চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৬০
লেখা আশিকা জামান
” য়্যু আর ভেরি স্মার্ট! লাইক ইট!” আগন্তুকের মুখে এমন কথা শুনে অন্বেষা ঘাবড়ে যাওয়া ভঙ্গিতে তাকায়।
” ব্যাপার না! টিন এজদের সাইকোলজি অনুযায়ী এই ধরণের ফ্যান্টাসি থাকা স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই ফ্রেন্ডদের সাথে বাজি ধরেছেন!” কী এক অদ্ভুত সম্মোহনে অনিক বলে চলেছে।
অন্বেষা বিস্মিত না হয়ে পারছেনা। অনিক ভ্রুক্ষেপহীনভাবে ঠোঁট বাঁকিয়ে আবার বলল,
” ফর য়্যূর কাইন্ড ইনফরমেশন এক্টিং এ আপনি খুবই কাঁচা! রিং হওয়ার সাথে সাথে আপনি আতি পাতি করে না তাকিয়ে সরাসরি সুইং চেয়ারের কাছে এসেছেন। কারণ আপনার অবচেতন মন জানে ফোনটা আপনি ইচ্ছে-করেই এখানে রেখেছেন! তাই আপনার সাব কনশাস মাইন্ড আপনার কনশাস মাইন্ডের উপর চাপ ফেলে। উত্তেজনায় এক্টিং এর ব্যপারটা আপনার মাথা থেকে আউট! এম আই ক্লিয়ার!”
অন্বেষা ঘাবড়ে গেলেও মুহুর্তেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়। ” আশ্চর্য রিং যেদিকে শোনা যাবে আমি’তো সেদিকেই যাব তাই না!
আর আপনি কোথাকার সাইক্রিয়াটিস্ট আসছেন যে আমাকে কনশাস, সাবকনশাস মাইন্ডস এফেক্ট বুঝাতে আসছেন! আপনাকে গায়ে পড়ে একটু হেল্প করতে বলেছি বলে আপনি আমাকে এইভাবে ইনসাল্ট করতে পারেন না!”
” আপনাকে ইনসাল্ট করার কোন ইনটেনশন আমার নাই।”
” তাহলে, কী করছেন এইগুলু? আপনার কী মনে হয় আপনাকে দেখে আমি প্রেমে দিওয়ানা হয়ে গেছি। তাই ফোন নাম্বার নেওয়ার জন্য এমন নাটক করছি।” এ-ইপর্যায়ে অন্বেষা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
অনিকের মুখে মৃদু হাসি খেলে যায়। একসময় হাসিটা অন্বেষার কান অব্দি পৌছে যায়। হাসিটা বহাল রেখেই অনিক বলল,
” রেগে গেলেন’তো হেরে গেলেন! এটার কিন্তু অনেক ব্যাড এফেক্ট আছে! এই যেমন মানুষ রাগে অন্ধ হয়ে সামটাইমস সত্যি কথা বলে দেয়।”
কথাটা শোনামাত্র অন্বেষা গটগট করে অনিকের সামনে দিয়ে হেটে যায়। বুঝে গেছে এই অতি চালাকের উপর বাটপারি করে লাভ নাই। উল্টা বাশ খেতে হবে। তাই মান সম্মান থাকতে থাকতে কেটে পড়াই শ্রেয়!
” হ্যালো মিস! ওঁ হ্যালো…
আরে…শুনুন…” অনিক একমনে ডেকে চলেছে। অন্বেষা মনে হয়না আজ আর সাড়া দেবে।
★★★★★
শেষ পর্যন্ত অঙ্কনের আর পাস্তা বানানো হয় নাই। যা করার অনন্যা’ই করেছে৷ কোমড় বেধেঁ রান্না করেছে। হয়তো এমন সুযোগ আর নাইবা পেল। নাহ্ ইচ্ছে টাকে অপূর্ণ রাখা যায়না।
অনন্যা তখন চিংড়ি মাছ কষাচ্ছিলো অঙ্কন বাকি রান্নাগুলো টেস্ট করছিল আর বিড়বিড় করে বলছিল, ” একদম পার্ফেক্ট! এই অনন্যা, আমি না মাঝেমধ্যে’ই ভাবী তোমরা আই মিন মেয়েরা এত এত ভ্যারাইটিস মশলা একেক প্রিপারেশনে একেক রকমভাবে আন্দাজে দাও। এতসব মনে রাখো কিভাবে! তালগোল পাকিয়ে যায়না। আমার তো মাথায় ক্যাঁচ করেনা!”
অনন্যা মৃদু হেসে বলে, ” বুঝবেনা এইগুলা মেয়েদের সাইকোলজি! তুমি বরং কিচেন থেকে যাও এখানে কষ্ট করে আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা।”..
” কেন দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা!” কথাটা বলেই অঙ্কন পেছন থেকে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে।
অনন্যা ঘাড় সামান্য হেলিয়ে অঙ্কনের দিকে তাকায়। অঙ্কন বলে, ” আমার বউ’টা এত কষ্ট করে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে রান্না করছে, আর বলে কি-না আমি চলে যাব।”
” উফ্, অঙ্কন লেগে যাবে’তো!” অনন্যার চোখেমুখে তখন মধুর যন্ত্রণা। সেই ভাষা বুঝতে যেন অঙ্কন সিদ্ধহস্ত। মুহুর্তের মাঝেই অনন্যার ডানবাহু চেপে ধরে ফ্রাইংপ্যানে খুন্তি নাড়াঁচাড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এবার আর সে বাঁধা দেয়না।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে অঙ্কন যখন আয়েশ করে বিছানায় অনন্যার কোলে মাথা রেখে শুয়ে । তখন অনন্যার বড় দূর্বোধ্য ইচ্ছে হয়! খুব করে ইচ্ছে হয় এখানে থেকে যেতে। গোটা রাত অঙ্কনের ভালোবাসায় সিক্ত হতে। কিন্তু অঙ্কন সে’তো নির্বিকার কিছুই বলছেনা। তাহলে কী সে নিজেই বলবে!
কথাটা আর বলা হয়ে উঠেনা তার পূর্বেই অনিক ফোন করে। অনন্যা যখন কথা শেষ করে অঙ্কন কেমন সরু চোখে তাকায়।
” অনন্যা, অনিক ভাইয়া কী বলছিলেন!”
” আমি কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করছিলো। আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরবে এমনটাই কথা ছিল। আমি বলেছি আমার আরও লেইট হবে ও যেন চলে যায়।”
অঙ্কন মাথা নিচু করে শুনে। এরপর অনন্যার উৎসুক দু’টি চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
” অনন্যা, অনেক’টা রাত হয়ে গেছে। খামোকা মিথ্যে বললে কেন? তোমার বাসায় ফেরা উচিৎ। আর সেটা ভাইয়ার সাথে হলেই আমি নিশ্চিন্ত।”
অনন্যা অবিশ্বাস্য সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। কথাটা যেন বিশ্বাস হতে চায়না। ওর এভাবে তাকিয়ে থাকাটা অঙ্কনের কাছে খুব একটা সুবিধের মনে হয়না। ” এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
অনন্যার ফোন আবার বাজে নিনিত ফোন করেছে। কিন্তু সে তুলেনা। চোরা চোখে অঙ্কনের দিকে তাকায়।
” আমি বাসায় ফোন করে বলে দেই আজ নিনিতের বাসায় থাকছি।”
” আশ্চর্য! তুমি নিনিতের বাসায় কেন থাকবে। বাসায় যাও সুবোধ বালিকা। ” অঙ্কন যেন বাধঁ সাধে।
” আরে, আমি কেন নিনিতের বাসায় থাকব। আমি’তো থাকব তোমার সাথে।” অনন্যা বলল হঠাৎ আহ্লাদী গলায়।
অঙ্কন বিছানায় বসে পড়ে। কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে মেঝেতে নখ খুঁড়তে থাকে। অনন্যা নির্নিমেষ তাকায় সরাসরি তার চোখের দিকে। ওই চোখের ভাষা বুঝা বরাবরের মতোই তার কাছে দুঃসাধ্য।
” অনন্যা, কাছে এসো!” অঙ্কনের এমন নিরুত্তাপ ঠান্ডা গলায় বলা কথাটা অনন্যার শরীর মন জুড়ে এক অন্যরকম উত্তেজনা তৈরী করে দেয়।
আকুলিবিকুলি করে ছুটে এসে অঙ্কনের বুকের উপর আছড়ে পড়ে।
অনন্যার মাথাটা নিজের কাধে ঠেকিয়ে অঙ্কন হঠাৎ শান্ত গলায় বলল, ” অনন্যা, আমার মনে হয় তোমার বাসায় যাওয়া উচিৎ। আমার সাথে যাবে, আমি বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসব!”
অনন্যা কিছু বলেনা। ভেতরটা যেন কেউ দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। ওঁকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে অঙ্কন আবার বলল, ” তোমার বাসায় যেতে আমার অস্বস্তি হয় তাই যাচ্ছি না। মা’কে বুঝাতে পারছিনা তাই রাগ করে এখানে এসে থাকছি তুমি’তো সব জানো, বুঝো। তুমি বিয়ের ব্যাপারটাও জানাতে দিচ্ছ না। অবশ্য এটা নিয়ে আমার আফসোস নেই। আমি মা’কে চিনি কয়েকদিন গাই গুঁই করলেও ঠিক সবকিছু মেনে নিবে তুমি টেনশন করোনা। এটা আমার উপর ছেড়ে দাও আর একটু বিশ্বাস রাখো। অনেক মিথ্যে মিথ্যে হয়েছে আর কোন মিথ্যে দিয়ে আমি সাময়িক আনন্দ পেতে চাই না।”
অনন্যার দু’চোখ যেন ঝাপসা হয়ে আসে। অঙ্কনকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। পেছন থেকে অঙ্কন হাত আকঁড়ে ধরে উঠে আসে তার মুখোমুখি। আঁজলা ভরে তুলে নেয় অনন্যার শুভ্র সুন্দর তুলোর মতো মুখমণ্ডল।
” কী হলো! কষ্ট পেলে আমার কথায়।”
” অঙ্কন নেক্সট মান্থে আমি আর ভাইয়া চলে যাচ্ছি। তোমার কাছে আসার এতবড় সুযোগটা আমি মিস করতে চাইনি। তাই ছুটে এসেছি। ভাবিনি তুমি বিরক্ত হবে। তাহলে আসতাম না।” চাপা অভিমানে অনন্যা গটগট করে কথাগুলো বলেই থামলো।
” অনন্যা, সুযোগ পেলেই সবসময় তার সদ্ব্যবহার করতে নেই! সুযোগ সন্ধানী ভালোবাসার চেয়ে দূরে থেকে গভীরভাবে ভালোবাসাটাই শ্রেয়।”
অনন্যা, অঙ্কনকে সরিয়ে দেয়। পা চালায়, নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
দূর থেকে অনন্যার এই বদলে যাওয়া মুখটা দেখে যেন অঙ্কনের বুকের ভেতরটাও ছ্যাৎ করে উঠে। নীলচে কষ্ট চারপাশটা ছেঁয়ে ধরে। খুব কষ্ট হয় অনন্যা যখন তাকে ভুল বুঝে, ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে।
” তুমি কী জানো তোমার ম্যাচিউরিটি শুন্যের কোঠায়। শারীরিকভাবে বাড়লে কী হবে তুমি মানসিকভাবে এখনো সেই টিন এইজেই পড়ে রয়েছো!” অঙ্কন থাকতে না পেরে বলতে বাধ্য হলো
” তাই বুজি আমাকে এখন ভালো লাগছেনা। ম্যাচিউর কাউকে চাই!” অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
অঙ্কন ঝড়ের বেগে এসে অনন্যার দু’বাহু খাঁমচে ধরে নিজের দিকে ঘুরায়।
” ছাড়ো! বলছি ছাড়ো! আমাকে ছুঁবেনা তুমি। দূরে সরে দাঁড়াও।” বুকের উপর অনন্যার হাত ছুড়াছুড়ি যেন সে বেশ উপভোগ করছে এটা তার চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
” ছাড়ার জন্য ধরি নাই এইটুকু সেন্স হিউমার নেই হুম!” কথাটা বলেই সে অনন্যার অধরে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দেয়।
কিছুক্ষণ ছটফট করে বাঁধা দিলেও পরক্ষণে নিজেই অঙ্কনের গলা জড়িয়ে ধরে।
ধাতস্থ হতেই অঙ্কন কানের কাছে মুকজ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” আমার এমন অভিমানী অনন্যাকেই চাই! যে কথায় গাল ফুলাবে, রেগে যাবে।”
অনন্যা সরু চোখে তাকায়। অঙ্কন ওই চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
” চলো! তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
অনন্যা ধীরপায়ে পা চালায় অঙ্কনের পিছুপিছু..
চলবে.
চলবে….
‘