চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২৮+২৯

0
550

#চিত্রলেখার_কাব্য
আটাশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা খানিকটা বিরক্তবোধ করছে। নওশাদের অফিসে সে এসেছে তাও ঘণ্টা দুয়েক হবে অথচ তাকে এখনো হলে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু বলতেও পারছে না। এবার অপর্ণা খানিকটা বিরক্ত হয়েই নওশাদের নম্বরে কল দিল।

-এসব কী নওশাদ সাহেব? আমাকে অফিসে ডেকে এভাবে বসিয়ে রাখার মানে কী? আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।

-আপনি ভেতরে আসুন। কেউ আটকাবে না।

অপর্ণা খট করে কল কেটে বেশ রাগী ভঙ্গিতে নওশাদের কেবিনে ঢুকলো। নওশাদ অপর্ণার আসার অপেক্ষায় ছিল তবুও অপর্ণাকে বাইরে বসিয়ে রেখেছিল ইচ্ছে করেই। অপর্ণা নওশাদের মুখোমুখি বসলো।

-ভালো আছেন অপর্ণা ভাবী?

-ভালো আর কই থাকলাম ভাই। যার দেবর কয়দিন আগে জেল থেকে বেরোলো তার কী আর ভালো থাকা যায়? মানুষ থাকতে দেয় ভালো?

-অযথা চিন্তা করতেছো অপর্ণা! অনিককে দুয়েকদিন এসব ঝামেলা সহ্য করতে হতে পারে। তোমাকে যে কারণে ডাকছি সেটা শোনো।

-জ্বী বলেন!

-লেখাকে আমার পছন্দ। বলতে গেলে বিয়েতে আমার আপত্তি নেই। বুঝতেই পারতেছো। এখন চিত্রলেখার আপত্তি থাকতে পারে। সেসব দেখার বিষয় তোমার। বিয়েটা যদি ঠিকমতো হয়, তাহলে লেখা সুখেই থাকবে। পাশাপাশি তোমাদেরও সুখের অভাব হবে না। বোঝোই তো।

-সব ঠিকই আছে কিন্তু আপনার বয়সটা..বুঝতেই পারছেন। এসব ম্যানেজ করতে হবে তো। আপাতত ভাবী হিসেবে কিছু উপহার তো পেতেই পারি।

নওশাদ হাসলো। এই মহিলা যে লোভী তা সে আগেই বুঝেছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও করেছে। ড্রয়ারে থাকা নেকলেসটা বের করে অপর্ণার হাতে তুলে দিল।

-ভাবীসাহেবা, আরো উপহার কিন্তু অপেক্ষা করছে। আপনি শুধু বিয়ের বাজনাটা বাজানোর ব্যবস্থা করুন।

অপর্ণা হাসিমুখে নেকলেসটা নিয়ে আরো কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা করলো। অতঃপর নওশাদের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ভাবলো কী করা যায়। অর্ণবকে কিছু একটা বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। অপর্ণা নানান চিন্তাভাবনা করতে করতে বাড়ি ফিরলো। নেকলেসটা ব্যাগে বেশ যত্নে রেখেছে সে। আজ মায়ের বাড়িতে যাবে সে। নিজের মায়ের থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নিবে। চিত্রলেখা নামক আপদটা যখন ভালোই ভালোই ঘাড় থেকে নামছে তখন অযথা তাকে পোষার কোনো দরকারই নেই।

________________

ক্লাসটা বড্ড বিরক্ত লাগছে চিত্রলেখার। ম্যাথ ক্লাসে এসে স্যার ইতিহাস বোঝাচ্ছেন। কী আজব! চিত্রলেখার বারবার হাই উঠছে। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ফোন বের করলো সে। রঙ্গনকে কি একবার টেক্সট করবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে শেষমেশ করেই ফেললো টেক্সট।

-ব্যস্ত?

রঙ্গনের রিপ্লাই আসলো না। চিত্রলেখা আবারো মন খারাপ করে ক্লাসে মনোযোগ দিল। কোনমতে ক্লাসে মন বসাতে পারছে না সে। অদ্ভুতভাবে রঙ্গনের উপরেই তার মন পড়ে আছে। রঙ্গনের বলা কথাগুলো তার কানে বাজছে। যতবার সে রঙ্গনের কথা মনে করছে, ততবার ঠোঁটের কোণে এক প্রসারিত হাসি ঝুলছে।

রঙ্গন বাড়িতে আসার পর থেকে আশফিনা আহমেদ তার সাথে একটাও কথা বলেননি। রঙ্গনও কিছু বলতে যায়নি। বাড়িতে ঢুকেই মাথাব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে সে। আপাতত কোনোরকম হৈহৈ-রৈরৈ এর মধ্যে সে থাকতে চায় না। কিন্তু অহমের ডাকাডাকিতে ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তার।

-এই ভাইয়া, ভাবী টেক্সট করছে উঠ!

রঙ্গন লাফ দিয়ে উঠলো। অহম কী বলছে এসব! চটজলদি উঠে নিজের ফোনটা অহমের হাতে দেখে খানিকটা ঘাবড়ালো সে। তড়িৎ গতিতে ফোনটা কেড়ে নিল।

-তো শেষমেশ আমার কথাই সত্যি হলো ভাইয়া!

-অহম, বিরক্ত করিস না তো যা।

-ভাবীর সাথে দেখা করাও তো। অনেকদিন হলো দেখিই না, এখন তো পরীক্ষাও ভালো দিয়েছি। এখন দেখা করাই যায়।

-তোর ভাই-ই দেখা করতে পারতেছে না আর তো তুই! তার চেয়ে বড় কথা তোর ভাবী এখনো আমাকে এক্সেপ্ট করেনি।

-আহারে বেচারা, করে নিবে নাও। মুখে না বললেও বুঝে নিও। এখন গেলাম আমি। তোমাদের কাবাবে হাড্ডি হয়ে আমার লাভ নাই।

অহম চলে যেতেই চিত্রলেখার নম্বর মেসেজ করলো রঙ্গন।

-না আসলে ঘুমিয়েছিলাম, মাথাব্যথা করছিল।

চিত্রলেখার হাতেই ফোন ছিল। সে চটজলদি রিপ্লাই করলো,

-ওহ, শরীর কি বেশি খারাপ?

-না। কিছু বলবে?

-আপনার অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রহর থেকে কিছু তুচ্ছ মুহূর্ত ধার নিতে পারি?

-যা বলবেন আপনি!

-আর এক ঘণ্টার মধ্যে আমার ক্লাস শেষ। কলেজের বাইরে অপেক্ষা করতে পারবেন?

-হ্যাঁ। তুমি ক্লাস শেষ করে কল দিও। আমি ফাইরে অপেক্ষা করবো।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখার একেকটা টেক্সট রঙ্গনের বুকে আঘাত করছে যেন। চিত্রলেখা তার দুঃসময়ের বন্ধু থেকে কি তবে প্রেয়সী হতে চললো?

_____________

অর্ণব দুপুরের খাবার বাড়িতে বসেই খাচ্ছে। ব্যবসার অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। বিক্রি নেই বললেই চলে, অদ্ভুতভাবে তাদের দোকানের ডিমান্ড যেন একেবারে তলানিতে মিশে গেছে। এ অবস্থায় কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না অর্ণব। তার উপর এখন অনিকেরও চাকরি নেই। সব মিলিয়ে দায়িত্বটা অর্ণবের কাঁধেই পড়েছে। এ বিষয় নিয়ে সে কারো সাথে কথাও বলতে পারছে না। অপর্ণাকে বললে সে বাড়াবাড়ি করবে নিশ্চিত আর অনিককে বললে সে দুশ্চিন্তা করবে। একাকী খেতে খেতে নানান প্রশ্ন অর্ণবের মাথায় এসে জট পাকাচ্ছে।

-অর্ণব শোনো।

-হ্যাঁ বলো কী হয়েছে।

-আমি একটু মায়ের ওখানে যাবো আজ, বাচ্চাদের নিয়ে আসতে।

-আমি রেখে আসবো?

-না আমি যেতে পারবো।

-আচ্ছা যাও।

-কিছু টাকা দাও তো। বাড়িতে যাচ্ছি, কিছু নিয়ে যাবো।

-গত পরশুই তো তিন হাজার টাকা নিলে, ওখান থেকে কিছু কেনো।

-ওটা খরচ হয়ে গেছে।

-কোথায়?

-ধূর! এত জেরা করার কী আছে আজব, লাগবে না তোমার টাকা। টাকার উপর শুয়ে থাকো ভাইকে নিয়ে।

অপর্ণা খানিকটা রূক্ষভাবেই বললো। অর্ণবের ইচ্ছে করছে না অপর্ণার সাথে তর্কে জড়াতে, অযথা যাওয়ার আগে ঝামেলা করতে চাইছে! অর্ণব চুপচাপ খেতে লাগলো। অপর্ণাও আর কথা বাড়ালো না তবে সাথী দূর থেকে এই দৃশ্যটা দেখলো। রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তরকারির বাটিটা এনে টেবিলে রাখলো সে।

-ভাইয়া কিছু হয়েছে? আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে খুব।

-না সাথী, কিছু হয়নি। অনিকের শরীরের কী অবস্থা? সকালে তো দেখলাম ঘুমোচ্ছিল।

-ওর কী হয়েছে বুঝতে পারছি না ভাইয়া। চাকরিটা চলে যাওয়ার পর থেকে খুব ভেঙে পড়েছে, কোনোভাবেই বোঝাতে পারছি না কিছু।

-চিন্তা করো না। যাও ওর কাছে থাকো।

সাথী মাথা নেড়ে চলে গেল। বাড়িতে সুখ শান্তির ছিটেফোঁটাও যেন নেই। চিত্রলেখা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে একটা কিছুও ভালো হচ্ছে না। এর দায়টা অপর্ণার! তবুও মুখ ফুটে সেসব বলতে পারেনা সাথী।

______________

ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে আছে চিত্রলেখা। রঙ্গন পাশে বসে চিত্রলেখাকে দেখছে। মেয়েটার চোখেমুখে আজ অন্যরকম দ্যুতি। সদ্য প্রেমে পড়া একটা আভা জ্বলজ্বলে করছে তার চাহনিতে তবুও মেয়েটা স্বীকার করছে না ভেবে খানিকটা মনোঃক্ষুণ্ন হয় রঙ্গন।

-আপনি জিজ্ঞাসা করলেন না তো কেন আপনাকে এখানে ডেকেছি।

-কেন ডেকেছো?

-আপনাকে একটা সত্যি কথা বলবো। তারপর যদি আপনার মনে হয় আমি আপনার যোগ্য তবেই আমাদের আগানো উচিত হবে।

-বলো।

-আপনার মামার যেসব ছবি ভাইরাল হয়েছিল সেসব আমি করেছিলাম।

-কিন্তু কেন?

-আপনার মামা আমায় বাজেভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন।

-এসব তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?

-আগে বললে কী হতো? প্রেমের শখ জাগতো না আপনার? প্রপোজ করতেন না? নাকি নিজের মামার এ রূপটা মেনে নিতে পারতেন? আপনি পারতেন বিশ্বাস করতে এটা এত সহজে? আপনার মা না থাকলে হয়তো আমি সেদিন বাঁচতাম না। উনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। উনি যদি না চান তাহলে আমি কখনোই আপনার সাথে জড়াবো না রঙ্গন।

-তুমি আমাকে ভালোবাসো চিত্রলেখা?

চিত্রলেখা নিশ্চুপ হয়ে গেল। রঙ্গনকে সে কেন বোঝাতে পারছে না এসব কিছুর পরিণতি কতটা অনিশ্চিত! তার বলা সামান্য একটা বাক্য দুটো পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সে চায় না তার জন্য তার ভাবীর জীবনে নতুন করে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হোক।

-আমি তোমাকেই বিয়ে করবো চিত্রলেখা। তুমি শুধু রাজি থেকো। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে আমি ভালোবাসার মানুষ হিসেবেই পাশে রাখতে চাই সবার অনুমতি নিয়েই। তখন নিষেধ করো না যেন।

চিত্রলেখা জানে এটা কখনো সম্ভব না। আশফিনা আহমেদ মরে যাবেন তবুও তাকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে মানবেন না।

চলবে …

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

রঙ্গনের অসহ্য লাগছে। কোনোভাবে নিজেকে স্থির করতে পারছে না। চিত্রলেখার সাথে কথা শেষ করে আসার পর থেকে সে নিজেকে শান্ত করতে পারতেছে না। নিজের মামা নামক পশুটার উপর যে ক্রোধ সে অনুভব করছে তা কোনোক্রমেই কমানো সম্ভব না। চিত্রলেখার বিষয়ে আপাতত বাড়িতে নতুন করে কথা তুলতে চাচ্ছে না সে তবে নওশাদকে সে শিক্ষা দিবেই। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো রঙ্গনের। এতে সে নওশাদকে শিক্ষাও দিতে পারবে আবার বাড়িতে কোনো ঝামেলাও হবে না। মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে নওশাদকে কল করলো রঙ্গন।

-হ্যালো মামা, কোথায় তুমি?

-বাড়িতে যাচ্ছি। বল কী হয়েছে।

-একা আছো?

-হ্যাঁ।

-আসলে একটা লোক আমাকে হুমকি দিচ্ছে। তুমি কি একটু আসতে পারবা?

-তোকে হুমকি দিচ্ছে? এত সাহস? আমার নাম বললেই তো কাজ হওয়ার কথা। তুই এড্রেসটা মেসেজ কর, আমি দশ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। দেখি কত বড় সাহস!

-আচ্ছা মামা, থ্যাংকস।

কল কেটে রঙ্গন মুচকি হাসলো। মার্কেটের কাছাকাছিই আছে সে। চটজলদি একটা লোকাল দোকান থেকে একটা হুডি কিনে রাখলো। নওশাদকে যে পাশে ডেকেছে ঐ পাশটা অন্ধকার। তাছাড়া রঙ্গন বেশ ভালো করে দেখে রেখেছে, নওশাদ আসলে কী করতে হবে তা ইতোমধ্যে কণ্ঠস্থ করে ফেলেছে সে।

নওশাদের আসতে মিনিট পনেরো লাগলো। রঙ্গনের ফোনে টেক্সট করে আসার জানান দিল সে। রঙ্গন এই মুহুর্তের অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। নিজের হাতে থাকা হুডিটা দিয়ে নওশাদের মুখের সামনের অংশ আষ্টেপৃষ্টে আবৃত করে ফেলল। অতঃপর কোনো শব্দ ছাড়া টানা পাঁচ মিনিট ধরে বেধড়ক মারতে থাকলো নওশাদকে। অন্ধকার তার উপর হুডির কারণে ঠিকমতো কিছু দেখতে না পায়ে ঘাসের উপর পড়ে থেকে কাঁতরাতে লাগলো নওশাদ। বেশ কিছুক্ষণ পর রঙ্গন নওশাদকে ছেড়ে ফেলে রেখে গেল। নওশাদ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। মুখ থেকে হুডি সরাতেই রঙ্গনের কল আসলো।

-মামা কোথায় তুমি? এই লোকটা বলছে এ নাকি তোমায় ধরে মেরেছে। কী যা তা বলতেছে! তোমাকে কেউ মারতে পারে? এ বোধহয় গাঁজা খাইছে মামা। তুমি কোথায় বলো তো।

-ভাগ্নে, আ..আমি একটু কাজে আটকে পড়েছি। তুই বিষয়টা সর্ট আউট করে নে। আমি পরে দেখবো।

-আচ্ছা মামা। তাহলে তো তুমি আসোইনি আর এই রামছাগল বলছে তোমায় নাকি কুকুরের মতন মেরেছে আবার বলতেছে এসব নাকি সবাইকে বলে বেড়াবে। এইটাকে পরে ধোলাই দিও তো মামা।

নওশাদ কোনোরকম সম্মতি জানিয়ে ফোনটা কাটলো। রঙ্গন হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে এগোলো। উচিত শিক্ষা দিতে পেরেছে। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না। রঙ্গন বেশ খোশমেজাজেই বাড়িতে ফিরলো। তখন অবধি সে বুঝতে পারেনি তার জন্য কী অপেক্ষা করছে বাড়িতে। সে ভেবেছিল তার মামার বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু রঙ্গন রাগের মাথায় যে আঘাতগুলো করেছে তা নওশাদের জন্য কাল হয়েই আসলো। নওশাদের ডান হাতের একটা হাড় ভেঙে গেছে এবং কপালের কাছে একটা গভীর ক্ষত হয়েছে। এসব রঙ্গন জানতে পারশো বাড়িতে ফেরার পর। রঙ্গনের বাবা মাশরুর আহমেদ তাকে জানালেন। নওশাদ তখনো স্বীকার করেনি মার খাওয়ার কথাটা, সে বলেছে এক্সিডেন্টের কারণে হয়েছে এসব। নওশাদের এ অবস্থা দেখে রঙ্গনের মোটেও খারাপ লাগছে না বরং না চাইতেও একটা আত্মতৃপ্তি তার চোখের চাহনিতে ফুটে উঠছে। মাশরুর সাহেব নওশাদকে দেখতে যাওয়ার কথা বলছিলেন রঙ্গনকে।

-রঙ্গন, আমাদের একবার নওশাদকে দেখতে যাওয়া উচিত। আশফিনার যে কী হয়েছে, যাবেনা বলছে। ভাইয়ের উপর কিসের এত রাগ বলতো যে এক্সিডেন্ট করেছে তবুও দেখতে যাবে না!

-মায়ের কথা থাক, আমরা যাবো চলো।

-হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। চল আমরা বের হই।

রঙ্গন নিজের চোখে দেখতে চাইছিল নওশাদের যন্ত্রণা। এখন সে সুযোগটাই সে হাতের নাগালে পেয়েছে তবে সুযোগটা লুফে নিতে দ্বিধা কোথায়?

সুযোগটা লুফে নেওয়ার সৌভাগ্য রঙ্গনের হলো না। আশফিনা আহমেদের কড়া স্বরে তাকে মলিন মুখে যেতে হলো উপরের ঘরের দিকে। অগ্নিচোখে তিনি বাড়ির সকলকে নিষেধ করলেন নওশাদের সাথে দেখা করতে যেতে। রঙ্গন এসবে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তার চোখজোড়া উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করেছে। তৃপ্তি তার চোখে ভাস্যমান। আশফিনা আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে। আজ যদি তার মা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তবুও সে সবটা সত্যিই বলবে। সে ভুল নয়, মিথ্যা বলার প্রয়োজন তার নেই।

-নওশাদকে তুমি মেরেছো?

আশফিনা আহমেদের প্রথম প্রশ্নেই ভড়কে গেল রঙ্গন। সে কখনোই ভাবেনি তার মা তাকে সরাসরি এ প্রশ্ন করবে। করার কথাও নয়।

-হ্যাঁ আমি মেরেছি।

-তাহলে চিত্রলেখা তোমায় বলেছে সেদিনের কথা। যা হয়েছে সেটা নিয়ে নতুন করে ঝামেলা করার দরকার ছিল রঙ্গন? নওশাদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? আঘাতটা যখন চিত্রলেখার উপর গিয়ে পড়বে তখন? কিভাবে আটকাবে তুমি?

-চিত্রলেখাকে বাঁচানোর জন্য আমি আছি সবসময় মা।

-অধিকার কী তোমার ওকে বাঁচানোর? ও কি তোমায় ভালোবাসে? ও বলেছে তোমায়? বাড়াবাড়ি করো না রঙ্গন। চিত্রলেখার জন্য আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি। কিন্তু তুমি যা করছো সেটা পাগলামি। চিত্রলেখাকে বাঁচাতে গিয়ে ওর ক্ষতি করে বসো না।

-মা আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।

-চিত্রলেখা একবারো বলেছে সে তোমাকে ভালোবাসে?

-সব কথা মুখে বলতে হয় না, মা। আমি অনুভব করতে পারি। তুমি শুধু একবার ওর পরিবারের সাথে কথা বলো, চিত্রলেখা যদি রাজি না থাকে আমি কোনদিন আর এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আসবো না।

-কথা আমি বলবো তবে আগে চিত্রলেখার সাথে। চিত্রলেখা যদি রাজি থাকে তবেই ওর পরিবারের কাছে যাবো আমি।

রঙ্গন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে কি ভুল শুনলো নাকি তার মা সত্যিই তার বিষয়টা বুঝতে পেরেছে?

-মা সত্যি?

-হুম। এটা নিয়ে এখন লাফিয়ো না, চুপচাপ নিজের ঘরে যাও আর চিত্রলেখাকে এসব এখনি বলতে হবে না। আমি কাল ওর সাথে দেখা করতে যাবো ওর কলেজে।

রঙ্গন মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। আশফিনা আহমেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। আলমারির লকার থেকে একটা অ্যালবাম বের করলেন তিনি। অ্যালবামটা রঙ্গনের ছোটবেলার। রঙ্গনের নানান রকম বয়সের ছবি শোভা পাচ্ছে সেখানে তবে প্রথম ছবিটা থেকে চোখ সরাতে পারছেন না আশফিনা আহমেদ। চিরপরিচিত রাস্তাটা, রঙ্গনের হাসিমুখ। আশফিনা আহমেদের চোখের কোণে জল আসে। বহুদিন আগলে রেখেছেন সবকিছু তিনি। কখনো এসব স্মৃতিবিজড়িত হয়ে কথা বলেননি। তবে কাল বলতে হবে। চিত্রলেখাকে মিথ্যে বলার কোনো কারণ তার কাজে নেই। সত্যিটা বললে হয়তো চিত্রলেখা নিজেই রঙ্গনকে অপছন্দের করা শুরু করবে। এতে পরোক্ষ আশফিনা আহমেদের কাজ হয়ে যাবে। তিনি মরে গেলেও চিত্রলেখাকে মানতে পারবেন না। এখন যা করার কালকেই করবেন তিনি। অ্যালবামটা বেশ যত্নে রাখা। প্রথম ছবিটা এখনো বের করা। রঙ্গনকে কোলে নিয়ে কান্না করছেন আশফিনা আহমেদ। পরের ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে রঙ্গনের গালে চুমু খেয়ে তাকে কোলের মধ্যে আড়াল করছেন। ছবিগুলো রঙ্গনের প্রথম ছবি, চিরচেনা একটা রাস্তার পাশে তোলা। এই দুইটা ছবি আশফিনা আহমেদের মনের খুব কাছের। এ ছবি দুটো তিনি রঙ্গনকেও দেখাননি কখনো। পাছে যদি রঙ্গন কিছু একটা আন্দাজ করে দূরে চলে যায় এ ভয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রঙ্গনকে তিনি যতটা যত্নে বড় করে তুলেছেন, তার প্রতিদানে রঙ্গন নিশ্চয়ই তাকে একা ফেলে যাবে না! আর তা নিশ্চিত করতেই আশফিনা আহমেদ নিজের পছন্দের কোনো মেয়ের সাথেই রঙ্গনের বিয়ে দিবেন যেটা চিত্রলেখা কখনোই নয়, ভুলক্রমেও না!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে