আর কখনো বলা হবে না চিত্রলেখাকে, সে চায়ও না বলতে। তবে চিত্রলেখা বিদায়বেলায় একটা কথাই বললো সিয়ামকে।

-ভাইয়া, সুবহার খেয়াল রেখো। ও অনেক পাগলাটে স্বভাবের তবে ওর মতো ভালো তোমায় কখনো কেউ বাসবে না। আর হ্যাঁ ও কান্নাকাটি করলে আমার সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসো, কেমন?

-অবশ্যই। তুইও নিজের খেয়াল রাখিস, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর আমি সুবহার টিসির জন্য বলেছিলাম কলেজে। বললো সামনের সপ্তাহে দিবে। টিসির পেপারটা তুই নিয়ে স্ক্যান করে পাঠাস আমাকে।

-আচ্ছা ভাইয়া।

-আচ্ছা এখন যা। আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ।

_______________________________

অপর্ণা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মায়ের বুদ্ধিটা ভালো তবে যথেষ্ট রিস্কি।তাছাড়া নওশাদ লোকটার ভরসা নেই। চিত্রলেখাকে তুলে নিয়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু করে যদি বলে আর বিয়ে করবে না তখন ঐ বোঝা নিজের ঘাড়েই বইতে হবে। অপর্ণা এই মতলবটা বাদ দিল। অন্য কোনোভাবে আগে অর্ণবকে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে। সে রাজি না হলে তখন এইটা ব্যাক-আপ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আজ সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। অপর্ণা ঠিক করলো আগামীকাল বাচ্চাদের নিয়ে ফিরবে। অর্ণবকে জানানোর জন্য কল করলো সে কিন্তু অর্ণবের ফোন ক্রমাগত ওয়েটিং পেয়ে অপর্ণার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। রাগে জেদে ফোনটা বিছানার উপর ঢিল দিয়ে ছুঁড়লো সে।

বন্ধুর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা শেষ করে খানিকটা স্বস্তি পেল অর্ণব। ব্যবসার লস নিয়ে আলাপ করছিল। এর মধ্যে বন্ধু নয়ন বেশ ভালো একটা বুদ্ধি দিল। অল্প কিছু টাকা তার বন্ধুর কোম্পানিতে ইনভেস্ট করলে সে অনেক প্রফিট দিতে পারবে। অর্ণবের বেশ বিশ্বস্ত বন্ধু নয়ন। অর্ণব দুশ্চিন্তা করলো না। অবশেষে বোধহয় একটা সমস্যার সমাধান হতে চললো। ফোনের মিসড কল লিষ্টে অপর্ণার নম্বর দেখে ভ্রু কুঁচকালো অর্ণব। অপর্ণা এতক্ষণ ধরে কল করছিল তাকে! এখন কল ব্যাক করলে কী যুদ্ধ বাঁধাবে কে জানে তবুও অর্ণব কল ব্যাক করলো।

-হ্যালো অপর্ণা?

-কোন প্রেমিকার সাথে এতক্ষণ আলাপ করলে?

-বন্ধু কল করেছিল।

-মেয়ে নিশ্চয়ই?

-নাহ ছেলে! সবকিছু নিয়ে সন্দেহ করা বন্ধ করো। বেশি সন্দেহ করলেই অশান্তি বেশি!

-আমি কাল ফিরবো আর তোমার আসতে হবে না। আমি নিজেই যেতে পারবো।

বলেই খট করে কল কাটলো অপর্ণা। অর্ণবের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। চিত্রলেখার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে তার আর চিন্তা থাকে না। আগে শুধু চিত্রলেখা ঘাড়ের উপর বসে খেতো, এখন অনিকও। টাকা জমানোর জায়গাই নেই আর। কোনদিন যে থালা নিয়ে রাস্তায় বসতে হয়! নানান ভাবনা চিন্তা করতে করতে টিভি অন করলো সে।

__________________________________

রাত সবে আটটা অথচ চিত্রলেখার ঘুম পাচ্ছে। বই হাতে নিলেই এখন তার ঘুম ধরে। চিত্রলেখার ইদানিং না পড়া রোগ ধরেছে, মোটেও পড়তে ইচ্ছে করে না। এরই মধ্যে আবার ফোনে মেসেজের শব্দ ভেসে উঠলো। ব্যস! পড়াশোনা রসাতলে। ফোন হাতে নিয়ে মেসেজটা চেক করতে লাগলো সে। রঙ্গনের মেসেজ।

-তুমি দেখিয়াও দেখলা না, তুমি শুনিয়াও শুনলা না! জ্বালায়া গেলা মনের আগুন, নিভায়া গেলা না।

-ফায়ার বিগ্রেড ডাকো।

-তুমিই সেই ফায়ার ব্রিগেড। এখন আগুন নেভাতে তুমি আসবা না আমি আগুনসমেত যাবো?

-পুড়তে থাকো। ফায়ার ব্রিগেড এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত।

-স্যরি স্যরি, পড়ো তুমি। ঘুমানোর আগে আমাকে জানিয়ো।

-স্যরি বলা লাগবে না। এমনিতেও পড়াশোনা হচ্ছে না আমার, মনোযোগই বসতেছে না। বই হাতে নিলেই ঘুম ধরে।

-এটার একটা সল্যিউশন আমার কাছে আছে। কতটা ইফেক্টিভ হবে তা জানিনা।

-কী?

-শোনো যখন ঘুম ধরবে তখন ঐ সাবজেক্টের যেকোনো একটা চ্যাপ্টারের খুব টাফ কোনো থিওরি বা ম্যাথ করার চেষ্টা করবা।

-এতে লাভ?

-আমরা যখন অল্পবিস্তর জানা জিনিস পড়তে যাই, তখন স্বভাবতই ঘুম ধরে তবে কোনো টাফ কিছু সামনে আসলে আমাদের ব্রেইন আরো এক্টিভ হয়। সবার ক্ষেত্রে আবশ্যক না এটা। আমার মতো অলস আবার টাফ প্রবলেম দেখেই ঘুমায়ে যায়। এজন্যই পাবলিকে হয়নি। এই দুই বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এরপর থেকে খুব বুঝে-শুনে তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবো। এখন সময় নষ্ট করা একদম উচিত না তোমার।

-আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। আমি পড়া শেষ করে ঠিক ঠিক দুই ঘণ্টার পর নক দিচ্ছি।

-আচ্ছা আমি অপেক্ষা করবো।

চিত্রলেখা ফোন রেখে পড়ায় মনোযোগ দিল। বেশ কিছুদিন ধরেই পড়া ঠিকমতো হচ্ছে না, আজ যে করেই হোক মনোযোগ রাখতে হবে। রঙ্গনের বুদ্ধিতে কাজ হলো। টাফ একটা থিওরি বুঝতে গিয়ে দু ঘণ্টার জায়গায় কখন তিন ঘণ্টা পেরিয়েছে খেয়ালই হলো না চিত্রলেখার। ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে পড়লো সে রঙ্গনকে অপেক্ষা করতে বলেছিল! চটজলদি ফোন হাতে নিল সে।

-রঙ্গন? ঘুমিয়ে পড়েছো?

রিপ্লাইয়ের আশা করলো না চিত্রলেখা। দুঘণ্টা পেরিয়ে তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে। এতক্ষণ নিশ্চিত রঙ্গন ঘুমিয়ে পড়েছে বা ব্যস্ত। চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে দেড় মিনিটের মাথায় রঙ্গনের রিপ্লাই আসলো।

-ভালোই মনোযোগ বসেছে বুঝলাম। এখন এগারোটা বেজে গেছে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

-আপনি খেয়েছেন?

-তোমার তুমি, আপনি মিক্সড করে বলার অভ্যেস যাবে না? আমি খাবো এখন। তুমি খেয়ে ঘুমাও। শুভ রাত্রি।

-শুভ রাত্রি।

চিত্রলেখা কল রেখে সোজা ঘুমিয়ে পড়লো। খেতে ইচ্ছে করছে না তার। সুবহার ওখানে খেয়েছিল, তাতেই পেট ভরেছে। রঙ্গনের সাথে আজকের কাটানো দিনটা বারবারই মানসপটে ভেসে উঠছে তার। চোখ বন্ধ করলেই রঙ্গনের হাত ধরার মুহূর্তটা তার চোখের পাতায় ভেসে উঠছে। অস্বস্তি অথবা ভালো লাগা কোনো একটা অনুভূতি তাকে ক্ষণে ক্ষণে পীড়িত করছে।

রাত বারোটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। কালোরঙা হুডিতে আবৃত ছেলেটা দারোয়ানকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করলো। গার্লস হোস্টেলের দারোয়ান অথচ বারোটা বাজার আগেই ঘুম! একে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ভাবতে ভাবতে ছেলেটা খুব সাবধানে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো। কোনোরকম শব্দ না করে নীরবে এগোতে লাগলো তার প্রেয়সীর ঘরের দিকে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে